ফিরহাদ হাকিম। —ফাইল চিত্র।
এক দিকে যেখানে বেআইনি নির্মাণ নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই একাধিক অভিযোগ জমা পড়ছে কলকাতা পুরসভার দফতরে, ‘টক টু মেয়র’ অনুষ্ঠানে ক্ষোভ উগরে দিচ্ছেন বিরক্ত সাধারণ নাগরিকেরা, সেখানে অভিযোগ, বেআইনি বাড়ি ভাঙতে গিয়ে খোদ শাসকদলেরই পুরপ্রতিনিধির কাছে রীতিমতো হেনস্থা হতে হয়েছে পুরসভার বিল্ডিং দফতরের ইঞ্জিনিয়ারদের। এমনকি, তাঁদের হুমকিও দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ। এই ঘটনায় প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে কি বেআইনি নির্মাণের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার পুর হুঁশিয়ারি ও প্রতিশ্রুতি আসলে স্রেফ লোক-দেখানো? যদি তা না হয়, তা হলে কি অভিযুক্ত পুরপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারবেন পুর কর্তৃপক্ষ?
পুরসভা সূত্রের খবর, মঙ্গলবার দুপুরে মেটিয়াবুরুজের ১৩৭ নম্বর ওয়ার্ডের মসজিদ তালাব লেনে একটি চারতলা বেআইনি নির্মাণ ভাঙতে যান বিল্ডিং দফতরের ইঞ্জিনিয়ারেরা। গোটা বাড়িটাই বেআইনি বলে পুরসভা জানিয়েছে। অভিযোগ, কিছুটা অংশ ভাঙার পরেই স্থানীয় তৃণমূল পুরপ্রতিনিধি ওয়াসিম আনসারি সদলবল ওই বাড়ির ছাদে হাজির হন। উপস্থিত ইঞ্জিনিয়ারদের উদ্দেশে তিনি নাগাড়ে কটূক্তি করতে থাকেন বলে অভিযোগ। তাঁদের মারধরের হুমকিও দেন।
এই ঘটনায় প্রশ্ন উঠেছে, বেআইনি বাড়ি ভাঙতে যাওয়া পুরসভার কর্মীদের সাহায্য করার বদলে স্থানীয় পুরপ্রতিনিধি তাঁদের বাধা দেন কী ভাবে? মেয়র ফিরহাদ হাকিম পুরনো সুরেই বলেন, ‘‘পুরসভা কোনও ভাবেই বেআইনি নির্মাণে প্রশ্রয় দেবে না। মেটিয়াবুরুজের ওই বেআইনি বাড়ি শীঘ্রই ভেঙে ফেলা হবে।’’ তা হলে বেআইনি বাড়ি ভাঙতে গেলে এক জন পুরপ্রতিনিধি কোন এক্তিয়ারে পুরসভার ইঞ্জিনিয়ারদের কাজে বাধা দেন? এ নিয়ে মেয়রকে ফোন এবং মেসেজ করা হলেও জবাব মেলেনি।
বিজেপির পুরপ্রতিনিধি সজল ঘোষের অভিযোগ, ‘‘টক টু মেয়র অনুষ্ঠানে একাধিক বার বেআইনি বাড়ি নিয়ে মেয়রের তোপের মুখে পড়তে হয়েছে বিল্ডিং দফতরের ইঞ্জিনিয়ারদের। তাঁদের দোষেই নাকি পুরসভা ‘চোরপোরেশন’-এ পরিণত হয়েছে বলে গত শনিবারই মন্তব্য করেন মেয়র। মেয়রকে একাধিক বার বলতে শোনা গিয়েছে, টাকা খান ইঞ্জিনিয়ারেরা। আর দোষ হয় পুরপ্রতিনিধিদের। বেআইনি বাড়ি ভাঙার কাজ পুর ইঞ্জিনিয়ারদের। তাতে পুরপ্রতিনিধির কোনও ভূমিকা নেই। তা হলে পুরপ্রতিনিধি সেই কাজে বাধা দেবেন কেন?’’
এই ঘটনায় পুরকর্মীরা যে ভাবে হেনস্থার শিকার হয়েছেন, তাতে প্রবল ক্ষুব্ধ বিল্ডিং দফতরের আধিকারিক-কর্মীরা। ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিয়োয় (আনন্দবাজার সেটির সত্যতা যাচাই করেনি) দেখা গিয়েছে, মঙ্গলবার দুপুরে ওয়াসিম আনসারি ওই চারতলা বেআইনি বাড়ির ছাদে উঠে পুরসভার বিল্ডিং দফতরের ইঞ্জিনিয়ারদের নাগাড়ে হুমকি দিচ্ছেন। তাঁদের মারধরের হুমকিও দেন তিনি। পুর আধিকারিকদের উদ্দেশে তাঁকে বলতে শোনা যায়, ‘‘কিসের ভিত্তিতে বাড়ি ভাঙতে এসেছেন? প্রামাণ্য নথি দেখান।’’ এর পরে সেই পুর ইঞ্জিনিয়ারেরা প্রয়োজনীয় নথি দেখাতে গেলে তখনও অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করা হয় বলে অভিযোগ। এই ঘটনার পরে পুর বিল্ডিং দফতরের সংখ্যাগরিষ্ঠ ইঞ্জিনিয়ারের অভিমত, খোদ পুরপ্রতিনিধি এমন আচরণ করলে বেআইনি বাড়ি ভাঙার কাজ কঠিন হয়ে পড়বে। বছরখানেক আগে দক্ষিণ কলকাতার বাঘা যতীন এলাকায় বেআইনি বাড়ি ভাঙতে গিয়ে একই ভাবে হেনস্থার শিকার হতে হয়েছিল পুরসভার বিল্ডিং দফতরের আধিকারিক-কর্মীদের। স্থানীয় পুরপ্রতিনিধির বাধার মুখে পড়ে সে বারও ফিরে আসতে হয় পুলিশ ও পুরসভার কর্মীদের।
এক জন পুরপ্রতিনিধি হয়ে কেনই বা তিনি বেআইনি বাড়ি ভাঙতে বাধা দিতে গেলেন? ১৩৭ নম্বর ওয়ার্ডের পুরপ্রতিনিধি ওয়াসিমআনসারির সাফাই, ‘‘পুরসভা থেকে যে বাড়িটি ভাঙতে এসেছিল, সেটি ভাঙার উপরে হাই কোর্টের স্থগিতাদেশ রয়েছে। এক জন পুরপ্রতিনিধি হয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের পাশে দাঁড়াতেই বেআইনি বাড়ি ভাঙতে বাধা দিয়েছিলাম।’’ কিন্তু বেআইনি বাড়ি ভাঙার বিষয়ে নাক গলানো কি পুরপ্রতিনিধির কাজ? এর উত্তর না দিয়েই ফোন কেটে দেন ওয়াসিম। মেটিয়াবুরুজের ওই বেআইনি বাড়ি ভাঙার উপরে আদালতের কোনও স্থগিতাদেশ আদৌ আছে কিনা, সে ব্যাপারে খোঁজ নিচ্ছে বিল্ডিং দফতর। এমন কোনও খবর তাদের কাছে নেই।
অন্য দিকে, বুধবার সিঁথি থানা এলাকার বি টি রোডে একটি চারতলা বেআইনি বাড়ি ভাঙতে গিয়ে বাধার মুখে পড়ে ফিরে আসতে হয় পুরসভার বিল্ডিং দফতরের কর্মীদের। অভিযোগ, সেখানে জনা ২৫ মহিলা বাসিন্দা পুরসভার কর্মী-ইঞ্জিনিয়ারদের ঘিরে ধরে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন। এমনকি, এক জন মহিলা নিজের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আত্মহত্যার চেষ্টাও করতে যান। প্রায় দু’ঘণ্টা ধরে চেষ্টা করার পরে বি টি রোডের বেআইনি বাড়ি না ভেঙেই ফিরে আসতে হয় পুরসভার কর্মীদের।