নবারুণ ভট্টাচার্য। সংগৃহীত।
মাস্টারমশাই, আপনি কিছু শোনেননি। শুধু আপনি কেন, আমরা কেউই কিছু শুনিনি!
যে কোনও উৎসবের ছুতোয় কানের কাছে তারস্বরে চলতে থাকা শব্দদূষণের মতো বাজছে ভাষায় বীররসের সঞ্চার ঘটানো কিছু বাছা বাছা শব্দ বা চোখা চোখা বিশেষণ। ও-সব আমরা কেউই যেন শুনিনি! বা শুনলেও সবই কানে সওয়া। গায়ে মাখার নয়। আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে ঘিরে অপশব্দ বিস্ফোরণের ভিডিয়ো চাউর হওয়ার পরে (যার সত্যতা আনন্দবাজার যাচাই করেনি) চারপাশে ক্রমশ এক ধরনের ‘ভাষা-সন্ত্রাস’ বৈধতা পাওয়ার দিকটাই অনেকে মেনে নিচ্ছেন।
বাক্ শৈলীতে এমন নজর কেড়েছেন যে তরুণ, (প্রাক্তন ছাত্রনেতা গিয়াসুদ্দিন মণ্ডল) তিনি আবার বুক ফুলিয়ে বলেওছেন, ‘এ তো আবেগের বহিঃপ্রকাশ!’ তিনি নাকি নবারুণ ভট্টাচার্যকে অনুসরণ করেন। শুনে হতবাক সাহিত্যিক বাণী বসু থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্যের অধ্যাপক-লেখক চিন্ময় গুহ। বাণী বিচলিত, “লেখকেরা নিজের কথা থেকে চারপাশে যা ঘটছে তা মিলিয়ে লেখেন! তাতে নানা শব্দের প্রয়োগ থাকে। সেটাকে দেখিয়ে কেউ যদি শিক্ষকের উদ্দেশে বলা অপভাষার সাফাই দেন, তবে সেই মূর্খামিকে কী বলব জানি না।” চিন্ময়ও তিতিবিরক্ত, “এ সবই কুযুক্তি! ওই ছেলেটি নবারুণ আদৌ পড়েছে বলে আমার মনে হয় না।’’
কে কী পড়েছে তো পরের কথা, কিন্তু চারপাশের ভাষাটাও ক্রমশ পাল্টে যাচ্ছে, দেখছেন অম্বেডকর বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজতত্ত্বের অধ্যাপিকা রুক্মিণী সেন। বাস্তবের
সমান্তরালে সমাজমাধ্যম জুড়ে এখন ভাষা নিয়ে বাছবিচার নেই। লঘু-গুরু বা ণত্ব-ষত্ব বোধ নিয়েও মাথাব্যথা নেই। রুক্মিণী বলছেন, “কোথায় কী বলতে হয়, অন্তরঙ্গ পরিসর বা জনপরিসরের ফারাক নিয়ে অলিখিত রীতি থাকে। এখন সেই ভেদরেখা মুছে যাচ্ছে। ভাষায় হিংসার ব্যবহার নিয়েও ছুতমার্গ কম। মনে হচ্ছে, বাস্তবেও লোকে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপের ভাষা বা শব্দহীন
অভিব্যক্তিতে কথা বলছে।’’
সাম্প্রতিক একটি ওয়েব সিরিজ়ে মেয়ের সামনেই ফোনে কথা বলার সময়ে মা ইংরেজিতে চার অক্ষরের একটি শব্দ বার বার বলছেন। কিশোরী কন্যাই মায়ের ভাষার ‘স্খলনে’ মজা পাচ্ছে। বাণী বসু বলছিলেন, ‘‘অপভাষা ভীষণ ভাবে সাধারণ ভাষার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। অনেকেরই দেখছি বাছবিচার নেই!”
আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিডিয়োটিতে এই বৃহত্তর সামাজিক প্রবণতার প্রতিফলন দেখলেও ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের মাপকাঠিতে এমন ঘটনা বেশ বিরল। মুখ্যমন্ত্রী নিজে বলেছেন, “একটু কটু কথা যে
ছেলেটি বলেছে, তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।’’ অতীতের নকশাল ছাত্রনেতা অসীম চট্টোপাধ্যায় বলছেন, “পশ্চিমবঙ্গে ছাত্র আন্দোলনের দীর্ঘ ইতিহাসে কখনওই এমন ভাষা ব্যবহার হত না।’’ তাঁর কথায়,
“আমরাও প্রেসিডেন্সির অধ্যক্ষকে ঘেরাও করেছিলাম। কিন্তু ব্যবহারে শিক্ষকের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হতে দিইনি। আজকের ভাষা, উচ্চ মহলের সমর্থন পেয়েই এতটা হিংস্র। এটা উচ্চতর নেতৃত্বের ভাষা, ভঙ্গির প্রতিফলন। যা দেখছে, তা-ই ওরা বলছে। এখন না আছে ভাষার প্রতি
মমত্ববোধ, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বা আদর্শ।’’
রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থাকাকালীন নানা পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন চিন্ময়বাবু। তবে তিনি বলছেন, ছাত্রেরা কখনও সরাসরি দুর্ব্যবহার করেনি। তাঁর কথায়, “আগের রাজনৈতিক জমানায় নানা উৎকট আন্দোলন হলেও একটা শৃঙ্খলা ছিল। ভাষাও তাই এতটা বেলাগাম হয়নি! কিন্তু এমন ছাত্র কখনও দেখিনি। ভাষা শুনে এদের আদৌ ছাত্র বলে মনে হচ্ছে না।’’
‘কাঙাল মালসাট’-এর একটি চরিত্রের মুখে অপভাষার হয়ে সওয়াল করেছিলেন নবারুণ। তাঁর ফ্যাতাড়ুদের মুখে নানা ধরনের যন্ত্রণা প্রকাশের মাধ্যম হয়ে ওঠে
তথাকথিত খিস্তিখেউড়। বাণী বসু বলছেন, “বিভিন্ন লেখকের লেখায় বাস্তবের প্রতিফলনের মাত্রা আলাদা। তা বলে, এই ছেলেটি তাঁকে অনুসরণ করছে শুনলে নবারুণও আঁতকে উঠতেন!’’