সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকারে ডুবে যাওয়া এক শহর থেকে বৈদ্যুতিক আলোয় সেজে ওঠা রাতের আনন্দনগরী হতে কলকাতার সময় লেগেছে কমবেশি একশো বছর। উনিশ শতকের গোড়ায় ধনীদের অট্টালিকার সদর দরজায় একটি করে আলো থাকত শুধু, বাবুরা রাতে বেরোতেন মশালচি সঙ্গে নিয়ে। ১৮২৩ সালে শহরে উন্নয়নের দায়িত্বে থাকা লটারি কমিটি ঠিক করে, কেরোসিনের আলোয় শহরের রাস্তা আলোকিত করতে হবে। লালদিঘির চারপাশে দশটি লোহার বাতিস্তম্ভে আলোর ব্যবস্থায় ১৮৪১-এ শুরু হয় এসপ্ল্যানেড, গভর্নর হাউস ও সংলগ্ন অঞ্চল আলোকিত করার আয়োজন। পরে কেরোসিনের আলো বসতে শুরু করে চৌরঙ্গি, স্ট্র্যান্ড রোড, পার্ক স্ট্রিট, চাঁদপাল ঘাট, গার্ডেনরিচ অঞ্চলে। ধাপে ধাপে পরিষেবা পৌঁছয় জোড়াসাঁকো-সহ শহরের উত্তরে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন কেরোসিনের আলোর তেজ দেখে অবাক হওয়ার কথা।
১৮৫৭ সালে এল গ্যাসের আলো, ওরিয়েন্টাল গ্যাস কোম্পানির ব্যবস্থাপনায়। গ্যাসবাতির ঔজ্জ্বল্যে মুগ্ধ শহরের প্রতিনিধি দীনবন্ধু মিত্র লিখলেন, “জ্বলিতেছে দীপপুঞ্জ জ্বলিতেছে পাখা, গ্যাসালোকে কলিকাতা যেন আভামাখা।” গ্যাসবাতির সঙ্গে জড়িয়ে ছিল বিতর্কও। বাতি বসানোর আড়ালে আছে বাড়ির ট্যাক্স বৃদ্ধির সরকারি কৌশল, সন্দেহে হিন্দু পেট্রিয়ট ও সর্বশুভকরী পত্রিকা তীব্র প্রতিবাদ জানায়। সময় মেনে জ্বালানো-নেভানো হত রাস্তার গ্যাসবাতি। পুরকর্মীদের পায়ে পায়ে তখন সকাল-সন্ধে এ শহরের। এক সময়ে তার রমরমাও গেল, এল ইলেকট্রিক আলো। ১৮৮৯-৯২ সালে হ্যারিসন রোড থেকে শুরু তার। সত্তর দশকের আগেই শহর থেকে বিদায় নিল গ্যাসবাতি, জেগে রইল পরিত্যক্ত বাতিস্তম্ভ।
বিজলি বাতির আগমনবার্তা ঘোষিত বহু আগেই। টেলিগ্রাফ বিভাগের ইঞ্জিনিয়ার কার্ল লুই শোয়েন্ডলারের চেষ্টায় হাওড়া স্টেশনের দু’টি প্ল্যাটফর্মে প্রথম ইলেকট্রিকের আলো জ্বলে ওঠার আগেই, ১৮৭৯-র ২৪ জুলাই বৈদ্যুতিক আলোর প্রথম পরীক্ষামূলক প্রদর্শন করে পি ডব্লিউ ফ্লুরি অ্যান্ড কোম্পানি। তবে শোয়েন্ডলারের পরীক্ষার এক বড় প্রাপ্তি ছিল বিদ্যুৎ সংক্রান্ত কাজে এদেশীয়দের হাতেখড়ি। শোয়েন্ডলার তাঁর রিপোর্টে স্থানীয় কারিগরদের দক্ষতার প্রশংসা করেছিলেন, সেই ধারাতেই বিজলি বাতির কারবারে প্রথম বাঙালি উদ্যোগের আত্মপ্রকাশ। ১৮৮১-র ৩০ জুন গার্ডেনরিচের এক সুতাকলে ৩৬টি ইলেকট্রিক বাল্ব জ্বালিয়ে তাক লাগিয়ে দেয় ওয়েলিংটন স্ট্রিটের দে শীল অ্যান্ড কোম্পানি। ১৮৯৫ সালে ‘ক্যালকাটা ইলেকট্রিক লাইটিং অ্যাক্ট’ পাশ করে বাংলার সরকার, তার দু’বছর পর শহরে বৈদ্যুতিক আলো পৌঁছনোর দায়িত্ব পায় লন্ডনের কিলবার্ন অ্যান্ড কোম্পানি। ১৮৯৭-এই তার নাম বদলে হয় ‘দ্য ক্যালকাটা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কর্পোরেশন’ (সিইএসসি), এ শহরের সঙ্গে যার সংযোগ ছুঁতে চলেছে ১২৫ বছর। ছবিতে ১৯৪৪-এর হাওড়া স্টেশনের সামনে অপেক্ষমাণ টানারিকশার সারি, সঙ্গে বিজলি বাতিস্তম্ভ।
সম্মাননা
কিশোরী মেয়েটি এইচ এম ভি স্টুডিয়োতে এসেছিল গানের অডিশন দিতে। গাইল ‘যদি পরাণে না জাগে আকুল পিয়াসা’, পরে ‘কালো পাখিটা মোরে কেন করে জ্বালাতন’। রিহার্সাল-ঘরে গান শুনে মুগ্ধ কাজি নজরুল ইসলাম বললেন, এ মেয়ে এক দিন বড় গাইয়ে হবে। বাংলা গানের জগৎ পরে পেয়েছিল ফিরোজা বেগমকে (ছবিতে)। কাজিসাহেবের গানে প্রবাদপ্রতিম, গেয়েছেন অন্য বহু ধারার গানও। গত ২৮ জুলাই শিল্পীর জন্মদিনে তাঁর অগণিত গুণমুগ্ধ শ্রোতা পেলেন উপহার, ডিজিটাল আর্কাইভ— ফিরোজা বেগম ডট কম। শিল্পীর ভ্রাতুষ্পুত্রী সুস্মিতা আনিস ও তাঁর পরিবারের উদ্যোগে গড়া এই আর্কাইভে আছে শিল্পীর জীবনকথা, সম্মাননা-তালিকা, গানভান্ডার— নজরুলগীতি, রবীন্দ্রসঙ্গীত, আধুনিক বাংলা গান, কাব্যগীতি, গজল। আছে গান সংক্রান্ত তথ্য, অনুষ্ঠান-সম্ভার, সাক্ষাৎকার, ছবি, চিঠি। জরুরি কাজ।
প্রয়াণের ১৭৫
রাজা রামমোহন রায়ের প্রয়াণের তেরো বছর পরে, তাঁর সহযোগী প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরেরও মৃত্যু হয় বিলেতের মাটিতেই, ১৮৪৬-এর ১ অগস্ট। তাঁর মৃত্যুকে ঘিরে ছিল রহস্য, দ্বারকানাথের জনপ্রিয়তা ও রাজকীয় আড়ম্বর তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে অনেককে প্ররোচিত করেছিল, এমন মতও প্রচলিত। প্রয়াণের ১৭৫ বছরে, আগামী কাল সন্ধেয় ‘সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ’-এর আয়োজনে সন্ধে সাড়ে ৬টায় আন্তর্জাল-আলোচনা— থাকবেন শক্তিসাধন মুখোপাধ্যায়, অনুপ মতিলাল, মানসী বড়ুয়া, রঞ্জিনী দাশগুপ্ত ও শুভজিৎ সরকার। অনুষ্ঠান সমাজের ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেলে। সে দিন বিকেলে অনুষ্ঠান দ্বারকানাথের শিল্পসাম্রাজ্যের সাক্ষী রানিগঞ্জের নারাণকুড়িতেও, ‘প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর মেমোরিয়াল হেরিটেজ কমিটি’র উদ্যোগে।
সযতনে
“পুরনো ছবির প্রিন্ট অনেক সময়ই পাওয়া যায় না, শুধু আমার ছবির ক্ষেত্রেই নয়, গত শতকের অনেক পরিচালকের ছবিরই একই অবস্থা। আমার প্রিন্ট-হারানো ছবির নেগেটিভ বা ভিডিয়ো-কপি থেকে তার প্রিন্ট পুনরুদ্ধার করতে হয়েছে। ফলে ফিল্মের প্রিন্ট সংরক্ষণ এখন রীতিমতো জরুরি,” বলছিলেন গৌতম ঘোষ। তাঁর সব ছবির সংরক্ষণের দায়িত্ব নিল ‘উত্তরপাড়া জীবনস্মৃতি আর্কাইভ’ ও ‘হিন্দমোটর ফোকাস’। অরিন্দম সাহা সরদারের তত্ত্বাবধানে ছবির ডিজিটাল কপি সংরক্ষণ, সঙ্গে সে সব ফিল্ম-সংশ্লিষ্ট যাবতীয় উপাদানও। গত ২৪ জুলাই গৌতম ঘোষের ৭১ পূর্তির জন্মদিনে সংস্থা দু’টির তরফে তাঁর হাতে অর্পিত হল ‘জীবনস্মৃতি সম্মাননা ২০২১’। তাঁর প্রথম বাংলা কাহিনিচিত্র দখল-এর পোস্টারের প্রতিলিপি প্রকাশ করলেন গৌতমের আজীবন কর্মসঙ্গী ও সহধর্মিণী নীলাঞ্জনা।
হৃদয়ের আলো
‘সত্য সেলুকস্! কি বিচিত্র এই দেশ!’ সংলাপ মনে রাখলেও, বাঙালি কি চন্দ্রগুপ্ত নাটকের রচয়িতা দ্বিজেন্দ্রলাল রায়কে মনে রেখেছে? রবীন্দ্রনাথ-নজরুল নিয়ে যত চর্চা, তত নয় অতুলপ্রসাদ-রজনীকান্ত-দ্বিজেন্দ্রলালকে ঘিরে। গত এক দশক সেই ‘ঘাটতি’ পূরণে উদ্যোগী ঋদ্ধি বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯ জুলাই দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের জন্মদিন উপলক্ষে ‘ঋদ্ধি বন্দ্যোপাধ্যায় মিউজ়িক অ্যাকাডেমি’ প্রকাশ করল ‘হৃদয়ের আলো’, ইউটিউব-অনুষ্ঠানে তারাবাঈ, পরপারে, সাজাহান নাটক থেকে পাঠ করলেন দেবশঙ্কর হালদার। নির্দেশনায় দেবজিত্ বন্দ্যোপাধ্যায়। ঋদ্ধির গলায় শোনা গেল স্বল্পশ্রুত দ্বিজেন্দ্র-গান, ‘হৃদয়ের আলো তুই রে সতত’... স্ত্রী সুরবালাকে নিয়ে লেখা।
জন্মদিনে
বাঙালির প্রিয় জাদুকর, প্রদীপচন্দ্র তথা পি সি সরকার জুনিয়র ৭৫ পূর্ণ করছেন আজ। বিশ্বময় অসুখে জীবন জাদুহীন, এই উদ্যাপন নয়তো বহুবর্ণ হওয়ার কথা ছিল। তবু এ দিনটিকে অন্য রকম ভাবে ভেবেছেন অসম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের গবেষক উজ্জ্বল সরদার। তাঁর উদ্যোগে আজ বারুইপুরের কাছে রামকৃষ্ণপুরে, পদ্মশ্রী সুধাংশু বিশ্বাসের গড়া শ্রীরামকৃষ্ণ সেবাশ্রমে দিনভর অনুষ্ঠান, খোদ পি সি সরকারের উপস্থিতিতে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার ঐতিহ্যবাহী ডাঙের পুতুলনাচ পরিবেশন করবে দুই বোন, স্বর্ণশ্রী ও রাজ্যশ্রী মন্ডল। ৭৫টি গাছ লাগানো হবে আশ্রমে আর জাদুশিল্পীর বারুইপুরের বাগানবাড়িতে। গত এপ্রিলে বাঘের সঙ্গে লড়ে স্বামী শঙ্কর শী-কে বাঁচিয়ে এনেছেন কুলতলির ভুবনেশ্বরী গ্রামের জ্যোৎস্না শী, চিকিৎসার খরচ জোগাতে বন্ধক রাখা চাষজমি উদ্ধারে তাঁদের অর্থসাহায্যের মতো উদ্যোগও এই জন্মদিন-যাপনের মানবিক মুখ।
দেখার মতো
এই মুহূর্তে এ বাংলার চিত্রকলার জগতে প্রবীণতম শিল্পী তিনি। নিজস্ব শিল্পকৃতির পরিসরে কিন্তু চিরনতুন। ২৯ জুলাই জন্মদিন ছিল শিল্পী সনৎ করের, দিনটি উপলক্ষে প্রতি বছর জুলাইয়ে চিত্রপ্রদর্শনী আয়োজন করে আসছে ‘দেবভাষা বই ও শিল্পের আবাস’, গত পাঁচ বছর ধরে। করোনাকালীন বিধিনিষেধ মাথায় রেখেই এ বছরও, গত ২৫ জুলাই থেকে আবাসে চলছে বর্ষীয়ান শিল্পীর ছবি নিয়ে প্রদর্শনী প্রিন্টস অ্যান্ড প্রিন্টস— উডকাট, এনগ্রেভিং, লিথোগ্রাফ-কৃতি। দেখা যাবে তাঁর প্রথম দিকের কাজ— অদেখা গ্রাফিক্স— যে পরিসরে তাঁর কাজ রীতিমতো পথ-দেখানো। এর আগে একই প্রদর্শনীতে প্রকাশিত হয়েছে শিল্পীর স্কেচ-খাতা, গল্পের বই, সাক্ষাৎকার-ভিত্তিক বই, এ বছর শিল্পরসিকদের জন্য অনন্য উপহার দু’মলাটে শিল্পীর শিল্পভাবনা— বলার মতো কিছু না। ১৯৯২ সালে দেশ পত্রিকার ‘সাহিত্য’ সংখ্যায় প্রকাশিত লেখাটিই বই আকারে বেরোচ্ছে, পুরনো শিরোনাম ধরে রেখেই। ‘মন ছবি আঁকে, হাত নয়’— লিখেছেন সেখানে। প্রদর্শনী ৫ অগস্ট পর্যন্ত, দেখা যাবে দেবভাষার ওয়েবসাইটেও। নীচের ছবিতে শিল্পীর লিথোগ্রাফ।
ক্যামেরাজীবন
বাবার পুরনো, নষ্ট হয়ে যাওয়া ছবির ‘নবরূপ’ দেখে ভদ্রলোক অবাক। ডান হাতের মণিবন্ধে ঘড়ি! এ অভ্যেসের কথা স্টুডিয়ো জানল কী করে! যাঁর ছবি, তিনি যে কমবয়সে ট্যাক্সি চালাতেন, স্টুডিয়ো মালিক তা কথাপ্রসঙ্গে জেনেছিলেন। ১৯৬০-৭০’এর দশকে শহরের ট্যাক্সিচালকদের ডান হাতে ঘড়ি পরাই ছিল ‘স্টাইল’, সে কথা মাথায় রেখেই ছবিতে এমন চমক শহরের শতবর্ষী বাঙালি স্টুডিয়োর। উনিশ শতকের কলকাতায় সাহেবপাড়ার নামী সংস্থার পাশাপাশি শোভাবাজার-বাগবাজার-চিৎপুরে বাঙালি উদ্যোগে গড়ে ওঠে বেশ কিছু স্টুডিয়ো, তাদের তোলা সাদা-কালো ছবিতে রয়ে গেছে বহু বাঙালি পরিবারের ইতিহাস। উত্তর কলকাতার ‘সি. ব্রস’ এবং ‘ডিভাইন’, এই দুই পুরনো স্টুডিয়োর কর্মকাণ্ড থেকে সামাজিক ইতিহাস রচনার উপাদান সংগ্রহের কাজ করেছেন শিক্ষক-গবেষক জিগীষা ভট্টাচার্য, সেই নিয়ে বললেন গত ১২ জুলাই, যদুনাথ ভবন মিউজ়িয়াম অ্যান্ড রিসোর্স সেন্টার-এর ‘আর্কাইভ্যাল টক সিরিজ়’-এ, আন্তর্জাল-আলোচনায়। শোনা যাবে সেন্টার-এর ফেসবুক পেজে, এখনও। ছবিতে উনিশ শতকে ব্যবহৃত ক্যামেরা।
ঘরে, বাইরে
এসেছে অলিম্পিক, বাঙালির চতুর্বার্ষিক খেলোয়াড়ি স্পিরিট দেখানোর উৎসব। অতএব কুলুঙ্গি থেকে বিস্মৃতির ধুলো ঝেড়ে বার করো মেরি কম-পি ভি সিন্ধু, রুপোবতী মীরাবাই চানুকে নিয়ে ফেসবুকে গাও নারীশক্তির জয়গান, সুতীর্থা-প্রণতির স্বপ্নভঙ্গে হাপুস কাঁদো। শুধু ঘরের মেয়েটা একটু খেলতে চেয়ে ছাদে যেতে চাইলেই বাজ কড়কড়াৎ: ‘‘অত খেলা কিসের! মাধ্যমিক কি কোনও বছরই হবে না ভাবছ? পড়তে বোস!’’