গির্জাগুলিকে কেন্দ্র করেই কলকাতার বড়দিন উদ্যাপন, কিন্তু মনে পড়ে কি সেই সব গির্জার কথা, যারা হারিয়ে গেছে কালস্রোতে? যেমন ১৭০৯ সালে স্থাপিত সেন্ট অ্যান’স চার্চ, ইংরেজরা যা তৈরি করেছিল তাদের প্রথম কেল্লার, মানে আজকের জিপিও চত্বরের ভেতরে? ইংরেজ ব্যবসায়ীদের চাঁদায় তৈরি গির্জার পশ্চিম দিকের উঁচু মিনার আর চূড়া-সহ গোটা গির্জাটি ছিল শহরের দর্শনীয় স্থাপত্য (ছবিতে)। তবে চালু হওয়ার দেড় দশকের মধ্যেই ছাদের কড়ি-বরগায় পচন ধরা-সহ নানা সমস্যার কথা জানা যায় কোম্পানির পুরনো দস্তাবেজে। ১৭৩৭ সালের ঘূর্ণিঝড়ে ভেঙে পড়ে বিখ্যাত চূড়াটি। সিরাজউদ্দৌলা ১৭৫৬ সালে কলকাতা আক্রমণ ও দখল করেন। তখন কামানের গোলায় গির্জাটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়। মুছে যায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রথম প্রেসিডেন্সি গির্জার চিহ্ন।
নির্মাণগত সমস্যার কথা ফিরে আসে কলকাতার হারিয়ে যাওয়া সেন্ট জেমস’ গির্জার প্রসঙ্গেও। আজকের ‘জোড়া গির্জা’ নামে সাধারণ্যে পরিচিত সেন্ট জেমস’ গির্জার পূর্বসূরি গির্জাটি তৈরি হয় ১৮২৬ সালে নেবুতলা লেনে, মানে আজকের সন্তোষ মিত্র স্কোয়ারের পিছনে। উইপোকার আক্রমণে গির্জাটির কড়ি-বরগা নষ্ট হলে তা মেরামত ও সংস্কারের চেষ্টা হয়, কিন্তু ১৮৫৮-য় সেটি হঠাৎ ভেঙে পড়ায় ওই নামেই লোয়ার সার্কুলার রোডে এক বাড়ি সংলগ্ন বিশাল বাগান নিয়ে তৈরি হয় নতুন গির্জা, ১৮৬৪ সালে। নেবুতলার কিছু ঠিকানায় ‘সেন্ট জেমস স্কোয়ার’ লেখায় রয়ে গেছে সেই স্মৃতি।
হারানো ভাসমান গির্জাটির গল্প বেশ মজার। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে চিনা বোম্বেটের হাত থেকে বাণিজ্যতরীগুলির সুরক্ষায় ‘লেডি ক্যানিং’ নামে এক রণতরী তৈরি হয় কলকাতায়। কিন্তু নকশা তৈরির সময় জাহাজে ভারী কামান রাখার বিষয়টাই ভাবা হয়নি। কার্যকারিতা পরখ করতে সমুদ্রে নিয়ে যাওয়া হলে, ঝড়ের মুখে কামানগুলো জলে ফেলে জাহাজটিকে রক্ষা করতে হয়েছিল। চার্চের পক্ষ থেকে এর অল্প কাল আগে ভাসমান চ্যাপেল ও লাইব্রেরি হিসেবে ব্যবহারের জন্য ডক কর্তৃপক্ষের কাছে একটি পুরনো জাহাজ চেয়ে আবেদন আসে। নতুন করে সাজিয়ে এই ‘লেডি ক্যানিং’কে লাইব্রেরি তথা খ্রিস্টান নাবিকদের উপাসনার জন্য চ্যাপেল হিসেবে দিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ডক কর্তৃপক্ষ। এই কাজে বাংলা সরকার ন’হাজার টাকা বরাদ্দ করেছিল। যাজক আব্রাহাম রাস্ট ১৮৭৫-এর শেষ বা ১৮৭৬-এর শুরুতে এই ভাসমান চ্যাপেলের দায়িত্ব নেন, তাঁর ব্যক্তিগত নথিতে মেলে টিপ্পনীও: “এ ভাবেই টাকার অপচয় হয়।”
মহাজনেরা বলেন, জলে দাগ কাটা যায় না। অনেকটা তেমনই, কয়েকটি নথির পাতায় কিছু কালো আঁচড় ছাড়া আর কোনও চিহ্ন না রেখেই, কলকাতার হারিয়ে যাওয়া স্থাপত্যের তালিকায় নাম তুলেছে এই গির্জাগুলি।
মননজীবন
গত বছর ফেব্রুয়ারিতে তাঁর প্রয়াণ, আর বছরশেষে তাঁর ৯০তম জন্মদিনে শহর শুনেছিল প্রথম ‘কৃষ্ণা বসু স্মারক বক্তৃতা’। অধ্যাপিকা, সুলেখিকা, সাংসদ কৃষ্ণা বসুর (১৯৩০-২০২০) মননজীবনের স্মৃতিতে নেতাজি রিসার্চ বুরো-র এই উদ্যোগ বৎসরান্তের কলকাতায় আরও এক বার, আগামী কাল ২৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৬টায়, তাঁর ৯১তম জন্মবার্ষিকীতে, ঐতিহাসিক নেতাজি ভবনে। বলবেন প্রাক্তন বিদেশসচিব এবং আমেরিকা ও চিনে ভারতের রাষ্ট্রদূত নিরুপমা রাও, ‘দ্য পাওয়ার অব সফ্ট পাওয়ার’ বিষয়ে। ১৯৫১ থেকে ২০২০, সাত দশকব্যাপী অজস্র রচনায় বাংলায় নেতাজি-চর্চার এক বিস্তৃত দিগন্ত প্রসারিত কৃষ্ণা বসুর লেখায়, সাহিত্য-সংস্কৃতি-রাজনীতি’সহ বাঙালির বৌদ্ধিক পরিসরের চলিষ্ণু বিবর্তনের আয়নাটিও বসানো তাতে। ১০৬টি রচনায় সাজানো প্রবন্ধ সংগ্রহ: ১৯৫১-২০২০ (আনন্দ) বইয়ের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনও হবে সে দিন।
ইস্কুল-কথা
উমা সেহানবীশের নেতৃত্বে, রবীন্দ্র-ভাবাদর্শে দীপ্ত এক দল শিক্ষাব্রতীর উৎসাহে ষাটের দশকের শেষে গড়ে ওঠে কলকাতা পাঠভবন স্কুল। প্রথম সভাপতি সত্যজিৎ রায়, উৎসাহদাতা মৃণাল সেন, সুব্রত মিত্র, চিন্মোহন সেহানবীশ, মীরা দত্তগুপ্ত, নিবেদিতা নাগ, গৌতম চট্টোপাধ্যায়, সুশোভন সরকার, অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। স্কুলে পড়িয়েছেন জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, পার্থ বসু, শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়, পিনাকী মিত্র, সুতপা ভট্টাচার্য, এন বিশ্বনাথনের মতো মানুষ। দুই পুরনো ছাত্র সরসিজ ও বিশ্বনাথের লেখায়-রেখায় ইস্কুল নামের বইয়ে সপ্রাণ সেই সবই। মুখবন্ধ শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ের। নেহরু চিলড্রেন’স মিউজ়িয়ামে প্রকাশ পেল গত ২৩ ডিসেম্বর।
দুই উৎসব
করোনাকাল বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলা থিয়েটারের, তা নিয়ে বিষণ্ণ ‘নান্দীকার’ ও ‘অন্য থিয়েটার’-এর দুই কর্ণধার। রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত বললেন, “দশ দিনের নাট্যোৎসব করতে পারছি না বলে দুঃখ খুবই, আবার দু’দিনের উৎসব করতে পারছি বলে আনন্দও হচ্ছে।” বিভাস চক্রবর্তী জানালেন “বাধ্য হয়ে সংক্ষিপ্ত সংস্করণ এ বার ‘নাট্যস্বপ্নকল্প’র, তবু যৎসামান্য আয়োজনেও থিয়েটারের সৌভ্রাতৃত্বের চেষ্টা।” স্বাতীলেখা সেনগুপ্তকে উৎসর্গীকৃত নান্দীকারের ৩৮তম জাতীয় নাট্যোৎসব, অ্যাকাডেমিতে, ২৫-২৬ ডিসেম্বর। সংবর্ধিত হবেন চিত্রা সেন, “প্রেরণাস্বরূপাদের শ্রদ্ধায়,” সোহিনী সেনগুপ্ত মনে করিয়ে দেন— চিত্রা সেন অভিনীত, ‘রঙরূপ’-এর জলছবি আছে এ উৎসবে। আছে তিতুমীর (থিয়েটার ফর্মেশন পরিবর্তক), ভানু সুন্দরীর পালা (চাকদহ নাট্যজন) ও নান্দীকার-এর মানুষ। ৩১ ডিসেম্বর অ্যাকাডেমিতে বিকেল সাড়ে ৫টা থেকে ‘নাট্যস্বপ্নকল্প ২০২১’-এ দুই জল্লাদের গপ্পো (সায়ক), বালজাকের প্রেমিকারা (প্রাচ্য) ও ঋদ্ধি সেনের প্রথম নির্দেশনায় স্বপ্নসন্ধানী-র ব্ল্যাঙ্ক ফায়ার।
বছর-শেষে
গোড়ায় নাম ছিল ‘শুভম’। ১৯৯৬ থেকে পোশাকি নাম হল ‘বিডন স্ট্রিট শুভম’, সে অর্থে এ বছর উত্তর কলকাতার এই নাট্যদলের পঁচিশ বছর পূর্তি। ছোট-বড় সকলের সক্রিয় উপস্থিতিতে নাটক তৈরি, আলোচনা, কর্মশালা, নাট্যমেলা করে এই দল। বছর-শেষের মিনার্ভা থিয়েটারে, ২৯ থেকে ৩১ ডিসেম্বর তাদের নিবেদন ‘২০তম শুভম নাট্যমেলা’, উৎসব অতিথি ভদ্রা বসু। দলের প্রযোজনায় নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের দুই বিখ্যাত নাটক ভাড়াটে চাই ও ভীমবধ-এর অভিনয় প্রথম দুই সন্ধ্যায়, সঙ্গে মূকাভিনয়; ৩০ সন্ধ্যায় গোবরডাঙা নকসা-র গাব্বু, চেতলা কৃষ্টি সংসদ-এর ইচ্ছেমতো। ক্যাপ-চার ও সামিয়ানা, দুই নাটক দিয়ে উৎসব শেষ, বছরও। কল্যাণব্রতী
স্ত্রীশিক্ষা প্রসার আন্দোলনের শরিক উনিশ শতকের ত্রিপুরাও। ১৮৭২-এ ঢাকায় গড়ে উঠল ‘ত্রিপুরা হিতসাধিনী সভা’, অচিরেই তার কাজ ছড়িয়ে পড়ল লোকহিতের বিস্তৃত পরিসরে, কলকাতা হয়ে উঠল তার প্রাণকেন্দ্র। ১৯৪০-এ বিমানবন্দরের কাছে হিতসাধিনী সভার নিজস্ব ভবনের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছিলেন তৎকালীন ত্রিপুরাধিপতি বীরবিক্রম কিশোরমাণিক্য। সে স্বপ্ন সত্য হয়নি, তবে শতবর্ষের প্রাক্কালে নেতাজির স্মৃতিধন্য ৩ নম্বর মির্জাপুর-এর (এখন সূর্য সেন স্ট্রিট) ‘মেসবাড়ি’ সভার স্থায়ী ঠিকানা হয়ে ওঠে। দুঃস্থ শিক্ষার্থীদের সাহায্য, কম্পিউটার ও স্বাস্থ্য বিষয়ক উদ্যোগে কল্যাণকর ঐতিহ্য বহমান আজও। ২৬ ডিসেম্বর সকাল ১০টায় ত্রিপুরা হিতসাধিনী সভা-র সার্ধশতবর্ষ উদ্যাপন অনুষ্ঠানের সূচনা নিজস্ব ভবনেই। বছর জুড়ে আরও অনুষ্ঠান, চলছে স্মারক সঙ্কলনের প্রস্তুতিও— জানালেন সম্পাদক দেবব্রত ভট্টাচার্য।
কেক-দিন
বড়দিনের সময় উৎসবের উপহার হিসেবে কেক পাঠান যাঁরা, কেক-বিপণির দামি পসরায় তাঁদের প্রয়োজন মেটে না। অনেকেই তাই লাইন দেন এন্টালি-তালতলার ছোট বেকারিগুলোয়। বেকারি থেকে দেওয়া রেসিপি অনুযায়ী ময়দা, ডিম, মাখন নিয়ে এসে, পছন্দের কেক তৈরি করে নিয়ে যান। সেখ একরামুল হকের কেকের রেসিপি তৈরি তাঁর দাদুর হাতে, গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলের বেকারি কর্মী ছিলেন তিনি। কিছু বিশেষ কেক তৈরিতে দেশি ঘি, বা ক্রেতার পকেটের কথা ভেবে ড্রাই ফ্রুটসের বদলে শুধু জায়ফল আর দারচিনিগুঁড়োর ব্যবহার বড়দিনকে আনে মাটির কাছাকাছি। ক্রেতাদের ফর্দমাফিক আনা জিনিস মূল কারিগর সেখ আব্দুল জলিলের নজরদারিতে চোখের সামনেই মিশিয়ে ঢোকানো হয় ওভেনে (ছবিতে)। অতঃপর হাজির নানা কেক— ফ্রুট, প্লেন, প্লাম, চকলেট। বাকি বছর পাউরুটি-বিস্কুটে, বড়দিনের আগে দিনদশেক এই বেকারিগুলো ব্যস্ত থাকে কেকে। ডি’গামা সাহেবের কেক হারিয়ে গেলেও, সেই ঐতিহ্যের আগুন আজও বেঁচে তথাকথিত অনামী এই সব ছোট ছোট বেকারিতে।
সমন্বয়ী
জেসুইট মিশনারি হয়ে এ দেশে এসে যাঁরা বঙ্গ তথা ভারতচর্চায় মগ্ন হয়েছেন, ফাদার ম্যাথু শিলিংস (১৯৩৩-২০১৬) (ছবিতে) তাঁদের অন্যতম। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর এই মানুষটি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফরাসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে ষোলো বছর অতিথি অধ্যাপক ছিলেন, গবেষণা করেছেন বোদল্যেয়রের সাহিত্য নিয়ে। জন্ম বেলজিয়ামে, কানাডার নাগরিক ম্যাথু সম্পাদনা করতেন সাহিত্যপত্রিকা মোহনা, বেরোত প্রত্যেক ২৫ বৈশাখ ও ২৫ ডিসেম্বরে, ১৯৯২-২০১২, কুড়ি বছরে প্রকাশিত ৪০টি সংখ্যা! পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকীতে বিস্মৃতপ্রায় বঙ্গপ্রেমীর স্মরণানুষ্ঠান আয়োজন করেছে ‘সম্প্রীতি আকাদেমি’, কেশব সেন স্ট্রিটের ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্ম মন্দিরে, আজ বিকাল ৪টায়। ‘বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতিতে বড়দিন’ নিয়ে আলোচনা, প্রকাশিত হবে ফাদার শিলিংস সম্পাদিত মোহনা পত্রিকায় প্রকাশিত নির্বাচিত কয়েকটি সাক্ষাৎকার সম্বলিত গ্রন্থ সর্বধর্ম সর্বমত (সম্পাদনা: সুরঞ্জন মিদ্দে)। সমন্বয়ী ফাদারের জীবন ও কৃতিকে স্মরণ করবেন বিশিষ্টজন।
ভালবেসে গান
শীতের সঙ্গেই হাজির উৎসব, বাংলা সঙ্গীতমেলা। ২৫ ডিসেম্বর থেকে ১ জানুয়ারি, রাজ্য সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের আয়োজনে রবীন্দ্রসদন, শিশির মঞ্চ, ফণীভূষণ বিদ্যাবিনোদ যাত্রামঞ্চ, রবীন্দ্র ওকাকুরা ভবন, মধুসূদন মুক্তমঞ্চ, রাজ্য সঙ্গীত আকাদেমি, দেশপ্রিয় পার্ক, হেদুয়া পার্কে প্রায় দেড় হাজার শিল্পীর গলায় প্রাণ পাবে বাংলা গান। তালবাদ্য-যন্ত্রে সহযোগী আরও শতাধিক শিল্পী। সুবিনয় রায় ও ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য স্মরণে প্রদর্শনী ‘শতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি’, স্বপন সোমের বিন্যাসে। ১ জানুয়ারি পর্যন্ত গগনেন্দ্র প্রদর্শশালায়, ২-৮টা।