Old kolkata

ঋদ্ধ ঐতিহ্যের মহানগরী

নির্দিষ্ট বছর ও তারিখ উল্লেখে কি কলকাতার নগর পত্তনের কথা বলা যায়? তবু, সতেরো শতকের দ্বিতীয়ার্ধ নগর-বসতির শুরুর কাল।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০২১ ০৪:৪৮
Share:

ছবি: রাজীব দে

ঠিক দুশো বছর আগে এক বৈশাখেই খবর হয়েছিল শহরের নগরায়ণ। ১২২৮ বঙ্গাব্দের ৩ বৈশাখে সমাচার দর্পণ-এ ছাপা হয়, “কলিকাতা শহরের যে সংস্থান পূর্ব্বে ছিল তাহাহইতে এইক্ষণে রাস্থা পুষ্করিণী দ্বারা অতিসুন্দর রাস্থা সংস্থান হইতেছে তাহা কোমিট্টীতে স্থির হইয়া প্রকাশ হইতেছে। এইক্ষণে যে রাস্থা আরম্ভ হইয়াছে সে জানবাজারে আরম্ভ হইয়া ধর্ম্মতলা পর্য্যন্ত মিলিত হইবেক।” আজ যে ধর্মতলাকে কেন্দ্র করে রাস্তার নীচ দিয়ে পাতাল রেলের গঙ্গা পেরিয়ে পশ্চিম পারে চলাচলের কাজও চলছে। ১৮২৬ সালে শুরু হয়েছিল কলকাতা থেকে চুঁচুড়া পর্যন্ত স্টিমার যাতায়াত। ঐতিহ্য কি শুধু রাস্তা, ঘাট, ইমারত, মন্দির, মসজিদ, গির্জা? সময়ের ধারায় আমাদের দেখা ও ভাবনাতেও এসেছে নানা পরিবর্তন।

Advertisement

নির্দিষ্ট বছর ও তারিখ উল্লেখে কি কলকাতার নগর পত্তনের কথা বলা যায়? তবু, সতেরো শতকের দ্বিতীয়ার্ধ নগর-বসতির শুরুর কাল। আঠারো শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে উনিশ শতক জুড়ে স্থাপত্য ইমারত হিসেবে রাইটার্স বিল্ডিং (ছবিতে এই ভবনের ছাদে ব্রিটিশ ভাস্কর্য), রাজভবন, বেলভেডিয়ার হাউস, টাউন হল, এশিয়াটিক সোসাইটি, ভারতীয় সংগ্রহালয়-এর মতো বহু প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে, সঙ্গে ব্যক্তি মালিকানাধীন ইমারতও। বদলে যেতে থাকে শহরের বিন্যাস। প্রাচীনত্বের হিসাবে কলকাতাকে খুব পুরনো বলা যাবে না, বাংলার অনেক মফস্‌সল শহর বরং প্রাচীনতর। তবু বিদেশি চমকে পরিবর্তনের ধারা বইতে লাগল। গ্রামবাংলা থেকে বিত্তশালীরা নতুন নগরে আকৃষ্ট হলেন। সমৃদ্ধির যাত্রায় বসতি গড়লেন তন্তুবায়, পটুয়া, কুম্ভকার, অলঙ্কার শিল্পী, মালাকার, শঙ্খবণিক, কংসবণিক, কর্মকার, সূত্রধার, বাঁশ-বেতের কারিগর, মৎস্যজীবীরা। আঠারো শতক থেকে নতুন বসতি গড়ে ওঠা।

আজকের মহানগরীর ভাঙা-গড়ার ইতিহাস জড়িয়ে আছে প্রায় তিনশো বছরের স্থাপত্য গড়ে ওঠায় নয়— রাস্তাঘাট, যানবাহন, জলা-জঙ্গল, গাছপালা, পশুপাখি, দেবদেবী, মেলা-উৎসব, খাদ্যাভ্যাসে, সর্বোপরি বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ইতিহাসেও। কলকাতার চৌহদ্দি পশ্চিমে গঙ্গা নদীর প্রবাহ ঘেরা, তাই উত্তর-দক্ষিণেই মূল বিস্তৃতি ঘটেছে। উনিশ শতকের শেষের তথ্যেও আছে, বালিগঞ্জ থেকে মাটির কলসি আমদানি হত কলকাতায়। তার একশো বছর আগেই চিৎপুর থেকে কালীঘাট পর্যন্ত প্রসারিত রাস্তা ছিল। এ পথেই আদি কলকাতার উপর দিয়ে সুতানুটি থেকে বনপথ ধরে তীর্থযাত্রীরা পৌঁছতেন গোবিন্দপুর ছাড়িয়ে কালীঘাট। সময়ের হিসাবে থাকে নানা প্রামাণ্য উপকরণ। দমদম ঢিবি উৎখননে বৃহত্তর কলকাতার প্রাচীনত্ব খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক অবধি পাওয়া যাচ্ছে। বাংলা গদ্যসাহিত্যের ভিত্তি যখন সুপ্রতিষ্ঠিত নয়, সেই উনিশ শতকের মাঝামাঝি পুরনো কলকাতার মন্দিরে ছন্দে লেখা প্রবেশবিধি: “নিষেধ বিধি কহি কিছু সভার আগেভাগে।/ গাড়ি পালকি ঘোড়া গজাদি নিষেধ আগে।” গতকাল ১৮ এপ্রিল ছিল বিশ্ব হেরিটেজ দিবস, সেই আবহে মহানগরীর সচল সংস্কৃতির বহুবিধ উপাত্তে মিলেমিশে থাকা উত্তরাধিকারের সংরক্ষণ নিয়ে আর একটু ভাবা যায় না?

Advertisement

গ্রন্থশিল্পী

সত্যজিৎ রায় কিছু পুরনো বই ফের বাঁধাই করাতে চান, কাজ হবে তাঁর বাড়িতেই। এক্ষণ পত্রিকার সম্পাদক নির্মাল্য আচার্য বিশপ লেফ্রয় রোডের বাড়িতে নিয়ে গেলেন নারায়ণচন্দ্র চক্রবর্তীকে। তাঁর নিখুঁত বাঁধাইকর্মে মুগ্ধ সত্যজিৎ লিখে দিলেন শংসাপত্র। প্রাক্তন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গাঁধীও রাজভবনের মূল্যবান বহু বই বাঁধানোয় ভরসা করেছিলেন তাঁকে। ১৯৬৭-তে সুবৃহৎ চেম্বার্স টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি ডিকশনারি-র ৫০,০০০ কপির অনন্য নির্মাণে যশস্বী নারায়ণবাবু (ছবিতে) রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পেয়েছেন দু’বার, ’৭৬-এ ট্রেন্ডস ইন হেমাটোলজি আর ’৭৯-তে হিস্ট্রি অ্যান্ড সোসাইটি বই নির্মাণের জন্য। গ্রন্থশিল্প ও বিপণন বিষয়ে ইংরেজি ও বাংলায় বহু প্রবন্ধ লিখেছেন, বলেছেন নানা শহরে। ২০১৬-তে আশি বছর উপলক্ষে তাঁকে সংবর্ধনা জানিয়েছিল অহর্নিশ পত্রিকা। আগামী ২৩ এপ্রিল বিশ্ব বই ও গ্রন্থস্বত্ব দিবস, কলকাতার বইপাড়া তাঁকে মনে রেখেছে বা তাঁর বাঁধাইশিল্পের ঘরানা আত্মস্থ করেছে, বলা যাবে না। সুদীর্ঘ কর্মজীবন থেকে অবসর নিলেন সম্প্রতি, খানিক অভিমানেই।

বাবাসাহেব

১৪ এপ্রিল ছিল ভীমরাও রামজি অম্বেডকরের (১৮৯১-১৯৫৬) ১৩০তম জন্মদিন— জ্ঞান দিবস ও সমতা দিবস রূপে যা উদ্‌যাপিত। দিনভর কলকাতা জুড়ে হল তাঁর জীবন ও কীর্তি স্মরণ। বৌবাজার থানা সংলগ্ন বৌদ্ধ ধর্মাঙ্কুর সভায় হল স্মরণ অনুষ্ঠান, কবি ও প্রতিনিধি সম্মেলন, অম্বেডকরের জীবনীগ্রন্থ প্রকাশ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান— অম্বেডকর ফাউন্ডেশন, বৌদ্ধ ধর্মাঙ্কুর সভা, তুহিনা প্রকাশনী, পিপল’স এডুকেশন সোসাইটি, অম্বেডকর কালচারাল কলেজ, অম্বেডকর বি এড কলেজ (বেথুয়াডহরি) এবং জয় ভীম ইন্ডিয়া নেটওয়ার্ক-এর সম্মিলিত উদ্যোগে। ভারতীয় জাদুঘরের আয়োজনে হল সাবিত্রীবাই ফুলে পুণে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বিজয় খারে-র বক্তৃতা। ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা প্রসঙ্গে বাবাসাহেব অম্বেডকরের ভাবনা, জাতীয় সংহতি ও গণতন্ত্র রক্ষায় তাঁর প্রণীত ধারাগুলির গুরুত্ব বোঝালেন বক্তা। অনুষ্ঠানটি দেখা ও শোনা যাবে ইন্ডিয়ান মিউজ়িয়াম, কলকাতা-র ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেলে।

স্মৃতি-আখ্যান

১৯৪০-৯০, গত শতকের এই দীর্ঘ সময়ব্যাপী ভারতীয় থিয়েটার ও তার শিল্পভাষার ক্রমবিবর্তনের ঐতিহাসিক মুহূর্তগুলিই তিনি ধরতে চেয়েছেন স্মৃতি-আখ্যানে, বলছিলেন ফয়সল আলকাজ়ি। ইব্রাহিম আলকাজ়ির পুত্র, অ্যালেক পদমসির ভাগ্নে ফয়সলের লেখা বইটির নাম এন্টার স্টেজ রাইট: দ্য আলকাজ়ি/ পদমসি ফ্যামিলি মেমোয়ার (স্পিকিং টাইগার)। ‘স্টারমার্ক কলকাতা’-র উদ্যোগে গত ১০ এপ্রিল এক আন্তর্জাল-অনুষ্ঠানে তাঁর সঙ্গে কথোপকথনে ছিলেন অধ্যাপক ও নাট্যবিশারদ আনন্দ লাল, লেখক ও শিক্ষাবিদ ফয়সলের দিল্লিতে প্রায় পঞ্চাশ বছরের নাট্যচর্চার সঙ্গে পরিচয় করালেন তিনি। চল্লিশের দশকের গোড়ায় স্বাধীনতা আন্দোলনের তীব্রতা বম্বের থিয়েটারে জন্ম দেয় এক নতুন সংস্কৃতির, হিন্দি-উর্দু-গুজরাতি-মরাঠি ও ইংরেজির সংমিশ্রণে তা-ই আস্তে আস্তে হয়ে ওঠে ভারতীয় থিয়েটারের বহুস্বর, বলছিলেন ফয়সল। আলোচনাটি শোনা যাবে স্টারমার্ক কলকাতা-র ফেসবুক পেজে।

উত্তরসত্য

এই সময়ের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিসরে একটি শব্দের বহুল ব্যবহার— ‘পোস্টট্রুথ’ বা ‘উত্তরসত্য’। উত্তরসত্য-যুগের বয়স এক দশকও নয় অথচ এরই মধ্যে তার পরাক্রমে প্রশ্ন উঠছে মানুষের সভ্যতার উত্তরাধিকার হিসেবে পাওয়া জ্ঞানপ্রণালী, বিচারবোধ, মূল্যবোধগুলির সারবত্তা নিয়ে। উত্তরসত্যের কারবারিরা শুধু মিথ্যা বা ক্ষতিকর ধারণাকেই মাথায় পুরে দেয় না, পাল্টে দেয় চিন্তার কাঠামোটাই, ভাবতে শেখায় একটা বিশেষ বিধ্বংসী ধাঁচে। তাদের কার্যকলাপ জাগায় সুদূরপ্রসারী উদ্বেগ ও ভয়। সমকালীন সমাজ ও রাজনীতি, এমনকি অর্থনীতিতেও উত্তরসত্যের উদ্ভব, তার গতিপ্রকৃতি ও প্রভাব নিয়েই লিখেছেন অধ্যাপক সুকান্ত চৌধুরী, ভাষা, অর্থ, সত্য (আনন্দ পাবলিশার্স) বইয়ে। সত্য ও মিথ্যার ভেতরের বিপ্রতীপ দূরত্ব ক্রমশ মুছে দিয়ে, মিথ্যাভাষণ বা ভাষার অপকৌশলে ক্ষতি সাধনের মধ্য দিয়ে কী করে শাসন করছে উত্তরসত্য, আমেরিকা থেকে ভারতের উদাহরণে আছে সেই পর্যালোচনাও।

সরোদে, স্মরণে

দক্ষিণ কলকাতার আশীষ খান স্কুল অব ওয়ার্ল্ড মিউজ়িক এই শহরে বাবা আলাউদ্দিন খাঁ-র সুরসাধনার ঐতিহ্য বহন করে আসছে শ্রদ্ধা ও সাধনায়, তাঁরই উত্তরাধিকারী ও শিষ্য উস্তাদ আশীষ খানের প্রচেষ্টায়। পদ্মবিভূষণ উস্তাদ আলি আকবর খানের জন্মশতবর্ষের শুরু এ বছর, গত ১৪ এপ্রিল তাঁর জন্মদিনে সেই উদ্‌যাপন হয়ে গেল রানিকুঠির রিজেন্ট পার্কের এই সঙ্গীত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। সকালে প্রতিষ্ঠানের প্রবেশদ্বারে বসানো হল বিশেষ ঐতিহ্য ফলক— জি এম কপূর, পণ্ডিত তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার, পণ্ডিত বিক্রম ঘোষ-সহ গুণিজনদের উপস্থিতিতে। দুপুর দুটো থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত হল মাইহার ঘরানার শিল্পীদের সরোদ সিম্ফনি কনসার্ট— পরিবেশনায় ছিলেন পণ্ডিত অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায়, পণ্ডিত প্রসেনজিৎ সেনগুপ্ত, পণ্ডিত রণজিৎ সেনগুপ্তের পাশাপাশি দীপ্তনীল ভট্টাচার্য, সিদ্ধার্থ বসু, ইন্দ্রায়ুধ মজুমদার, সৌগত রায়চৌধুরী, দেবাঞ্জন ভট্টাচার্যের মতো নবীনরা। কোভিড-বিধি মেনে উপস্থিত ছিলেন সঙ্গীতপ্রেমী শ্রোতারা। যাঁরা যেতে পারেননি তাঁরাও বঞ্চিত হবেন না এই অভিজ্ঞতা থেকে, ফেসবুকে ‘আশীষ খান স্কুল অব ওয়ার্ল্ড মিউজ়িক’ পেজে সযত্নে রক্ষিত প্রতিটি পরিবেশনা।

ধ্রুপদাঙ্গ কীর্তন

এশিয়াটিক সোসাইটিতে এক গবেষণা প্রকল্পে বাংলার কীর্তনের ইতিহাস নিয়ে কাজ শুরু। সেই গবেষণাই পরে পূর্ণতা পেল ভারত সরকারের রিসার্চ ফেলোশিপ প্রাপ্তিতে, ক্ষেত্রসমীক্ষায় কয়েক বার বৃন্দাবনে গিয়ে কলকাতার মেয়ে প্রকৃতি দত্ত আবিষ্কার করলেন, বৃন্দাবনের ‘সমাজ কীর্তন’-এ গাওয়া নানা পদে ধ্রুপদের মায়াময় সহাবস্থান। বারোটি ধ্রুপদাঙ্গ কীর্তন-পদের উপর গবেষণাপত্র জমা পড়ল সময়ের নিয়মেই, কিন্তু তার পর কী? বাবা, ভারতবিখ্যাত মূকাভিনয়শিল্পী যোগেশ দত্তের প্রেরণায় এ বছরের গোড়ায় সাতটি পদ রেকর্ড করেছেন প্রকৃতি। এ বার বিভিন্ন বৈষ্ণব উৎসব ও বাঙালি উপলক্ষ মাথায় রেখে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে প্রকাশ পাচ্ছে এক-একটি পদ। দোলের দিন প্রকাশ পেয়েছে গোবিন্দদাসের পদ জয় জয় যদুকুল জলনিধিচন্দ, আর নববর্ষে চণ্ডীদাসের পদ বঁধু কী আর বলিব আমি। আগামী দিনগুলিতে শোনা যাবে নরোত্তম দাস ঠাকুর, জয়দেবের পদ, বহুশ্রুত ভজ গৌরাঙ্গ কহ গৌরাঙ্গ-ও— ধ্রুপদ-ঘরানায়। ধ্রুপদাঙ্গ কীর্তনের সঙ্গে বড় প্রাপ্তি দেবশঙ্কর হালদারের সুচারু ভাষ্যপাঠ। দু’টি পদই শোনা যাবে প্রকৃতি দত্তের নিজের ও ‘পদাবলি’ ইউটিউব চ্যানেলে।

জীবনযুদ্ধ

নিজেকে ‘জেহাদি’, ‘সংগ্রামী’ বলতেই পছন্দ করে আবু ওসামা। তার স্বপ্ন সিরিয়ায় আইএস (ইসলামিক স্টেট)-এর জয়পতাকা ওড়ানো, দুই ছেলের নামও সে রেখেছে আল কায়দার দুই প্রধানের নামে। এই আবু ওসামার বাড়িতেই অতিথির বেশে ঢুকে পড়েন তালাল দেরকি। দামাস্কাস শহরের এক তথ্যচিত্র নির্মাতা তিনি, মৌলবাদ আর অন্ধবিশ্বাস কী করে দখল নেয় এক-একটি মন ও মানুষের আর ক্রমে তার পরিবার ও প্রতিবেশকেও, সেটাই বুঝতে চেয়েছিলেন চিত্রভাষে। আইএস-ভাবধারার সহমর্মী সাজতে হয়েছিল তালালকে, ছিল জীবনাশঙ্কা। ঝুঁকি নিয়েই দু’বছর ছিলেন আবু ওসামার বাড়িতে, সাক্ষী থেকেছেন জেহাদি সভা থেকে শিশুদের খেলাধুলো, উগ্র হিংস্রতা থেকে উষ্ণ পারিবারিকতা সব কিছুর। এই নিয়েই তৈরি অব ফাদার্স অ্যান্ড সন্স ছবিটি। সানডান্স থেকে মিউনিখ ছবি-উৎসবে আদৃত, জার্মান ফিল্ম অ্যাওয়ার্ডস-এ সেরা তথ্যচিত্রের পুরস্কার পাওয়া ছবিটি আন্তর্জালে দেখার সুযোগ ২১ এপ্রিল বুধবার সন্ধে সাড়ে ৬টায়, গ্যোয়টে ইনস্টিউট/ ম্যাক্সমুলার ভবন কলকাতার ‘ডকু-ফোরাম অনলাইন’ অনুষ্ঠানে। বিশদ তথ্য পাওয়া যাবে ইনস্টিটিউটের ফেসবুক পেজে।

নববর্ষের ছবি

চার বছর আগে, ১৪২৪ বঙ্গাব্দের বৈশাখ-শুরুর দিনটিতে পথ চলা শুরু ‘দেবভাষা’র। দেখতে দেখতে চার বছর পেরিয়ে এসেছে দক্ষিণ কলকাতার এই বই ও শিল্পের আবাস। সময়ের নিরিখে নবীন, যদিও তার প্রকাশনার বয়স পেরিয়েছে এক দশক। ২০১১ সালের জানুয়ারিতে কবি তুষার চৌধুরীর কবিতাবই প্রকাশের মধ্য দিয়ে প্রকাশনায় হাতেখড়ি, গত এক দশকে চিত্রকলা থেকে কবিতা, শিল্পতত্ত্ব থেকে স্মৃতিকথা-আত্মকথা, নানা বিষয় ও আঙ্গিক উঠে এসেছে দেবভাষা প্রকাশিত বইয়ে। বই আর শিল্প-প্রদর্শনী হাত ধরাধরি করে থাকে দেবভাষা-র ভাবনায়, নতুন বছরে নানাবিধ বই প্রকাশের পরিকল্পনার পাশাপাশি নববর্ষের সন্ধেয় শুরু হয়েছে ‘দেবভাষার জন্মদিনের চিত্রপ্রদর্শনী’। দেখা যাবে সোমনাথ হোর, রেবা হোর, বি আর পানেসর, যোগেন চৌধুরী, সনৎ কর, গণেশ হালুই, রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় (ছবিতে শিল্পীর একটি চিত্রকৃতি), বিমল কুণ্ডু, সুশোভন অধিকারী-সহ প্রবীণ-নবীন শিল্পীদের বিভিন্ন মাধ্যমে আঁকা ছবি। প্রদর্শনী ২৯ এপ্রিল পর্যন্ত, মঙ্গলবার বাদে রোজ দুপুর আড়াইটে থেকে রাত সাড়ে ৮টা, কোভিড-বিধি মেনে।

বরেণ্য

শিল্পের পীঠস্থান প্যারিসে পাড়ি দিয়েছিলেন খড়্গপুরের ছেলে, ভাস্কর্য নিয়ে পড়াশোনা করতে। বয়স তখন কুড়ির কোঠায়, স্বদেশ তখনও স্বাধীন নয়। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ইন্ডিয়ান সোসাইটি অব ওরিয়েন্টাল আর্ট-এর নিবিষ্ট শিক্ষার্থী, গিরিধারী মহাপাত্র ও ভিক্‌তর জিয়োভানেল্লির মতো শিল্পশিক্ষকের কাছে ভাস্কর্যের পাঠ নেওয়া চিন্তামণি কর (১৯১৫-২০০৫) গিয়েছিলেন লন্ডনেও— ‘রয়্যাল সোসাইটি অব ব্রিটিশ স্কাল্পটর্স’-এর সম্মানিত সদস্য হয়েছিলেন। ১৯৫৬ সালে দেশে ফেরেন। কলকাতায় গভর্নমেন্ট কলেজ অব আর্ট অ্যান্ড ক্রাফ্ট-এর অধ্যক্ষ, পদ্মভূষণ, ফ্রান্সের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মানে ভূষিত ভাস্কর ও চিত্রশিল্পী চিন্তামণি করের ১০৭তম জন্মদিন আজ, ১৯ এপ্রিল। প্রতি বছর তাঁর জন্মদিন উদ্‌যাপন করে থাকে কলকাতার শিল্প প্রতিষ্ঠান ‘সর্বভারতীয় চারুকলা মন্দির’, সঙ্গী ‘ভাস্কর ভবন ট্রাস্ট’। নরেন্দ্রপুরে শিল্পীর স্মৃতি ও কৃতিধন্য ‘ভাস্কর ভবন’-এর আমিনা কর গ্যালারিতে আজ বিকেল সাড়ে ৪টেয় আয়োজন— বরেণ্য শিল্পীর আবক্ষ মূর্তিতে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন, গুণিজন-উপস্থিতিতে স্মরণানুষ্ঠান।

কবি কবিতা

২০০৮ সালে এফএম রেডিয়োর এক অনুষ্ঠানে সঞ্চালক সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কথা বলেছিলেন কবি উৎপলকুমার বসুর সঙ্গে। দীর্ঘ, অন্তরঙ্গ সেই আলাপচারিতা এর আগে মুদ্রিত হয়নি কোথাও, প্রকাশ করল কবিতা পত্রিকা আদম (সম্পাদনা: গৌতম মণ্ডল), তাদের সাম্প্রতিক সংখ্যাটিতে। ২৫ বছরের যাত্রায় শুরু থেকেই উৎপলকুমারের প্রশ্রয়ী সহযোগ পেয়েছে এই পত্রিকা, যোগেন চৌধুরীর আঁকা কবির প্রতিকৃতিই হয়ে উঠেছে অনন্য সাক্ষাৎকারটির শিল্পিত কথামুখ। করোনালাঞ্ছিত গত বছরটি বহু সারস্বতের বিদায়ে বিধুর— অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, সুধীর চক্রবর্তী, শম্ভু রক্ষিত ও পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলালের প্রতিকৃতি এঁকেছেন হিরণ মিত্র। বন্ধু অলোকের কবিতায় স্থান-কালের ক্রমিক প্রসার নিয়ে লিখেছেন শঙ্খ ঘোষ, সুধীর চক্রবর্তী: ব্যক্তিগত চোখে নিবন্ধে জয় গোস্বামীর অবলোকন। আছে শতবর্ষ-অতিক্রান্ত বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা, পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলালের অপ্রকাশিত কবিতা ও কবিকে নিয়ে কালীকৃষ্ণ গুহের লেখা, শম্ভু রক্ষিতের কবিতাকৃতি নিয়ে গদ্য। কবিতাই এ পত্রিকার প্রাণবায়ু, দুই বাংলার একশো জন কবির প্রকাশিত কবিতাবাতাসে বুক ভরে নেওয়া।

চিত্রবিচিত্র

ইংরেজি ক্যালেন্ডারে ছোট্ট করে লেখা বাংলা তারিখ দিয়েই কাজ সারতে হবে এ বছর, যখন এমনটাই মনে হচ্ছে, ঠিক সেই সময়েই, বাংলা নববর্ষে সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ল একখানা বাংলা ক্যালেন্ডার। নির্মাণে ‘বাংলানাটক ডট কম’, সহযোগিতায় জর্জ টেলিগ্রাফ ইনস্টিটিউট। লোকগান থেকে হস্তশিল্প— লোকসংস্কৃতির চর্চা ও রক্ষণে কলকাতা তথা বাংলার গণ্ডি ছাড়িয়ে বহির্বঙ্গেও সুবিদিত বাংলানাটক ডট কম সংস্থা, তাদের পরিকল্পনায় ১৪২৮ বঙ্গাব্দের ক্যালেন্ডার সেজে উঠেছে পিংলার পটচিত্র, কুশমন্ডির কাঠের মুখোশ, চড়িদার ছৌ মুখোশ (ছবিতে), বিকনা ও দরিয়াপুরের ডোকরা, নতুনগ্রামের কাঠের পুতুল, সবংয়ের মাদুর, নানুরের কাঁথাশিল্প থেকে তেপান্তর নাট্যগ্রাম বা বননবগ্রামের বাউল আশ্রমের ছবিতে। ডিজিটাল পরিসরে প্রচারিত ক্যালেন্ডারটির অল্প সংখ্যক মুদ্রিত সংস্করণও প্রকাশিত, সেখানে এক-একটি পাতার কিউআর কোড স্ক্যান করলে পৌঁছে যাওয়া যাচ্ছে সংশ্লিষ্ট শিল্পবস্তুটির সন্ধান দেওয়া ওয়েবসাইটে। অভিনব উদ্যোগ।

কবিতার মাস

শুধু কবিতার জন্য কত কিছু, ভেবেছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। সে স্বপ্ন আরও বহু জনের। গোটা একটা মাস— এপ্রিল— কবিতা পড়ার, আলোচনার, কবিতার ঐতিহ্য উদ্‌যাপনের। ১৯৯৬ সালে আমেরিকায় ‘ন্যাশনাল পোয়েট্রি মান্থ’-এর সূচনা, পরে বিশ্বের অন্যত্রও তার বিস্তৃতি। সেই আয়োজনে শামিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের লিটারারি সোসাইটিও। বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেসবুক পেজে কুড়িটি শব্দ বা শব্দবন্ধ সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে, এ মাসের এক-একটি তারিখ দিয়ে। সেই শব্দ ও সময়সীমা অনুযায়ী কবিতা লিখতে পারেন যে কেউ, পাঠাতে পারেন সোসাইটিকে বা তার ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টেও। কবিতাকে ঘিরে অনর্গল সৃষ্টিধারাই এই উদ্‌যাপনের উদ্দেশ্য। অনুভূতিকে গণ্ডিতে বাঁধা যায় না, এই আয়োজনে তাই ভাষার কোনও বিধিনিষেধ নেই।

ফেরা

বসন্তের শেষ রেশটুকু থাকতে থাকতে, আমপাকা গরমটুকু পড়ার আগেই বেশ ঘুরে নেওয়া যাচ্ছিল শহর, সে সুখ সইল না। করোনা-তরঙ্গে ফের অশনিসঙ্কেত। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, ইন্ডিয়ান মিউজ়িয়াম, বিড়লা তারামণ্ডল ঝাঁপ ফেলেছে আবারও, চিড়িয়াখানা-সহ বাকি দ্রষ্টব্য জায়গাগুলোও বুঝি বন্ধ হয়-হয়। নাটকপাড়া, সিনেমাহল থেকে শপিং মল, রেস্তরাঁ বন্ধের আশঙ্কা... চিন্তার ভাঁজ-পড়া কপাল আর কুঁচকানো ভুরু নিয়ে সেই ভার্চুয়ালেই ফিরতে হবে?

বাঙালির অন্নপূর্ণা, বাঙালির রাম

শারদীয়া অকালবোধনের জনপ্রিয়তায় আমরা প্রায় ভুলে গেছি বাসন্তী পুজোর কথা। চৈত্র মাসের শুক্ল পক্ষের সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী শেষে দশমীতে বিসর্জন। এই অষ্টমীতেই আয়োজন হয় অন্নপূর্ণা পুজোর, আর নবমীতে শ্রীরামচন্দ্রের জন্মতিথি— রামনবমী।

পার্বতীকে অগ্রাহ্য করে শিব ভিক্ষান্ন সংগ্রহে বেরিয়ে ব্যর্থ হয়ে শেষে কাশীতে অন্নপূর্ণারূপী পার্বতীর কাছ থেকে ভিক্ষা গ্রহণে বাধ্য হন। এই পৌরাণিক কাহিনির আয়নায় শক্তির মাহাত্ম্য প্রতিষ্ঠা দেখেছেন মহেন্দ্রনাথ দত্ত। অন্য দিকে সুজলা সুফলা দেশেও নিরন্তর অন্নের অভাব ও সেই অনটন থেকে মুক্তির চিন্তাই যেন প্রতিফলিত হয়েছে অন্নপূর্ণা পুজোয়। অন্নপূর্ণা উঠে এসেছেন মঙ্গলকাব্যের চরিত্র হয়ে। গড়ে উঠেছে অন্নপূর্ণার মন্দির।

এই পরম্পরা থেকে আলাদা নয় শহর কলকাতাও। অন্নপূর্ণা পুজোর আয়োজন হয় শহরের নানা জায়গায়। তার মধ্যে অন্যতম উত্তর কলকাতার বাগবাজার। এই অঞ্চলের একাধিক প্রাচীন অন্নপূর্ণা মন্দিরের মধ্যে রামকৃষ্ণ লেনের গোবিন্দচন্দ্র সরকার প্রতিষ্ঠিত মন্দিরটির (বাঁ দিকের ছবিতে এই মন্দিরের অন্নপূর্ণা) শতবর্ষ পূর্ণ হবে আগামী বছর। এ ছাড়াও বাগবাজারের বেশ কয়েকটি পুরনো পরিবারেও অন্নপূর্ণা পুজো পালিত হয়ে আসছে বহু বছর ধরে।

পঞ্চদশ শতকে কৃত্তিবাস রামায়ণ বা শ্রীরাম পাঁচালীকে আক্ষরিক অনুবাদ না করে রামকথাকে বাংলার সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের অঙ্গীভূত করেছিলেন। বাংলায় আগে থেকেই রামায়ণ চর্চা থাকা সত্ত্বেও, কৃত্তিবাসের পরেই সাধারণ বাঙালির স্মৃতি-সত্তা-কল্পনার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠেন রামচন্দ্র, বললে অত্যুক্তি হয় না। রামায়ণের নায়ক দেবদেউল ছেড়ে জনজীবনে সুখ-দুঃখের আশ্রয় রূপে ধরা দিলেন।

কালনা বা শান্তিপুরে রামচন্দ্রের যে প্রাচীন দারুবিগ্রহ গড়া হয়েছে, তার মধ্যে নবদূর্বাদল বর্ণের নয়নাভিরাম রামচন্দ্রের দেখা মেলে। তাঁর মুখশ্রীর অবিচ্ছেদ্য অংশ তাঁর পৌরুষব্যঞ্জক গোঁফ (ছবিতে ডান দিকে শান্তিপুরে বড় গোস্বামীবাড়ির বিগ্রহ)। কাঠের মূর্তি থেকে উনিশ শতকে কাঠ খোদাইয়ের ছবি, সগুম্ফ রামচন্দ্রের কল্পনা বাংলার শিল্পীদের এক অনুপম কল্পনা।

চোরবাগান স্টুডিয়োর ছবিতে বা কলকাতার উপকণ্ঠে আগরপাড়ায় গিরিবালা দাসীর মন্দির-অলঙ্করণে রাজ্যাভিষেকের দৃশ্যেও শ্রীরামচন্দ্রের গুম্ফশোভিত রূপই ধরা দিয়েছে। হাওড়ার বিখ্যাত রামরাজাতলার মূর্তিও ব্যতিক্রম নয়। ধুতি পরা, মাথায় চূড়া বাঁধা শান্তিপুরি আটপৌরে রূপেই হোক বা রাজবেশে সিংহাসনে আসীন রাজা, আপামর বাঙালির সঙ্গে তাঁর এক সহজ আত্মিক সংযোগ, যার জোরে বাঙালি কবি লিখতে পারেন, ‘ও ভাই আমরা মাটির খাঁটি ছেলে দূর্বাদল-শ্যাম,/ আর মোদের রূপেই ছড়িয়ে আছেন রাবণ-অরি রাম।’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement