Surgery

Surgery: কোভিডে খুইয়েছিলেন দুই পা, হাল ছাড়েননি, আবার ‘নিজের পা’-এ দাঁড়ালেন রিমা

যে হাসপাতালে তাঁর দু’টি পা বাদ দিতে হয়েছিল, সেই হাসপাতালেই আবার ‘নিজের পা’-এ দাঁড়ালেন রিমা নন্দী দত্ত। বুধবার দুপুরে।

Advertisement

শান্তনু ঘোষ

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ মে ২০২২ ০৭:৩৭
Share:

কোভিডে হারিয়েছিলেন দু’টি পা। কৃত্রিম পায়ের সাহায্যে ফের রিমা নন্দী দত্তকে দাঁড় করালেন এসএসকেএম হাসপাতালের চিকিৎসকেরা। ছবি: রণজিৎ নন্দী

যে হাসপাতালে তাঁর দু’টি পা বাদ দিতে হয়েছিল, সেই হাসপাতালেই আবার ‘নিজের পা’-এ দাঁড়ালেন রিমা নন্দী দত্ত। বুধবার দুপুরে।

Advertisement

প্রায় এক বছর আগে করোনা আক্রান্ত হয়ে পা হারিয়েছিলেন দমদম জ’পুর রোডের বাসিন্দা বছর বিয়াল্লিশের রিমা। হাঁটুর নীচ থেকে কেটে বাদ দিতে হয়েছিল। চোখের সামনে নেমে এসেছিল একরাশ অন্ধকার। কিন্তু তাঁকে ভরসা জুগিয়ে ছিলেন চিকিৎসকেরা। বলেছিলেন, কোনও না কোনও ব্যবস্থা হবে। সেই প্রতিশ্রুতিই এ দিন পূরণ হল। দীর্ঘ চিকিৎসার পরে জার্মানি থেকে সরকারি খরচে আনা কৃত্রিম পা লাগানো হল রিমার দুই হাঁটুর নীচে। তাতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে, হাঁটাচলার প্রশিক্ষণের মধ্যেই তিনি বললেন, ‘‘হোক না কৃত্রিম পা। আমি আবার দাঁড়িয়েছি, হাঁটছি। ইচ্ছে করছে, মেয়ের কাছে ছুটে যাই।’’

রিমার চোখেমুখে ছিটকে পড়া আশার আলো দেখে পরিজন থেকে চিকিৎসক, সকলেই বলছেন, ‘‘এই দিনটারই তো অপেক্ষা ছিল।’’ শল্য বিভাগে অস্ত্রোপচারের
পর থেকে পিজির ফিজিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন (পিএমআর) বিভাগে চিকিৎসাধীন ছিলেন রিমা। বিভাগীয় প্রধান চিকিৎসক রাজেশ প্রামাণিক ও শল্য চিকিৎসক দীপ্তেন্দ্র সরকার জানাচ্ছেন, করোনা পরবর্তী সমস্যা হিসেবে রিমার দু’টি পায়ের ধমনী ও শিরায় রক্ত জমাট বেঁধেছিল। তাতেই বিপত্তি। প্রাণে বাঁচলেও পা বাদ যাওয়ার ধাক্কা ছিল সাঙ্ঘাতিক। শারীরিক ভাবে তো বটেই, মানসিক শক্তি তলানিতে গিয়ে ঠেকেছিল। রাজেশ বলেন, ‘‘লড়াইটা কঠিন ছিল। কিন্তু হাসপাতালের সকলের লক্ষ্য ছিল, করোনার কাছে হারব না। উনিও প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, দাঁড়াবেন এবং হাঁটবেন।’’ এসএসকেএমের অধিকর্তা মণিময় বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘ওঁর লড়াই আমাদের সকলের জেদকে বাড়িয়ে দিয়েছিল। তাই স্বাস্থ্য ভবনকে জানিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ করা হয়েছিল।’’ সূত্রের খবর, খরচ হয়েছে প্রায় ৪ লক্ষ টাকা।

Advertisement

গত বছর মার্চে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হন রিমা। এপ্রিলে কোভিড ধরা পড়লে স্থানীয় বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হন। রিমা বলেন, ‘‘বাড়ি ফেরার দিন দুয়েক পর থেকে পা ফুলতে শুরু করে। সঙ্গে অসহ্য জ্বালা-যন্ত্রণা।’’ স্ত্রীর দুই পায়ে রক্তের ছোপ পড়তে দেখে চমকে যান বিশ্বরূপ দত্ত। তিনি বলেন, ‘‘কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না। শেষে চিকিৎসক যোগীরাজ রায়ের কাছে যেতেই, উনি অবিলম্বে পিজিতে নিতে বলেন। ১১ মে সেখানে ভর্তি করি।’’ কিন্তু দু’দিনের মাথায় ফের করোনা ধরা পড়ায় শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে পাঠানো হয় রিমাকে।

১০ দিন পরে নেগেটিভ হয়ে ফের পিজিতে ফিরলেও, দেখা যায় তাঁর দু’টি পা পুরো কালো। শল্য বিভাগে পরীক্ষায় দেখা যায় পচন ধরেছে। শল্য চিকিৎসক দীপ্তেন্দ্র সরকারের কথায়, ‘‘প্রতিটি সেকেন্ড মূল্যবান ছিল। অবিলম্বে পা বাদ না দিলে প্রাণ সংশয় হতে পারে বুঝে অস্ত্রোপচার করি। করোনার সাইটোকাইন ঝড়ের কারণে শিরা ও ধমনীতে ছোট করে রক্তের জমাট বাঁধার ঘটনা হয়েছে। কিন্তু এমন বড় ভাবে রক্ত জমাট বাঁধা বিরল।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘পোস্ট-কোভিডে দু’টি পা একসঙ্গে বাদ দেওয়ার ঘটনা বিশ্বেও বিরল বলে মনে হয়। করোনা কেড়ে নিলেও রোগীকে পা ফিরিয়ে দেওয়াই ছিল একমাত্র লক্ষ্য।’’

এ দিন বোনকে দাঁড়াতে দেখে চোখের কোণ চিকচিক করে ওঠে দাদা শঙ্কর নন্দীর। জুনের প্রথমে অস্ত্রোপচারের পরের দিন আচ্ছন্ন ভাব কাটতেই চাদর সরিয়ে নিজের অবস্থা দেখে অস্থির হয়ে উঠেছিলেন রিমা। শঙ্কর বলেন, ‘‘বোনকে স্থির করতে গালে চড় মেরে বলেছিলাম, তোকে বাঁচতে হবে। কিন্তু আবার দাঁড়াবে, তা ভাবিনি।’’ গত জুলাইয়ে শল্য থেকে পিএমআর বিভাগে রিমা আসার পরে চিকিৎসকেরা দেখেন, বাঁ পায়ের ক্ষত কিছুতেই শুকোচ্ছে না। স্ক্যানে দেখা যায়, হাঁটুর কাছ পর্যন্ত হাড়ে সংক্রমণ ছড়িয়েছে। তখন পিজির অস্থিশল্য চিকিৎসক আনন্দকিশোর পাল অস্ত্রোপচার করে তা ঠিক করেন। পিএমআর-এর চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, ওষুধ প্রয়োগের পাশাপাশি হাঁটুর নীচে অংশকে নির্দিষ্ট আকৃতিতে নিয়ে আসা হয়।

বিভিন্ন প্রশিক্ষণ শুরু হয়। ধীরে ধীরে নিজে থেকে উঠে বসা, হুইলচেয়ারে ওঠার মতো বিভিন্ন কাজে আবার সাবলম্বী হতেই অস্থায়ী কৃত্রিম পা লাগিয়ে দেখা হয়, তিনি কতটা নিতে পারছেন। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ওই বিভাগে ভর্তি থাকলেও করোনার তৃতীয় ঢেউয়ের জন্য বাড়ি পাঠানো হয় রিমাকে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে আবার ভর্তি হন। রাজেশ বলেন, ‘‘সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় স্থায়ী ভাবে কৃত্রিম পা লাগানো হবে। কিন্তু দেশীয় কৃত্রিম পায়ের ওজন অনেকটা বেশি। তাই বিদেশি প্রযুক্তির পা, যেটির ওজন কম এবং কার্যকারিতা অনেক বেশি, সেটি লাগানোর পরিকল্পনা করা হয়। সরকারি হাসপাতালে বিনা মূল্যে তা যে সম্ভব, এ তারই প্রমাণ।’’ চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, আর কয়েক দিনের প্রশিক্ষণ শেষে অবলম্বন ছাড়া হাঁটবেন রিমা।

বৃদ্ধা শাশুড়ি, সাত বছরের মেয়ে, দেওরকে নিয়ে সংসার রিমার। বিশ্বরূপ বলছেন, ‘‘চিকিৎসকদের আশা ও ভরসায় স্বপ্ন দেখতাম, রিমা আবার হাঁটছে। সেই স্বপ্ন পূরণ হল।’’ আর প্রায় এক বছর পরে আবার দাঁড়ানো-হাঁটার ছবি মেয়েকে পাঠানোর জন্য উদ্‌গ্রীব রিমা বললেন, ‘‘খুব মনে পড়ছে, একটাই কথা— ‘হাল ছেড়ো না বন্ধু’।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement