আরজি কর হাসপাতালের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষকে ছুটিতে পাঠিয়েছে হাই কোর্ট। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
আরজি কর হাসপাতালের সেমিনার হলের কাছের একটি ঘর সংস্কারের জন্য ভেঙে ফেলা এবং বুধবার রাতে মেয়েদের রাত দখল কর্মসূচিতে হামলার কারণে জরুরি বিভাগে ভাঙচুর— দুই প্রশ্নে রাজ্যকে ভর্ৎসনা করেছে আদালত। পুলিশের ভূমিকা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়েছে। বুধবার রাতে কেন পুলিশ পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দিতে পারল না, প্রশ্ন তোলে আদালত। এত মানুষের জমায়েতে নিরাপত্তার কী বন্দোবস্ত ছিল, সেখানে ১৪৪ ধারা জারি করার প্রয়োজনীয়তা ছিল কি না, পুলিশের গোয়েন্দারা কী ভূমিকা পালন করেছেন, প্রশ্ন উঠেছে। এ ছাড়া, আদালত সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেওয়ার পরেই কেন সেমিনার হলের পাশের ঘর ভাঙা হল, সেই প্রশ্নের মুখেও পড়েছে রাজ্য সরকার। তারা জানায়, চিকিৎসকদের দাবি অনুযায়ী বিশ্রাম ঘর তৈরি করার কাজ শুরু হয়েছিল। তবে ঘটনাস্থল সুরক্ষিত। এর পরেই আদালত রাজ্যকে হলফনামা দিয়ে জানাতে হবে, ঘটনাস্থল সুরক্ষিত কি না, সুরক্ষার কী কী বন্দোবস্ত সেখানে রয়েছে।
আরজি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষকে ভর্ৎসনা করেছে আদালত। তাঁর আইনজীবী আদালতে নিরাপত্তার দাবি জানিয়েছেন। বলেছেন, ‘‘আমার মক্কেলকে নিরাপত্তা দেওয়া হোক। সিবিআইয়ের সঙ্গে আমরা সহযোগিতা করেছি। রাজ্য বা কেন্দ্রীয় বাহিনী, যে কোনও সংস্থাকে নিরাপত্তা দিতে নির্দেশ দিক আদালত।’’
এর পর আইনজীবীর উদ্দেশে বিচারপতির মন্তব্য, ‘‘আপনি তো প্রভাবশালী ব্যক্তি। আপনার সঙ্গে রাজ্য রয়েছে। কেন আবার নিরাপত্তা চাই? বাড়িতেই থাকুন। শান্তিতে থাকুন। না হলে বলুন, কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করে দিচ্ছি।’’
মৃত চিকিৎসকের নাম এবং ছবি প্রকাশ না করার জন্য অনুরোধ করলেন বিচারপতি। তাঁর মন্তব্য, ‘‘আমরা অনুরোধ করছি মৃতাকে যাঁরা চেনেন তাঁরা তাঁর নাম এবং ছবি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেবেন না। সংবাদমাধ্যমও কোথাও তা প্রকাশিত করতে পারবে না। এটা করা যাবে না, এ বিষয়ে নির্দিষ্ট আইন রয়েছে।’’
পরবর্তী শুনানির দিন সিবিআই তদন্তের অগ্রগতির রিপোর্ট জমা দেবে আদালতে। আগামী বুধবার পরবর্তী শুনানি।
হাসপাতালে গিয়ে পরিস্থিতি খতিয়ে দেখার জন্য সিবিআইকে স্বাধীনতা দিল আদালত। হামলার ফলে হাসপাতালের কোন অংশ কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তা খতিয়ে দেখবে কেন্দ্রীয় সংস্থা। রাজ্য এ নিয়ে হলফনামা জমা দেবে। কত দিনে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, রাজ্যের কাছে তা জানতে চেয়েছেন বিচারপতি।
আরজি কর হাসপাতালে হামলার ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে আদালত। রাজ্যের আইনজীবীর উদ্দেশে প্রধান বিচারপতির মন্তব্য, ‘‘পুলিশ নিজেকে রক্ষা করতে পারছে না। জনতাকে ঠেকাতে পারছে না। আইনশৃঙ্খলা কী ভাবে রক্ষা করবে?’’ ভবিষ্যতে এমন ঘটনা নিয়ন্ত্রণে কী পদক্ষেপ করবে পুলিশ? জানতে চেয়েছে আদালত।
কেন সেমিনার হলের কাছের ঘরটি এখনই ভাঙতে হল? এত তাড়াহুড়ো কিসের? হলফনামা দিয়ে রাজ্যের কাছে জানতে চাইল আদালত। ঘটনাস্থল যে নিরাপদ রয়েছে, তা-ও হলফনামা আকারে রাজ্যকে জানাতে হবে। এ প্রসঙ্গে প্রধান বিচারপতির মন্তব্য, ‘‘এত তাড়াহুড়ো কেন? সব হাসপাতালেই পর্যাপ্ত বিশ্রাম-ঘর রয়েছে। শিলিগুড়ি হাসপাতালে যান। এত বড় একটা ঘটনা ঘটেছে, এই পরিস্থিতিতে আপনারা সেখানে গোলমাল (ডিসটার্ব) করছেন! ঘটনাস্থল নিরাপদ রয়েছে এই মর্মে হলফনামা দিন।’’
জরুরি বিভাগের চার তলার যে সেমিনার হল থেকে চিকিৎসকের দেহ উদ্ধার করা হয়েছিল, সেই স্থান সুরক্ষিত রয়েছে বলে দাবি করেছে রাজ্য। কেন সংস্কারের কাজ শুরু হল? সেই প্রশ্নে রাজ্যের আইনজীবী জানান, চিকিৎসকদের দাবি মেনে ওই অংশে আর একটি বিশ্রামের ঘর তৈরি করা হচ্ছে। সেই কাজ শুরু হয়েছিল।
আরজি কর হাসপাতালের অধ্যক্ষের পদ থেকে গত সোমবার ইস্তফা দিয়েছিলেন সন্দীপ ঘোষ। তার পর তাঁকে অন্য হাসপাতালে নিযুক্ত করা হয়। মঙ্গলবার হাই কোর্ট তাঁকে লম্বা ছুটিতে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। শুক্রবারের শুনানি চলাকালীন অধ্যক্ষের আইনজীবীর উদ্দেশে প্রধান বিচারপতির মন্তব্য, ‘‘সবটাই আমাদের প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ। আপনি চিন্তা করবেন না। আপনি খুবই ক্ষমতাশালী। আপনি আমাদের নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করছেন। বাড়িতে শান্তিতে থাকুন। না হলে বাড়িতে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করার নির্দেশ দেব।’’
বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর আইনজীবী আরজি কর হাসপাতাল চত্বরে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের আবেদন জানিয়েছেন।
আইনজীবী বিকাশরঞ্জনের সওয়ালের পর বিচারপতি তাঁর উদ্দেশে বলেন, ‘‘আপনারা বলছেন, ৭০-৮০ জন হাসপাতালে ভাঙচুর করেছে। রাজ্য আবার সাত হাজার লোকের জমায়েতের কথা বলছে। ৭০-৮০ জন যদি এটা করে থাকে, তা হলে তাঁদের উদ্দেশ্য কী?
মামলাকারীদের হয়ে সওয়াল করতে গিয়ে আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘আরজি করে হামলার পর পুলিশ কমিশনার বলেছেন, সারা শহর জুড়ে প্রতিবাদ হচ্ছে। আমরা কী করতে পারি? অর্থাৎ, পুলিশের তরফে কোনও সমর্থন নেই! কমিশনারের বক্তব্যের ভিডিয়ো রেকর্ড রয়েছে। এ সব কী হচ্ছে? সরকারি হাসপাতালে ভাঙচুর করা হচ্ছে!’’
আরজি কর-কাণ্ডে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিল আদালত। তার পরেই দেখা যায়, সেমিনার হলের কাছে সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছে। ভেঙে ফেলা হচ্ছে একটি ঘর। কেন তা করা হল? আদালতে প্রশ্ন তুলেছেন মামলাকারীদের আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য।
আদালত রাজ্যের উদ্দেশে প্রশ্ন করেছে, ১৪৪ ধারা জারির প্রয়োজন ছিল কি না দেখেছেন? এত বড় ঘটনা। চিকিৎসকরা ধর্না দিচ্ছেন। বিক্ষোভ, প্রতিবাদ হচ্ছে। রাজ্য কী করেছে? ওই ঘটনার পরে সতর্কতা হিসাবে কী করেছে পুলিশ? এর পর প্রধান বিচারপতির মন্তব্য, ‘‘এটা রাজ্য প্রশাসনের সম্পূর্ণ ব্যর্থতা। পুলিশ নিজেদের কর্মীদের রক্ষা করতেই পারেনি।’’
আরজি করে হামলার ঘটনায় পুলিশের গোয়েন্দাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলল আদালত। রাজ্যের উদ্দেশে প্রধান বিচারপতির মন্তব্য, ‘‘সাধারণত ১০০ জনের জমায়েত হলেই গোয়েন্দারা নজর রাখেন। সাত হাজার মানুষের জমায়েতে তাঁরা কী করছিলেন? এত লোকের জমায়েত হল আর পুলিশের গোয়েন্দারা কিছু জানলেন না, এটা বিশ্বাস করা কঠিন।’’
আরজি করে হামলার প্রশ্নে রাজ্যের আইনজীবী আদালতে জানিয়েছেন, মূল ঘটনাস্থলে কিছু হয়নি। সেখানে পৌঁছতে পারেননি হামলাকারীরা।
আরজি করে হামলার ঘটনা প্রসঙ্গে রাজ্যকে আদালতের প্রশ্ন, ‘এ সব কী হচ্ছে?’ জবাবে রাজ্যের আইনজীবী জানান, আন্দোলন চলাকালীন আচমকা প্রায় সাত হাজার মানুষ হাসপাতালে ঢুকে পড়েন। তাঁদের মধ্যে কয়েক হাজার মানুষ ভাঙচুর চালান। পুলিশও সেই হামলায় আক্রান্ত হয়েছে।
কলকাতা হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানম এবং বিচারপতি হিরণ্ময় ভট্টাচার্যের বেঞ্চে আরজি করে হামলার ঘটনা নিয়ে নতুন মামলা করা হয়েছে।
আরজি কর-কাণ্ড নিয়ে একাধিক জনস্বার্থ মামলা হয়েছিল হাই কোর্টে। বুধবার রাতে হাসপাতালে হামলার ঘটনায় নতুন করে আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। জরুরি শুনানির আর্জি জানান মামলাকারীরা। আবেদন মঞ্জুর করা হয়েছে।