সুরক্ষা: ধোঁয়া-ধুলো থেকে বাঁচতে মাস্ক ব্যবহার করছেন ট্র্যাফিক পুলিশকর্মীরা। মঙ্গলবার, গিরিশ পার্কের কাছে চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ে। ছবি: সুমন বল্লভ
বিতর্ক-আলোচনা চলছিলই। সঙ্গে তাল মিলিয়ে দাবি, পাল্টা দাবিও চলছিল। কিন্তু সে সব ছাপিয়ে বাতাসে ভাসমান ধূলিকণার (পিএম ১০) উপস্থিতির ভিত্তিতে দশকের সব থেকে দূষিত দশ দিনের ‘শিরোপা’ জুটল ২০১৮ সালের ১-১০ ডিসেম্বর! যদিও সে ‘শিরোপা’ নিয়ে
উদ্বিগ্ন পরিবেশকর্মী-গবেষক এবং চিকিৎসক মহল। শুধু তাই নয়, শহরের দূষণ নিয়ে খোঁজ রাখা সাধারণ মানুষেরও কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলছে এ খবর।
কারণ, রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের ২০০৯ সাল থেকে ২০১৮ সালে এ শহরের ডিসেম্বরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, অন্য বছরের প্রথম দশ দিনের দূষণের মাত্রাকে পিছনে ফেলে দিয়েছে চলতি বছরের গত দশ দিন! সে দিনের যে পর্বই হোক, গত দশ দিনের বেশির ভাগ সময়ে বাতাসে ভাসমান ধূলিকণার মাত্রা স্বাভাবিকের থেকে ছ’গুণ, কখনও বা সাত গুণ বেশি থেকেছে শহরে।
তথ্য বলছে, ২০০৯ সালের ৪ ডিসেম্বর দুপুর ২টোয় বি টি রোডের রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ভাসমান ধূলিকণার মাত্রা ছিল প্রতি ঘনমিটারে ৬২১ মাইক্রোগ্রাম। প্রথম দশ দিনের মধ্যে সে বছর দূষণ সর্বাধিক মাত্রা ছুঁয়েছিল ওই দিনই।
ওই বছর বাদ দিলে ২০১১, ২০১২, ২০১৪ ও ২০১৫ সালের ডিসেম্বরের প্রথম দশ দিনে বাতাসে ভাসমান ধূলিকণার উপস্থিতি স্বাভাবিক মাত্রার থেকে চার গুণ বেশির মধ্যে ঘোরাফেরা করেছে। ২০১১ সালের ২ ডিসেম্বর রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে রাত ১১টায় পিএম ১০-এর পরিমাণ ছিল প্রতি ঘনমিটারে ৪৩৯.৬৮ মাইক্রোগ্রাম। ২০১২ সালে বাতাসে ভাসমান ধূলিকণার উপস্থিতি ৪০০-র ঘর ছুঁয়েছিল ৫ ডিসেম্বর। সে দিন রাত ১১টায় রবীন্দ্রভারতী এলাকায় পিএম ১০-এর পরিমাণ ছিল ৪২৩.৩৫। ২০১৪ সালের ১০ ডিসেম্বর রাত ১১টায় রবীন্দ্রভারতী চত্বরে পিএম ১০-এর উপস্থিতি ছিল প্রতি ঘনমিটারে ৫০০ মাইক্রোগ্রাম এবং ২০১৫ সালের ২ ডিসেম্বর সকাল ৬টায় রবীন্দ্রভারতী এলাকায়
ভাসমান ধূলিকণার পরিমাণ ছিল ৪১৮.৮৩ মাইক্রোগ্রাম।
বাকি চার বছর, অর্থাৎ ২০১০, ২০১৩, ২০১৬ ও ২০১৭ সালে রবীন্দ্রভারতী ও ভিক্টোরিয়া সংলগ্ন এলাকায় বাতাসে ভাসমান ধূলিকণার পরিমাণ সহনশীল মাত্রার থেকে গড়ে তিন থেকে সাড়ে তিন গুণ বেশি ছিল। রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ সূত্রের খবর, ২০১০ সালের ২ ডিসেম্বরের দুপুর ২টোয় ভিক্টোরিয়ায় পিএম ১০-এর পরিমাণ ছিল প্রতি ঘনমিটারে ৩১৮ মাইক্রোগ্রাম। ২০১৩ সালের ১০ ডিসেম্বর আবার ওই একই সময়ে রবীন্দ্রভারতী এলাকায় ভাসমান ধূলিকণার পরিমাণ ছিল ৩৪৯.৪৩ মাইক্রোগ্রাম।
২০১৬ সালে ডিসেম্বরের প্রথম দশ দিনের দূষণের মাত্রা কিছুটা সহনশীল ছিল। শুধু ৫ ডিসেম্বর সকাল ৮টায় রবীন্দ্রভারতী চত্বরে
ভাসমান ধূলিকণার পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল প্রতি ঘনমিটারে ৩১৭.৫৮ মাইক্রোগ্রাম। ২০১৭ সালের ছবিটাও একই। ওই বছর ৪ ডিসেম্বর বেহালা চৌরাস্তায় পিএম ১০-এর পরিমাণ ছিল ৩১৯।
সেখানে ২০১৮ সালের ৪ ডিসেম্বর বাতাসে ভাসমান ধূলিকণার পরিমাণ সহনশীল মাত্রার থেকে সেই যে ছ’গুণের বেশি হয়েছিল, ক্রমেই তা ঊর্ধ্বমুখী। গত বৃহস্পতিবার রাতে তা বেড়ে সহনশীল মাত্রার থেকে সাত গুণ বেশি হয়ে যায়! গত শুক্রবার সকাল ৬টায়ও ধূলিকণার পরিমাণ ছিল ৭৭৯.৩ মাইক্রোগ্রাম। সোমবার বিকেল ৫টায় রবীন্দ্রভারতী চত্বরে পিএম ১০-এর পরিমাণ ছিল ৬৪২.৫, এক ঘণ্টা পড়ে যা বেড়ে দাঁড়ায় ১১১০.০৭ মাইক্রোগ্রামে!
ক্রমবর্ধমান দূষণের কারণ ব্যাখ্যা করে পরিবেশকর্মী-গবেষকদের একাংশের বক্তব্য, যানবাহনের ধোঁয়া, নির্মাণস্থলের দূষণ, পাতা পোড়ানো-সহ দূষণের নিত্য নতুন উৎস বেড়েছে এ শহরে। রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের চেয়ারম্যান কল্যাণ রুদ্র বলেন, ‘‘শীতকালে বাতাসের গতি থাকেই না। ফলে কোথাও ধূলিকণার উৎস হলে তা ছড়িয়ে পড়তে পারে না।’’ আলিপুর আবহাওয়া দফতরের অধিকর্তা গণেশকুমার দাসও বলেন, ‘‘এমনিতে শীতের সময়ে দূষণ বেশিই হয়। শহরে বহুতল বাড়ার কারণে বাতাসের গতি বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। তাতেও দূষণ বাড়ে।’’ পরিবেশকর্মী বনানী কক্কর বলেন, ‘‘রবীন্দ্র সরোবরে সকালে গেলেই দেখা যাবে, যখন সাধারণ মানুষ হাঁটছেন, তখনই ঝাঁট দেওয়া হচ্ছে। একেই এত ধুলো-দূষণের জেরে শ্বাস নেওয়াই মুশকিল হয়ে যাচ্ছে, সেখানে নিজেরাই ভুল পরিকল্পনা করে দূষণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। কেউই কিছু করছেন না দূষণ রোধে। সকলেই শুধু দেখছেন!’’ পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত অবশ্য বলেন, ‘‘দূষণের যে উৎসগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব পুলিশ-প্রশাসনের হাতে আছে, সেগুলো কি করা হচ্ছে? গাছ লাগিয়ে দূষণের মাত্রা কমানোর চেষ্টা কি করা হচ্ছে?’’
সে সব নিয়ে চলতে পারে বিতর্ক। কিন্তু বাস্তবটা হল, দশকের দূষিত দশ দিন এ বছরেরই!