আলিপুরে আটক হওয়া গাড়ি। (ডান দিকে) বাগমারির ঘটনায় আহত দীপ যাদব। — নিজস্ব চিত্র
শহরের রাজপথ কি ক্রমেই দুর্ঘটনার আঁতুড়ঘর হয়ে উঠছে?
কলকাতা পুলিশ এবং কেন্দ্রীয় সরকারের পরিসংখ্যান কিন্তু সেই প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে।
কেন্দ্রীয় সরকারের সড়ক পরিবহণ মন্ত্রকের গত বছরের পরিসংখ্যান বলছে, দুর্ঘটনাপ্রবণ শহরগুলির তালিকায় দেশের মধ্যে তৃতীয় স্থানে রয়েছে কলকাতা। আহতের সংখ্যার নিরিখে দিল্লি এবং চেন্নাইয়ের পরেই রয়েছে এ শহর।
পরিস্থিতি যে এখনও বদলায়নি, শুক্রবার রাতের অম্বেডকর কলোনি, শনিবার সকালের বাগমারির ঘটনা তা আরও এক বার বুঝিয়ে দিল। ১২ ঘণ্টার ব্যবধানে জোড়া দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন সাত জন।
উভয় ক্ষেত্রেই প্রাথমিক তদন্তের পরে পুলিশের অনুমান, বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানোর জেরেই দুর্ঘটনা। তদন্তকারীরা জানান, শুক্রবার রাত সাড়ে দশটা নাগাদ আলিপুর থানা এলাকার অম্বেডকর কলোনিতে চলছিল বিসর্জনের প্রস্তুতি। সরস্বতী পুজোর পরদিন প্রতিমা বিসর্জনের জন্য একত্র হয়েছিলেন এলাকার বাসিন্দারা। সেই সময়ে ওই জায়গায় একটি গাড়ি পার্ক করতে গিয়েই ঘটে বিপত্তি। বেপরোয়া গতিতে চলা গাড়িটি প্রথমে মণ্ডপের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক যুবককে ধাক্কা মারে, তার পরে একটি ঝুপড়ি ভেঙে ঢুকে যায়। গাড়ি আটক করে আহত চালক রামবিলাসকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গুরুতর আহত রামবিলাসকে শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এই ঘটনায় আহত তিন জনকে প্রাথমিক চিকিৎসার পরে ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু প্রদীপ দাস এবং রাজকুমার দাস গুরুতর আহত অবস্থায় একবালপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি।
এই ঘটনার ঠিক ১২ ঘণ্টা পরে শনিবার বেলা সাড়ে দশটা নাগাদ নারকেলডাঙা থানার বাগমারি ব্রিজে রাস্তা পেরোতে গিয়ে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে এক ন’বছরের বালক। প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিযোগ, বেপরোয়া গতিতে আসা একটি গাড়ি ধাক্কা মারে দীপ যাদব নামে ওই বালককে। পুলিশের সহযোগিতায় স্থানীয় বাসিন্দারা তাকে এনআরএসে নিয়ে যায়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, দীপ মাথায় গুরুতর চোট পেয়েছে।
আলিপুর কিংবা বাগমারি কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। কলকাতা ট্র্যাফিক পুলিশ সূত্রে খবর, গত সপ্তাহে আটটি দু্র্ঘটনা ঘটেছে। ফড়িয়াপুকুর, এজেসি বসু রোড, পাটুলি— এক সপ্তাহে শহরের নানা প্রান্তে পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ছ’জনের, আহতও হয়েছেন অনেকে। দিন ছয়েক আগে, ২৯ জানুয়ারি পথ দুর্ঘটনা রুখতে পুলিশের তৎপরতার দাবিতে অবরুদ্ধ হয়েছিল বাগমারি। ২৮ তারিখ সেখানে বাইক দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিল দ্বাদশ শ্রেণির বিনীত চহ্বাণ। পথ নিরাপত্তায় পুলিশের তৎপরতা বা়ড়ানোর দাবিতে অবরোধ করেছিলেন স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশ। এক সপ্তাহ না কাটতেই ফের বাগমারিতেই ঘটল দুর্ঘটনা।
লালবাজারের কর্তারা জানাচ্ছেন, সিগন্যাল সবুজ সঙ্কেত দিলেই গাড়ির গতি বেড়ে যায়। বেপরোয়া গতি এবং পথচারীদের নিয়ম না মেনে রাস্তা চলাচলের জেরেই এই বিপত্তি ঘটে। বিশেষত, ট্রাম লাইনের পাশের রাস্তাগুলিতে বাইক উল্টে যাওয়া নিত্য ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রাজ্যের মুখ্য প্রশাসক উদ্যোগী হওয়া সত্ত্বেও দুর্ঘটনার কবল থেকে বেরোতে পারছে না কলকাতা। রাজ্য জুড়ে লাগাতার প্রচারেও ফল মিলছে না। যদিও পুলিশ এ কথা মানছে না। লালবাজারের কর্তাদের দাবি, রাতারাতি সব কিছু বদলে দেওয়া সম্ভব নয়। সচেতনতা প্রচা র জারি রয়েছে। আগের তুলনায় পথ দুর্ঘটনাও কমেছে।
কলকাতাকে দুর্ঘটনার আঁতুড়ঘর মানতে নারাজ কলকাতা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (১) বিনীত গোয়েল। তিনি বলেন, ‘‘ভারতের অন্যান্য বড় শহরের তুলনায় কলকাতার অবস্থা অনেক ভাল। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সেফ ড্রাইভ, সেভ লাইফ’ প্রকল্প দুর্ঘটনা কমাতে যথেষ্ট সাহায্য করছে।’’
নিজস্ব সংবাদদাতা: একেই বোধ হয় বলে ‘চলো নিয়ম মতে’!
ধর্মতলার মোড়ে বাস দুর্ঘটনায় আহত এক ব্যক্তি রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তায় দাঁড়ানো পুলিশ ভ্যানে হেলান দিয়ে বসে। কিন্তু সেই পুলিশের গাড়ি তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যায়নি। কেন? কলকাতা পুলিশের পদস্থ কর্তাদের
যুক্তি, তাঁদের অ্যাম্বুল্যান্সে প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকে। তাই পুলিশের গাড়ির বদলে অ্যাম্বুল্যান্সে নিয়ে যাওয়াটাই নিয়ম।
লালবাজারের খবর, ওই পুলিশের গাড়ি কন্ট্রোল রুম মারফত অ্যাম্বুল্যান্সকে খবর দিয়েছিল। ঘটনাস্থল থেকে মেরেকেটে মাত্র ৭৫০ মিটার দূরে রাজভবনের দক্ষিণ গেটে দাঁড়ানো অ্যাম্বুল্যান্স এসে
ওই ব্যক্তিকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। তবে অভিযোগ, ওই সামান্য পথটুকু পেরোতে ২৪ মিনিট সময় লেগেছে তাদের।
শনিবার বিকেলের এই ঘটনার পরেই পুলিশের ভূমিকা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ধর্মতলার মোড়ে দাঁড়ানো মানুষজন। বলেছেন, পথ দুর্ঘটনা নিয়ে লালবাজার হাজার উপদেশ শোনালেও এ দিনের ভূমিকায় তাঁদের অমানবিক মুখটাই ফুটে উঠেছে। যদিও লালবাজার দাবি করেছে, দেরি অতটাও হয়নি। বড়জোর ১০ মিনিট বেশি গিয়েছে।
কী হয়েছিল এ দিন?
পুলিশ সূত্রের খবর, এ দিন বিকেল ৪টে ২০ মিনিট নাগাদ ধর্মতলার মোড়ে বাসে চাপতে গিয়ে পড়ে যান হাওড়ার বাসিন্দা শেখ রাইহান। বাসের পিছনের চাকায় তাঁর ডান পায়ে আঘাত লাগে। রাস্তাতেই পড়ে যান তিনি। ঝরঝর করে রক্ত পড়তে থাকে। আশপাশে দাঁড়ানো লোকজন ছুটে আসেন। ঘটনাস্থলের কাছেই দাঁড়িয়েছিল কলকাতা পুলিশের মোবাইল ভ্যান। সেখান থেকেও পুলিশকর্মীরা ছুটে আসেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানাচ্ছেন, ধর্মতলার মোড়ে দাঁড়ানো লোকজন এবং পুলিশকর্মীরাই রাইহানকে রাস্তা থেকে তোলেন। পুলিশের মোবাইল ভ্যানের গায়ে ঠেস দিয়ে বসানো হয় তাঁকে। ওই ভ্যানে কর্তব্যরত পুলিশকর্মীরাই কন্ট্রোল রুমে দুর্ঘটনার খবর দেন। রাইহানকে হাসপাতালে নিয়ে
যাওয়ার জন্য আশপাশের বাসিন্দারা মোবাইল ভ্যানটিকেই অনুরোধ
করেন। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি। যে বাসটিতে রাইহান আহত হয়েছিলেন, সেই বাসেই ছিলেন মুকেশ যাদব। চাঁদনি চকের এই বাসিন্দা দুর্ঘটনা হয়েছে দেখেই বাস থেকে নেমে পড়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘‘বার বার পুলিশকে অনুরোধ করলাম। কিন্তু ওরা কথায় কান দেয়নি।’’
এ সব শুনে অবশ্য বিরক্ত হয়েছেন ডিসি (সেন্ট্রাল) অখিলেশ চতুর্বেদী। ঘটনাস্থল তাঁর আওতাতেই পড়ে। তিনি বলেন, ‘‘বিষয়টি খতিয়ে দেখব। গাফিলতি থাকলে শাস্তিও দেওয়া হবে।’’
এ দিন অনেকেই বলছেন, নিয়ম মেনে না হয় পুলিশের গাড়ির বদলে অ্যাম্বুল্যান্সে আহত ব্যক্তিকে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু অ্যাম্বুল্যান্স আসতেও
এত সময় নিল কেন? কলকাতা পুলিশের এক শীর্ষকর্তার ব্যাখ্যা, ওই সময়ে পথে যানজট ছিল। তার ফলেই সামান্য দেরি হয়েছে। কিন্তু অ্যাম্বুল্যান্সের মতো জরুরি পরিষেবা দেওয়ার গাড়ি কেন যানজটে আটকে দেরিতে পৌঁছবে, তার অবশ্য সদুত্তর মেলেনি।
কলকাতা পুলিশের একাংশের বক্তব্য, ধর্মতলার মোড়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় নিত্যদিন একটি ট্রমা কেয়ার অ্যাম্বুল্যান্স দাঁড় করানো থাকে। এ দিনের ঘটনাস্থল থেকে ওয়াই চ্যানেলে দাঁড়ানো সেই গাড়ির দূরত্ব মেরেকেটে দেড়শো মিটার হতো। সেই গাড়ি পৌঁছল না কেন? লালবাজারের খবর, ওয়াই চ্যানেলের গাড়িটিকেই অন্য জায়গায় পাঠানো হয়েছিল। তাই দুর্ঘটনার পরে রাজভবনের দক্ষিণ গেটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা অ্যাম্বুল্যান্স নিয়ে আসা হয়েছিল।