ফাইল চিত্র।
এটা কিসের অফিস? এত পুলিশ যখন, নিশ্চয়ই বড় কিছু হবে! কলকাতা পুলিশের সদর দফতর লালবাজারের সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময়ে দুই যুবকের কথোপকথন শুনেই প্রশ্নটা মাথায় এসেছিল তাঁর। সরকারি ভবনের গায়ে কেন লেখা থাকবে না কিসের দফতর? শহরে যাঁরা নতুন, তাঁরাই বা বুঝবেন কী ভাবে?
এই ভাবনা থেকেই বছরখানেক ধরে চিঠির লড়াই লড়ে সমস্যার সমাধান করতে পেরেছেন বরাহনগরের বাসিন্দা বৃদ্ধ মধুসূদন মাজি। তাঁর চিঠিতেই লালবাজার ভবনের গায়ে লাগানো হয়েছে গ্লোসাইন বোর্ড। তাতে লেখা, ‘কলকাতা পুলিশের সদর দফতর’। সঙ্গে ভবনের ঠিকানা এবং কত সালে সেটি তৈরি হয়েছে, সেই তথ্য। চিঠির লড়াই জেতা অশীতিপর বললেন, ‘‘শুধু বোর্ড লাগানোই নয়, এই কাজে যে ২ লক্ষ ২০ হাজার ৮৫৯ টাকা খরচ হয়েছে সেটাও লালবাজার আমাকে চিঠি লিখে জানিয়েছে। তথ্যের অধিকার নিয়ে এত কথা হয়, এইটুকু তথ্য জানা তো সকলের অধিকার।’’
২০১৯ সালের ১০ মে তথ্য জানার অধিকার আইনে মধুসূদনবাবু প্রথম চিঠিটি দেন। তার উত্তর আসেনি। তিনি ফের একটি চিঠি দেন। তাতে পাঁচটি প্রশ্ন রাখেন। (১) কলকাতা পুলিশের সদর দফতর লালবাজারের ঠিকানা এবং রাস্তার নম্বর কি ১৮ লালবাজার স্ট্রিট, কলকাতা- ৭০০০০১? (২) যদি এটাই ঠিকানা হয়, সেটা কি মূল ভবনের বাইরে কোথাও উল্লেখ করা আছে? (৩) যদি না করা থাকে, তা হলে কেন করা হয়নি? (৪) এটা কি মূল ভবনের বাইরে উল্লেখ করা হবে? (৫) যদি না করা হয়, তার কারণ জানানো হোক। মধুসূদনবাবুর দাবি, প্রথম দু’টি প্রশ্নের উত্তর যথাক্রমে হ্যাঁ এবং না আসে। কিন্তু বাকি সব ক’টি প্রশ্নের ক্ষেত্রেই, এ সম্পর্কে নথিভুক্ত তথ্য তাদের কাছে নেই বলে জানানো হয় লালবাজারের তরফে।
ফের চিঠি দেন মধুসূদনবাবু। এর মধ্যেই বৃদ্ধ দেখা করেন লালবাজারের কর্তাদের সঙ্গে। তাঁর কথায়, ‘‘পুলিশের বড়কর্তাদের বুঝিয়ে বলি এটার প্রয়োজনীয়তা। তাঁরা বুঝে বিষয়টি দেখা হবে বলে আশ্বাস দেন। সেই মতোই ২০২০ সালের ডিসেম্বরে চিঠি দিয়ে জানানো হয়, লালবাজার ভবনের গায়ে নাম ও ঠিকানা লিখে দেওয়া হয়েছে। এখন সরকারি এমন সব ভবনের গায়ে দফতরের নাম ও ঠিকানা উল্লেখ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।’’
আদতে হাওড়ার বাসিন্দা, রেলের প্রাক্তন কর্মী মধুসূদনবাবু এখন থাকেন বরাহনগরের নৈনানপাড়া লেনে। স্ত্রী, ছেলে, বৌমা ও নাতনিকে নিয়ে সংসার। হাঁটতে বেরোন সকাল-বিকেল। সেই অবসরেই রাস্তার ধারের মূর্তিতে নজরদারি চালান। কার মূর্তি, তাঁর জন্ম এবং মৃত্যুর তথ্য ঠিকঠাক লেখা না থাকলেই দাঁড়িয়ে পড়েন। মূর্তিটি যাঁরা বসিয়েছেন, তাঁদের কাছে প্রতিবাদপত্র পাঠিয়ে দেন। কখনও কখনও তাঁর চিঠি যায় রাজ্যপাল, রাজ্যের বিভিন্ন দফতর এবং কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধানদের কাছেও।
মধুসূদনবাবু জানান, ২০১২ সালে রবীন্দ্র সদনে গিয়ে দেখেন, চত্বরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় মূর্তি থাকলেও লেখা নেই যে, মূর্তিটি কার! বিষয়টি জানিয়ে সদনের তৎকালীন প্রশাসনিক অফিসারকে চিঠি দেন তিনি। সদন কর্তৃপক্ষ মূর্তির নীচে রবীন্দ্রনাথের নাম, জন্ম এবং মৃত্যুর তারিখ লেখেন। কিন্তু মৃত্যুর তারিখ ভুল ছিল। ফের তিনি চিঠি দেওয়ায় ভুল সংশোধন হয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে রবীন্দ্র মূর্তি, বাবুঘাটের কাছে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ময়দান এলাকায় মাতঙ্গিনী হাজরা এবং আকাশবাণী ভবনের সামনে চিত্তরঞ্জন দাশের মূর্তিতেও নাম, জন্ম-মৃত্যুর তথ্য লেখার আর্জি জানিয়ে চিঠি দিয়েছিলেন মধুসূদনবাবু। প্রস্তাব মতো কাজ করার কথা জানিয়ে এসেছিল সরকারি চিঠি। একই ভাবে তিনি চিঠি দিয়েছিলেন রবীন্দ্র সদনের বাইরে গ্লোসাইন বোর্ডে সদনের নাম বাংলা, হিন্দি এবং ইংরেজিতে লেখার আর্জি জানিয়ে। সেই কাজও হয়েছে কয়েক দিনেই।
বৃদ্ধ বলেন, ‘‘টাকাপয়সা না থাকলে মানুষ গরিব তো বটেই, তথ্য না থাকলেও গরিব। তথ্য ছাড়া বিজ্ঞানের নবতম আবিষ্কার হাতে পেলেও বুঝবেন না, তা দিয়ে করে কী!’’