ভোট গণনার প্রস্তুতি সারা নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য
নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়াম সংলগ্ন স্ট্রংরুমের বাইরে বুধবারের দুপুর রোদে হাজির সবুজ পাঞ্জাবি, সাদা পাজামা পরা বৃদ্ধ। বন্দুকধারীর ‘এখানে কী চাই?’ প্রশ্নের উত্তরে বৃদ্ধ বললেন, ‘‘সব ঠিকঠাক চলছে কি না, দেখতে এসেছি।’’ বন্দুকধারী এ বার বিরক্ত হয়ে বলে দিলেন, ‘‘চলুন, চলুন। এখানে দাঁড়াবেন না।’’
নাছোড় বৃদ্ধকে সরাতে এর পরে আসতে হল নির্বাচন কমিশনের কর্মীদের। তাঁরা বুঝিয়ে বললেন, ‘‘নির্বাচন কমিশনের দেওয়া পরিচয়পত্র থাকলে সকাল সকাল চলে আসুন। তখন কেউ সরাবে না।’’ অগত্যা চলে যাওয়ার আগে বৃদ্ধ বললেন, ‘‘দেখবেন দাদা, ভোট যেন লুট না হয়।’’
আজ, বৃহস্পতিবার, সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনের ফল ঘোষণা। তার আগে উত্তর এবং দক্ষিণ কলকাতার ভোট গণনা কেন্দ্রগুলির বাইরে নিরাপত্তার প্রবল কড়াকড়ি। সামান্য ভিড় দেখলেই তেড়ে যাচ্ছেন কেন্দ্রীয় বাহিনী ও রাজ্য পুলিশের কর্মীরা। নিশ্ছিদ্র পাহারার ব্যবস্থা দেখা গেল নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামেও। সেখানে কলকাতা উত্তর লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত সাতটি বিধানসভা এলাকার জন্য সাতটি কাউন্টিং হল তৈরি করা হয়েছে। এ ছাড়াও পোস্টাল ব্যালট গোনার জন্য রয়েছে পৃথক একটি কাউন্টিং হল। প্রতিটি হলে ১৪টি করে কাউন্টিং টেবিল বসানো হয়েছে। এ ছাড়া, একটি বিশেষ ভিভিপ্যাট কাউন্টিং বুথ (ভিসিবি) করা হয়েছে প্রতিটি হলের মধ্যে।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
এই গণনা কেন্দ্রের জন্য দু’জন বিশেষ পর্যবেক্ষক-সহ মোট তিন জন পর্যবেক্ষককে নিযুক্ত করা হয়েছে। বিশেষ পর্যবেক্ষকেরা দু’টি করে বিধানসভা এলাকার দায়িত্বে থাকবেন। আর এক জন সামলাবেন তিনটি বিধানসভা এলাকা। তাঁদেরই এক জন এ দিন বললেন, ‘‘ভোর পাঁচটায় আসতে হবে আমাদের। কখন ফিরব, জানি না। ইভিএমের পরে ভিভিপ্যাট গোনার জন্য আরও আট থেকে দশ ঘণ্টা লাগতে পারে। লটারি করে নেওয়া অন্তত পাঁচটি ভিভিপ্যাট তো গুনতেই হবে। ভিভিপ্যাটের সংখ্যা বাড়লে তো কথাই নেই।’’
দক্ষিণ কলকাতায় আবার ভোট গণনা হচ্ছে মোট পাঁচটি কেন্দ্রে। এর মধ্যে রয়েছে ঠাকুরপুকুরের বিবেকানন্দ কলেজ, ডায়মন্ড হারবার রোডের সেন্ট টমাস বয়েজ় স্কুল, লর্ড সিনহা রোডের সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস হাইস্কুল, বেলতলা রোডের বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট হাইস্কুল এবং হেস্টিংসের পশ্চিমবঙ্গ টিচার্স ট্রেনিং বিশ্ববিদ্যালয়। সাখাওয়াত মেমোরিয়ালে গিয়ে দেখা গেল, স্কুলের এক দিক খোলা রেখে ভর্তির প্রক্রিয়া চলছে। অন্য অংশটি কার্যত দুর্গ বানিয়ে ফেলেছে কেন্দ্রীয় বাহিনী। স্কুলবাড়ির তিনতলায় গণনা কেন্দ্র আর দোতলায় স্ট্রংরুম। স্কুলে ঢোকার মুখে মজুত করা হয়েছে সিমেন্টের বস্তা। সেটাই কেন্দ্রীয় বাহিনীর ‘যুদ্ধক্ষেত্র’! ওই পথে ঢুকতে গেলে গণনা কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাচনী আধিকারিক অর্ণব বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘কাউকে ঢুকতে দিচ্ছি না। নেতা গোছের কয়েক জন এসেছিলেন সকালে। তাঁদেরও চলে যেতে বলা হয়েছে।’’
দুপুর রোদে বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট হাইস্কুলের সামনে আবার পড়ুয়াদের লম্বা লাইন। স্কুলের গেট আটকে দাঁড়ানো কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানদের কাছেই স্কুলে ঢুকতে দেওয়ার অনুরোধ করে চলেছেন পড়ুয়াদের অভিভাবকেরা। স্বপ্না হালদার নামে এক অভিভাবক বলেন, ‘‘ছেলেকে ভর্তি করানোর ফর্ম তুলতে এসেছি। কিন্তু এঁরা তো স্কুলে ঢুকতেই দিচ্ছেন না। এখনই ভোট গুনছেন নাকি!’’ রোদে কাহিল আর এক অভিভাবক বললেন, ‘‘এমনিতেই দু’মাস ছুটি দিয়ে পড়াশোনা তুলে দিয়েছে। এখন ভর্তি হওয়াতেও সমস্যা!’’
ওই স্কুলের বাইরেই শামিয়ানা টাঙিয়ে বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে এক রাজনৈতিক দলের তরফে। সেখানেই চেয়ার পেতে খোশগল্পে ব্যস্ত কয়েক জন যুবককে গিয়ে এক অভিভাবক বলেন, ‘‘ওঠো ভাই। একটু বসতে দাও। কাল তো নেতাদের জ্বালায় এখানে দাঁড়ানোও যাবে না।’’ এক যুবকের পাল্টা টিপ্পনী, ‘‘দাঁড়াবেন কেন, আমাদের সঙ্গেই আবির খেলবেন।’’
কলকাতা উত্তর জেলা নির্বাচন অফিসার দিব্যেন্দু সরকার বলছিলেন, ‘‘ইভিএম গণনা হয়ে গেলে ফলাফলের চিত্রটা অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে যাবে। তখনও ভিভিপ্যাটের গণনা বাকি থাকবে ঠিকই, তবে তাতে ফলের চিত্রটা পাল্টানোর সুযোগ রয়েছে বলে মনে হয় না।’’
গণনা কেন্দ্রের বাইরে এখন কোন আবির ওড়ে, সেটাই দেখার।