কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। ফাইল চিত্র।
চুয়াত্তর বছরের বৃদ্ধের শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁর দেহ কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে দান করতে গিয়েছিলেন পরিজনেরা। কিন্তু হাসপাতাল থেকে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়, মৃতদেহ গ্রহণের শংসাপত্র পেতে হলে নোটারি হলফনামা জমা দিতে হবে!
মঙ্গলবার কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের এমন নিদানে অবাক ওই বৃদ্ধের পরিজনেরা এবং মরণোত্তর দেহদান আন্দোলনে যুক্ত অনেকেই। কারণ, দেহদান করার ক্ষেত্রে এমন কোনও সরকারি নিয়ম বা নির্দেশিকা রয়েছে বলে কারও জানা নেই। তবে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে এমন ঘটনা প্রথম নয়। এর আগে গত ৬ অগস্ট একই রকমের ভোগান্তির শিকার হতে হয়েছে টালিগঞ্জ ও বাগুইআটির দুই মৃতের পরিজনদের। জানা যাচ্ছে, ওই দিন টালিগঞ্জের বাসিন্দা সাগরনারায়ণ বাধানি ও বাগুইআটির সাধনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেহদান করতে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে আসা হয়েছিল। অভিযোগ, সেই সময়ে তাঁদের পরিজনদেরও ওই হাসপাতালের অ্যানাটমি বিভাগ থেকে জানানো হয়, নোটারি হলফনামা জমা দিতে হবে।
বুধবার সাধনার জামাই অর্ঘ্য মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘চিকিৎসাশাস্ত্রের উন্নতির জন্য আমরা দেহদান করছি। সেখানে নোটারি হলফনামার কী প্রয়োজন, তা আজও বুঝতে পারিনি। ওই দিন খুবই ভোগান্তি হয়েছিল।’’ তিনি জানাচ্ছেন, ৪ অগস্ট বছর ৮৫-র সাধনা মারা যান। পরদিন দুপুর ২টো নাগাদ তাঁরা মৃতদেহ নিয়ে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে পৌঁছন। তখন তাঁদের জানানো হয়, দেহ দিতে গেলে নোটারি হলফনামা জমা করতে হবে। বৃদ্ধার দুই মেয়ে সেখানে উপস্থিত থেকে সম্মতিপত্র দেওয়ার পরেও কেন এমন হলফনামা লাগবে, প্রশ্ন তোলেন অর্ঘ্য। তাঁর কথায়, ‘‘অ্যানাটমি বিভাগের এক জন চিকিৎসক খুব দুর্ব্যবহার করেন। জানিয়ে দেন, নোটারি হলফনামা না দিলে দেহ নেওয়া যাবে না। যেন দেহ ফিরিয়ে নিয়ে যাই। তখন আমি চেঁচামেচি করায় দেহটি নেওয়া হয়।’’
কারও মৃত্যু হলে তাঁর পরিজনেরা শোকগ্রস্ত থাকেন। ওই পরিস্থিতিতে সমাজের ভালর জন্য কোনও কাজ করতে গিয়ে যদি তাঁদের এমন হেনস্থার শিকার হতে হয়, তবে কি দেহদান আন্দোলন ক্ষতিগ্রস্ত হবে না? মরণোত্তর দেহদান আন্দোলনের সঙ্গে দীর্ঘদিন যুক্ত শ্যামল চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘কোনও মেডিক্যাল কলেজ এ ভাবে নোটারি হলফনামা চায় না। শুধু কলকাতা মেডিক্যাল কলেজেই দাবি করা হয়। এতে মৃতের পরিজনদের ভোগান্তি বাড়ে। এমন হতে থাকলে তো মরণোত্তর দেহদানে কেউ আগ্রহীই হবেন না।’’ কলকাতারই আরও একটি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের এক কর্তা জানাচ্ছেন, মৃতদেহ গ্রহণের সময়ে নিকট আত্মীয়ের থেকে সম্মতিপত্র নেওয়া হয়। কোনও ব্যক্তি যদি জীবিত অবস্থায় অঙ্গীকার করে যান, তা হলে সেই নথি জমা নেওয়া হয়। সেগুলির বিনিময়েই মৃতদেহ গ্রহণের শংসাপত্র দেওয়া হয় পরিজনকে। তিনি আরও বলেন, ‘‘তবে অ্যানাটমি বিভাগের মর্গে জায়গা না-থাকলে মৃতদেহ নেওয়া যায় না। আর তো কোনও সমস্যা হওয়ার কথা নয়।’’
শ্যামলের দাবি, ‘‘গত ৫ অগস্টের ঘটনার পরে বিষয়টি রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা দেবাশিস ভট্টাচার্যকে জানাই। তিনিও জানিয়ে দেন, এমন কোনও নিয়ম নেই।’’ কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের অ্যানাটমি বিভাগের প্রধান কল্যাণ ভট্টাচার্যের দাবি, অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকেই মৃতদেহ গ্রহণের শংসাপত্র নেওয়ার সময়ে পরিজনদের নোটারি হলফনামা জমা দিতে বলা হয়। তাঁর দাবি, ‘‘এক বার এক মৃতের পরিজনেরা বিদেশ থেকে এসে প্রশ্ন তোলেন, তাঁরা সম্মতি না দেওয়া সত্ত্বেও কেন দেহ নেওয়া হয়েছে? তা নিয়ে বিস্তর সমস্যা হয়েছিল। তাই পূর্বতন বিভাগীয় প্রধান এমন হলফনামা জমা নেওয়া চালু করেছিলেন।’’
তবে কল্যাণের আরও দাবি, ‘‘দেহদান করার সময়ে ওই নোটারি চাওয়া হয় না। সেই সময়ে জানিয়ে দেওয়া হয়, যাতে কয়েক দিন পরে সার্টিফিকেট নিতে আসার সময়ে ওই নোটারি নিয়ে আসেন।’’ রাজ্যের স্বাস্থ্যসচিব নারায়ণস্বরূপ নিগমের কথায়, ‘‘দেহদানের ক্ষেত্রে নোটারি হলফনামা জমা দেওয়ার কোনও নিয়মই নেই। সম্মতিপত্র দিলেই চলে। বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখছি।’’