Kolkatar Karcha

কলকাতার কড়চা: হাসি-কান্নার স্মৃতিসম্ভার

লক্ষ মানুষ নাকি সাদা জামা পরে গাঁধী টুপি চাপিয়ে ছুটছে লাল কেল্লায়, নেহরুর কথা শুনতে?

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৪ অগস্ট ২০২১ ০৮:৫৪
Share:

দেশটা না কি এ বার সত্যিই স্বাধীন হয়ে যাবে? ঘোর বর্ষাতেও তাই তেরঙা তৈরি করছিল খুদে ডানপিটেরা। মাঝরাতে বড়রা রেডিয়োয় জওহরলাল নেহরুর ভাষণ শুনলেন, সকাল হতেই তুমুল হইচইয়ে ঘুম ভাঙল ছোটদের। ১৫ অগস্ট, ১৯৪৭। ব্রিটিশ রাজের তিমিররাত মুছে স্বাধীনতার সূর্য উঠল। মেয়েরা শাঁখ বাজালেন, বেরোল শোভাযাত্রা। লক্ষ মানুষ নাকি সাদা জামা পরে গাঁধী টুপি চাপিয়ে ছুটছে লাল কেল্লায়, নেহরুর কথা শুনতে? দিনের হর্ষহিল্লোল জুড়োলে, পর দিন কাগজে স্বাধীনতার খবরের পাশে... ভাগ হয়ে গিয়েছে দেশ!

Advertisement

নথি বলছে, দেশভাগে ক্ষতিগ্রস্ত অন্তত ১.৪ কোটি, প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় ২০ লক্ষ মানুষ। আর জীবন বলে, সে দিনের স্কুলপড়ুয়া ছেলের দল, কলেজের দুই-বিনুনি মেয়েরা অনেকেই ভেসে গিয়েছেন, ভিটেছাড়া হওয়ার জ্বালা আর স্বাধীন দেশ দেখার শিহরন বুকে নিয়ে। এখনও জীবিত যাঁরা— আশির কোঠায়, নবতিপর বা একশো-অতিক্রান্ত— বলে যান পুরানো সেই দিনের কথা। ভারত-ইতিহাসের এক জরুরি কালপর্বের সাক্ষী এই সব মানুষের কথা ভিডিয়ো রেকর্ড করে, তাঁদের যাপিত অতীত আর স্বাধীনতার ছবি-খবর জুড়ে ইতিহাসের তোরঙ্গ ভরছে ‘গীতিকা ট্রাস্ট’। এ বছরের ১ জুন থেকে ১৫ অগস্ট পর্যন্ত ৭৫ দিনে ৭৫টি ভিডিয়ো দেখা যাচ্ছে তাদের ইউটিউব চ্যানেলে। এ ভাবেই স্বাধীনতার ৭৫ উদ্‌যাপন। এ শহর, রাজ্য বা দেশেরও বাইরে থাকা যে মানুষেরা স্বাধীনতার দিন ও সেই সময়ের স্মৃতিবিবরণ এই তথ্যভান্ডারে জুড়তে চান, তাঁদের সহযোগ চাইছেন ওঁরা।

বেণুবিনোদ দাস, আশিস চৌধুরীরা বলেছেন সিরিল র‌্যাডক্লিফের অবিবেচনার কথা। বাংলা-পঞ্জাব ভাগের সময় সিলেটকে নিয়ে টানাহেঁচড়া, গণভোটের জেরে কেউ স্বাধীনতার সূর্যকে দেখেছেন ফাঁকা আলুর গুদামে। কেউ মুরুব্বিদের খামখেয়ালিপনায় ১৫ অগস্ট রাতে শুনেছেন তাঁরা ভারত নয়, পূর্ব পাকিস্তানের লোক: ‘এক্ষুনি ভিটে ছাড়ো!’ আবার পর দিনই ঘোষণা: না, ভারতেই আছে তাঁদের এলাকা। এমন বহু ভুল হিসেবের শিকার কৃষ্ণনগর, খুলনার অগুনতি পরিবার। ব্ল্যাকআউটের স্মৃতি, সুড়ঙ্গে দিনযাপনের গল্প, দেশভাগের পর গ্রাম জুড়ে নেমে আসা মৃত্যুর অভিশাপের কথকতা পড়েছেন মহর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়। আছে সুরাবর্দি, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ আর ছোট্ট ‘ইন্দিরা’কে দেখার বিস্ময়। বিস্মৃতির ঘড়ঘড় থামিয়ে হঠাৎ রেডিয়োয় ‘আমি সুভাষ, বার্লিন থেকে বলছি’র আবেগ-মন্থনে ফের কিশোরী হয়ে ওঠেন ১০১ বছর বয়সি আরতি মুখোপাধ্যায়। ওঁরা বলছেন— আমরা পরাধীনতা দেখেছি, দেখেছি স্বাধীন দেশও। স্বাধীনতার অর্থ, তার মূল্যও ওঁদের জীবন-অভিজ্ঞতা দিয়েই জানা। উত্তরপ্রজন্ম জানুক সেই অতীত, তা থেকে শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে যাক আগামী পথে, স্বাধীনতার ৭৫ বর্ষপূর্তির আবহে সেটাই লক্ষ্য ওঁদের। ছবিতে ১৯৫০-এর শিয়ালদহ স্টেশনে ‘বরিশাল এক্সপ্রেস’-এ আসা উদ্বাস্তু স্রোত, স্বজন-বন্ধুদের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে এ পারের মানুষ।

Advertisement

মগন-গীত

‘মগন’ তাঁর ছদ্মনাম, ‘মগন গীত’-সম্ভারেই আজও সপ্রাণ সঙ্গীতাচার্য চিন্ময় লাহিড়ী (১৯২০-১৯৮৪) (ছবিতে)। মধুবন্তী ও মিঞা মল্লার মিশিয়ে তৈরি করেছিলেন মধুমল্লার, আহির ভৈরব ও মল্লারের মিশ্রণে আহিরী মল্লার, এ ছাড়া কুসুমী কল্যাণ, শিবানী, যোগমায়া, প্রভাতী ভৈরব, শ্যামকোষ, নন্দকোষের মতো রাগ। অজস্র বন্দিশ বেঁধেছেন, ঠুংরি, দাদরা, কাজরী, গজল, ভজনও। বিশিষ্ট বঙ্গ-গীতিকারদের বাণী সুরে বেঁধে উপহার দিয়েছেন অপূর্ব বাংলা রাগপ্রধান। তার কিছু শ্রুত, বহুলাংশই অশ্রুত। রসজ্ঞদের কাছে সেই সম্পদ পৌঁছনোর কাজটি করছেন ‘মগনমন্দির’-এর দুই কর্ণধার— আচার্যপুত্র পণ্ডিত শ্যামল লাহিড়ী ও পুত্রবধূ বিদুষী মন্দিরা লাহিড়ী। আচার্যের সঙ্গীত বিষয়ক আলোচনা, নোটেশন-খাতা, ডায়েরি, নথি নিয়ে আর্কাইভ তৈরির কাজ চলছে। ১৭ অগস্ট তাঁর প্রয়াণদিন, এই আবহে সঙ্গীতাচার্যের সৃষ্টির সংরক্ষণ ও প্রসারের কাজটি জরুরি অতি।

অঞ্জনঘন

এস্রাজে রবীন্দ্রসঙ্গীতের অভ্যাস শান্তিনিকেতনে শিরোধার্য হলেও, কলকাতায়, অন্তত অনুষ্ঠানমঞ্চে তা জনপ্রিয় হতে লেগেছে বিস্তর সময়। গুণী বাজিয়ের সংখ্যা হাতে গোনা— রমেশচন্দ্র চন্দ্রের সুযোগ্য শিষ্য, বেহালার পোড়া অশ্বত্থতলার অঞ্জন বসু (১৯৫৬-২০২১) সেই শূন্যস্থান পূর্ণ করেছিলেন আশির দশকেই। অন্য বাদ্যযন্ত্রে, কণ্ঠবাদনেও ছিলেন দক্ষ, কিন্তু এস্রাজ-বাজিয়ে হিসেবেই নিজেকে অপরিহার্য করে তুলেছিলেন গত চার দশক। কেবল গানের নিখুঁত অনুসরণেই নয়, নৃত্যনাট্যের আবহ রচনায়, আকাশবাণী-দূরদর্শনে আদর্শ বাদনের ইতিহাস গড়ে দিয়েছিলেন এই শিল্পী। মারণরোগে চলে গেলেন গত ৪ অগস্ট— সুভদ্র, মার্জিত বাদনশৈলীর এক অধ্যায় ফুরিয়ে গেল সেই সঙ্গেই।

বিজ্ঞানভাষ

বাংলায় প্রথম বিজ্ঞান পত্রিকা জন ক্লার্ক মার্শম্যানের সম্পাদনায় দিগ্‌দর্শন, ১৮১৮ সালে। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে এর পর অনেক পত্রিকার জন্ম হয়েছে। লিভার ফাউন্ডেশন-এর উদ্যোগে দু’বছর ধরে প্রকাশিত হচ্ছিল ত্রৈমাসিক ওয়েব-পত্রিকা বিজ্ঞানভাষ, গত ৬ অগস্ট থেকে তার নবরূপ, দৈনিক হিসেবে (বিজ্ঞানভাষ ডট ওআরজি)। প্রতি দিন বাংলায় বিজ্ঞানের খবর, বিষয়েও বৈচিত্র— প্রকৃতি, পরিবেশ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, জিন চিকিৎসা, প্রযুক্তি, আবিষ্কারের গল্প, ‘ফেক নিউজ়’ নিয়েও আলোচনা। আছে সাক্ষাৎকার, ছাত্রছাত্রীদের লেখায় বিস্তর ‘কেন’-র উত্তর খোঁজা। দৈনিক বিজ্ঞানভাষ ওয়েব-পত্রিকার আনুষ্ঠানিক উন্মোচন করলেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়।

মুখোশের মন

ভাবনাটাই আসল, ভাবনার ভিতরে ঢুকতে হবে, বলছিলেন নব্বই বছরের মুখোশ শিল্পী, সেরাইকেল্লার কানাহাইয়া লাল মহারাণা। মলয় দাশগুপ্তের হোয়্যার দ্য মাস্ক স্পিকস দ্য মাইন্ড তথ্যচিত্রে। গত ৯ অগস্ট উদ্‌যাপিত ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস’-এর আবহে আরও তাৎপর্যময় ছবিটি। ঝাড়খণ্ডে তোলা এ ছবির মূল বিষয় ছৌ মুখোশ ও তার শৈল্পিক প্রয়োগ, বিশেষত সেরাইকেলার ছৌ নাচে। “শিল্পকর্ম নিয়ে বহু দেশে ঘুরেছেন, রাষ্ট্রপতি সম্মান-সহ বিবিধ পুরস্কার পেয়েছেন কানাহাইয়া লাল, অথচ দেখেছি, কত সরল জীবন যাপন তাঁর, অবলীলায় বলে চলেন মুখোশের নান্দনিকতা নিয়ে, যা তাঁর জীবন-নিঃসৃত অভিজ্ঞতা। এ ছবিতে আছে ওঁর কথোপকথন, যা কাজে লাগবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের,” মত পরিচালকের।

মৈত্রীর ৫০

‘রুশ-ভারত চুক্তি/ বাংলাদেশের মুক্তি’— ’৭১-এ স্লোগান উঠেছিল কলকাতায়। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষ নেওয়ায় যখন একাধিক বিশ্বশক্তির সঙ্গে লড়তে হচ্ছে ভারতকে, তখন পাশে দাঁড়ায় সোভিয়েট ইউনিয়ন। স্বাক্ষরিত হয় মৈত্রী চুক্তি। ভারত-রুশ বন্ধুতা অবশ্য অনেক পুরনো। ১৪৬৮ সালে ভারতে আসেন পরিব্রাজক আফানাসি নিকিতিন। অষ্টাদশ শতকের শেষে কলকাতায় এসে প্রথম বাংলা নাট্যমঞ্চ প্রতিষ্ঠা করেন গেরাসিম লেবেদেভ। ১৯৫৫-তে ক্রুশ্চেভ-বুলগানিনের সংবর্ধনা সভায় ব্রিগেডে বাঁধভাঙা ভিড়ও স্মৃতিতে উজ্জ্বল। মৈত্রী চুক্তির সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে গত ৯ অগস্ট থেকে গোর্কি সদনে চলছে প্রদর্শনী— রয়েছে নানা সময়ের দ্বিপাক্ষিক সরকারি সনদ, নথি ও চিত্র, দুই সরকারের নেতাদের বৈঠকের ছবি এবং দুই দেশের সম্পর্ক নিয়ে অনেকগুলি বই। প্রদর্শনী কোভিডবিধি মেনে ১৬ অগস্ট পর্যন্ত, দুপুর ১টা-৪টে, শনি-রবি বাদে।

ঐতিহাসিক

১৯৩৭, অক্টোবর। নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির বিশেষ অধিবেশন কলকাতায়। রবীন্দ্রনাথ তখন আছেন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের বাড়ি ‘গুপ্ত নিবাস’-এ, কমিটির অধিবেশনে শহরে এসে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এখানে এসেছিলেন মহাত্মা গাঁধী, জওহরলাল নেহরু, সুভাষচন্দ্র বসু, সরোজিনী নায়ডু। পরাধীন দেশে সাম্প্রদায়িক অস্থিরতার আবহে সে সময় প্রশ্ন ঘনিয়েছে ‘বন্দে মাতরম্‌’-কে জাতীয় সঙ্গীত করা নিয়ে। এ বাড়ি থেকেই সুভাষচন্দ্রকে লেখেন কবি, “বন্দেমাতরম গানের কেন্দ্রস্থলে আছে দুর্গার স্তব, তাই তা সাহিত্যে গ্রহণযোগ্য হলেও রাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে মুসলমানদের পক্ষে গ্রহণযোগ্য না হতেও পারে।” এ প্রসঙ্গে আলোচনা করতে ২৫ অক্টোবর গুপ্ত নিবাসে এলেন নেহরু, পরে একই গাড়িতে রওনা হলেন চৌরঙ্গি স্কোয়ারে সেই ক্লিনিকের দিকে, যেখানে আলট্রাভায়োলেট রে থেরাপি নিতে যেতেন কবি। পর দিন ‘বন্দে মাতরম্‌’ সম্পর্কে তাঁর মত লিখে নেহরুকে পাঠান রবীন্দ্রনাথ, তার তিন দিন পর ওয়ার্কিং কমিটি ‘বন্দে মাতরম্‌’ নিয়ে সিদ্ধান্ত প্রকাশ করে। জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের সাক্ষী এই বাড়িটি (ছবিতে ২০১৯-এর চিত্র) এখন ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট-এর তত্ত্বাবধানে রক্ষিত।

ঝুলন-পুতুল

ঝুলন পূর্ণিমা আসছে। একদা ছোটরা মুখিয়ে থাকত ঝুলনের জন্য— পাহাড়, বন, বাঘ-ভালুক, শিকারি, বন্দুকধারী সেপাই, ফেরিওয়ালা, সবার পুতুলের ভাঁড়ার থেকে এটা-ওটা জড়ো করে সাজিয়ে তুলত জীবনের চেনা-অচেনা ছবি। সময় বদলেছে, ঝুলনের সেই আগ্রহ আর চোখে পড়ে না। বড়দেরও সময় নেই কাঠের গুঁড়ো, বালি, হরেক জিনিসপত্র জোগাড়ের। তবু কলকাতার নানান কুমোরপাড়ায় আজও তৈরি হয় ঝুলনের পুতুল। মূলত ছাঁচের ব্যবহারে, কাঁচা মাটির উপর রং করে তৈরি এই পুতুল গড়েন মৃৎশিল্পী পরিবারের মহিলারা। তাই হয়তো ট্রাফিক পুলিশ (ছবিতে) বা গর্জানো বাঘ, সকলেই বেশ আদুরে। করোনায় গত বছর থেকে বিক্রি নেই, এ বছর ঝুলনের পুতুল গড়বেন না, ভেবেছিলেন উল্টোডাঙার কাছে দক্ষিণদাড়ির অঞ্জলি পাল। হঠাৎ বরাত আসায় কিছু পুতুল গড়েছেন। আগে টাকা চার-পাঁচে বিক্রি হত, এখন প্রতি পুতুল পঁচিশের আশেপাশে। আটপৌরে অন্তরঙ্গতায় গড়া এই পুতুল হারিয়ে গেলে, মুছবে ঐতিহ্যও।

কে বাঁচিতে চায়

স্বাধীনতা দিবসের ছুটি পড়েছে রবিবার। ৭৫ বছরে এ কী দাগা দিলেন ভারতভাগ্যবিধাতা, শোকে মুহ্যমান সোশ্যাল মিডিয়া। অবশ্য রসিকতাও কম পড়েনি। কম্পিউটারের কারিকুরিতে গাড়ির পিছনের আধখানা মুছে, সেই ছবি সেঁটে লিখছেন কেউ, এই নিয়েই বেরোব কাল, তেলের যা দাম! আবার অন্য কেউ: বড় বড় দোকানগুলো জব্বর স্বাধীনতা-ছাড় দিচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী তো স্বাধীনতার ৭৫ বছরে কাল অন্তত পেট্রলে ৭৫ টাকা ছাড় দিতে পারতেন! এক দিনের মুক্তি!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement