ক্যামাক স্ট্রিটে তাঁদের হাতে ধরা পড়া এক ব্যক্তি । ছবি: সুদীপ ঘোষ
রাতের কলকাতা কতটা নিরাপদ?
হায়দরাবাদের কাছে গণধর্ষণ ও খুনের ঘটনার পরেই প্রশ্নটা উঠেছিল নানা মহলে। শুক্রবার রাতে শহরের রাস্তায় অভিযানে নামা কলকাতা পুলিশের বিশেষ মহিলা বাহিনী ‘উইনার্স’ও দেখল, ছবিটা একেবারেই স্বস্তির নয়। মোড়ে মোড়ে চলছে মত্ত বাইকবাহিনীর দাপট। একা মহিলা দেখলেই ঘিরে ধরে উত্ত্যক্ত করা কিংবা বাইক ছুটিয়ে পিছু নেওয়া সমানে চলছে! হাতেনাতে ১৪ জনকে গ্রেফতারও করেছে ‘উইনার্স’। যা আরও বড় প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। তা হলে কি শহরের রাস্তায় যে কোনও রাতে এটাই ‘স্বাভাবিক’ চিত্র?
পরনে পুলিশের সাদা উর্দি। হেলমেটের ভিতরে খোঁপা। নি-ক্যাপ, বাইকার্স গ্লাভস পরা ‘উইনার্স’ দল যখন মোটরবাইকে সওয়ার হয়ে লালবাজার থেকে বেরোচ্ছে, তখন রাত প্রায় সাড়ে ন’টা। সঙ্গে বিশ্বজিৎ দেবনাথের নেতৃত্বে গুন্ডা দমন শাখার অফিসারদের নিয়ে কয়েকটি গাড়ি। বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট, ডেকার্স লেন, ধর্মতলা চত্বর পাক খেয়ে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময়ে হঠাৎই দাঁড়িয়ে পড়েন ‘উইনার্স’-এর এক সদস্য। দেখা যায়, হাসপাতালের মূল গেটের কিছুটা দূরেই তটস্থ হয়ে দাঁড়িয়ে এক তরুণী। কয়েক জন যুবক তাঁকে ঘিরে ধরে কিছু একটা বলে চলেছে। তরুণী যেন শুনেও শুনছেন না। রাত তখন প্রায় সাড়ে ১০টা। রাস্তায় থাকা হাতে গোনা কয়েকটি ট্যাক্সির চালকেরা দাঁড়িয়ে বিষয়টি দেখলেও কেউই সাহায্যে এগিয়ে যাচ্ছেন না।
‘উইনার্স’ দলের এক মহিলা গিয়ে জিজ্ঞাসা করেন, ‘‘কী ব্যাপার?’’ প্রশ্ন শুনেই ছুটতে শুরু করে ওই যুবকদের এক জন। বাকি দু’জনকে ধরে ফেলেন অন্যেরা। গুন্ডা দমন শাখার অফিসারেরা এর পরে তাদের পুলিশের গাড়িতে তোলেন। যাঁকে উত্ত্যক্ত করা হচ্ছিল, সেই তরুণী বললেন, ‘‘বহুক্ষণ ধরেই ওরা পিছু নিয়েছিল। সঙ্গে না গেলে দেখে নেবে বলছিল।’’ ১০০ নম্বরে ফোন করলেন না কেন? তরুণীর উত্তর, ‘‘খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কাউকে
ফোন করছি দেখে যদি ওরা আরও হিংস্র হয়ে ওঠে!’’
রাত আড়াইটে পর্যন্ত চলা ‘উইনার্স’-এর অভিযানে এমনই নানা ঘটনা দেখা গিয়েছে। কোথাও রাতের পার্টি সেরে বেরোনো মহিলা না চাইলেও ট্যাক্সি ডেকে দিয়ে সঙ্গে যেতে জোড়াজুড়ি করতে দেখা গিয়েছে কয়েক জন যুবককে। কোথাও আবার প্রকাশ্যে মদের আসর বসানো লোকেরা ‘উইনার্স’-এর মহিলা পুলিশদেরই সঙ্গ দিতে বলেছে। আটকও হয়েছে তারা। সিআইটি রোডের লেডিজ় পার্কের কাছে একা এক মহিলার পথ আটকে মোটরবাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গিয়েছে কয়েক জনকে। তাদেরও দাবি, মহিলাকে তাদের সঙ্গে যেতে হবে! যত টাকা লাগে দেওয়া হবে। ‘উইনার্স’-দের দেখেই তারা বাইক নিয়ে পালাতে চেষ্টা করে। তবে স্কুটারে ধাওয়া করে তাদেরও ধরে ফেলেন ‘উইনার্স’রা। মহিলাকে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হয়।
পুলিশের গাড়িতে তোলার সময়ে ধৃতেরা কেউ কেউ কেঁদেও ফেলে। তখন ‘উইনার্স’-এর এক সদস্যকে বলতে শোনা যায়, ‘‘ধরে নিয়ে গিয়ে গুলি করব না। আইন মেনে যা শাস্তি হওয়ার হবে। কলকাতায় ট্রাইবাল জাস্টিস হয় না।’’
২০১৮ সালে ২৪ জন কনস্টেবল ও চার জন অফিসারকে নিয়ে তৈরি হয় ‘উইনার্স’। গত কয়েক বছরে যে সমস্ত এলাকা থেকে ইভটিজ়িং বা যৌন হেনস্থার অভিযোগ বেশি এসেছে, সেখানেই নজরদারির জন্য প্রাথমিক ভাবে ‘উইনার্স’-দের নিয়োগ করা হয়। শুক্রবার রাতের অভিযানের দায়িত্বে থাকা ‘উইনার্স’ মিতা কংসবণিক জানান, এখন দিনের চার বেলা নানা দলে ভাগ হয়ে শহরের রাস্তায় নজরদারি চালাচ্ছেন তাঁরা। তবে হায়দরাবাদের ঘটনার পরেই শুক্রবার রাতে তাঁদের এই বিশেষ অভিযানের পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
কেমন সেই অভিজ্ঞতা?
দলের এক সদস্য বলেন, ‘‘এত দিনে অনেক কিছু দেখেছি। ইলিয়ট পার্কে আমাদেরই একটি মেয়েকে এক যুবক বলেছিল, একা আছিস? পার্কে যাবি? ৩০০ দেব। আরে বল না, আরও বেশি চাই? তা-ই দেব! সে দিনই ওই যুবক গ্রেফতার হয়। তবে শুক্রবার দেখলাম, শহরের পরিস্থিতি সে ভাবে বদলায়নি।’’ ওই সদস্য এ-ও বললেন, ‘‘একই সময়ে তো সব জায়গা দেখা সম্ভব হয় না। কোথায় কী ঘটছে কে জানে?’’
তা হলে উপায়? এক অফিসার বললেন, ‘‘শুক্রবারই একটি মেয়ে বলল, তোমাদের দেখে সাহস পেলাম। আমরা বলেছি, কলকাতা পুলিশের তেজস্বিনীতে এসো। সাহস পাবে।’’