এসএসকেএম হাসপাতালে গণ কনভেনশনে বলছেন অনিকেত মাহাতো। —নিজস্ব চিত্র।
টলিউড অভিনেত্রী দেবলীনা দত্ত জুনিয়র ডাক্তারদের গণ কনভেনশনে বক্তব্য রাখছেন। তিনি বলেন, ‘‘থ্রেট কালচার ভুলে গেলে চলবে না। নির্যাতিত কোনও মহিলা না হয়ে পুরুষও হতে পারতেন। হুমকি সংস্কৃতির কারণেই এ সব হচ্ছে। তার বিরুদ্ধেই আমাদের লড়াই। দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই। হুমকি দেওয়া মানেই ভয় পাওয়া। তাঁরা ভয় পাচ্ছেন বলেই হুমকি দিচ্ছেন।’’
গণ কনভেনশনে দেবলীনা দত্ত। —নিজস্ব চিত্র।
সঙ্গীতশিল্পী অন্বেষা দত্ত জুনিয়র ডাক্তারদের গণ কনভেনশনে গান গাইলেন। রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে আরজি কর-কাণ্ডের প্রতিবাদ জানালেন তিনি। গেয়েছেন অরিজিৎ সিংহের ‘আর কবে’ও।
গণ কনভেনশনে অন্বেষা দত্ত। —নিজস্ব চিত্র।
সমাজকর্মী বোলান গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘‘দলীয় রাজনীতিতে আর বিশ্বাস রাখছেন না সাধারণ মানুষ। এই ঘটনায় ফাস্টট্র্যাক আদালতের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। আমাদের দেশে বিচারপতির সংখ্যা কম। বিচার হয় না তাই। তদন্ত কমিশন আদতে সব ঠান্ডা ঘরে পাঠিয়ে দেয়। তদন্ত কবে শেষ হবে, কেউ বলতে পারবেন না। জুনিয়র ডাক্তারেরা বুড়ো হয়ে যাবেন। এই বিচারব্যবস্থাকে প্রশ্ন করতে পারে একমাত্র জনগণ। সুপ্রিম কোর্টকে চাপ দিতে হবে। নাগরিক সমাজ দ্রুত বিচার চাইছেন, এই বার্তা পৌঁছে দিতে হবে।’’
গণ কনভেনশনে বোলান গঙ্গোপাধ্যায়। —নিজস্ব চিত্র।
গণ কনভেনশনে উপস্থিত মীরও। তিনি বলেন, ‘‘এটাই আসল ছবি, যা ৫০ দিন ধরে চলছে। আমরা বিচার চাই। মুখ্যমন্ত্রী উৎসবে ফিরতে বলেছিলেন। ডাক্তারেরা বন্যার ত্রাণ দিতে গিয়ে উৎসবে ফিরেছেন। আমরা যা পারিনি, তা ডাক্তারেরা করে দেখিয়েছেন। এটা মানবিকতার উৎসব। এতে কোনও ভেদাভেদ নেই।’’ আরজি কর আবহে যে তারকারা মুখ খোলেননি তাঁদের কটাক্ষ করে মীরের বার্তা, ‘‘যাঁরা মুখ খুলতে পারেন না, তাঁদের এত কিসের ভয়? পুরস্কার না পাওয়ার ভয় কি? দোষীদের ‘গারদ শুভেচ্ছা, বাকিদের শারদ শুভেচ্ছা’।’’
গণ কনভেনশনে মীর। —নিজস্ব চিত্র।
আরজি করে নির্যাতিতার প্রতীকী মূর্তি রাখা হবে বলে প্রস্তাব হল জুনিয়র ডাক্তারদের গণ কনভেনশনে। নির্যাতিতার প্রতীক হিসাবে যন্ত্রণাদীর্ণ নারীমূর্তি রাখা হবে হাসপাতাল চত্বরে। ২ অক্টোবর ওই মূর্তি রাখা হতে পারে।
গণ কনভেনশনে ছিলেন সমাজকর্মী মীরাতুন নাহার। তিনি বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি রাজ্যের সর্বত্র ধ্বংসের বীজ বপন করেছেন, তাঁর নাম কৃষ্ণাক্ষরে লেখা থাকবে ইতিহাসে।’’
২৯ সেপ্টেম্বরের কর্মসূচির নাম দেওয়া হয়েছে, ‘পাড়ায় থাকছি একসাথে, উৎসবে নয় প্রতিবাদে’। ওই দিন বিচারের দাবিতে রাজপথ থেকে অলিগলি ভরানোর জন্য সাধারণ মানুষকে আহ্বান করেছেন জুনিয়র ডাক্তারেরা।
অনিকেত আরও বলেন, ‘‘ন্যায়বিচার কেউ পাচ্ছেন না। তাই আমাদের আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছেন। এই সলতে যেন নিভে না যায়। এই অঙ্কুরকে বিনষ্ট হতে দেবেন না, এটা জুনিয়র ডাক্তারদের তরফে অনুরোধ। বিচার ছাড়া আমাদের আর কোনও চাওয়া নেই। রাজ্য সরকারের তদন্তকারী দলের অপদার্থতা সর্বত্র দেখা যাচ্ছে। আমরা কেন নিরাপত্তা চাইছি, সেটাও বুঝতে হবে। নমনীয়তা আমাদের দুর্বলতা নয়। কেন বিচার দেরি করা হচ্ছে?’’
অনিকেত আরও বলেন, ‘‘হাসপাতালে হাসপাতালে যে ‘হুমকি সংস্কৃতি’ শুরু হয়েছে, তা ভয়াবহ। আমরা বন্যাত্রাণ দিতে গিয়ে ভয়ের কথা শুনেছি। শুধু আমাদের কলেজ ক্যাম্পাস নয়, কাজের জায়গাতেও ভয়ের পরিবেশ রয়েছে। সবাইকে সচেতনতার ব্যাটন হাতে নিয়ে চলতে হবে।
দেবাশিস জানান, উৎসবের মানসিক প্রস্তুতি নেই তাঁদের। বলেন, ‘‘সামনে পুজো আসছে। আমরা কাউকে উৎসবে বিরত থাকতে বলতে পারি না। কিন্তু আমরা উৎসবের জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত নই।’’
দু’টি নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করলেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। দেবাশিস জানান, আগামী ২৯ সেপ্টেম্বর এবং ২ অক্টোবর তাঁদের কর্মসূচি রয়েছে। ২ তারিখ মহালয়া। সে দিন তাঁরা মহামিছিলের ডাক দিয়েছেন। তার পর ধর্মতলায় মহাসমাবেশ হবে। দুপুর ১টা থেকে এই কর্মসূচি রয়েছে মহালয়ার দিন।
দেবাশিস আরও বলেন, ‘‘রোগীর পরিষেবায় ঘাটতি হলে রোষের মুখে পড়ি আমরা। তাই কেন্দ্রীয় ভাবে রেফারের সিস্টেম দরকারি। আমাদের আন্দোলন গণ আন্দোলন। ২৭ তারিখ সুপ্রিম কোর্টে শুনানির কথা ছিল। তা পিছিয়ে যাওয়ায় আমরা হতাশ। মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট হোক, তদন্তকারী সংস্থা হোক আর রাজ্য সরকার হোক, সাধারণ মানুষ চায় দ্রুত সত্য সামনে আসুক। ২৯ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা ৬টায় আমাদের নতুন কর্মসূচি রয়েছে।’’
দেবাশিস হালদার বলেন, ‘‘আমাদের বিচারহীনতার ৫০ দিন হল। আমরা কিছু পেলাম, কিছু পেলাম না। এই আন্দোলনের মুখ সকলেই। স্বাস্থ্য ভবনের ধর্না তুলে নেওয়ার পর অনেকে বলছেন, আমাদের আন্দোলন থেমে গিয়েছে। নির্যাতিতার জন্য ন্যায়বিচার ছিনিয়ে না আনা পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। আন্দোলন শেষ হয়ে গিয়েছে ভাবলে ভুল হবে। এই ঘটনা যাতে আর না ঘটে, তা আমরা সুনিশ্চিত করে ছাড়ব। আশা করব, দলীয় অ্যাজেন্ডা সরিয়ে আমাদের পাশে থাকবেন। অনেকে বলছেন আমরা নতুন সাত দফা দাবি করছি। আমাদের ওই পাঁচ দফা দাবিই আছে।’’
গণ কনভেনশনের মঞ্চ থেকে জুনিয়র ডাক্তারদের প্রতিনিধিরা বলেন, ‘‘সেটিং হয়ে গিয়েছে বলে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমাদের শিরদাঁড়া সোজা আছে। সাহস ছোঁয়াচে। তা আমাদের এক জনের কাছ থেকে অন্য জনের কাছে যাচ্ছে।’’
টলিউডের চিত্র পরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এই আন্দোলন স্বাভাবিক নয়। ডাক্তারদের যখন রাস্তায় বসতে হচ্ছে, বিচার চাইতে হচ্ছে, বুঝতে হবে, সব ঠিক নেই। এই সময়গুলি সুখের নয়। জুনিয়র ডাক্তারদের বলব, আপনারা একা নন। কোটি কোটি মানুষ আপনাদের সঙ্গে আছেন। সন্দীপ ঘোষরা সব জায়গায় আছেন। তাঁদের সাফাইয়ের সময় এসেছে। আপনারা শিরদাঁড়া সোজা রাখুন। বিচার পেতে সময় লাগবে। আমরা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করব। এই ঘটনার নেপথ্যে থাকা প্রত্যেকের শাস্তি হোক।’’
চিকিৎসক অর্ণব সেনগুপ্ত বলেন, ‘‘আন্দোলনের একটি যৌথমঞ্চ হওয়া দরকার। শুধু চিকিৎসক নন, সাধারণ মানুষেরও সেখানে উপস্থিতি প্রয়োজন। আন্দোলনকে দীর্ঘতর করতে যৌথমঞ্চ প্রয়োজন। বিচারের পাশাপাশি চিকিৎসক এবং রোগীদের মানবাধিকারের বিষয়গুলি দেখা প্রয়োজন। রোগীদের কথাও ভাবতে হবে।’’
চিকিৎসক তীর্থঙ্কর গুহঠাকুরতা বলেন, ‘‘হাসপাতালগুলিতে ‘হুমকি সংস্কৃতি’ খুব গুরুতর বিষয়। আমরা শিক্ষকদের কাছে বকুনি খেয়ে বড় হয়েছি। কিন্তু এখন শুনছি টাকা দিয়ে পাশ করা যায়। শুধু মেয়ে নয়, কোনও ছেলে যদি বলেন, তাঁকে যৌন নিগ্রহ করা হয়েছে, তাঁর পাশেও থাকতে হবে।’’
দীপ্তেন্দ্র সরকার বলেন, ‘‘আরজি কর নিয়ে আমাদের সন্দেহ মিথ্যা ছিল না। যাঁদের সন্দেহ করা হয়েছিল, সিবিআই তাঁদেরই ডেকেছে। কিন্তু ৫০ দিন পরেও সমাজের অন্ধকার কেটেছে বলে আমি মনে করি না। সিবিআইয়ের দেওয়া খামের তথ্য দেখে প্রধান বিচারপতিও বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন। ওই খামে মৃত্যুর তথ্য রয়েছে। খামে কী রয়েছে তা নিয়ে যদি তিন-চার মিনিট উনি কিছু বলতেন, তা হলে পশ্চিমবঙ্গের ১০ কোটি মানুষের বিচলিত হওয়ার কারণ কিছুটা কমত।’’
এসএসকেএমের ডিরেক্টর মণিময় বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘জুনিয়র ডাক্তারেরাই আমাদের স্তম্ভ। এমন ন্যক্কারজনক ঘটনা যে কোনও হাসপাতালে ঘটতে পারে, তা কল্পনাও করা যায় না। এর সঙ্গে যাঁরা সরাসরি বা পরোক্ষ ভাবে যুক্ত, তাঁদের সকলকে চিহ্নিত করা হোক। উপস্থিত সকলকে মতামত দিতে বলেন মণিময়। সকলের মতামতের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে বলে জানান তিনি।
অপপ্রচার করে কণ্ঠরোধ করা যাবে না। গণ কনভেনশন থেকে এমনই বার্তা দিলেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। তাঁরা জানিয়েছেন, বিভিন্ন মহলে তাঁদের আন্দোলন নিয়ে নানা অপপ্রচার চলছে। অনেকে বলছেন, তাঁরা নতুন নতুন দাবি করছেন। কিন্তু তা সঠিক নয়।