Kolkatar Korcha

কলকাতার কড়চা: দুই কারিগর, এক কলেজ

বিদ্যাসাগর থেকে অরবিন্দ, বিবেকানন্দ থেকে সুভাষচন্দ্র, মধুসূদন থেকে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, কে আসেননি উত্তরপাড়ায়? উনিশ শতকে বঙ্গ-রেনেসাঁস পুষ্ট করেছে গঙ্গার পশ্চিম পাড়ের এই ভূমিকেও।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০১ মার্চ ২০২১ ০৫:৪৮
Share:

দুর্গাচরণ রায়ের লেখা, ১৮৮৭ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত কল্প-আখ্যান দেবগণের মর্ত্ত্যে আগমন-এ উত্তরপাড়ায় পৌঁছে বরুণ অন্য দেবতাদের দেখাচ্ছেন, “উত্তরপাড়ার স্কুল দেখুন। পল্লীগ্রামে যত স্কুল আছে তন্মধ্যে এই স্কুলটি সর্ব্বোৎকৃষ্ট... উত্তরপাড়ার ধনাঢ্য ও বিখ্যাত জমীদার বাবু জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের যত্নে ও সাহায্যে এই স্কুলটী প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে।” পরে দাতব্য চিকিৎসালয় আর বিখ্যাত লাইব্রেরিও: “বাড়ীটি কলিকাতার টাউনহলের ফ্যাসানে নির্ম্মিত... পুস্তকালয়টীর খরচের জন্য জয়কৃষ্ণ বাবু একখানি তালুক দান করিয়াছেন। তাঁহার দ্বিতীয় পুত্র সর্ব্বদা ইহার তত্ত্বাবধান লওয়াতে দিন দিন উন্নতিও হইতেছে।” সে বছরই ২০ জুন ‘উত্তরপাড়া কলেজ’-এরও প্রতিষ্ঠা, দুর্গাচরণের লেখায় তা নেই। নইলে দেবতারা দেখতে পেতেন, উচ্চশিক্ষা প্রসারের শুরুর পর্বে যখন সারা বাংলায় কলেজ হাতে গোনা, উত্তরপাড়াবাসীর শিক্ষা-সংস্কৃতিপ্রীতি তখন মনপ্রাণ ঢেলে দিয়েছিল এই কলেজ প্রতিষ্ঠায়। সঙ্গী ছিল বাবু জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের (১৮০৮-১৮৮৮) (ছবিতে বাঁ দিকে) ও পরে তাঁর পুত্র রাজা প্যারীমোহন মুখোপাধ্যায়ের (১৮৪০-১৯২৩) (ডান দিকের ছবি) অপার দাক্ষিণ্য।

Advertisement

বিদ্যাসাগর থেকে অরবিন্দ, বিবেকানন্দ থেকে সুভাষচন্দ্র, মধুসূদন থেকে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী বা শিশিরকুমার ভাদুড়ী, কে আসেননি উত্তরপাড়ায়? উনিশ শতকে বঙ্গ-রেনেসাঁস পুষ্ট করেছে গঙ্গার পশ্চিম পাড়ের এই ভূমিকেও। কলকাতায় বেথুনের স্কুল গড়ায় দশ হাজার টাকা দিয়েছিলেন জয়কৃষ্ণ। উত্তরপাড়ায় স্কুল গড়েছেন (১৮৪৬), কলকাতার সঙ্গে এই অঞ্চলের সংযোগ সাধনে প্রত্যক্ষ সাহায্য করেছেন বালিখাল নির্মাণে, গড়েছেন লাইব্রেরি (১৮৫৯)। উত্তরপাড়া কলেজ (এখন রাজা প্যারীমোহন কলেজ) প্রতিষ্ঠা করতে লড়াই করেছেন ৩৫ বছর! বার বার প্রস্তাব নাকচ হয়েছে, ইংরেজ সরকার দায়িত্ব নিতে চায়নি, পারিবারিক বিবাদ ধ্বস্ত করেছে, কিন্তু জয়কৃষ্ণ থামেননি। ১৮৮৭-তে আসে সাফল্য। উত্তরপাড়া স্কুলটিই কলেজে উন্নীত হয়।

প্যারীমোহন ও তাঁর পুত্র কুমার ভূপেন্দ্রনাথের সময়ও কলেজ এগিয়েছে, লড়াই জারি রেখেই। সে লড়াই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আবহে টিকে থাকার, স্বাধীন দেশে ডানা মেলার লড়াই। ১৯৩৫-এ প্রাক্তনী সংগঠন, ১৯৩৯-৪০ শিক্ষাবর্ষে প্রথম এক ছাত্রীর ভর্তি (১৯৩৯-এর ৮ জুন আনন্দবাজার পত্রিকায় ভর্তির বিজ্ঞাপন বেরিয়েছিল), ’৫৫-তে স্নাতক স্তরে ওঠা— এ এক আনন্দযাত্রা, তবে শিক্ষক থেকে পরিচালন সমিতি, ছাত্রছাত্রী, সকলের অশেষ ত্যাগ স্বীকারের মূল্যে। সুদীর্ঘ এই অভিযাত্রাকে দুই মলাটে বেঁধেছেন আজকের কলেজ কর্তৃপক্ষ, ১৩০-এ রাজা প্যারীমোহন কলেজ স্মারক-সম্ভার (লেভান্ত বুকস্‌) নামের সদ্যপ্রকাশিত গ্রন্থে, বর্তমান অধ্যক্ষ সুদীপকুমার চক্রবর্তীর দক্ষ সম্পাদনায়। এ শুধু এক কলেজের ইতিহাস নয়, বিপুল প্রামাণ্য নথি ও তথ্যের আলোয় উত্তরপাড়ার সমাজ-সংস্কৃতি-শিক্ষার ইতিহাস, জয়কৃষ্ণ-প্যারীমোহনের ঔদার্যগাথা। জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের ছবিটি সজল মিত্রের, প্যারীমোহনের ছবিটি পার্থ ভট্টাচার্যের আঁকা। ছবি সৌজন্য: কলেজ কর্তৃপক্ষ

Advertisement

জীবনচিত্র

তাঁর লেখায় আখ্যানের সোজা চলন বর্জিত অনেক সময়েই। কাহিনির গতিপথকে পাল্টে লিখেছেন নতুন কাহিনি, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের (ছবিতে) লেখা আবিষ্ট করে আসছে বাঙালি পাঠককে, কয়েক দশক ধরে। লেখক শীর্ষেন্দু যত পরিচিত, ব্যক্তি শীর্ষেন্দুর জীবনচর্যা, ধর্মবোধ, দৈনন্দিন যাপন প্রকাশিত নয় তত। সেই কাজটিই করেছেন অশোক বিশ্বনাথন, তাঁর তথ্যচিত্র শ্যাডোজ় অব অ্যাম্বিগুইটি-তে। ভারতের লেখক-সাহিত্যিকদের নিয়ে তথ্যচিত্র নির্মাণ ও প্রযোজনার কাজটি নিয়মিত করে আসছে অকাদেমি, তারাশঙ্কর-প্রেমেন্দ্র-মহাশ্বেতা-অলোকরঞ্জন-সুনীল-শঙ্খ-নবনীতাদের নিয়ে তৈরি তথ্যচিত্র-তালিকায় এ বার যুক্ত হল এই ছবিও। অশোকের তথ্যচিত্রেও সমান্তরাল অনেক গল্প ও আঙ্গিক, শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়-প্রফুল্ল রায়-সমরেশ মজুমদার-বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের সাক্ষাৎকারের পাশাপাশি শীর্ষেন্দুর লেখা থেকে হওয়া চলচ্চিত্রের অংশ, লেখক-জীবনের চলচ্ছবিও। ছবিতে আলাদা করে কোনও ভাষ্য েনই, গোটা ছবি জুড়ে থাকা লেখকের নিজমুখে কথাই ধারাভাষ্য। সম্প্রতি ছবিটির বিশেষ প্রদর্শন হয়ে গেল নন্দন-৩’এ।

বিস্মৃতপ্রায়

ভারতে মহাজাগতিক রশ্মি নিয়ে কাজ করা প্রথম মহিলা বিজ্ঞানী বিভা চৌধুরী। ১৯১৩ সালে কলকাতায় জন্ম, বসু বিজ্ঞান মন্দিরে পার্টিকল ফিজ়িক্স নিয়ে গবেষণা শুরু করেন আচার্য দেবেন্দ্রমোহন বসুর সঙ্গে, ভারতে প্রথম ক্লাউড চেম্বারও তৈরি করেন তাঁরা। নেচার পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল তাঁদের বহু গবেষণা। ১৯৪৫ সালে বিভা প্যাট্রিক ব্ল্যাকেট-এর গবেষণাগারে যোগ দেন, শেষ করেন পিএইচ ডি-ও। ১৯৪৮-এ পদার্থবিদ্যায় নোবেল পান ব্ল্যাকেট, বিভার অবদানও কম ছিল না তাতে। দেশে ফিরে যোগ দেন টাটা ইনস্টিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ-এ। ১৯৯১ সালে এ শহরেই তাঁর প্রয়াণ। বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ ভবনে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ২২তম ‘রমাতোষ সরকার বক্তৃতা’য় বিস্মৃতপ্রায় বিজ্ঞানী বিভা চৌধুরীকে নিয়ে বললেন অধ্যাপক উপেন্দ্রনাথ নন্দী। বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেলে শোনা যাবে বক্তৃতাটি।

সৃষ্টির পথ

তিনি কবি, ঔপন্যাসিক, শিশুসাহিত্যিক, আবার দক্ষ পত্রিকা সম্পাদক, ভ্রমণচিত্র নির্মাতাও। দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে এ শহর অমরেন্দ্র চক্রবর্তীর বহুমুখী প্রতিভা ও পরিচয়ের বিস্তার ধারণ করেছে সগর্বে। আগামী ৩ মার্চ, বুধবার আশি পূর্ণ করছেন তিনি। সেই উদ্‌যাপন উপলক্ষে সে দিন সন্ধে ৬টায় রোটারি সদনে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। প্রকাশিত হবে একটি বই— আট দশকের অমরেন্দ্র: তাঁর সৃষ্টির পথ। লীলা মজুমদার, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, মহাশ্বেতা দেবী, অশোক মিত্র, বেলাল চৌধুরী, শঙ্খ ঘোষ, দেবেশ রায়, অমিয় দেব, সৌরীন ভট্টাচার্য, পবিত্র সরকার, জহর সরকার-সহ এই প্রজন্মের লেখকদের কলমেও ঋদ্ধ এই বই। কবি শঙ্খ ঘোষের লিখিত ভাষণ পাঠে সম্পন্ন হবে বইয়ের উদ্বোধন-পর্ব।

গানের সুরে

শিল্পজগৎ থেকে রাজনীতিতে এসেছেন, এমন মানুষ বিরল নন। কিন্তু উল্টোটা? গৌতম দেবকে মানুষ চেনে পর্যটনমন্ত্রী, শাসক দলের নেতা হিসেবে। এই ‘বেসুরো’ বাজারে তিনি বেজে উঠেছেন সুরে। কলকাতায় প্রকাশ পেল তাঁর প্রথম গানের অ্যালবাম, এ জীবন পুণ্য করো। অ্যালবামে পাঠ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের। মন্ত্রী বলছিলেন, বছর দেড়েক আগে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে গ্রামে রাত কাটাতে গিয়ে গানের শুরু। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত তিনি, ‘‘রবীন্দ্রনাথ ও সৌমিত্র, আমার কাছের দুই মানুষ। তাঁদের নিয়ে কাজ করব, দীর্ঘ দিনের ইচ্ছে ছিল।’’ তবে তাঁর আফসোস, অ্যালবামের প্রকাশ দেখে যেতে পারলেন না সৌমিত্রবাবু। পুরো উদ্যোগটির পরিকল্পনা ও পরিচালনায় অনিন্দ্য মজুমদার।

অবনীন্দ্রনাথ ১৫০

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৭১-১৯৫১) জন্মের সার্ধশতবর্ষ উদ্‌যাপন উপলক্ষে বিচিত্রপত্র পত্রিকা (সম্পাদনা: সৌরদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, সৌম্যকান্তি দত্ত) প্রকাশ করেছে বিশেষ সংখ্যা অবনীন্দ্রনাথ ১৫০। বিশেষ আকর্ষণ অবনীন্দ্রনাথের বিখ্যাত বাগেশ্বরী শিল্প প্রবন্ধাবলী-র লীলা মজুমদারের করা এ যাবৎ অপ্রকাশিত ইংরেজি অনুবাদের একাংশ; আছে সাময়িকপত্রে প্রকাশিত অবনীন্দ্রনাথের রচনাপঞ্জি, কয়েকটি ‘দুর্লভ’ লেখার পুনর্মুদ্রণ, সম্প্রতি প্রয়াত অবনীন্দ্রনাথ-পৌত্র অমিতেন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা। সত্যজিৎ রায়ের ফিল্ম টেকনিশিয়ানস্ নামের ক্রোড়পত্রটিতে আছে সন্দীপ রায়ের গুরুত্বপূর্ণ একটি লেখা— বাবা ও তাঁর ফিল্ম টেকনিশিয়ানস্। সুদক্ষ এই সহযোগীদের একটি সংক্ষিপ্ত তথ্যপঞ্জিও দিয়েছেন তিনি। মুদ্রিত হয়েছে সত্যজিৎ রায়ের প্রতিদ্বন্দ্বী ছবির সম্পূর্ণ চিত্রনাট্য, পরিচালকের বিখ্যাত খেরোর খাতা থেকে এই ছবির জন্য করা স্কেচ, পোস্টার, বিজ্ঞাপনগুলিও পত্রিকার সুপ্রাপ্তি।

আলাপে জেন্ডার

বাংলার শহর-গ্রাম-মফস্‌সলে ‘জেন্ডার-সচেতনতা’ গড়তে প্রায় দুই দশক ধরে কাজ করে চলেছে ‘এবং আলাপ’ সংগঠনের সদস্যরা। কাজ করতে গিয়েই দেখা, বাংলা ভাষায় এ বিষয়ে সহজবোধ্য বই ও উপাদান কম। সেই ঘাটতি পূরণেই ‘আলাপে জেন্ডার’ নামে একটি বাংলা ওয়েবসাইট ও আর্কাইভ শুরু করছেন তাঁরা। থাকছে লকডাউন ও আমাদের জীবন নিয়ে লেখা ও ভিডিয়ো, এ ছাড়া লকডাউন, শিক্ষা ও জেন্ডার, লকডাউনে মেয়েরা, লকডাউন ও সমাজমানস-এর মতো বিষয়ও। ৬ মার্চ বিকেল ৫টায় অনলাইন অনুষ্ঠানে আর্কাইভ উদ্বোধন, ৬-৯ মার্চ আন্তর্জালেই নানা অনুষ্ঠান। ৭ মার্চ খেলার মাঠের মেয়েদের লড়াই, ৮ মার্চ গৃহশ্রমিক মেয়েদের জীবন, ৯ মার্চ দুঃসময়ের লেখালিখি নিয়ে কথা। আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবসের আবহে সামগ্রিক এই প্রয়াস।

দর্শকের দরবার

নাট্যদল সুখচর পঞ্চম ৩১-এ পড়ল, তাদের নাট্যমেলা ‘দর্শকের দরবার’-এর বয়স হল ২৬। করোনাকালে সকল ভয় থেকে অভয়যাত্রাই এ মেলার মূল সুর। থাকবে খুদে প্রতিভাদের নাট্যপ্রচেষ্টা অভয়যাত্রা, পিংলা গ্রামের মণিমালা চিত্রকরের পটের গান। দেখা যাবে দেবশঙ্কর হালদার, শুভাশিস মুখোপাধ্যায়, গৌতম হালদার, বিশ্বনাথ বসু, রূপঙ্কর বাগচীর নামভূমিকায় অভিনীত একগুচ্ছ নতুন মঞ্চনাটক। বিশেষ আকর্ষণ রিকশাচালক নাটক সমিতির শ্মশানবন্ধু, আমতা পরিচয় নিবেদিত সাবিত্রী বাঈ ফুলে-র মতো অন্তরঙ্গ পরিসরের নাটক। মুক্তাঙ্গনে অভিনীত হবে মঞ্চ ভেঙে বেরিয়ে আসা সহজিয়া নাট্য। পঞ্চম-এর ৩১ বছরের শতাধিক নাটকের বাছাই মঞ্চসজ্জার প্রদর্শনী, নাট্যসংক্রান্ত বক্তৃতামালা, আলোচনা সভাও থাকবে। এ বছরের ‘নাট্যজীবন সম্মান’ পাবেন পদ্মাপারের শিশির কুমার দত্ত। নাট্যমেলা শুরু ৫ মার্চ, চলবে উৎপল দত্তের জন্মদিন ২৯ মার্চ পর্যন্ত— পানিহাটি লোকসংস্কৃতি ভবনে, জলসাঘর আর্ট গ্যালারি এবং তপোবন মুক্তাঙ্গনে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে।

আলোকবৃত্তে

আশি-নব্বইয়ের সন্ধিক্ষণেও রাস্তার পাশ জুড়ে থাকত থিয়েটারের বিরাট পোস্টার। সারকারিনা, বিশ্বরূপা, স্টার, রংমহল, মিনার্ভা, রঙ্গনা, অহীন্দ্র মঞ্চ— কলকাতার উত্তর থেকে দক্ষিণে, ‘ব্রডওয়ে অব বেঙ্গল’ নামে খ্যাত নাট্যমঞ্চগুলি এখন অতীত, ইতিহাস। উনিশ শতকে ব্যক্তিগত বিনোদনের উদ্দেশ্যে পথ চলা শুরু, বাংলা থিয়েটার কিন্তু ব্রিটিশকে ধাক্কা দিয়েছে, বিশ্বযুদ্ধ, মহামারি, মন্বন্তর, দেশভাগ পেরিয়েছে তার চলার পথে। এই বিচিত্র ও বর্ণিল ঘটনাস্রোতকেই ছুঁয়ে দেখেছে সুজয়প্রসাদ চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত, ‘এসপিসিক্রাফট’ ও ইউটিউব চ্যানেল ‘ঘোষ কোম্পানি’ নির্মিত তথ্যচিত্র স্পটলাইট। সেখানে নাটক নিয়ে বলেছেন ব্রাত্য বসু, সোহাগ সেন, স্মৃতিচারণ করেছেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। তথ্যচিত্রের অনুপ্রেরণা সৈকত মজুমদারের দ্য ফায়ারবার্ড উপন্যাস থেকে পাঠ করেছেন নীরজ কবি। সে কালের নহবৎ নাটকের ভিডিয়ো ফুটেজ, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের নীলকণ্ঠ নাটক পাঠের মূল্যবান রেকর্ডিংয়ে ঋদ্ধ এই তথ্যচিত্রের বিশেষ প্রদর্শন হয়ে গেল ২৩ ফেব্রুয়ারি, দক্ষিণ কলকাতার কাফে জ়ুম টি ও গ্রাফি-তে।

নতুন’ ইস্কুল

করোনাকালে মাসের পর মাস ক্লাসরুম, ল্যাব, লাইব্রেরির পাশে মনখারাপের ধুলো জমছিল বাড়িতে— বন্ধু, মাস্টারমশাই-দিদিমণিহীন রুটিনে। সরস্বতী পুজোর মুখে যখন নয় থেকে বারো ক্লাসের পড়ুয়াদের আনাগোনা শুরুর আর পুজোরও অনুমতি হল, উচ্ছ্বাস বাঁধ মানেনি কলকাতার সূর্য সেন স্ট্রিটের শতাব্দীপ্রাচীন মিত্র ইনস্টিটিউশন (মেন)-এর পড়ুয়া আর শিক্ষক-শিক্ষিকাদের। সরস্বতী পুজোর ক’দিন আগে থেকেই এগারো-বারো ক্লাসের ক’জন ছাত্র সকাল থেকে সন্ধে বসে পড়েছিল রঙের কৌটো, তুলি নিয়ে। ইস্কুলের সিঁড়ি, স্তম্ভ-সহ বহু জায়গা তাদের ছোঁয়ায় হয়ে উঠেছে চিত্রবিচিত্র (ছবিতে)। এ কাজে ওদের পথ দেখিয়েছেন আর্ট কলেজের দুই যুবা শিল্প-শিক্ষার্থী, আর পুরো কাজটির ভাবনা-প্রেরণা ঝাড়গ্রামের খোয়াবগাঁ, মাটির বাড়ির দেওয়ালে দেওয়ালে অপরূপ শিল্পকৃতির সেই গ্রাম। বুদ্ধ, বৃক্ষদেবতা, সবুজ বনে বাঘ আর হরিণের মিলমিশ ফুটে উঠেছে ছবিতে। সতত উৎসাহে সঙ্গে ছিলেন স্কুলের ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক বিপ্লব নাহা বিশ্বাস-সহ সমস্ত শিক্ষক-শিক্ষিকা।

শিল্পবিশ্ব

তৃতীয় বছরে পড়ল এই শহরের শিল্প সংস্থা কলকাতা সেন্টার ফর ক্রিয়েটিভিটি (কেসিসি)-র বার্ষিক সম্মেলন ‘বসুধৈব কুটুম্বকম্‌’। অতিমারি-লাঞ্ছিত গত বছরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিল্পকৃতির সহজ স্বাভাবিক উৎপাদন থেকে পরিবেশন ও বিপণন-শৃঙ্খলও। ক্রমে আলো আসা শিল্প-সংস্কৃতির পৃথিবীতে নতুন ভাবনা-বিনিময়ের জোয়ার আনতেই এ বছরের সম্মেলনের নাম দেওয়া হয়েছে ‘বসুধৈব কুটুম্বকম্‌: দ্য ফ্রিজ়িং মোমেন্ট’। অনুষ্ঠান দু’দিন ধরে, ৬ ও ৭ মার্চ। বিভিন্ন অধিবেশনে আলোচনা হবে আর্ট পলিসি, শিল্পকর্মের ডিজিটালাইজ়েশন, শিক্ষা ও মানসিক স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও শিল্প, শিল্প ও অ্যাক্টিভিজ়ম ঘিরে। থাকবেন শিল্প, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ক্ষেত্রে এই শহর ও দেশ-বিদেশের বিশেষজ্ঞ, কর্মী ও শিল্পীরা।

সুবন্ধু স্মরণে

রুশ ও ইউরোপীয় ইতিহাসচর্চায় তাঁর অবদান অনন্য। প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাচর্চার গণ্ডি ছাপিয়ে সমসাময়িক ঘটনাপ্রবাহেও ছিল সমান আগ্রহ। নিজের দৃঢ় মতামত থাকলেও অন্যের মত শুনতেন মন দিয়ে— প্রকৃত অর্থেই লিবারাল। এ সব টুকরো স্মৃতিই উঠে এল অধ্যাপক হরিশঙ্কর বাসুদেবনের (উপরে ডান দিকের ছবিতে) বন্ধুবর্গ আয়োজিত স্মরণসভায়। তাঁর জন্মদিন উপলক্ষে, ১৮ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় গোর্কি সদনে আয়োজিত সভায় অমলিন বন্ধুত্বের গল্প শোনালেন সুরঞ্জন দাস, জয়ন্ত সেনগুপ্ত, কুণাল চট্টোপাধ্যায়, জহর সরকার প্রমুখ। তপতী গুহঠাকুরতার হাতে উদ্বোধন হল তাঁর সারা জীবনের কাজ নিয়ে তৈরি হওয়া ওয়েবসাইটের, প্রদর্শিত হল ইউরেশিয়ায় তাঁর বিখ্যাত অভিযান নিয়ে তৈরি তথ্যচিত্র: ফুটস্টেপস অব আফানাসি নিকিতিন। এর আগে, ১২ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় আন্তর্জালে হরি বাসুদেবন স্মরণে বক্তৃতার আয়োজন করেছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগও। ‘দি এম্পারার ইন ওয়ার্ল্ড হিস্ট্রি’ বিষয়ে বললেন ব্রিটিশ অ্যাকাডেমির ফেলো অধ্যাপক ডমিনিক লিভেন।

অন্য ধারার

বসন্তের বাতাস বয়ে গেল যেন ক’টা দিন... বসুশ্রী প্রেক্ষাগৃহে দেশ-বিদেশের ছোট-বড় ছবি নিয়ে হয়ে গেল ‘আর্টহাউস এশিয়া ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’, ২১-২৮ ফেব্রুয়ারি। উদ্যোক্তা ও দর্শকরাও মূলত তরুণ তরুণী— কেউ সিনেমা নিয়ে পড়াশোনা করছেন, কেউ ছবি বানাচ্ছেন। “বৈচিত্রের এই বিস্তার, ভাবনার এই বৈভবই বজায় রাখতে চেয়েছি উৎসবে,” জানালেন অধিকর্তা শপথ দাস। দেখানো হল ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরীর নতুন ছবি মায়ার জঞ্জাল, যার পটভূমি কলকাতা। মেয়েদের ছবি থেকে ফিল্মের অভিনয়, নানা বিষয়ে বসল আলোচনার আসর। তবে দর্শক-শ্রোতাদের সবচেয়ে মুগ্ধ করলেন তরুণ মজুমদার আর বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, দু’জনেই দীর্ঘ সময় ধরে কথা বললেন নিজেদের ছবি করার অভিজ্ঞতা থেকে শুরু করে সিনেমার শিল্পভাবনা নিয়ে।

মেলাময়

ছোট-বড় স্টল, সাজানো-গোছানো। রোজ সন্ধেয় আলোচনা, গানবাজনা। দক্ষিণ কলকাতার তালতলা মাঠে গতকাল শেষ হল ‘পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ড’ আয়োজিত প্রথম একুশে বই উৎসব। প্রতি বছরেই হবে, শোনা যাচ্ছে। ঢাকার একুশে বইমেলা পিছিয়ে গেছে এ বছর, কলকাতা ছোট্ট করে হলেও বইমেলা পেল, মন্দ কী! ও দিকে ২৬ ফেব্রুয়ারি শুরু হয়েছে সপ্তম বছরের নিউটাউন বইমেলা, ৭ মার্চ পর্যন্ত। ৪-৬ মার্চ কলেজ স্কোয়ারে চলবে ‘সারা বাংলা লিটল ম্যাগাজ়িন মেলা’, লিটল ম্যাগাজ়িন সমন্বয় মঞ্চের আয়োজনে। শহর এখন মেলাময়।

এই শহরেও উঁকি দেয় রুশ দেশ

সময়টা ১৯৩১ সালের মাঝামাঝি। বিপ্লবী দীনেশ গুপ্তের ফাঁসির আর কয়েক ঘণ্টা বাকি। শেষ বার ছেলেকে দেখতে এসে মায়ের কান্না আর থামেই না। দীনেশ বললেন, “মা, তোমার কি মাক্সিম গোর্কির মা উপন্যাসটার কথা মনে আছে? ওটা আবার পড়ো, আশ্রয় পাবে।” বিশ শতকের গোড়াতেই বাঙালির কাছের মানুষ হয়ে ওঠেন রুশ সাহিত্যিক গোর্কি। মনে পড়তে পারে, রবীন্দ্রনাথের পয়লা নম্বর (১৯১৭) ছোটগল্পে এবং শেষের কবিতা (১৯২৮) উপন্যাসে গোর্কি ও মা-এর উল্লেখ। কবির নিজেরও রুশ দেশের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল গভীর। ১৯৩০-এর সেপ্টেম্বরে চোদ্দো দিনের সোভিয়েট সফরে গিয়েছিলেন, জনগণমন গেয়ে বিদায় জানিয়েছিল রুশ শিশুদল।

কলকাতার আনাচে-কানাচেও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে রুশ দেশের নানা টুকরো। পর্যটক যুবরাজ আলেক্সেই সাতলিকভ-এর ডাকনাম ছিল ‘ইন্ডিয়ান’। বাড়িতে তিনি ফারসি বা ভারতীয় পোশাক পরতেন। ১৮৪১ সালে ভারতে এসেছিলেন, তাঁর চিঠিপত্রে সে কালের কলকাতার বিস্তৃত বর্ণনা পাওয়া যায়। তিনি লিখছেন, “...কলকাতায় নোঙর ফেললাম। প্রথম দর্শনে সেন্ট পিটার্সবার্গের কথা মনে পড়ছে: একটা নদী, নেভার মতো বিপুল, কিছুটা দূরে দূরে ইউরোপীয় বাড়ির সারি, সমতল, এবং দেবদারু গাছের জঙ্গল।” তিনি মুগ্ধ হয়েছেন দ্বারকানাথ ঠাকুরের সঙ্গে আলাপে, জ়ারের শীতপ্রাসাদের সঙ্গে কলকাতার রাজভবনের মিল দেখে বিস্মিত হয়েছেন। অন্য দিকে, বাংলা ও ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস-এর স্ত্রী ছিলেন রুশ। ১৭৮০ সালে কলকাতায় অর্থোডক্স চার্চ তৈরি হয় তাঁর উদ্যোগে। আবার, ১৯০৫ সালে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম চিত্রকর্মটি ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালকে উপহার দিয়েছিলেন জয়পুরের মহারাজা, যেটি আসলে রুশ শিল্পী ভ্যাসিলি ভেরশাগিন-এর আঁকা।

দুইয়ের সংযোগ যুগে যুগে। ১৯৬১ সালে মহাকাশচারী ইউরি গাগারিন কলকাতায় এলে বিমানবন্দর থেকে পাঁচ হাজার মানুষের মধ্য দিয়ে এক শোভাযাত্রা করে তাঁকে নিয়ে যান তৎকালীন রাজ্যপাল পদ্মজা নায়ডু। দুপুরের সভায় ৮০,০০০ মানুষের সমাগম হয়েছিল, মহাকাশের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছিলেন গাগারিন। পরে কলকাতার প্রেস ক্লাব, রাজভবন, বোটানিক্যাল গার্ডেনও ঘুরে দেখেন তিনি। দু’বছর পরে কলকাতায় আসেন প্রথম মহিলা মহাকাশ-অভিযাত্রী ভালেন্তিনা তেরেশকোভা। এর পর, ধর্মতলার বিখ্যাত লেনিন মূর্তি ১৯৭০ সালে উপহার হিসেবে কলকাতায় পাঠিয়েছিল সোভিয়েট সরকার। ১৯৭৩ সালে যখন প্রথম মেট্রোর কাজ শুরু হল, তখন সোভিয়েট ইউনিয়ন আর পূর্ব জার্মানি থেকে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে আসা হয়েছিল।

এ রকম আরও অজস্র রুশ-যোগের গল্প আর ছবি সাজিয়ে রাশিয়ান প্লেসেস ইন অ্যান্ড অ্যারাউন্ড কলকাতা নামে একটি পুস্তিকা তৈরি করেছেন গোর্কি সদনের তিন আধিকারিক— ভ্লাদিমির দিমেনতিয়েভ, মাধবী ভট্টাচার্য ও গৌতম ঘোষ। ইতিহাসের সম্পদ ছড়ানো আছে রাস্তাঘাট, বাড়িঘর, বইপত্রে। গেরাসিম লেবেদেভ, ইভান মিনায়েভ, নিকোলাই রোয়েরিখদের মতো রুশ সংস্কৃতি-ব্যক্তিত্বদের কথা ও কাহিনি সেখান থেকে তুলে এনে শহরের পাতে পরিবেশন করার কাজটি দুরূহ, পরিশ্রমসাধ্য। অমূল্য তো বটেই। ছবিতে গোর্কি সদনে মাক্সিম গোর্কির আবক্ষ মূর্তি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement