কলকাতা যে কেমন লাগবে, ভেবে শিহরন হয়েছিল তাঁর। ‘এস এস মোম্বাসা’ জাহাজে, ডায়েরিতে মার্গারেট এলিজ়াবেথ নোবল লিখেছিলেন সে কথা। কলকাতা ডকে জাহাজ ভিড়ল ২৮ জানুয়ারি ১৮৯৮, তাঁকে অভ্যর্থনায় উপস্থিত স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দ, তাঁর বন্ধু ও গুরু, কিছু দিন আগেই যাঁর চিঠিতে এসেছে আশ্বাস ও আহ্বান: ভারতের কাজে, বিশেষত ভারতের মেয়েদের কাজে, প্রয়োজন এক ‘সিংহিনী’র। সাহেবপাড়া পার্ক স্ট্রিট, সেখানেই এক বাড়িতে প্রথম ওঠা। চিঠিতে বন্ধুকে সে বাড়ির নকশা এঁকে, লিখেছেন বর্ণনা: ছোট্ট বেডরুমেরও আট দরজা, বাথরুমের দুটো, সে বাথরুমে টিনের পাত্র বা স্পঞ্জ রাখা, ব্যবস্থা দেখে মনে হয়েছিল এ যেন রাজপথে চারমাথার মোড়ে দাঁড়িয়ে স্নানের শামিল।
যেখানেই গেছেন— দক্ষিণেশ্বরে, বা বাগবাজারে সারদা দেবী-সাক্ষাতে, বিবেকানন্দ সঙ্গে আলমোড়া-কাশ্মীর বা ১৬ নং বোসপাড়া লেনে নিজের ঘরটিই— লিখে রেখেছেন অনুপুঙ্খ। বাগবাজারের এ বাড়িতেই থাকা, এ বাড়িতেই গড়ে উঠল স্কুল। এ স্কুল মেয়েদের, তাঁরও— ভগিনী নিবেদিতারও। কায়মনোবাক্যে তখন তিনি ভারতের। বাংলার। কলকাতার। এই শহরের এক ছোট্ট ঘরে বসেই লেখালিখি— বই, পত্রপত্রিকার। মেয়েদের ক্লাস নেওয়া। এখানেই আসতেন মান্যগণ্য কত জন। ১৮৯৯-এর মার্চে কলকাতায় লাগল প্লেগ, রামকৃষ্ণ মিশনে সেবা ও ত্রাণকাজের তত্ত্বাবধায়কও নিবেদিতা। রাধাগোবিন্দ তথা আর জি কর লিখে গেছেন বাগবাজারের প্রতিটি বস্তিতে সেই করুণাময়ীর উপস্থিতির কথা। রোগীর চিকিৎসার খরচ মেটাতে নিজের দুধ-ফলের খরচা থেকে অনায়াসে দুধটুকু বর্জনের কথা।
শুধু জীবন নয়, মহাজীবন এ এক। সর্বার্থে সার্থকনামা, ভারতের জন্য, মানুষের জন্য নিবেদিতা এই জীবনবৃত্তান্ত ধরা আছে শঙ্করীপ্রসাদ বসু, প্রব্রাজিকা আত্মপ্রাণা, লিজ়েল রেমঁ-সহ বহু জনের কলমে, অনুবাদেও। আছে পাঁচ খণ্ডে দ্য কমপ্লিট ওয়ার্কস অব সিস্টার নিবেদিতা (প্রকা: অদ্বৈত আশ্রম)। ভগিনী নিবেদিতার (১৮৬৭-১৯১১) জন্মের সার্ধশতবর্ষ পূর্তির আবহেও প্রকাশিত বহু গ্রন্থ, পত্রিকা। সেই চর্চা ও স্মরণধারাতেই নবতম সংযোজন দক্ষিণেশ্বরের রামকৃষ্ণ সারদা মিশন কর্তৃক প্রকাশিত বই ওয়ান বার্নিং লাভ/ আ পিকটোরিয়াল বায়োগ্রাফি অব সিস্টার নিবেদিতা। ১২০ পৃষ্ঠার বইয়ের পাতায় পাতায় দুর্লভ ও সযত্নমুদ্রিত বহু ছবি; আলোকচিত্র, চিত্রকৃতি, চিঠি ও নথির প্রতিলিপি। নিবেদিতার স্মৃতিধন্য স্থান, ব্যক্তি ও ঘটনাবলি উদ্ভাসিত সনিষ্ঠ সম্পাদনায়। ইস্কুলে নিবেদিতার হাতে লেখা মেয়েদের পড়াশোনার রিপোর্ট কার্ড, বইয়ের পাণ্ডুলিপির পাতা, অবনীন্দ্রনাথের আঁকা ভারতমাতা নিয়ে লেখা নিবন্ধের প্রতিলিপি, ভারতের জাতীয় পতাকার বজ্রচিহ্নিত নকশা... ২৮ অক্টোবর নিবেদিতার জন্মদিনের আবহে এ এক অনবদ্য উপহার। ছবিতে ১৮৯৯ সালে হ্যারিংটন হোটেলের লেটারহেডে নিবেদিতার হস্তাক্ষরে স্বামী বিবেকানন্দের বলা কথার নোট।
কীর্তনপ্রাণ
বাল্যে তবলা বাজাতেন কৃষ্ণচন্দ্র দে-র সঙ্গে, বালকের ধুতি সামলাতেন মান্না দে। অভিজ্ঞতার ঝুলিতে ইন্দুবালা-আঙুরবালার কাছে গান শেখা; চিত্তরঞ্জন দাশের কন্যা অন্নপূর্ণা দেবীর সঙ্গে সঙ্গত, রাধারানি দেবীকে গান শেখানো, সঙ্গীতপথে পদচারণার আশ্চর্য বৃত্তান্ত। গায়ক, মৃদঙ্গবাদক দুই ভূমিকাতেই অনায়াস যাতায়াত, পদাবলি কীর্তন প্রাণ ছিল পণ্ডিত নিমাই মিত্রের (১৯৩৩-২০২১)। নন্দকিশোর দাস, রাধারমণ কর্মকার, ব্রজেন সেন প্রমুখের কাছে শিখেছেন, আসরে (ছবিতে) গেয়েছেন প্রায় আট দশক। সঙ্গ করেছেন রামদাস বাবাজি, মহানামব্রত ব্রহ্মচারী, আনন্দময়ী মায়ের। বাংলার অসংখ্য কীর্তনীয়া ও বাদক তাঁরই হাতে গড়া, প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কীর্তনচর্যাশ্রম। কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রকের সিনিয়র ফেলোশিপ-সহ নানা সম্মানে ভূষিত বর্ষীয়ান এই শিল্পী প্রয়াত হলেন গত ১৭ সেপ্টেম্বর।
জল-কথা
পৃথিবীর তিন ভাগ জলের বেশিটাই নোনা। বাকি ২.৮ ভাগ জলের অনেকটাই আসে খাল, বিল, নদী, নালা থেকে। অথচ, মানুষ নির্বিচারে সে সব বুজিয়ে চলেছে। পশ্চিমবঙ্গও ব্যতিক্রম নয়। ট্রেন শহর ছাড়াতে পথের ধারে সঙ্গী ছোট-মাঝারি জলাশয়, সেই চেহারাতেও বদল ইদানীং। বুজে আসছে রামসার সাইট, পূর্ব কলকাতার জলাভূমি অঞ্চলও। আশার কথা, মানুষ জলাভূমি বোজানোর বিরুদ্ধে এখন একজোট হচ্ছেন। যেমন, উত্তর দমদম পুরসভার ঋষি অরবিন্দ পার্ক কল্যাণ সংসদ-এর উদ্যোগে প্রকাশিত হয়েছে দি ওয়েটল্যান্ড বিরাটি নামে এক স্মরণিকা। তাতে এই অঞ্চলের ৬৬ কাঠা এবং ৩১ কাঠার দু’টি জলাশয়কে রক্ষার জন্য দীর্ঘ ২৮ বছরের নাগরিক সংগ্রামের তথ্যসমৃদ্ধ কাহিনি। এমন বিন্দু বিন্দু থেকেই তো সিন্ধু তৈরি হয়। নাগরিক উদ্যোগ ও সক্রিয়তার।
জরুরি কাজ
হিতেশরঞ্জন সান্যালের প্রয়াণের পর তাঁর গবেষণার কাগজ, ছবির সঙ্গে দুর্লভ ক’টি সাময়িকপত্রেরও ঠিকানা হয় কলকাতার সেন্টার ফর স্টাডিজ় ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস। তত দিনে সমাজবিজ্ঞান ও ইতিহাস গবেষণায় সাময়িকপত্রের মূল্য অবিসংবাদী, অথচ তাদের সংরক্ষণে ব্যাপক উদ্যোগ ছিল না। ১৯৯৩ থেকে মাইক্রোফিল্ম ও পরে ডিজিটাল পদ্ধতিতে সংরক্ষণের কাজটি করে যাচ্ছে সেন্টারের আর্কাইভ, সাময়িকপত্রের সঙ্গে জুড়েছে ছবি, বই ও পুঁথি। প্রায় তিন দশকের চেষ্টায় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ লাইব্রেরি, নৈহাটি বঙ্কিমভবন-সহ বালি, কোন্নগর, চন্দননগর, শান্তিপুর, গুপ্তিপাড়া, মেদিনীপুর, বীরসিংহ, ফুলিয়ার পুরনো গ্রন্থাগার ও প্রতিষ্ঠানে রক্ষিত পুঁথি, বই, সংবাদ ও সাময়িকপত্রের ডিজিটাল সংরক্ষণ হয়েছে, কাজ হয়েছে অসমিয়া, নেপালি, হিন্দি, উর্দু, পালি, ফারসি, ওড়িয়া পুঁথি, বই ও সাময়িকপত্র নিয়েও। আর্কাইভের এই অমূল্য সম্ভারের বহুলাংশ আন্তর্জাল-পরিসরে পড়তে পারেন যে কেউ, বিনামূল্যে। আন্তর্জাল গ্রন্থাগারের বিকল্প নয়, কিন্তু গ্রন্থাগারে রক্ষিত বিরল পুঁথির ডিজিটাল প্রতিরূপ বিশ্বের পাঠকের কাছে পৌঁছনোর ব্যাপারটাই আলাদা। বিশেষত এই অতিমারিকালে।
সার্ধশতবর্ষে
‘বলো বলো বলো সবে’ বা ‘উঠ গো ভারত-লক্ষ্মী’, একদা তাঁর গানেই বাঙালি দেশবন্দনার পাঠ নিয়েছিল। ‘মোদের গরব মোদের আশা’ উদ্বুদ্ধ করেছিল ভাষাচেতনায়। কবি, গীতিকার অতুলপ্রসাদ সেনের (১৮৭১-১৯৩৪) জন্মের সার্ধশতবর্ষ পূর্ণ হল গত ২০ অক্টোবর। রামমোহন রায় ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল স্টাডিজ়-এর উদ্যোগে আন্তর্জাল আলোচনা ও সঙ্গীতানুষ্ঠান হল সে দিন, বিশিষ্টজনের অংশগ্রহণে। সন্ধ্যায় সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের উদ্যোগে বিধান সরণির সমাজমন্দিরেও হল অতুলপ্রসাদ-স্মরণ। প্রথম অনুষ্ঠানটি এখনও দেখা যাবে ইনস্টিটিউট-এর ফেসবুক পেজে।
পোস্টারে ইতিহাস
এ পার-ও পারের বেড়া ভেঙে গেলে যে ভুবন ধরা দেয়, তার কোনও সীমা নেই— অপার। কাঁটাতারের ও পারে বাংলা ভাষা বা বাংলাদেশের জন্য যে লড়াই, এ পারও কি তাতে নেই? দুইয়ের সম্পর্ক নিবিড় বললে ভুল হয়, তারা একই দেশের জমি, একই ভাষাভাষী। মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছরে কলকাতার ‘পোস্টার ওয়ার্কশপ’ দল গান-কবিতা-পোস্টার জড়ো করে, তা থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজেরাই বানিয়ে ফেলেছে নতুন নতুন পোস্টার। দুই বাংলার বহু শিল্পীর সৃষ্টিতে রঙিন হয়ে উঠেছে ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ সংগ্রামী ইতিহাস। ১৯৫০-৬০’এর দশকের রাজনৈতিক পোস্টারের খবর দেয় পোস্টারগুচ্ছের সঙ্গে প্রকাশিত রফিকুন নবীর প্রবন্ধ। সে ইতিহাস অন্য ভাবে ধরেন শুভেন্দু দাশগুপ্ত, আগাগোড়া হাতে লেখা তাঁর দীর্ঘ রচনায়। মুক্তিযুদ্ধের ৫০— অপার বাংলার পোস্টার নামে পুস্তিকাটি বাণিজ্যিক নয়, একেবারে সকলের জন্য— আন্তর্জালে ছড়িয়ে পড়ছে হাতে-হাতে। পোস্টারের ধর্ম তা-ই, মাঠে-ঘাটে-দেওয়ালে-রাস্তাতেই খুশি। নীচের ছবিতে নতুন ও পুরনো তিনটি পোস্টার, পুস্তিকা থেকেই নেওয়া।
আনন্দের ভাষা
গোটা ছবি পদ্যে বানিয়ে ফেলা যায়, হীরক রাজার দেশে-র দর্শককুল বিস্ময়ে বিভোর। লালমোহনবাবুর মুখে ‘তং মত করো’ বা ‘এটা আ-মা-র’ বাঙালির মুখে-মুখে ফেরে আজও। সত্যজিৎ শুধু ফিল্মনির্মাতা নন, ভাষাশিল্পীও— ফেলুদা বা শঙ্কুকাহিনিতে শব্দ ব্যবহারের ফারাক সচেতন নজর এড়ায় না। ভাষার দিক থেকে সত্যজিৎকে নিয়ে ভেবেছেন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের পড়ুয়ারা, ‘সত্যজিৎ রায়ের ভাষা’ আন্তর্জাল-আলোচনায় উঠে এল সত্যজিৎ-কৃতির আনন্দের সেই ভাষা। ভাষাবিজ্ঞানের প্র্যাগম্যাটিক্স, সোশিয়োলিঙ্গুয়িস্টিক্স, রেটরিক তত্ত্বের আলোয় পড়ুয়ারা ছানবিন করলেন ফেলু-কাহিনি, চারুলতা, সত্যজিতের উপেন্দ্রকিশোর-অনুবাদ ইত্যাদি।
স্মৃতির শহর
সরকারি দুধের গাড়ি এসে সকালে ঘুম ভাঙাত শহরের। কার্ডে সই করতে করতে দুধের বোতল এগিয়ে দিতেন যে মেয়েরা, তাঁদের এক জন অনেকটা অংশ জুড়ে ছিলেন মৃণাল সেনের ইন্টারভিউ ছবিতে। হরিণঘাটার সেই দুধের বোতল আনতে ভোরে দুধের ডিপোর সামনে লম্বা লাইন পড়ত। কত বদলেছে কলকাতা, পুঞ্জিত স্মৃতি থেকে তুলে এনে মনে করালেন পিউ মহাপাত্র। শান্তিনিকেতনের কলাভবনের ছাত্রী, ছবি আঁকেন, শিল্পের শিক্ষক ও আলোচক। তাঁর আঁকা-লেখায় আশ্চর্য বই লেটার টু মাইসেল্ফ, প্রকাশক দিল্লির ‘ব্লু পেনসিল’। একটা বাক্সের ভেতর হলুদ রঙের অনেকগুলো পোস্টকার্ড, তাতে হারানো কলকাতার নানান অনুষঙ্গ, ফেলে আসা প্রান্তিক মানুষজনের স্মৃতি। লিখেছেন যেমন পিউ, তেমন এঁকেছেনও— পুরনো দশ পয়সা, দেশলাই কাঠি, রেশন কার্ড, দুধের বোতল (সঙ্গের ছবি)। যেন ম্যাজিক বাক্সে স্মৃতির শহর।
লক্ষ্মীবাবু
শুরুতে নিশ্চয়ই ছিল লক্ষ্মীবাবুর সোনা-চাঁদির দোকান কোনও। পরে এক নামে বহু দোকানের উদ্ভবে আলাদা করে প্রয়োজন হয় ‘আসল’ লক্ষ্মীবাবুর দোকানের পরিচিতি। দিনে দিনে এক দাবি নিয়ে অনেকের উত্থানে ‘লক্ষ্মীবাবু’-ই হয়ে উঠলেন এক ব্র্যান্ড। দক্ষিণের ভবানীপুর, বা পুবের মুনশিবাজারের মতো এলাকায় শুধু নামমাহাত্ম্যেই লক্ষ্মীবাবুর সোনার দোকান হয়ে উঠল কলকাতার নিজস্ব স্বাক্ষর। দেড় বা দুই শতকের প্রাচীনত্ব দাবি করা দোকানগুলিতে খোঁজ করলে মেলে ‘লক্ষ্মীনারায়ণ’ নামে একাধিক ব্যক্তির। বাঙালির সমৃদ্ধি সাধনার পথও তো লক্ষ্মী-নারায়ণের যুগল উপাসনাতেই। ‘ধনতেরস’-এর আগের যুগে সঞ্চয় বলতে যখন সোনা বা সোনার ধান বুঝত বাঙালি, সে সময় এ সব ছোট দোকানেই বাঁধা থাকত তার সঞ্চয়ের ঠিকানা। লক্ষ্মীবাবুর নামবাহী বহু দোকান আজ অতীত। বদলে গেছে পুরনো, আটপৌরে শহরটাও।