কলকাতার কড়চা: আজও অমলিন ধারা

১৩৫ হাজরা রোডে গোস্বামী ধামের পুজোয় পারিবারিক রীতি মেনে প্রতিমা তৈরি হয়। এ বাড়ির প্রতিমাসজ্জার বিশেষ বৈশিষ্ট্য, চালচিত্রে প্রতি বছর এক-একটি ঐতিহ্যশালী শিল্পমাধ্যমকে ফিরিয়া আনা হয়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০২৩ ০৭:৪৩
Share:

থিমের পুজোর রমরমার পাশাপাশি আজও বহু মানুষের কাছে কলকাতার বনেদি বাড়ির প্রাচীন পুজোগুলির আকর্ষণ রয়ে গেছে অমলিন। কলকাতার সমাজ সংস্কৃতি ও অর্থনীতি গড়ে ওঠার ইতিহাসের সঙ্গে নানা ভাবে জড়িয়ে আছে এই সব বাড়ির পুজো। দুর্গাপুজোর চার দিনে তাই ‘ঠাকুর দেখা’র সুযোগে পরিচিত হওয়া যায় বাঙালির সুদীর্ঘ সাংস্কৃতিক ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে। তার বহু উদাহরণও আজকের কলকাতায় ছড়িয়ে আছে। ভবানীপুর অঞ্চলে, হরিশ মুখার্জি রোডের পশ্চিমে চন্দ্রনাথ চ্যাটার্জি স্ট্রিটে দে-বাড়ির দেড়শো বছরেরও বেশি প্রাচীন পুজো যেমন। প্রাক্‌-স্বাধীনতা যুগের ব্রিটিশ-বিরোধিতার প্রতীক হিসেবে কোনও এক সময় এখানে কোট-বুট পরা অসুরের প্রচলন হয়েছিল। সেই ধারা আজও বজায় রয়েছে।

Advertisement

১৩৫ হাজরা রোডে গোস্বামী ধামের পুজোয় পারিবারিক রীতি মেনে প্রতিমা তৈরি হয়। এ বাড়ির প্রতিমাসজ্জার বিশেষ বৈশিষ্ট্য, চালচিত্রে প্রতি বছর এক-একটি ঐতিহ্যশালী শিল্পমাধ্যমকে ফিরিয়া আনা হয়। এ বছর যেমন বাড়ির পরম্পরা মেনে চালচিত্রে মধ্যিখানে শিবকে রেখে দুই দিকে ফুটে উঠেছে দশাবতার (উপরের ছবি)— রিভার্স গ্লাস পেন্টিং শিল্পরীতির প্রণোদনায়। তবে কাচের পরিবর্তে এখানে ব্যবহৃত স্বচ্ছ প্লাস্টিক শিট। তাঞ্জাভুরের মতো জায়গায় এই শিল্পধারার চর্চা হলেও, উনিশ শতকে জনপ্রিয় এই শিল্প-আঙ্গিক বাংলা থেকে প্রায় হারিয়েই গেছে।

দর্পনারায়ণ ঠাকুর স্ট্রিটে বৈষ্ণবদাস মল্লিক-বাড়ির, বহু দেবদেবীর ছবি-সম্বলিত চালচিত্রের কথাও বলার। প্রতি বছর চালচিত্র আঁকা হয় বাড়িতে সংরক্ষিত প্রাচীন চালির অনুকরণে; এ বাড়িতে মহিষাসুরমর্দিনী নয়, পুজো হয় ষাঁড়ের পিঠে বসা শিবদুর্গা মূর্তির। শিবদুর্গার চেয়ে লক্ষ্মী-সরস্বতী আকারে অনেকটা বড়। বিডন স্ট্রিটের ভোলানাথ ধাম, হিদারাম ব্যানার্জি লেনে গোবিন্দলাল দত্তের বাড়ি, ঠনঠনিয়া দত্তবাড়িতেও পুজো পান সপরিবার শিবদুর্গা।

Advertisement

মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গা, শিবদুর্গা ছাড়াও আর এক রকম মূর্তির পুজো হয় কলকাতার কয়েকটি বাড়িতে। সেখানে দুর্গার অভয়া রূপ। যেমন সূর্য সেন স্ট্রিট লাগোয়া বৈঠকখানা রোডের সেন বাড়িতে, এখানে দ্বিভুজা অভয়াদুর্গার পায়ের কাছে বসে থাকে সিংহ; সঙ্গে কার্তিক গণেশ লক্ষ্মী সরস্বতী। পটুয়াটোলা লেনের ধরবাড়িতে দ্বিভুজা অভয়াদুর্গার পায়ের কাছে বসে থাকে দু’টি ছোট্ট সিংহ; একচালার প্রতিমায় দুর্গার চার সন্তান, সঙ্গে জয়া-বিজয়াও। কলুটোলার দেবেন্দ্র মল্লিক রোডে শ্রীরামকৃষ্ণের পদধূলিধন্য ধরবাড়িতেও দ্বিভুজা অভয়া মূর্তি— আজও অমলিন ঐতিহ্যধারা।

দুর্গা পুতুল

দুর্গাপুজো মানে কি শুধুই প্রতিমা আর প্রতিমাশিল্পের খোঁজ? সারা বাংলা জুড়ে লোকশৈল্পিক পুতুল গড়ার যে পরম্পরা, তারও এষণা— বাংলার পুতুলশিল্পীরা এই সময় অন্য নানা পুতুলের সঙ্গে দুর্গা পুতুলও তৈরি করেন যে! তারও কত না বাহার, মাটি ডোকরা কাঠ শোলা ঝিনুক পাট, কত না মাধ্যম। এই দুর্গা পুতুল আর তার শিল্পীদের নিয়েই পুজোর মুখে নতুন একটি বই এল বইবাজারে, বাংলার দুর্গা পুতুল (প্রকা: মৃত্তিকা), লিখেছেন সোমা মুখোপাধ্যায়। এই দুর্গা পুতুলদের বিসর্জন নেই, শিল্পরসিক মানুষ তাদের রেখে দেন স্বগৃহে, আদুরে মেয়ের মতোই। সাকুল্যে পঞ্চান্ন পাতার বই (ছবি প্রচ্ছদ থেকে), তারই মধ্যে দুর্গা পুতুলশিল্প ও শিল্পীদের সংগ্রাম, সঙ্কট ও সম্ভাবনা ধরতে চেয়েছেন লেখিকা। বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে বাংলার চার মহিলা শিল্পী— প্রতিমাশিল্পী চায়না পাল, ডোকরা শিল্পী গীতা কর্মকার, কাপড়ের পুতুলশিল্পী অঞ্জনা চক্রবর্তী ও নিশারানী রায়কে, সেও চমৎকার।

গণিত নিয়ে

১৯৭১-এর ২১ সেপ্টেম্বর কলকাতায় প্রতিষ্ঠা অ্যাসোসিয়েশন ফর ইমপ্রুভমেন্ট অব ম্যাথমেটিক্স টিচিং (এআইএমটি)-র, স্কুল স্তরে গণিত শিক্ষার উন্নতিকল্পে। পাঁচ দশক ধরে এই সংস্থা ছাত্রছাত্রীদের গণিতপ্রতিভা ও দক্ষতা অনুসন্ধান পরীক্ষা, প্রকাশনা, রাজ্য থেকে আন্তর্জাতিক স্তরে বহু আলোচনাচক্র আয়োজন করেছে, স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত শিক্ষক ও গণিতপ্রেমীদের নিয়ে। গত ১ অক্টোবর হাওড়ার নিউ আন্দুল এইচ সি স্কুলে হয়ে গেল ৫২তম প্রতিষ্ঠাদিবসের অনুষ্ঠান ও ৫০তম বার্ষিক সম্মেলন; মূল আলোচ্য বিষয় ছিল মাধ্যমিক স্তরে জ্যামিতি চর্চা। জ্যামিতির বিকাশ ও প্রয়োগ, কম্পিউটার ও গণিতের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বললেন বিশিষ্ট শিক্ষকেরা, ছিলেন কলকাতা ও জেলার ছাত্র ও অভিভাবকরাও।

বই ‘পুজো’

মনুষ্যত্বের বিকাশে বইয়ের বিকল্প কিছু নেই— জেনেও কেন দিন দিন কমছে বই-পড়া মানুষের সংখ্যা, পাঠকের অভাব টের পাচ্ছে প্রকাশনী সংস্থা থেকে শুরু করে গ্রন্থাগারগুলো? সমস্যার মোকাবিলায় অন্য রকম এক আয়োজন এ বার শহরে, তিন দিনের ‘বই পুজো’ আয়োজন করেছে নাগরিক গোষ্ঠী ‘আমরা বইপ্রেমী’। বেহালার মদনমোহনতলায় গতকাল থেকে শুরু অন্য রকম এই ‘পুজো’, চলবে ২২ অক্টোবর অবধি। ফুল-বেলপাতা-মন্ত্রোচারণে নয়, পুজোর শুরু বই পড়ে, শেষও তাই। বাহাত্তর ঘণ্টা চলবে একটানা। বই বিক্রির কোনও ব্যবস্থা থাকছে না, গল্প-কবিতা পাঠ বা সাহিত্য-আলোচনাও নয়। বইপ্রেমীরা শুধু আসল, গোড়ার কাজটি করবেন— বই পড়বেন নিজেদের মতো করে, ব্যস।

‘শিল্প’ বিপ্লব

বনেদি বাড়ির চৌহদ্দি থেকে বারোয়ারি মণ্ডপে দুর্গাপুজোর যাত্রা আসলে বাঙালির এক ধর্মীয় উৎসবের গণতন্ত্রায়নের ইতিহাস। আজকের ‘থিমের পুজো’য় সেই গণতন্ত্রায়ন বিস্তার পেয়েছে শিল্পের পরিসরে, শিল্পী-কারিগর’সহ দুর্গাপুজোর কর্মীরা মিলে সাধারণ্যে সফল ভাবে ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন শিল্প-অভিজ্ঞতা। এও এক সাংস্কৃতিক, ‘শিল্প’ বিপ্লব। ‘পুজো, প্রতিরোধ ও.../ দুর্গোৎসবের আঙিনায় শিল্পকলা ও রাজনীতি’ শীর্ষক আলোচনায় এই ভাবনাই উঠে এল সনাতন দিন্দা সুশান্ত পাল মৌটুশি চক্রবর্তী অন্বয় মুখোপাধ্যায়ের আলোচনায়। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের পি সি মহলানবিশ সভাঘরে গত ৬ অক্টোবর এই কথালাপের উদ্যোগ করেছিল শহরের ইতিহাস-অনুরাগী গোষ্ঠী ‘ভয়েজেস ফ্রম দ্য পাস্ট-অতীতপ্রবাহ’।

সুরাঞ্জলি

জীবনের মন্ত্রগান ছিল শৃঙ্খলা। মাসখানেকও হয়নি, গত ২৬ সেপ্টেম্বর প্রয়াত হয়েছেন ‘দক্ষিণী’ সঙ্গীত প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার সুদেব গুহঠাকুরতা— আজ জন্মদিন তাঁর। শোকার্ত স্মরণ বা স্মৃতিবেদনার মালা গাঁথা নয়, রবীন্দ্রনাথের গানের শুদ্ধতার অন্যতম এই রক্ষককে ঘিরে সুদূর কানাডার বাঙালিদের সাংস্কৃতিক সংস্থা ‘অপার বাংলা’র শ্রদ্ধাঞ্জলি ‘তোমায় নতুন করে পাব বলে’, দেখা যাবে আজ সকাল ন’টা থেকে তাদের ইউটিউব চ্যানেলে। গান, স্মৃতিচারণ, পাঠ, শ্রদ্ধার্পণের অমল রতনহারটি গেঁথেছেন শাশ্বত সান্যাল। কলকাতার ‘নবরবিকিরণ’ও তাদের নিজস্ব স্টুডিয়োতে রেকর্ড করেছে দুই পর্বের সুদেব-শ্রদ্ধাঞ্জলি, ইউটিউবে দেখা যাবে শারদোৎসবের পর পরই। এরই মধ্যে ভবানীপুর ব্রাহ্ম সম্মিলন সমাজে সুহৃদবন্ধুজন ও দক্ষিণী-র ছাত্রছাত্রীরা স্মরণ করলেন তাঁদের সুরের গুরুকে।

নতুন রূপে

উনিশ শতকে পাথুরিয়াঘাটা ঠাকুরবাড়ি জমজমাট থাকত বাংলা গানের আসরে: কীর্তন থেকে কবিগান, রাগসঙ্গীত, নাচের আসর চলত রাতভর। এ বাড়ির, বিশেষত শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুরের সঙ্গীতপ্রীতি এমন ছিল যে দেশ-বিদেশ থেকে নানা বাদ্যযন্ত্র সংগ্রহ করতেন তিনি, পাশ্চাত্য অর্কেস্ট্রা-নোটেশনের আদলে ভারতীয় সঙ্গীতের নোটেশন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছিলেন। দুর্গাপুজোও হত বাড়িতে। গত বছর থেকে বাড়ির মেয়ে, নৃত্যশিল্পী সৌরজা ঠাকুরের উদ্যোগে শুরু হয়েছে নবরূপে শারদোৎসব। এ বছর মহালয়ার দিনে হয়েছে অনুষ্ঠান, চলবে পুজোর ক’দিনও। অষ্টমীর দিন রবীন্দ্রগানের স্বরলিপিকারদের স্মরণ করবে গীতি-আলেখ্য ‘স্বরলিপিখানি’, মনোজ মুরলী নায়ারের নেতৃত্বে ‘ডাকঘর’-এর উদ্যোগ। আবোল তাবোল-এর শতবর্ষে পালা, বাউল গান, সৌরজা ঠাকুরের নৃত্য, শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়ের পুরাতনী গান ও কীর্তন; পুতুলনাচ কবিগান মার্গসঙ্গীতে ভরা উৎসব। ছবিতে টেগোর প্যালেস।

এ বার বাংলায়

কেমন মানুষ, আর কেমন শাসকই বা ছিলেন ওয়াজিদ আলি শাহ? একটা মত বলে, তিনি ছিলেন নাচগানে মেতে থাকা, কর্তব্য অবহেলাকারী অযোগ্য শাসক। কেউ আবার তাঁকে মনে রাখতে চান ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কূট চালে রাজ্য হারানো, এক সৃষ্টিশীল কিন্তু হতভাগ্য নবাব হিসেবে। হয়তো এই দুইয়ের মধ্যেই কোথাও অবস্থান প্রতিভাবান এবং একরোখা এই মানুষটির, ব্রিটিশরা যাঁকে কখনও ‘পোষ মানাতে’ পারেনি, বদলে যাওয়া সময়ের লিখন পড়েও যিনি পূর্বজদের সহবত ও সংস্কৃতি বজায় রেখেছিলেন শেষাবধি। নবাব ওয়াজিদ আলি ও তাঁর সময়কে বোঝার জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি বই সমঝদারদের জানা, লখনউ বিশেষজ্ঞ রোজ়ি লিউলিন-জোন্স’এর দ্য লাস্ট কিং ইন ইন্ডিয়া: ওয়াজিদ আলি শাহ। পরিচিত ইংরেজি বইটি এ বার বেরোল শুভময় রায়ের বাংলা অনুবাদে, ভারতে শেষ বাদশাহ ওয়াজিদ আলি শাহ (প্রকা: পরবাস) নামে। গত ৯ অক্টোবর প্রতিক্ষণ বই-চা ঘরে অনুষ্ঠানে বইটি উপস্থাপন করলেন শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবিতে সপুত্র নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ, প্রচ্ছদ থেকে।

নজির

বাড়ির প্রাচীন পুজোর গোড়ার দিকের নথি, ফর্দ বা হিসাবের কাগজের হঠাৎ খোঁজ পড়ে যদি, পাওয়া যাবে? অনেকেই হাত তুলে দেবেন, ও সব কোথায়! তথাকথিত সাধারণ এই সব কিছুকে ইতিহাসের উপাদান স্বীকারে এখনও অনভ্যস্ত আমরা। তবে পরিবার-সংস্কৃতির ঐতিহ্য চর্চায় বাড়ির পূজাপার্বণ সংক্রান্ত নথি সংরক্ষণের সচেতনতা ক্রমে বাড়ছে। যেমন পিতামহ চন্দ্রকান্ত ভৌমিকের রচনা সংগ্রহ বার করেছেন লেকটাউনের শেখর ভৌমিক ও পরিবারের সকলে। ১৯২৭ সালে নোয়াখালিতে শুরু করা দুর্গাপুজোর খরচের হিসাব, চন্দ্রকান্তের সঙ্কলিত শনিঠাকুর লক্ষ্মী মঙ্গলচণ্ডীর পাঁচালি মুদ্রিত সেখানে; আবার ‘মেহার কালী মাহাত্ম্য’, ‘সীতাকুণ্ড ও চন্দ্রনাথ মাহাত্ম্য’-এর মতো রচনাও। পারিবারিক ও আঞ্চলিক ইতিহাসের নমুনা সংরক্ষণে শহরের প্রাচীন বাড়ি ও পরিবারগুলি এমন আরও নজির স্থাপন করলে কী ভালই না হয়!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement