সকাল থেকে দিন শুরু হত ওঁদের। গুদাম থেকে মালপত্র বার করে, মাথায় চাপিয়ে এনে গাড়ি বা ভ্যানে তুলে দেওয়া। আক্ষরিক অর্থেই মাথার ঘাম পায়ে ফেলে চলত কাজ। বসার ফুরসতটুকু মিলত না। মাস গেলে জুটত কয়েক হাজার টাকা। এক রাতের আগুন তাঁদের রুজির সেই একমাত্র অবলম্বনকে গুরুতর প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে। কী ভাবে দিন চলবে, দেশের বাড়িতে টাকাই বা পাঠাবেন কী ভাবে— সে সব ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছেন না রমেশ সাউ, ভবেশ প্রসাদ, রামু নায়েকরা। রবিবার সকাল থেকে জগন্নাথ ঘাটের পাশে পুড়ে যাওয়া গুদামের সামনে শূন্য দৃষ্টি নিয়ে বসে ছিলেন তাঁরা।
বিহারের বাসিন্দা রমেশ-ভবেশ-রামুরা গত কুড়ি বছর ধরে ওই গুদামে মোটবাহকের কাজ করছেন। গুদাম থেকে মালপত্র বার করার সময়ে প্রায় ৫০ জন মুটে হাত লাগান। তার পরে সেই বস্তা মাথায় চাপিয়ে গাড়ি বা ভ্যানে তুলে দেন। কিন্তু আগুনের জন্য সেই কাজ হারিয়েছেন তাঁরা। বিহারের ছাপরার বাসিন্দা রমেশের বাবাও পেশায় ছিলেন মোটবাহক। বাবার হাত ধরেই রমেশের কলকাতায় আসা। পঁচিশ বছর বয়স থেকে মোটবাহকের কাজ শুরু করেন। রমেশ বলেন, ‘‘গুদামের মাল বয়ে রোজ মোটামুটি চারশো টাকা হাতে আসে। এ বার কী ভাবে সংসার চলবে?’’ একই কথা রামুর মুখেও। মাল বয়ে কেউ ১০ হাজার, কেউ ১২ হাজার টাকা রোজগার করেন। রামু বলছেন, ‘‘দেশের বাড়িতে স্ত্রী-ছেলে-মেয়ে রয়েছে। মাসে পাঁচ হাজার টাকা করে পাঠাতাম। সামনের মাসে কী করে টাকা পাঠাব, জানি না।’’
এ দিন সকালে একটি দোকানের সামনে বেঞ্চে বসেছিলেন রমেশরা। ফুলবোঝাই একটি গাড়ি আসতেই তাঁরা ছুটলেন সেই দিকে। তবে কুড়ি জন ছুটলেও মাল নিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেলেন মাত্র চার জন। ওঁরাই জানালেন, ফুল ভর্তি ওই গাড়ি জগন্নাথ ঘাটের ধারে থাকা বিভিন্ন দোকানে পাঠানো হবে। স্থানীয় সূত্রের খবর, বড়বাজার ও পোস্তা এলাকার মোটবাহকেরা এলাকাভিত্তিক কাজ করার সুযোগ পান। সেই সীমার বাইরে অন্য জায়গায় মাল বয়ে নিয়ে যেতে পারেন না তাঁরা। গিরিশ সাউ নামে এক মোটবাহক বলেন, ‘‘বন্দরের গুদাম থেকে মাল বয়ে নিয়ে যাই। অন্য গুদাম থেকে মাল নিয়ে যেতে পারব না। সে সব জায়গার জন্য আলাদা মোটবাহক রয়েছেন। তবে এখন তো অন্য জায়গায় কাজ খুঁজতে হবে।’’ অকূল পাথারে পড়েছেন জগন্নাথ ঘাটের সামনে থাকা ভ্যানচালকেরাও। ওড়িশার বাসিন্দা রবি ওঝা নামে এক ভ্যানচালক বলেন, ‘‘মোটবাহকেরা গুদাম থেকে মালপত্র নিয়ে আমাদের ভ্যানে তুলে দেন। কিন্তু আগুনে কোনও জিনিসই তো বাঁচানো গেল না।’’ গুদাম ফের কবে চালু হবে, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখে দাঁড়িয়ে সেই অপেক্ষাতেই তাঁদের এখন দিন গোনা।