হাতে হাত: ভেঙে পড়া গাছ সরাচ্ছেন পাড়ার ছেলেরাই। উত্তর কলকাতা এলাকায়। নিজস্ব চিত্র
পাড়ার রক, মাচা বা চায়ের দোকানে বসেই আড্ডা চলে ওঁদের। কখনও আবার বাইকে চষে বেড়াতে দেখা যায় এক পাড়া থেকে অন্য পাড়ায়। গলির মোড়ে গভীর রাত পর্যন্ত ওঁদের জটলায় বিরক্ত হন পাড়ার অনেক বাসিন্দা। রাস্তায় দেখা হলে প্রায় ওঁদের এড়িয়েই চলাফেরা করেন সকলে।
চেনা মুখের ছেলেগুলিই সারা বছর এমন ভাবে ব্রাত্য থাকেন পাড়ার লোকেদের কাছে। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় আমপান বাড়িয়ে দিয়েছে ওঁদের গুরুত্ব। সকলেই বলছেন, সে সময়ে ওই যুবকেরাই হয়ে উঠেছিলেন পাড়ার ‘হিরো’। সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের মতে, ‘‘বিপদে পড়লে বোঝা যায় ওঁদের প্রয়োজনীয়তা।’’ যেমন ঝড় পরবর্তী পরিস্থিতিতে তা টের পেয়েছে এই শহরও।
আমপানের ধাক্কায় বিপর্যস্ত হয়েছে শহরের উত্তর থেকে দক্ষিণ। মূল রাস্তা থেকে শুরু করে অলিগলিতে উপড়েছে অসংখ্য গাছ, বাতিস্তম্ভ। ছিঁড়েছে বিদ্যুতের তার। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে প্রশাসন, সিইএসসি-র ভূমিকা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন। লাগাতার চলেছে বিক্ষোভ-অবরোধ। এ সবের মাঝে অবশ্য পাড়ার ব্রাত্য ছেলেরাই এগিয়ে এসেছিলেন ত্রাতার ভূমিকায়। রাস্তায় পড়ে থাকা গাছের ডাল কাটতে হাতে তুলে নিয়েছিলেন কাটারি, কুড়ুল। কোথাও আবার এলাকার বহুতলে যাতে তাড়তাড়ি আলো জ্বলে, সে জন্য অন্য পাড়া থেকে সিইএসসি-র কর্মীদের ধরেও এনেছিলেন। চরম বিপর্যয়ের দিনে ওই যুবকদের পাশে পেয়ে অবাক হয়েছেন অনেকেই। আর তাই কোথাও কোথাও পাড়ার ‘রকে বসা’ ছেলেদের সঙ্গেই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে গাছ সরাতে দেখা গিয়েছিল বহুজাতিক সংস্থায় কর্মরত যুবককে।
শহর অবশ্য এই প্রথম এমন দেখল তা নয়। ঢাকুরিয়ার বেসরকারি হাসপাতালে আগুন লাগার পরে উদ্ধারকাজে প্রথম ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন পাশের বস্তির বাসিন্দারাই। আমপানের তাণ্ডব থামার পরে তেমনই নেতাজিনগরে নিজেদের পাড়ার ছবিটা দেখতে বেরিয়েছিলেন চিনা, বাবুরা। পাড়ায় যাতে অসুবিধা না-হয়, তার জন্য পাশে পেয়েছিলেন মনোব্রত পালকে। মনোব্রতের কথায়, ‘‘পুরোটা করতে পেরেছি বলব না। তবে যতটা সম্ভব হয়েছে, করেছি। যাঁরা বাঁকা চোখে দেখতেন, তাঁরাই কাজ দেখে বাবা-বাছা করে কথা বলেছেন।’’ পাড়ার রাস্তা ছাড়াও কারও বাড়ির উপরে হেলে পড়া গাছও কেটেছেন ওই যুবকেরা।
আমপানে ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ির ছাউনি সারাতে হাত লাগিয়েছেন স্থানীয় যুবকেরা।
আবার বিজয়গড় থেকে গল্ফগ্রিন যাওয়ার রাস্তায় পড়ে যাওয়া গাছ কাটা না-হলে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া যাবে না বলে জানিয়ে দিয়েছিল সিইএসসি। শেষে মুশকিল আসান হন শুভজিৎ সরকার-সহ পাড়ার অন্য ছেলেরা। শুভজিৎ বললেন, ‘‘নিজেরাই খানিকটা গাছ কাটার পরে একটি অংশে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয় সিইএসসি। গাছ সরিয়ে গাড়ি যাওয়ার মতো রাস্তা করে দিয়েছিলাম।’’
একই রকম ভাবে ফান্টুস দে, গোপাল দাসেরা তাঁদের বন্ধুদের নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের উল্টোডাঙা মেন রোড এবং দাসপাড়া এলাকায়। ফান্টুসের কথায়, ‘‘সারা বছরই আমরা এমন কাজ করি।’’ আবার ১০ নম্বর ওয়ার্ডের শিবশঙ্কর মল্লিক লেনের বস্তিতে ঝড়ে উড়ে যাওয়া ছাউনি মেরামতিতেও পৌঁছে গিয়েছিলেন গব্বর, মুন্নু, বুদুয়া, কালীরা। এমন ভাবেই বেহালা, যাদবপুর, পাইকপাড়া, নাকতলা, গড়িয়া, দমদম থেকে শুরু করে বালি, বরাহনগর— সর্বত্র বিপর্যয় সামলাতে বহুতলের প্রতিবেশীদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন দিন আনা-দিন খাওয়া এই যুবকেরা। প্রশাসনের কাজেও সহযোগিতা করেছেন। শীর্ষেন্দুবাবু বলছেন, ‘‘এই যুবকদের আমরা অন্য সময়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করি। বিপদের সময়ে এঁরাই কিন্তু মানুষের জন্য প্রাণ দিয়ে করেন।’’
ঝড়ের সৌজন্যে রাতারাতি হয়ে ওঠা ‘হিরোরা’ অবশ্য বলছেন, ‘ছাই ফেলতে ভাঙা কুলোই তো লাগে।’
আরও পড়ুন: কোথায় গেল? দিনভর তন্নতন্ন খোঁজ, শ্যাবি তখন থানায় বসে লাঞ্চ আর আদর খাচ্ছে