বিপজ্জনক: পার্ক স্ট্রিট এলাকার একটি বহুতলের পুরনো লিফ্টটি রয়েছে এ ভাবেই। নিজস্ব চিত্র।
লিফ্টের সামনে লোহার গেটের নীচের কিছুটা অংশ আর অবশিষ্ট নেই। এই অবস্থায় লিফ্ট এসে থামছে মাটির বেশ কিছুটা উপরে। ভিতরে ঢুকে গায়ের জোরে বারকয়েক টানার পরে গেট যদিও বা কোনও মতে আটকাচ্ছে, লিফ্ট চলতে শুরু করলেই তৈরি হচ্ছে আতঙ্ক! ঘড় ঘড় শব্দের সঙ্গে কম্পন। মনে হবে, এই বুঝি দড়ি ছিঁড়ে পড়ল! লিফ্টের ভিতরে না জ্বলছে আলো, না ঠিক আছে সুরক্ষার কোনও ব্যবস্থা।
চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ে গিরিশ পার্ক মেট্রো স্টেশন সংলগ্ন ছ’তলা বাড়ির লিফ্টের এখনই এমনই অবস্থা। শুধু ওই বাড়ি নয়, শহরের বিভিন্ন প্রান্তে একাধিক বহুতলে দেখা গেল লিফ্টের একই রকম দুরবস্থার ছবি। কোথাও লিফ্টের দরজার কোণে বেশ কয়েক ইঞ্চি ফাঁক। কোথাও আবার মালিক-ভাড়াটে বিবাদেদীর্ঘদিন রক্ষণাবেক্ষণ না হওয়ায় লিফ্ট থামছে কয়েক দফা ঝাঁকুনি দিয়ে। অধিকাংশ জায়গাতেই না আছে লিফ্টের চালক, না আছে দেখাশোনার লোকজন। রক্ষণাবেক্ষণেরও তেমনই দশা।
গত দু’মাসে দু’বার লিফ্ট বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটেছে শহরে। পার্ক স্ট্রিটে লিফ্ট মেরামতির কাজ চলার সময়ে আচমকা সেটি চলতে শুরু করায় চাপা পড়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছিল। আবার কসবার রাজডাঙায় একটি নার্সিংহোমে কেব্ল ছিঁড়ে লিফ্ট নীচে পড়ায় মারা যান এক মহিলা চিকিৎসক। অল্প সময়ের ব্যবধানে এমন দু’টি ঘটনার পরেও শহরের বহুতলগুলিতে লিফ্ট-চিত্র যে বদলায়নি, তা কয়েক জায়গায় ঘুরতেই স্পষ্ট বোঝা গেল। একাধিক বহুতলে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, সেখানে লিফ্ট রক্ষণাবেক্ষণের সব দায়িত্ব কোনও একটি সংস্থার উপরে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তারা কী কাজ করছে, দেখার কেউ নেই। কোথাও আবার সে সবেরও বালাই নেই। কোনও কোনও বহুতল কর্তৃপক্ষের আবার বিকল লিফ্ট চালু করতে পাড়ার ইলেকট্রিশিয়ানই ভরসা। যা সচেতনতার পাশাপাশি নজরদারি নিয়েও প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে।
নিয়ম বলছে, কোনও বিল্ডিংয়ে লিফ্ট লাগানোর ক্ষেত্রে পুরসভা এবং বিদ্যুৎ দফতরের অনুমতি নিতে হয়। লিফ্ট লাগানোর পর তার ‘ফিট সার্টিফিকেট’ রাখাও বাধ্যতামূলক। ফিট সার্টিফিকেট ইস্যু করার আগে লিফ্টের ভারবহন ক্ষমতা থেকে শুরু করে কেবল, মোটর বাকি সব কিছু দেখে নেওয়া হয়। কলকাতা পুরসভার বিল্ডিং বিভাগের এক কর্তা বলেন, ‘‘প্রতিবছর ফিট সার্টিফিকেট নিতে হয়। বিল্ডিং অথবা আবাসনের তরফেই আবেদনের পর পুরসভার এক জন চিফ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারকে দিয়ে লিফ্টের রক্ষণাবেক্ষণের অবস্থা খতিয়ে দেখার পরেই ‘ফিট সার্টিফিকেট’ ইস্যু করে দেওয়া হয়।’’
শহরের একাধিক লিফ্ট রক্ষণাবেক্ষণকারী সংস্থার আধিকারিকেরা জানাচ্ছেন, লিফ্টের কেব্ল থেকে শুরু করে মোটর, ভারবহন ক্ষমতা, সেন্সর— সব কিছু ঠিক মতো কাজ করছে কি না, তা নিয়মিত পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া উচিত। লিফ্টের মেশিন রুমের ‘ড্রাইভ ইউনিট’ এবং তার সঙ্গে যুক্তযন্ত্রাংশগুলির সময় মতো রক্ষণাবেক্ষণও খুব জরুরি বলে মত বিশেষজ্ঞদের। এমনকি, প্রতি দু’মাস অন্তর লিফ্টের যন্ত্রে পর্যাপ্ত তেল আছে কি না, কন্ট্রোল স্ক্রু ঠিক আছে কি না, তা-ও পরীক্ষা করানো জরুরি বলে জানাচ্ছেন তাঁরা।
শহরের একটি লিফ্ট রক্ষণাবেক্ষণকারী সংস্থার কর্তা সুজয় হালদার বলছেন, ‘‘মনে রাখতে হবে, লিফ্ট একটা সিস্টেমে চলে। যেখানে কন্ট্রোলার ইউনিট লিফ্টের ওঠানামার বিষয়টিকে নিয়ন্ত্রণ করে। ড্রাইভ ইউনিটও সমান গুরুত্বপূর্ণ। কোনও একটি ইউনিট বিকল হলেই লিফ্ট চলাচলে প্রভাব পড়বে।’’ অনেক সময়ে খালি চোখে লিফ্টের মধ্যে কোনও অসুবিধা চোখে না পড়ায় রক্ষণাবেক্ষণে ঢিলেমি আসতে পারে। এই প্রবণতাও বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে বলেও অভিমত লিফ্ট বিশেষজ্ঞদের।