গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
পাড়ায় কারও সঙ্গে প্রায় বাক্যালাপই ছিল না শুভব্রতর। কদাচিৎ দোকান-বাজারে যেতেন। স্টেশনারি দোকান থেকে শ্যাম্পু কিনতে গেলেও নাকি ইংরেজিতে কথা বলতেন। বাংলায় কথা প্রায় বলতেই চাইতেন না। এ হেন শুভব্রতর জন্য আচমকা শিরোনামে বেহালার অখ্যাত গলি।
গলির ঠিক মুখেই দোতলা বাড়িটা। ঠিকানা— ২৫, এস এন চ্যাটার্জি রোড। গৃহকর্ত্রী বীণা মজুমদারের মৃত্যু হয়েছিল বছর তিনেক আগে। আপাতত দেহ থাকবে পিস হাভেনে, ছেলে শুভব্রত বাইরে রয়েছেন, ফিরলে অন্ত্যেষ্টি হবে। জানিয়েছিলেন বীণাদেবীর স্বামী গোপালচন্দ্র মজুমদার। কিন্তু কবে ছেলে ফিরলেন, কবে অন্ত্যেষ্টি হল, নাকি আদৌ হল না, কেউ জানতেই পারেননি। তিন বছর পরে জানা গেল, পিস হাভেনে নয়, দেহ রাখা ছিল মজুমদারদের বাড়িতেই। বড় আকারের বিশেষ ফ্রিজ কিনেছিলেন শুভব্রত। রাসায়নিক প্রয়োগ করে সেই ফ্রিজের মধ্যে রেখে দিয়েছিলেন মায়ের দেহ!
বুধবার রাতে প্রকাশ্যে এসেছে এই ঘটনা। রাতেই শুভব্রতকে গ্রেফতার করে নিয়ে গিয়েছে পুলিশ। গোটা পাড়া চমকে গিয়েছে। পাশের বাড়িতেই একটা মৃতদেহ এত দিন ধরে লুকিয়ে রাখা ছিল! বিশ্বাস করতে পারছেন না অনেকেই? কেনই বা এ রকম করলেন শুভব্রত? মায়ের প্রতি অবিচ্ছেদ্য টান? নাকি মায়ের পেনশনটা বহাল রাখার ছক? কী ছিল উদ্দেশ্য? জোর জল্পনা এস এন চট্টোপাধ্যায় রোডের প্রত্যেকটা বাড়িতে।
আরও পড়ুন:
শুধু দেহ নয়, মাকে ‘রাখতেই’ কি এই আয়োজন
সংরক্ষণ কী ভাবে, কাটছে না ধোঁয়াশা
ঘটনার অস্বাভাবিকতায় এলাকার মানুষ হতচকিত হলেও, এই ঘটনায় শুভব্রতর ভূমিকা নিয়ে কিন্তু প্রায় কেউই বিস্মিত নন। এলাকার অনেকেই বলছেন, শুভব্রতর আচরণ বরাবরই একটু অস্বাভাবিকই ছিল। তাঁর পক্ষে এমন ঘটনা ঘটানো খুব অপ্রত্যাশিত নয়।
আর্যবীর চক্রবর্তী থাকেন ওই পাড়াতেই। ঠিকানা ২৫/৪ এস এন চ্যাটার্জি রোড। শুভব্রত মজুমদারের আর তাঁর বাড়ির মাঝে মাত্র একটা বাড়ি। আর্যবীর জানালেন, কোনও দিন পাড়ার কারও সঙ্গে শুভব্রতকে কথা বলতে দেখেননি তিনি। ‘‘আগে বাইরে থাকতেন। কিন্তু গত আড়াই-তিন বছর ধরে নিয়মিতই বাড়িতে যাতায়াত ছিল শুভব্রতর। তিনি ঠিক কী করেন, সে সব কেউ স্পষ্ট করে জানতেন না। শুভব্রতর বাবা গোপাল মজুমদারের সঙ্গে পাড়ার লোকের কথাবার্তা হত। কিন্তু ছেলে কী করেন, গোপালবাবু কোনও দিনই তা স্পষ্ট করে কাউকে জানাননি।’’ বললেন আর্যবীর।
বীণাদেবীর মৃতদেহ নিয়ে অস্বাভাবিক কোনও কাণ্ডকারখানা যে চলছে, সে রকম কানাঘুষো কিন্তু পাড়ার একাংশে ছিল। মজুমদার বাড়ির পরিচারিকার মাধ্যমেই সে খবর বাইরে আসে বলে জানা গিয়েছে। পরিচারিকার ছেলের গৃহশিক্ষক স্থানীয় রাজনৈতিক শিবিরে খবরটি জানান। একতলার একটা ঘরে দুটো এসি লাগিয়ে এক বিরাট ফ্রিজের মধ্যে মৃতদেহ রাখা হয়েছে বলে তিনি জানতে পেরেছিলেন। মৃতদেহ চিরে ভিতর থেকে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বার করে নেওয়া হয়েছিল, গজ ভরে দেওয়া হয়েছিল ভিতরে, পচন আটকাতে রাসায়নিক ব্যবহার করা হচ্ছে বলেও তিনি শুনেছিলেন। সে কথাই ওই গৃহশিক্ষক পাড়ার কয়েক জনকে জানিয়েছিলেন।
এস এন চ্যাটার্জি রোডের এই বাড়িই বুধবার রাত থেকে শিরোনামে। ছবি: সংগৃহীত।
শাসক দলের এক স্থানীয় নেতা বললেন, ‘‘আমার কানে এসেছিল কথাটা। আমি মজুমদার বাড়িতে যাই। সে-ও প্রায় বছর দু’য়েক আগে। আমরা সবাই জানতাম বীণা মজুমদার মারা গিয়েছেন। তাই ওঁদের বাড়িতে গিয়ে শুভব্রতর কাছে ডেথ সার্টিফিকেট চাই। ভোটার লিস্ট থেকে নামটা বাদ দিতে হবে, সেই জন্য ডেথ সার্টিফিকেট দরকার, বলেছিলাম শুভব্রতকে। দু’বার গিয়েছিলাম। ডেথ সার্টিফিকেট পাইনি। দ্বিতীয় দিন শুভব্রত খুব খারাপ ব্যবহারও করেছিলেন। তার পর আমরা আর মাথা ঘামাইনি।’’
ডেথ সার্টিফিকেট কেন দিতে চাননি শুভব্রত? প্রশ্ন উঠেছে তা নিয়েই। তাঁর মায়ের মৃত্যু হয়েছে, সে কথা চাপা ছিল না। কিন্তু সে সংক্রান্ত নথিপত্র বাইরে বেরনো রুখতে শুভব্রত কিছুটা তৎপর ছিলেন। একাংশের দাবি, বীণাদেবী সরকারি চাকরি করতেন। অবসরের পর মোটা পেনশন পেতেন। সেই পেনশন বহাল রাখতেই শুভব্রত বিষয়টি চাপা দিতে চেয়েছিলেন।
তিন বছর চাপাই ছিল বিষয়টা। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। বুধবার রাতে পুলিশ ঘিরে ফেলে মজুমদার বাড়ি। একতলার ঘরে রাখা ফ্রিজ থেকে উদ্ধার হয় বীণা মজুমদারের ‘মমি’। মেলে বেশ কিছু রাসায়নিকের ব্যারেল। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, যে ফ্রিজে মৃতদেহ রাখা হয়েছিল। সে রকমই আরও একটি ফ্রিজ কিনে রাখা হয়েছিল ওই বাড়িতে। মৃত্যুর পরে বাবার দেহও কি ওই ভাবেই সংরক্ষণ করার ইচ্ছা ছিল শুভব্রতর? প্রশ্ন তুলে দিয়েছে দ্বিতীয় ফ্রিজটি।
কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ ঘটনার তদন্ত হাতে নিয়েছে। বীণা মজুমদারের পেনশন প্রতি মাসে তাঁর অ্যাকাউন্টে ঢুকছিল কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। যদি তা ঢুকে থাকে, তা হলে সংশ্লিষ্ট ব্যাঙ্কের কর্মীরাও জড়িত থাকতে পারেন এই কাণ্ডে। কারণ পেনশনভোগীদের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময় অন্তর জীবিত থাকার শংসাপত্র দেখতে চায় ব্যাঙ্ক। শংসাপত্র না দেখানো গেলে বন্ধ হয়ে যায় পেনশন। বীণাদেবীর ক্ষেত্রেও সেই প্রক্রিয়া যদি অনুসৃত হয়ে থাকে, তা হলে তিন বছর ধরে তাঁর নামে পেনশন জমা পড়া সম্ভব নয়।
একাংশ আবার বলছেন, পেনশনটাই লক্ষ্য না-ও হতে পারে। মায়ের প্রতি অগাধ টান বা কোনও মানসিক বিকৃতির কারণেই হয়ত বাড়িতে বছরের পর বছর মৃতদেহ লুকিয়ে রাখছিলেন শুভব্রত। মনে করছেন প্রতিবেশীদের একাংশ। তবে তদন্তকারীরা সে বিষয়ে এখনও কোনও মন্তব্য করেননি। শুভব্রতর মানসিক বিকৃতি রয়েছে, এমন কোনও মন্তব্যও এখনও তদন্তকারীদের তরফে করা হয়নি।