চ কেভেনটার্সে গিয়ে একটু কফি খাওয়া যাক।”— তোপসের প্রতি ফেলুদার এই সংলাপ দার্জিলিঙের পটভূমিতে সত্যজিতের প্রথম বড়গল্প ‘ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি’র পাশাপাশি মনে পড়িয়ে দেয় মা’র সঙ্গে তাঁর দার্জিলিং বেড়ানোর প্রথম স্মৃতিও। বছর সাতেক বয়স তখন, মন ছটফট করছিল কলকাতার বাড়ির দেওয়ালে টাঙানো ঠাকুরদার আঁকা কাঞ্চনজঙ্ঘার ছবির সঙ্গে আসল কাঞ্চনজঙ্ঘা মিলিয়ে দেখার। দার্জিলিঙে যেখানে ছিলেন সেই এলগিন ভিলায় এক ভোরে ঘুম ভেঙে ছুটে গেলেন জানলায়, চেয়ে রইলেন যত ক্ষণ না সূর্যের রঙ গোলাপি থেকে সোনালি, রুপোলি হয়। “পৃথিবীর বহু দেশে বহু নামকরা সুন্দর দৃশ্য দেখেছি, কিন্তু সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের কাঞ্চনজঙ্ঘার মতো সুন্দর দৃশ্য আর কোথাও দেখিনি,” লিখেছিলেন সত্যজিৎ।
তাঁর এ সব অনুপুঙ্খ স্মৃতি, এবং একই ভাবে ‘মেমরিজ় অব লখনউ’, যার সঙ্গে জড়ানো সত্যজিতের প্রথম ফেলুদা-উপন্যাস বাদশাহী আংটি-র (বাঁ দিকের ছবিতে এর স্কেচ) অনুষঙ্গ, তাঁর রচিত চাইল্ডহুড ডেজ় থেকে চয়ন করে স্মৃতিতে খোদাই, বর্ণিল এক উজ্জ্বল চিত্রশালা যেন গ্রন্থিত দ্য ফেলুদা জার্নাল-এ, প্রথম খণ্ড সম্প্রতি প্রকাশিত দ্য পেঙ্গুইন লাইব্রেরি (ভিনটেজ/ পেঙ্গুইন র্যানডম হাউস) থেকে। ফেলুদার উল্লিখিত কাহিনি দু’টি-সহ ‘কৈলাশ চৌধুরীর পাথর’ ও ‘শেয়াল-দেবতা রহস্য’-র সত্যজিৎ-কৃত পাণ্ডুলিপি, প্লট বিন্যাস, স্কেচ, হেডপিস, শিল্পকর্মাদির সমাহার এই বই। ষাটের দশকে ছোটদের জন্য নবপর্যায়ে সন্দেশ পত্রিকা সম্পাদনার কাজ শুরু না করলে, নবীন পাঠকদের মুখ চেয়ে কলম না ধরলে হয়তো ফেলুদার কাহিনিকার হয়ে ওঠা হত না সত্যজিতের, মুখবন্ধে খেয়াল করিয়েছেন সন্দীপ রায়। গ্রন্থ-সম্পাদনায় তাঁর দুই সঙ্গী ঋদ্ধি গোস্বামী ও পিনাকী দে।
সন্দীপ রায়েরই প্রচ্ছদ পরিকল্পনায় প্রকাশ পেয়েছে বিচিত্রপত্র পত্রিকার ‘সম্পূর্ণ সুকুমার সংখ্যা’, তাতে বড় আকর্ষণ সুকুমার রায়ের চলচিত্ত চঞ্চরী-র সম্পূর্ণ পাণ্ডুলিপিটি (ডান দিকের ছবি), রায় সোসাইটির সৌজন্যে। সুকুমারকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ বুদ্ধদেব বসু প্রেমেন্দ্র মিত্র সৈয়দ মুজতবা আলী লীলা মজুমদার প্রমুখের রচনার পাশে সিদ্ধার্থ ঘোষের দুর্লভ লেখা ‘সুকুমার রায়ের গদ্য রচনা’; সুশোভন অধিকারী লিখেছেন খাপছাড়া আর আবোল-তাবোল-এর ছবি নিয়ে। আছে সুকুমারের ‘খিচুড়ি’ কবিতাটির সত্যজিৎ-কৃত ইংরেজি অনুবাদ, পিতার প্রতিকৃতিটিও পুত্রেরই আঁকা।
