Kolkatar Karcha

কলকাতার কড়চা: ‘জুড়ায় দেখিলে মন তায়’

ক্ষুদ্র, অন্য রকম প্রয়াসেই হোক কিংবা বৃহত্তর বাজার স্তরে, এ বার দোলে আবির ফের স্বমহিমায় হাজির।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ মার্চ ২০২২ ১০:১৯
Share:

চিনাবাজারের আবির-সম্ভার। ছবি: অমিতাভ পুরকায়স্থ।

তখনও শহর হয়ে ওঠেনি কলকাতা। এখনকার ডালহৌসি অঞ্চলে ছিল সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের কাছারিবাড়ি। সেখানেই দু’টি মঞ্চে গোবিন্দ-শ্রীরাধিকার বিগ্রহ রেখে আবির খেলা হত দোলে। লাল হয়ে যেত দিঘির জল, যে স্মৃতি আজও ধরে রেখেছে ‘লাল দিঘি’ নামটা। পরে শহরের মূল উৎসব হিসেবে দুর্গাপুজো উঠে এলেও, আড়ম্বর জৌলুসে বহু কাল পাশাপাশিই থেকেছে দোল ও দুর্গোৎসব। আর সেখানে নায়কের আসন অলঙ্কৃত করেছে আবির। উনিশ শতকের কলকাতার দোলের বিবরণ দিতে গিয়ে ঈশ্বর গুপ্ত লিখেছেন, “যার ইচ্ছা হয় যারে, আবীর কুম্‌কুম্‌ মারে, পিচকারি কেহ দেয় কায়।/ উড়ায় আবীর যত, কুড়ায় লোকেতে কত, জুড়ায় দেখিলে মন তায়।”

Advertisement

সে কালে দোলে শোলার ছোট গোল নুটি বানিয়ে তার মধ্যে আবির ভরে ছোড়া হত, জানিয়েছেন মহেন্দ্রনাথ দত্ত। তিনিই জানিয়েছেন ‘ম্যাজেণ্ডার’ বা ‘ডাই’ গোত্রের রং এসে দোলের শৌখিন আনন্দ মাটি করার কথা। এ কালের বাজারচলতি বাঁদুরে রং বুঝি সেই ‘অধোগমন’-এরই ফল। তবে দোলের আবিরের নিজস্ব অস্তিত্ব উধাও হয়নি কখনওই, বিশেষত ধর্মীয় অনুষঙ্গে। উপাদানের অপকর্ষে অবশ্য আবিরের গুণমান নিয়েও কথা উঠেছে। গত এক দশকে সে ছবি অনেকটা বদলেছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় তৈরি পরিবেশবান্ধব আবির তথা ‘হার্বাল’ আবিরের সৌজন্যে। কলকাতার বাজারে চাহিদানুযায়ী এই আবিরের সিংহভাগ অবশ্য আসে উত্তরপ্রদেশের হাথরস ও ছত্তীসগঢ়ের রায়পুর থেকে, জানালেন চিনাবাজারের বিক্রেতা ধর্মেন্দ্র খারওয়াড়।

করোনা পরিস্থিতিতে গত দু’বছর শমিত ছিল দোল উদ্‌যাপন। এ বার জীবন স্বাভাবিক হওয়ার পথে, আবিরের বিকিকিনিও ফিরছে পুরনো ছন্দে। চিনাবাজারের পাইকারি দোকান, জানবাজারের খুচরো পসরায় ভিড় সে কথাই বলছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে বাড়তে থাকা স্বাস্থ্য-সচেতনতার প্রভাব দেখা যাচ্ছে ফুল থেকে তৈরি হার্বাল আবিরের কেনাবেচায়। বিভিন্ন ব্র্যান্ডের এই আবিরের দাম একটু বেশি হলেও বিক্রি হচ্ছে ভালই। ছোটদের কথা মাথায় রেখে ‘ফুড গ্রেড’ উপাদান দিয়েও আবির তৈরি হচ্ছে কলকাতাতেই। নাগেরবাজার ষাটগাছি বটতলার সুজাতা দাস কর্নফ্লাওয়ারের সঙ্গে বিট, কাঁচা হলুদ, অপরাজিতা ফুল ও পালং শাক ইত্যাদি ব্যবহার করে যথাক্রমে লাল, হলুদ, নীল ও সবুজ রঙের আবির তৈরি করছেন, ছোটদের মুখে চলে গেলেও কোনও ক্ষতি হবে না এই আবিরে। ছোট ছোট প্যাকেটে ভরা, চন্দনগুঁড়োর ব্যবহারে সুরভিত এই আবিরের চাহিদা বন্ধু-পরিচিতবৃত্তে ভালই। ক্ষুদ্র, অন্য রকম প্রয়াসেই হোক কিংবা বৃহত্তর বাজার স্তরে, এ বার দোলে আবির ফের স্বমহিমায় হাজির। সবার রঙে রং মেশানোর উৎসবে বর্ণিল হয়ে উঠবে মহানগরের সপ্তাহান্ত।

Advertisement

শতবর্ষী

যাদবপুর থেকে তারুণ্য চিরতরে বিদায় নিল, তাঁর অবসর গ্রহণের দিন বলেছিলেন শঙ্খ ঘোষ। ছাত্রদের মুশকিল আসান ছিলেন তিনি, হিমেন্দু বিশ্বাস— যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন অব স্টুডেন্টস; ছাত্র, শিক্ষক, কর্মী সবার ‘বিশ্বাসদা’। সিলেটের হবিগঞ্জের জমিদার পরিবারের ছেলে, লোকসঙ্গীত ও গণসঙ্গীত জগতের দিকপাল হেমাঙ্গ বিশ্বাস তাঁর অগ্রজ। ’৪৩-এর মন্বন্তর দেখেছেন, ’৪৬-এর দাঙ্গাও— আগামী কাল ১৩ মার্চ ছোঁবেন শতবর্ষের মাইলফলক। তাঁকে নিয়েই তৈরি বিবেক গুহ সম্পাদিত বই শতবর্ষে যাদবপুরের বিশ্বাসদা (ছবিতে), লিখেছেন অমিয় দেব সৌরীন ভট্টাচার্য পবিত্র সরকার অশোক মুখোপাধ্যায় সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় মৈনাক বিশ্বাস অরিজিৎ বিশ্বাস শান্তনু চক্রবর্তী শর্মিষ্ঠা দাশগুপ্ত প্রমুখ। আগামী কাল সন্ধ্যা ছ’টায় যাদবপুরের ত্রিগুণা সেন মেমোরিয়াল হল-এ বইটি উদ্বোধন করবেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, থাকবেন সুরঞ্জন দাস।

স্মরণে

হঠাৎই মারা গেলেন পল ফার্মার, গত ২১ ফেব্রুয়ারি। আমেরিকার হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে ‘ইউনিভার্সিটি প্রফেসর’ ছিলেন তিনি— একাধারে চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও নৃতত্ত্ববিদ। বহু বই, প্রথম সারির অসংখ্য গবেষণাপত্রের লেখক, মহাপণ্ডিত, এই সব পরিচয়ের ঊর্ধ্বে গোটা পৃথিবী তাঁকে মনে রাখবে চিকিৎসাবিজ্ঞানকে যথাযথ রাজনীতির চশমায় দেখার অত্যাশ্চর্য ক্ষমতার জন্য। পশ্চিম আফ্রিকায় ইবোলা মহামারির কারণ সন্ধান করতে গিয়ে ফার্মার দেখিয়েছিলেন, রোগের আসল শিকড় আসলে দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসনের ফলে ধ্বস্ত জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থায়। আজীবন জনস্বাস্থ্যের গুরুত্বের কথা বলেছেন ফার্মার, বলেছেন সব মানুষের বেঁচে থাকার সমান অধিকারের কথা। কাজের মানুষটিকে স্মরণ করল এ শহরও, গত কাল অবনীন্দ্র সভাঘরে লিভার ফাউন্ডেশন আয়োজিত অনুষ্ঠানে। বললেন অচিন চক্রবর্তী, স্থবির দাশগুপ্ত ও অভিজিৎ চৌধুরী, সঞ্চালনায় কুমার রাণা।

প্রতিবাদে, সম্মানে

বৃদ্ধা সোফিয়ার সঙ্গে অপেক্ষা করে আলিশা, তাহা, ক্যাথরিন, রোজ়, ইয়ানি... ওদের পরিবারের পুরুষেরা উধাও, রাষ্ট্রশক্তির সন্ত্রাসে। উপত্যকার নদীর খরস্রোত ফিরিয়ে দেয় একটা-দুটো পুরুষ লাশ, ক্রমে শান্ত সাধারণ মেয়েদের করে তোলে অসামান্য। ‘কল্যাণী নাট্যচর্চা কেন্দ্র’র সাম্প্রতিক প্রযোজনা নদীটা, এরিয়েল ডর্ফম্যান রচিত উইডোজ় অবলম্বনে, কলকাতায় প্রথম অভিনয় আগামী কাল ১৩ মার্চ সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায়, অ্যাকাডেমিতে। দুপুর ৩টেয় সেখানেই এরিয়েল ডর্ফম্যানের আর একটি নাটক অবলম্বনে মেয়েটি, দু’টিরই নির্দেশক কিশোর সেনগুপ্ত। অন্য দিকে গতকাল সন্ধ্যায় অ্যাকাডেমিতে ‘সায়ক’-এর আয়োজনে শিশিরকুমার বসু ও দীপঙ্কর সেনগুপ্ত স্মৃতি-সম্মান পেলেন যথাক্রমে চলচ্চিত্রকার গৌতম ঘোষ ও মঞ্চ-পরিকল্পক বিলু দত্ত। সঙ্গে ছিল নাটক পাড়ুই মশা’র বিষয়আশয়, মেঘনাদ ভট্টাচার্যের নির্দেশনায়।

স্বাদ-সাহিত্য

ছয় খণ্ডের একটি বই-সিরিজ়, ফুডপ্যাথি। প্রতিটি প্রচ্ছদেই এক মুড়িমাখাওয়ালা, পশ্চাৎপটে পাল্টে পাল্টে যাওয়া রঙে-রেখায় খাদ্যসন্ধানী নগরভিড়। গ্রন্থনাম, আর স্মারক রায়ের করা প্রচ্ছদ-অলঙ্করণই বুঝিয়ে দেয় বিষয়— পথঘাটের স্বাদ-সাহিত্য। স্ট্রিট ফুড বা পথখাবারের হাতে-গরম সন্ধান সমাজমাধ্যমে কম নয়, কিন্তু সেখানে যার অভাব, বর্ণনার সেই প্রসাদগুণ ও সরস সরেস আলোচনা সম্পদ এই বইগুলির। ‘৯ঋকাল বুকস’ প্রকাশিত, সামরান হুদা ও দামু মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত এই গ্রন্থমালায় সারা পৃথিবীর, ভারতের আর দুই বাংলার পথের খাবার নিয়ে রোচক বহু লেখার ঠাঁই। উৎসর্গপত্রও অনন্য: পাইকপাড়া থেকে শাহবাগ, কাশী, বেঙ্গালুরু, ইয়াঙ্গন, লন্ডনের পথখাদ্যপুরোধাদের প্রতি নিবেদিত।

পথের গল্প

স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে নগরায়ণের যাত্রা ধরা আছে শহরের পথনামের মধ্যে। সেই ইতিহাস ধরে রাখায় একটা বড় কাজ পি টি নায়ারের বই আ হিস্ট্রি অব ক্যালকাটা স্ট্রিটস। বাংলায় তা অনুবাদ করেন তৎকালীন সিএমডিএ-তে কর্মরত কমলা বন্দ্যোপাধ্যায়। যোগ করেন নিজ গবেষণালব্ধ তথ্য: পথনামের বর্ণানুক্রমিক বিন্যাস সরিয়ে এনেছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী, বিদ্বান, কবি, পথিকৃৎ, বিচারপতি, বরণীয় স্মরণীয় ভিন্‌দেশি মানুষ-সহ বহু উপবিভাগ, প্রাধান্য দিয়েছিলেন নারীদেরও। অনুবাদক-গবেষকের অকালপ্রয়াণে থেমে গিয়েছিল বইয়ের কাজ, পড়ে ছিল পাণ্ডুলিপি। দীর্ঘ বিরতির পরে সম্প্রতি প্রকাশিত হল সেই বই, কলকাতার রাস্তার গল্পকথা (প্রকাশক: প্যাপিরাস)। কলকাতা-অনুসন্ধিৎসুদের কাজে লাগবে।

বৃক্ষকথা

সোমবারের দুপুরে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের প্রধান দ্বারে জনা পনেরো-কুড়ির উৎসুক জমায়েত। শুধু দুধসাদা স্মৃতিসৌধটিরই নয়, ৫৭ একরের বিরাট এই উদ্যান জুড়ে ছড়িয়ে থাকা গাছেদেরও আছে কত ইতিহাস, গল্পকথা। এদের চেনাতেই ‘নেচার ট্রেল’-এর আয়োজন করেছেন কর্তৃপক্ষ, সেটিই শুরু হল গত ৭ মার্চ। ছোট্ট দলটিকে দেখানো হল নানা গাছ— শিশু, হরিতকী, লটকন, নাগলিঙ্গম, নিশিপদ্ম, কাজুবাদাম, কর্পূর গাছ, ব্যাডমিন্টন বল ট্রি, বোলা ট্রি, বুদ্ধ নারকেল, মালবেরি, সসেজ ট্রি, আরও কত কী। প্রায় ৭.২ মিটার বেড়ের বিশাল গুঁড়িওয়ালা, কোস্টারিকার জাতীয় গাছটি বিপুল ছায়া মেলে ধরেছে উদ্যানের এক কোণে, লালের আগুন ঝরাচ্ছে ঋজু আফ্রিকান টিউলিপ, গলগলি গাছের ফাঁক দিয়ে ঝলসাচ্ছে দূরের ভিক্টোরিয়া (ছবিতে), কোথাও মগডালে বা পাতার আড়ালে খানিক জিরিয়ে নিচ্ছে চিল আর কণ্ঠি ঘুঘু। এই গাছেদের দেখে প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতি আরও একটু সংবেদনশীল হোক মানুষ, সেটাই উদ্দেশ্য। প্রতি সোমবার ভিক্টোরিয়ার গাছেদের নিবিড় সাক্ষাতের সুযোগ পাবে শহর। বিশদ তথ্য ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, কলকাতা-র ফেসবুক পেজে।

না-দেখা ছবি

প্রবীণ শিল্পী রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আঁকা ছবির প্রদর্শনী আগেও দেখেছে এ শহর, তবে এ বারের ব্যাপারটি আলাদা। গতকাল ১১ মার্চ থেকে দেবভাষা বই ও শিল্পের আবাসে শুরু হল তাঁর চিত্রসম্ভার নিয়ে যে প্রদর্শনীটি, সেই ছবিগুলির কোনওটিই আগে কখনও কোনও প্রদর্শনীবদ্ধ হয়নি। ১৯৯৯ সাল থেকে ২০২২, দুই দশকেরও বেশি সময়পর্বে আঁকা ৯২টি চিত্রকৃতিতে (সঙ্গের ছবিতে তারই একটি), রঙে-রেখায় সৌন্দর্যের শৈল্পিক অনুসন্ধান— প্রদর্শনীর নামও ইন সার্চ অব বিউটি। বসন্তের আগমনে প্রতি বছর চিত্রপ্রদর্শনীর আয়োজন করে থাকে দেবভাষা, করে রঙের উদ্‌যাপন। গতকাল সন্ধ্যায় উদ্বোধন হল প্রদর্শনীর, চলবে আগামী ২৮ মার্চ পর্যন্ত, মঙ্গলবার বাদে রোজ দুপুর আড়াইটা থেকে রাত সাড়ে ৮টা।

কবিতার জন্য

কবিতার সঙ্গে কলকাতার প্রেম চিরকালের। কবিতা উদ্‌যাপনে এ বার এ শহর ডেকে নিচ্ছে দেশ-বিদেশের নানা শহরকেও। ১১-১২ জুন মহানগরে হবে ‘কলকাতা পোয়েট্রি কনফ্লুয়েন্স’, কবিতার ভাষান্তর ও রূপান্তর নিয়ে সম্মেলন, ইজ়েডসিসি-তে। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার কবিরা আসবেন কবিতা শোনাতে। কবিতা উদ্‌যাপন হবে নাটকে, গানে, বাচিক শিল্পের মাধ্যমে। থাকবে কবিতা নিয়ে স্বল্পদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র, কবিতার বইমেলা, আলাপচারিতা। এখনও সময় বাকি কিছু, তবে এরই মধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছে কবিতার ভাষান্তরের কাজ। দি অ্যান্টোনিম পত্রিকা ও ভাষা সংসদ-এর যৌথ উদ্যোগে চলছে দশটি ভারতীয় ভাষার কবিতা অনুবাদের প্রতিযোগিতা। ইংরেজি ও বাংলায় অনুবাদের জন্য রয়েছে পুরস্কারও। শুধু কবিতার জন্য এত আয়োজন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement