জীবন যেমন: ফুটপাতের সংসার। বিধান সরণিতে। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক
জ্বালা ধরানো গ্রীষ্ম, থইথই বর্ষা অথবা হাঁড়ে কাঁপন ধরানো শীত— আবহাওয়া যেমনই হোক, ওঁদের ঠিকানা বদলায় না। কলকাতার রাজপথ থেকে অলিগলি, ওঁদের আশ্রয় একটাই— ফুটপাত। সেখানে না আছে দেওয়ালের নিভৃতি, না আছে ছাদের আশ্বাস। আবহাওয়া বিরূপ হলে ভরসা বড়জোর ছেঁড়া-ফাটা একটা ত্রিপল। তা-ও সকলের জোটে না। কলকাতা পুরসভা ফুটপাতবাসীদের জন্য নৈশাবাসের ব্যবস্থা করলেও সেখানে ঠাঁই পান না সকলে। তাই এখনও বহু মানুষকে, বলতে গেলে প্রাণ হাতে করেই দিন যাপন করতে হয় ফুটপাতের উপরে। মাঝেমধ্যে সরকারি তরফে তাঁদের নামধাম লিখে নিয়ে দিন বদলের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় বটে, কিন্তু বাস্তব চিত্রটা বদলায় না।
দিনকয়েক আগে তালতলা থানা এলাকার লেনিন সরণিতে গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে মৃত্যু হয়েছিল তৃষা দত্ত নামে একটি শিশুর। বছর আটেকের তৃষা সন্ধ্যা পর্যন্ত সঙ্গীদের সঙ্গে খেলার পরে আটটা নাগাদ ফুটপাতেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। আচমকাই পিছনের এক বহুতলের বেসমেন্ট থেকে উঠে এসে ঘুমন্ত তৃষাকে পিষে দেয় একটি বেপরোয়া গাড়ি। গুরুতর জখম শিশুটিকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলেও শেষরক্ষা হয়নি। মৃত্যু হয় তৃষার। এই ঘটনার পরেও অবশ্য বিধান সরণি, যদুনাথ দে রোড, মানিকতলা রোড, হেদুয়া-সহ শহরের একাধিক রাস্তার দু’পাশে খোলা ফুটপাতেই দিন কাটাচ্ছে কয়েকশো পরিবার। কেউ কেউ জানিয়েছেন, ফুটপাতেই বছর পঞ্চাশ কেটে গিয়েছে তাঁদের। ছেলেমেয়েদেরও মানুষ করেছেন সেখানেই। বছরের পর বছর খোলা আকাশের নীচেই রাত কেটেছে। লেনিন সরণিতে ঘুমন্ত শিশুর মৃত্যুর ঘটনা এই শহরের ফুটপাতবাসীদের নিরাপত্তা নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে পুলিশ এবং পুরসভার ভূমিকা নিয়েও। শহরে এমন কয়েক হাজার ফুটপাতবাসী থাকলেও তাঁদের জন্য কেন কোনও ব্যবস্থা করা হচ্ছে না, তা নিয়ে যেমন প্রশ্ন উঠেছে, তেমনই প্রশ্ন উঠেছে শহরের পথে বেপরোয়া গাড়ি চলাচল নিয়েও।
শনিবার রাতের ওই দুর্ঘটনাই অবশ্য প্রথম নয়। এর আগেও শহরের একাধিক রাস্তায় ছোট-বড় দুর্ঘটনায় প্রাণ গিয়েছে ফুটপাতবাসীদের। বছর দুই আগে বিধান সরণিতেই ফুটপাতে উঠে গিয়েছিল একটি বেপরোয়া গাড়ি। সেই ঘটনাতেও এক জন ফুটপাতবাসী আহত হন। গাড়িটি একটি স্তম্ভে ধাক্কা মারায় রক্ষা পান ফুটপাতে ঘুমিয়ে থাকা কয়েক জন। সেই ঘটনার পরেও যে পরিস্থিতির কোনও বদল হয়নি, লেনিন সরণির দুর্ঘটনাই তার প্রমাণ।
পুরসভা অবশ্য আশ্রয়হীন, ভবঘুরে ও ফুটপাতবাসীদের জন্য বছরকয়েক আগে নৈশাবাস তৈরি করা শুরু করে। পুরসভা সূত্রের খবর, শহরের বিভিন্ন এলাকায় এমন ৪২টি নৈশাবাস তৈরি করা হয়েছিল। সেখানে সম্পূর্ণ নিখরচায় রাত কাটানোর ব্যবস্থা থাকলেও অনেকেরই ঠাঁই হয় না। তাঁদের রাত কাটে সেই ফুটপাতেই। প্রায় ৫০ বছর ধরে বিধান সরণির ফুটপাতে সপরিবার রয়েছেন রেণু সিংহ। পুরসভার নৈশাবাস সম্পর্কে প্রশ্ন করতেই বললেন, ‘‘ও বাড়িতে আমাদের জায়গা হয় না। পাড়ার দাদারা নিজেদের লোকজনকে সেখানে রাখেন। রাতে যদিও বা কোনও মতে ওখানে থাকতেও পারি, দিন তো কাটাতে হবে সেই ফুটপাতেই। আর সংসারের এত জিনিস নিয়ে ওখানে ঢুকতেও দেয় না। তাই আমাদের ফুটপাতই ভরসা।’’ একই কথা জানালেন মানিকতলা রোডের ফুটপাতবাসী জীবন যাদব।
কিন্তু পুরসভা কী বলছে? মেয়র পারিষদ (বস্তি উন্নয়ন ও পরিবেশ) স্বপন সমাদ্দার বললেন, ‘‘রাতে যাতে কাউকে রাস্তা বা ফুটপাতে ঘুমোতে না হয়, তার জন্য নৈশাবাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এমনকি, পুলিশকেও বলা হয়েছে ফুটপাতবাসীদের সেখানে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে। এর পাশাপাশি, আরও নৈশাবাস তৈরি করতে জমির খোঁজ করছি।’’
কলকাতা পুলিশের এক কর্তার দাবি, ‘‘শহরের প্রতিটি মানুষের জন্য রাস্তা যাতে নিরাপদ হয়, আমরা সেটাই চাই। এর জন্য নজরদারির পাশাপাশি দুর্ঘটনা আটকাতে একাধিক কড়া ব্যবস্থার পথে হাঁটা হয়েছে। বেড়েছে ট্র্যাফিক আইন ভাঙার অপরাধে জরিমানার অঙ্কও। ফুটপাতে শুয়ে যাঁরা রাত কাটান, তাঁরা যাতে নৈশাবাসে যান, তার জন্য সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ সারা বছর ধরে করা হয়।’’
(চলবে)