সত্যজিতের স্কুলজীবন কেটেছে যে বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট হাই স্কুলে, একশো বছরের মুখে দাঁড়ানো সেই স্কুল তাঁকে স্মরণ করল সম্প্রতি, ‘জানা-অজানা সত্যজিৎ’ অনুষ্ঠানে। মুখ্য বক্তা ছিলেন প্রসাদরঞ্জন রায় ও দেবাশিস মুখোপাধ্যায়। ছিলেন জয়দীপ মুখোপাধ্যায় রঞ্জন প্রসাদ, তত্ত্বাবধানে যুধাজিৎ মুখোপাধ্যায়। স্কুল ছাড়ার বছর দশেক পরে এই স্কুলে ফিরতে হয়েছিল সত্যজিৎকে এক বার এক অনুষ্ঠানে, লিখেছিলেন: “হলঘরে ঢুকে মনে হয়েছিল... দরজায় যে মাথা ঠেকে যায়!... অবিশ্যি হবে নাই বা কেন... এখন আমি প্রায় সাড়ে ছ’ফুট। স্কুল ত আছে যেই কে সেই, বেড়েছি শুধু আমিই।” (যখন ছোট ছিলাম/ আনন্দ)
ফিরে দেখা
১৮১৭ সালে প্রতিষ্ঠা হিন্দু কলেজের, তার তিন বছর পর কলকাতায় জন্ম কিশোরীচাঁদ মিত্রের (ছবি)। ‘ম্যাকলে মিনিটস’-এর জেরে শহরের ধনী পরিবারগুলিতে পুত্রসন্তানকে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলায় গতি আসে, কিশোরীচাঁদও ডেভিড হেয়ারের স্কুল হয়ে আসেন হিন্দু কলেজে। আট বছরের সহপাঠে তাঁর সঙ্গী ছিলেন প্যারীচরণ সরকার মাইকেল মধুসূদন দত্ত রাজনারায়ণ বসু জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাকুর প্রমুখ। হিন্দু কলেজের গোড়ার দিকের যে ছাত্রেরা পরে এ শহরে ও বঙ্গে পশ্চিমি যুক্তিবাদ ও প্রগতিবাদের প্রসার ঘটান, কিশোরীচাঁদ তাঁদের অন্যতম। উনিশ শতকের কলকাতার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ এই মানুষটির প্রয়াণের সার্ধশতবর্ষে তাঁকে নিয়ে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেছেন তাঁর বংশধরেরা, বায়োগ্রাফিক্যাল রাইটিংস অন কিশোরীচাঁদ মিত্র। ক্যালকাটা রিভিউ, বসুমতী পত্রিকায় কিশোরীচাঁদকে নিয়ে প্রকাশিত লেখা সঙ্কলিত এখানে। জরুরি কাজ।
ঘোড়াগুলি, আজও
সময়ের আগেই দৌড়তে শিখেছিল ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’, এগিয়ে ছিল সময়ের চেয়ে। ভালবাসা বিদ্রোহ রাজনীতি, কী নেই তাদের গানে! আজও সে গানে যৌবন পাগল হয়, বাঙালি খুঁজে পায় এক গুরুত্বপূর্ণ কালখণ্ড। বাঙালির নস্টালজিয়াকে ছুঁতে নব্বই দশকের মাঝামাঝি ফিরেও এসেছিল মহীনের ঘোড়ারা। আর এই ২০২৩-এ এল একটি বই— গৌতম ও মহীনের ঘোড়াগুলি (প্রকা: লিবের ফিয়েরি/এল এফ বুকস)। উজ্জ্বল বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত এ বইয়ে মহীনের ঘোড়াগুলি নিয়ে হিরণ মিত্র দীপক মজুমদার নবারুণ ভট্টাচার্য তাপস দাস আব্রাহাম মজুমদার প্রদীপ চট্টোপাধ্যায় অশোক বিশ্বনাথন ল্যাডলী মুখোপাধ্যায় দেবজ্যোতি মিশ্র প্রমুখের লেখা; আজ বিকেল ৫টায় নিউ টাউনের সৃষ্টিসন্ধান ভবনে আনুষ্ঠানিক প্রকাশ— কথায়, গানে।
আপসহীন
সিদ্দিক কাপ্পানকে কে না চেনেন! হাথরসে দলিত কিশোরীর গণধর্ষণ ও হত্যার খবর করতে যাওয়ার পথে গ্রেফতার হন কেরলের এই সাংবাদিক, দু’বছর ছিলেন কারাবন্দি। ভারতে সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকের স্বাধীনতা কোথায় দাঁড়িয়ে, তুলে ধরেছিল এ ঘটনা। সাংবাদিকদের আপসহীন সাহসী লড়াইকে তুলে ধরতে আগামী কাল ১৬ জুলাই এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে পিপল’স ফিল্ম কালেক্টিভ, হাজরার কাছে সুজাতা সদনে বিকেল সাড়ে ৫টায়। ‘নিউজ় ম্যাটারস’ প্রসঙ্গে সিদ্দিক কাপ্পান স্বয়ং বলবেন তাঁর অভিজ্ঞতা ও লড়াই নিয়ে। দেখানো হবে সুস্মিত ঘোষ ও রিন্টু টমাস-এর তৈরি তথ্যচিত্র রাইটিং উইথ ফায়ার, বুন্দেলখণ্ডের দলিত মহিলা সাংবাদিকদের পরিচালিত সংবাদপত্র ও ডিজিটাল সংবাদমাধ্যম খবর লহরিয়া-র যাত্রাপথের গল্প।
সিনেমার ক্লাস
সিনেমা নিছক বিনোদনবস্তু নয়, চিত্রকলা ভাস্কর্য সাহিত্য সঙ্গীতের মতো চর্চার বিষয়। আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রের অনুপুঙ্খ চর্চা করতে করতেই সত্যজিৎ রায় ও তাঁর বন্ধুরা পত্তন করেছিলেন ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি-র। ক্রমে বাংলা তথা ভারতীয় সিনেমাকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পৌঁছে দিয়েছিলেন এই সৃজনশিল্পীরা। সে দিনের ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলন আজ স্তিমিত, পাল্টেছে তার রূপ ও মেজাজ। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের চলচ্চিত্রবিদ্যার শিক্ষাও কি উন্নত সিনেমা-সংস্কৃতিতে উত্তরণ ঘটাতে পারছে সমাজজীবনের? এই ভাবনা থেকেই রবিন মিডিয়া শপ-এর উদ্যোগ ‘সিনেমার ক্লাস’। গত ৯ জুলাই নন্দন-৩’এ হয়ে গেল প্রথম আয়োজনটি, জঁ-লুক গোদার আর ইঙ্গমার বার্গম্যানের চলচ্চিত্রভাবনা ও শৈলী নিয়ে বললেন শেখর দাশ ও অশোক বিশ্বনাথন, সুজয় সোমের সঞ্চালনায়।
সময়ের রূপক
সংসৃতি-র নতুন প্রযোজনা খোক্কস, নাচে-গানে ভরা আধুনিক রূপকথা। রূপকের মোড়কে এ নাটক সময়ের মুখোমুখি দাঁড় করায়; খোক্কসের বিরুদ্ধে স্বপনকুমারের লড়াই আর তার সহযোগী বিড়াল গাধা পাখি কুকুর তৈরি করে এক স্বপ্নজগৎ, বাস্তবকে ছাপিয়ে এক চিরন্তন সত্য গড়ে। ইভাগ্নি শোরটস্-এর দ্য ড্রাগন নাটকের বঙ্গীকরণ করেছেন অর্পিতা ঘোষ, সিনোগ্রাফি ও নির্দেশনা দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের। গানের সুর করেছেন রূপম ইসলাম, মঞ্চে গান গেয়েছেন বাজিয়েছেন নেচেছেন অভিনেতারা। দেবশঙ্কর হালদার ফের অন্য রূপে, সঙ্গে উজ্জ্বল এক ঝাঁক সহ-অভিনেতা। আগামী কাল ১৬ জুলাই রবিবার, মধুসূদন মঞ্চে সন্ধে সাড়ে ৬টায়।
‘মেটাল আর্ট’
জার্মান সিলভারের তৈরি টি-পট রূপ পাল্টে হয়েছে সুদৃশ্য ল্যাম্প। চারটে সেফটিপিন এমন ভাবে ‘সাজানো’, যেন বাবা-মা-ছানার সংসার, আবার মাতৃগর্ভেও বেড়ে উঠছে একটি শিশু। বড় ধাতব পেরেক বেঁকেচুরে যেন অভিমানী পুরুষ ও নারী, দু’দিকে মুখ ঘুরিয়ে দু’জন (নীচে বাঁ দিকে)। নেল ক্লিপার দিয়ে তৈরি মানব-মানবী, স্প্যানার দিয়ে মাছ, চেন লিঙ্ক দিয়ে ক্রুশ, চামচ দিয়ে ময়ূরের পেখম, গাড়ি আর সাইকেলের যন্ত্রাংশে কচ্ছপ বা পেঁচা (ডান দিকের ছবি)। ধাতুর শীতলতায় শিল্পের উষ্ণতা খুঁজে পান কাশ্যপ রায়, চার পাশের জীবনের কেজো বাস্তবকে করে তোলেন শৈল্পিক। কে বলে ষাট পেরোলেই মনে জং ধরে! চৌষট্টি বছর বয়সে ‘মেটাল আর্ট’কে সঙ্গী করেছেন শিল্পী, তাঁর কাছে এই শিল্পচর্চা একাধারে আবেগ, নিরাশা, পাগলামি, বহু বিনিদ্র রজনীর ফল। অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসের সেন্ট্রাল গ্যালারিতে ১১ জুলাই থেকে চলছে প্রদর্শনী, চলবে আগামী ১৭ তারিখ অবধি, দুপুর ১২টা থেকে রাত ৮টা।
বহুমুখী
নদিয়ার শান্তিপুরের ছেলে গিয়ে পড়লেন লখনউতে। কারণ— বিশ শতকের গোড়ার বঙ্গে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ। ভাগ্যিস গিয়েছিলেন, তা না হলে হয়তো শিল্পজগতে আসাই হত না ললিতমোহন সেনের (১৮৯৮-১৯৫৪), কে বলতে পারে! লখনউয়ের সরকারি আর্ট কলেজ থেকে ১৯১৭-তে পাশ করে বেরোনো, কুড়ি বছর বয়সে সেখানেই শিক্ষকতায় যোগদান। ১৯২৫-এ ফেলোশিপ নিয়ে গেলেন লন্ডনের রয়াল কলেজ অব আর্ট-এ, অধ্যক্ষ তখন উইলিয়াম রোদেনস্টাইন। চিত্রকলা, কাঠখোদাইয়ে খুলে গেল দিগন্ত, সদস্য হলেন ব্রিটেনের রয়াল ফোটোগ্রাফিক সোসাইটি-র, গ্রাফিক আর্টের নানা মাধ্যমে হলেন সিদ্ধহস্ত। দেশে ফিরে নিজের কলেজেই শিক্ষকতা, পরে ১৯৪৫-এ অধ্যক্ষ হন ললিতমোহন। বহুমুখী এই শিল্পীর ড্রয়িং, তেলরং, টেম্পেরা, প্রিন্ট, ফোটোগ্রাফ, ডিজ়াইন, ভাস্কর্য ইত্যাদি (ছবিতে তারই একটি) নিয়ে রেট্রোস্পেক্টিভ স্তরের প্রদর্শনী কিউরেট করেছেন দেবদত্ত গুপ্ত, ইমামি আর্ট-এ তার প্রিভিউ হল গতকাল। দেখা যাবে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত।
কবিতাজীবন
এ বছরেই বেরিয়েছে তাঁর নির্বাচিত কবিতার সঙ্কলন কবিতা মঞ্জুষা, আর আজীবন কবিকৃতির জন্য পশ্চিমবঙ্গ কবিতা আকাদেমি তাঁকে দিয়েছে ২০২৩-এর ‘জীবনানন্দ দাশ সম্মাননা’। হিরণ্ময় অন্ধকার, সঙ্গে আমার বালককৃষ্ণ, দেরী হবে রে... তোর গায়ে এখনো সংসারের গন্ধ-এর মতো কাব্যের কবি সুধেন্দু মল্লিক পঞ্চাশের দশকের সমুজ্জ্বল কবিকুলের অন্যতম। তাঁর রক্তে কবিতার উত্তরাধিকার: পিতামহ কুমুদরঞ্জন মল্লিক, পিতা জ্যোৎস্নানাথ। গোড়ায় কলেজে অর্থনীতির শিক্ষকতা, পরে বেছে নেন বিচারকের পেশা, কিন্তু কবিতায় থেকেছেন আজীবন। বেশ কয়েকটি পত্রিকার সম্মাননা পেয়েছেন; সরকারি স্বীকৃতি এল এই পড়ন্ত বেলায়, যখন গুরুতর অসুস্থ অশীতিপর কবি (জন্ম ১৯৩৫) নিউ টাউনের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।