Stagnant Water

কলকাতার কড়চা: জীবন জুড়ে জলযন্ত্রণা

আজও জোর বৃষ্টি হলে কলকাতার পথে পাড়ায় নৌকা ভাসানোর পরিস্থিতি হয়, সে কি অতীত-অবহেলার পরিণতি?

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৬ জুন ২০২১ ০৮:১৬
Share:

এক পশলা বৃষ্টি হইয়া গিয়াছে...রাস্তাঘাট সেঁতসেঁত করিতেছে। বাবুরামবাবু...একখানা ভাড়া গাড়ী অথবা পাল্কীর চেষ্টা করিতে লাগিলেন কিন্তু ভাড়া বনিয়া উঠিল না... বাবুরামবাবুর রকমসকম দেখিয়া কেহ কেহ বলিল, ওগো বাবু, ঝাঁকা মুটের উপর বসে যাবে?” প্যারীচাঁদ মিত্রের আলালের ঘরের দুলাল-এ পাওয়া যায় এই জল-ছবি। ১৮৫৭ সালে রচিত এই গ্রন্থ পরিচয় করিয়ে দেয় আজ থেকে ১৬৪ বছর আগের কলকাতার রাস্তায় বর্ষাকালে জলযন্ত্রণার ছবির সঙ্গে। বাবুরামবাবু সে দিন ঝাঁকা মুটের উপর না বসলেও, ১৯৬৩ সালে অজয় কর তাঁর সাত পাকে বাঁধা ছবিতে বর্ষার জলে ডুবন্ত কলেজ স্ট্রিটে ঝাঁকা মুটের মাথায় পথচারীর বসে যাওয়ার দৃশ্য দেখিয়েছেন।

Advertisement

কলকাতার পথঘাট কেবল বর্ষাকালে নয়, উনিশ শতকের গোড়ায় ভেসে যেত গঙ্গায় বান এলেও। সে জল জমে থাকত কয়েক সপ্তাহ ধরে, নিকাশির অভাবে। কলকাতার নিকাশি ব্যবস্থা গঙ্গামুখী হওয়ার ত্রুটিটা প্রথম নজরে আসে লড ওয়েলেসলির, যাঁর হাতেই বলতে গেলে তৈরি কলকাতার নগর পরিকল্পনার নীল নকশা। ত্রুটিটা ছিল, কলকাতার ভূমির ঢাল পূর্বমুখী হওয়া সত্ত্বেও নিকাশি ব্যবস্থা ছিল পশ্চিমে গঙ্গামুখী। ওই সময় থেকে কলকাতার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তারা বুঝতে পেরেছিলেন, সুপরিকল্পিত পয়ঃপ্রণালী ছাড়া নিকাশি ব্যবস্থার উন্নয়ন সম্ভব নয়। আর এই নিকাশি ব্যবস্থায় খামতি থাকার জন্যই কলকাতা রোগ-অসুখের আঁতুড়ঘর।

কলকাতার নিকাশি ব্যবস্থার পরিকল্পনা নিয়ে নানা প্রস্তাব এসেছিল। কিন্তু উন্নয়ন কমিটির মনে হয়েছিল, পূর্বমুখী একটা প্রধান জলনিকাশি পথ তৈরি না করে ছোটখাটো নর্দমা নির্মাণ অর্থহীন। ১৮৩৭ সালে ক্যাপ্টেন টমসন কুড়ি লক্ষ টাকা ব্যয়ে আচ্ছাদিত নর্দমার প্রস্তাব দেন। কিন্তু বাতিল হয়ে যায় সে প্রস্তাব। ১৮৫৫ সালে মিউনিসিপ্যাল ইঞ্জিনিয়ার উইলিয়াম ক্লার্ক প্রথম ভূগর্ভস্থ নর্দমার পরিকল্পনা তৈরি করেন। পরিকল্পনা খতিয়ে দেখার জন্য নিয়োগ করা হয় একটা বিশেষ কমিটি। তারা ক্লার্কের পরিকল্পনার কিছু পরিবর্তন ঘটিয়ে অনুমোদন করেন ১৮৫৯ সালে। নির্মাণকাজ শেষ হয় ১৮৭৫ সালে। এই ভূগর্ভস্থ নর্দমার দৈর্ঘ্য ১১২ মাইল। এই নিকাশি ব্যবস্থা একশো ভাগ সফল হয়নি, যদিও কিছুটা লাঘব হয়েছিল রাস্তার জল জমার সমস্যার। উত্তর ও মধ্য কলকাতার মানুষ রেহাই পায়নি জলবন্দি অবস্থা থেকে। অথচ সে সময় একমাত্র লন্ডন ও জার্মানির হামবুর্গ ছাড়া বিশ্বের আর কোনও শহরে এই ভূগর্ভস্থ নিকাশি ব্যবস্থা ছিল না।
১৮৭৫ সালে কলকাতায় যে ভূগর্ভস্থ নর্দমা তৈরি হয়েছিল, মাঝেমধ্যে কিছু সংস্কারকাজ হলেও পরবর্তী ১৩০ বছরে তার আমূল সংস্কার হয়নি কিছু। নর্দমার কর্মক্ষমতা হ্রাস পেয়েছিল পলি জমে, যা সরানোর কাজে কলকাতা পৌরসংস্থা হাত দেয় ২০০৬-০৭’এ। আজও জোর বৃষ্টি হলে কলকাতার পথে পাড়ায় নৌকা ভাসানোর পরিস্থিতি হয়, সে কি ওই অতীত-অবহেলার পরিণতি? ছবিতে ২০১৭ সালের কলকাতায় বর্ষার জলযন্ত্রণা।

Advertisement

ত্রাতা

ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে চব্বিশ পরগনার মজিলপুরে এসেছিলেন তিনি। ১৮৬৪ সালের ৫ অক্টোবরের প্রবল ঘূর্ণিঝড় আর জলপ্লাবনে ডায়মন্ড হারবার-কুলপি-বিপর্যস্ত, সাগর-কূলবর্তী দক্ষিণ প্রান্ত ভেসে গিয়েছে জলোচ্ছ্বাসে। প্রাণ গিয়েছে কয়েক হাজার মানুষের। বারুইপুর মহকুমার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট নিয়ে এসেছিলেন ‘কয়েক ডোঙ্গা চাউল, ডাইল, চিড়া, লবণ, কয়েক পিপা সর্ষপ তৈল ও কয়েক থান পরিধেয় বস্ত্র’। সঙ্গে ছিল বন্দুকধারী পুলিশও। পরে যান ডায়মন্ড হারবার মহকুমায়, দুই মহকুমাতেই তাঁর ত্রাণ বণ্টন, হিসেবের দক্ষতা উচ্চমহলে প্রশংসিত হয়েছিল। প্রকৃতির রোষের মুখে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর তৎপরতা ও হৃদয়বত্তার ছবিটা আজও অমলিন। সে দিনের সেই কর্মিষ্ঠ মানুষটি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (ছবিতে যুবক বয়সে)। আজ, ২৬ জুন, তাঁর জন্মদিন।

মরুগান

মরুভূমির ঐতিহ্যবাহী লোকসঙ্গীত পশ্চিম রাজস্থানের আত্মা। বাড়মের, জয়সলমের, জোধপুর, বিকানের শুধু মরুভূমি, দুর্গ ও প্রাসাদের জন্যই বিখ্যাত নয়, সুপরিচিত লাঙ্গা, মাঙ্গানিয়ার এবং মীর জনগোষ্ঠীর লোকসঙ্গীতের জন্যও। বাংলার ঘরে বসেই সেই মরুর গান শোনার সুযোগ, বিশ্ব সঙ্গীত দিবস উপলক্ষে গুগল আর্টস অ্যান্ড কালচার-এর সঙ্গে বাংলানাটক ডট কম-এর গাঁটছড়ায়। ‘আর্টস অ্যান্ড কালচার ডট গুগল ডট কম’-এ গিয়ে ‘পার্টনার/বাংলানাটক’ ক্লিক করলেই দেখা যাবে রাজস্থানের চার জেলার ১৫০ জন শিল্পীর পরিবেশনা— তিনটি ডিজিটাল প্রদর্শনীতে, ছবি ও অডিয়ো-ভিডিয়োয় মরুভূমির সমৃদ্ধ লোকসঙ্গীত-ঐতিহ্য। দেখা ও শোনা যাবে নানা বাদ্যযন্ত্র— সিন্ধি সারেঙ্গি, কামাইচা, খরতাল, অ্যালগোজা, ঢোল, মোরচাং, মুরলী। লোকসঙ্গীতের এই ঐতিহ্যবাহী ধারাকে কী ভাবে এগিয়ে নিয়ে চলেছে তরুণ প্রজন্ম, জানা যাবে তা-ও। এর আগে বাংলার পটচিত্র, ছৌ নাচ, মাদুর শিল্প, দোল নিয়েও অনলাইন প্রদর্শনী করেছে বাংলানাটক ডট কম।

মননের আলো

২১ জুন কি ‘শুধু গানের দিন’ই? গান নিয়ে চর্চা আর লেখালিখির মধ্য দিয়ে সে চর্চার একটা নান্দনিক ও বৌদ্ধিক রূপ ফুটিয়ে তোলার প্রয়াস করেছে কলকাতার ‘সূত্রধর’ প্রকাশনা। সঙ্গীত দিবস উপলক্ষে প্রকাশিত হয়েছে তাদের তিনটি বই— রাধাকান্ত নন্দীর তবলার বোল, তবলিয়ার বুলি, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের রবীন্দ্রসংগীত আর সুধীর চক্রবর্তীর বাংলা সংগীতচিন্তার নবজন্ম। লেখকদের নিয়ে আলাদা করে দু’কথা বলার দরকার পড়ে না, সঙ্গীত ও তার শিক্ষণ-জগতে প্রত্যেকেই স্বনামধন্য, বিভিন্ন কালপর্বে বাংলার সঙ্গীত-ঐতিহ্য ও ইতিহাসের দিগ্‌দর্শকও তাঁরা। মননের আলো দীপ্ত হয়ে উঠেছে ভাষা ও ভাবের সারল্যে। ছোট্ট বইগুলি, কিন্তু গভীর।

পুরাতাত্ত্বিক

১৯৬২ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পুরাতত্ত্বে স্নাতকোত্তর, পরে আমেরিকার মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ে জন ডি রকফেলার ফেলোশিপ নিয়ে উচ্চতর শিক্ষা। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মিউজ়িয়োলজি বিষয়ের প্রথম পিএইচ ডি ছাত্র তিনিই, সমীর মুখোপাধ্যায় (১৯৩৯-২০২১)। দীর্ঘ কর্মজীবনে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতত্ত্ব ও সংগ্রহশালাতত্ত্ব বিভাগের প্রধান ছিলেন, বিভাগের উদ্যোগে বাংলার নানা স্থানে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যে সক্রিয় ভূমিকা ছিল তাঁর। লিখেছেন বহু গবেষণামূলক প্রবন্ধ, প্রাচীন ভারতীয় মৃৎশিল্প বিষয়ে তাঁর কাজ আদৃত দেশে-বিদেশে। গত ১২ জুন চলে গেলেন সুবক্তা, ছাত্রদরদি এই ইতিহাসবিদ অধ্যাপক।

সিনে-বাংলা

নাচঘর, খেয়ালী, দীপালী, চিত্রলেখা— বিশ শতকের প্রথম দিকে উঠে এল বহু চলচ্চিত্র পত্রিকা, সাময়িকী। দেশ, মাসিক বসুমতী-তে জুড়ল বায়োস্কোপ-চর্চাও। নায়িকাদের আলোকচিত্রে হলিউডি ছায়া, ভারতীয় চিত্রকলারও আবেশ। গ্রেটা গার্বোর প্রেমজীবন, ‘নকশা’য় রঙিন মার্লিন ডিট্রিচ। দেশে তখন নট-নটী থেকে ছায়ানট-ছায়ানটী হয়ে নায়ক-নায়িকায় উত্তরণের পর্ব। প্রাক্-স্বাধীনতার বাংলার সিনে-চর্চার আলোয় পত্রপত্রিকায় ফিল্ম অভিনেত্রীর পরিচিতি নির্মাণ, লিঙ্গচেতনা নিয়ে বললেন স্পন্দন ভট্টাচার্য, যদুনাথ ভবন মিউজ়িয়াম অ্যান্ড রিসোর্স সেন্টার-এর ‘আর্কাইভাল টক সিরিজ়’-এ, গত ২১ জুন। ফেসবুকে এই বক্তৃতা সিরিজ়ের পরের পর্ব ২৮ জুন, বিকেল ৪টেয়। বাঙালির ছবি দেখা ও যৌনতার গণ্ডি নিয়ে বলবেন বিজলীরাজ পাত্র।

ঐতিহ্যের তীরে

নগরসভ্যতার বিকাশ নদীর পাড়ে, কলকাতা যেমন হুগলি নদীতীরে। অতীতে যে নদীতে বাণিজ্যতরী আসত, সে গঙ্গা আজ পরিত্যক্ত আদিগঙ্গা। আর্মেনিয়ানরা ১৭৩৪-এই তৈরি করেন ঘাট, পরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে গড়ে ওঠে চাঁদপাল ঘাট, জগন্নাথ ঘাট, একাধিক গুদামঘর। স্থানীয়দের চাঁদায় তৈরি হয় প্রিন্সেপ ঘাট, রাজচন্দ্র দাস তৈরি করান বাবুঘাট, হাটখোলা ঘাট। নানা সময়ের মানচিত্রে ঠাঁই পাওয়া কলভিনস ঘাট, পুলিশ ঘাট আজ বিলুপ্ত বা বিস্মৃতপ্রায়। ইউরোপীয় স্থাপত্যের স্বাক্ষরবহ ঘাটগুলি সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় সমাবেশেরও মিলনস্থল। এই সব স্থাপত্যে বিধৃত শহরের নদীভিত্তিক ইতিহাস— যার অনেকাংশ রক্ষিত কলকাতা পোর্ট ট্রাস্টের মিউজ়িয়ামে— জানা গেল গত ১৮ জুন, হুগলিতীরের ঐতিহ্যমণ্ডিত স্থাপত্য বিষয়ে জাতুরং পোখারাতসিরি, সঙ্ঘমিত্রা বসু, গৌতম চক্রবর্তী ও রংগন দত্তের আন্তর্জাল-আলোচনায়। আয়োজক পুণের ‘লিভিং ওয়াটার্স মিউজ়িয়াম’। ছবিতে বন্দরের অন্নপূর্ণা ঘাট, ২০১৯ সালে সংস্কারের পরে।

নব রূেপ

ব্রাহ্মসমাজ (সভা) প্রতিষ্ঠার আড়াই দশক আগেই রামমোহন একেশ্বরবাদ প্রচার করেছিলেন, ফারসি ভাষায় তুহ্ফত্-উল্-মুওয়াহিদ্দিন পুস্তিকায়। আনুমানিক ১৮০৩-০৪ সাল নাগাদ পুস্তিকাটি (ছবিতে তারই প্রচ্ছদ) রচনা করেন তিনি; আনন্দচন্দ্র বেদান্তবাগীশের সঙ্গে রামমোহন রচনাবলী গ্রন্থনার সময়ে ১৮৮৪ সালে ঢাকার মৌলবি ওবেদুল্লাহ-আল-ওবেইদিকে দিয়ে যার ইংরেজি অনুবাদ করান রাজনারায়ণ বসু। ১৮৯৯ সালে গিরিশচন্দ্র সেন মূল ফারসি থেকে পুস্তিকাটির বঙ্গানুবাদ করেছিলেন, ১৯৪৯-এ দ্বিতীয় বঙ্গানুবাদ প্রকাশ করেন সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের সম্পাদক জ্যোতিরিন্দ্রনাথ দাস। এ বার সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ ও রামমোহন মেমোরিয়াল মিউজ়িয়াম-এর যৌথ উদ্যোগে নবকলেবরে প্রকাশিত হতে চলেছে তুহ্ফত্— মূল ফারসি-সহ বাংলা (জ্যোতিরিন্দ্রনাথ-কৃত) ও ইংরেজি অনুবাদে। আগামী কাল, ২৭ জুন সন্ধ্যায় আন্তর্জালে প্রকাশ-অনুষ্ঠানে থাকবেন ইতিহাসবিদ ফয়সল দেবজি, রুদ্রাংশু মুখোপাধ্যায়, সুদীপ্ত সেন। আয়োজনে রামমোহন রায় জন্ম-সার্ধদ্বিশতবার্ষিকী পুনর্মূল্যায়ন সমিতি।

আম-দরবার

‘বর্ষা, তো ফর্সা’— আম প্রসঙ্গে এমন একটা কথা চালু। মানে, বর্ষার জল পড়লে আমের স্বাদও নাকি ফিকে হয়ে আসে। জামাইষষ্ঠী এসে আমের দাম বাড়িয়েছিল কলকাতার বাজারে, এ বার বর্ষার মুখে বিদায়বেলায় দর বাড়িয়ে নিচ্ছে হিমসাগর। এখন মাঝমাঠ দাপাচ্ছে ল্যাংড়া, কিন্তু হরেদরে হিমসাগরের তুলনায় সে মহার্ঘতর। পরিবর্ত খেলোয়াড় হিসেবে এ বার মাঠে নামার পালা চৌসার, আরও পরে ফজলির উঁকিঝুঁকি। আম-দরবারের চিরন্তনী ক্যালেন্ডার।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement