এই রকমই এক বর্ষার দিনে, ১৮২৮ সালে অগস্ট মাসের ২০ তারিখে, বুধবার, রাজা রামমোহন রায় আত্মীয় সভা থেকে তৈরি করলেন নতুন সংগঠন, ব্রাহ্ম সমাজ। ‘সভা’ থেকে ‘সমাজ’? কেবলই কি শব্দের তফাত? না কি এর কোনও আলাদা তাৎপর্য ছিল? বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ব্রায়ান হ্যাচার বলছেন, তাৎপর্য ছিল, গভীর। আলাদা ‘পলিটি’ বা সমাজ তৈরির মাধ্যমে, আলাদা নেতৃত্ব নির্মাণের সূত্রে, এক স্থায়ী বিধিবদ্ধ জীবনযাপনের দিশা তৈরি হল সে দিন— রামমোহন (ডান দিকের ছবি) রইলেন যার কেন্দ্রে।
বাংলা ও ভারতের ইতিহাসে রাজা রামমোহন রায় পরিচিত ‘সংস্কারক’ হিসেবে, সংস্কারের মাধ্যমে আধুনিকতার উদ্বোধক হিসেবে। এ-ও আজ বহু-আলোচিত যে, এই আধুনিকতা বা মুক্তির অনেকটাই পশ্চিমি সভ্যতার আয়নায় দেখা। ব্রিটিশ নথিপত্রে প্রথম থেকেই রামমোহনের যে ‘সমাজ’ সম্পর্কে প্রভূত আগ্রহ প্রকাশিত— আধুনিকতা, বা আরও স্পষ্ট করে দেখলে, ঔপনিবেশিক আধুনিকতা থেকে কি তাকে বিচ্ছিন্ন করে বোঝা যায়?
প্রশ্নটা নতুন করে ফিরিয়ে আনলেন হ্যাচার তাঁর সদ্য-প্রকাশিত বইতে, যার নাম হিন্দুইজ়ম বিফোর রিফর্ম (হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি, ২০২০)। আনলেন এক অসাধারণ তুলনার মধ্যে দিয়ে। ভারতের পুব দিকে বাংলায় যখন রামমোহন-সংস্কারের যুগ, ঠিক তখনই পশ্চিম দিকে গুজরাতে চলছে সহজানন্দ স্বামীর (বাঁ দিকের ছবি, শিক্ষাপত্রী পত্রিকায় তাঁর প্রতিকৃতি) ধর্ম-সংস্কার, তৈরি হচ্ছে আর এক ‘পলিটি’ বা সমাজ, স্বামীনারায়ণ সম্প্রদায়। দুই নেতা একেবারেই সমসাময়িক: রামমোহন ১৭৭২-১৮৩৩, আর সহজানন্দ ১৭৮১-১৮৩০। সহজানন্দের কথা স্বল্পশ্রুত, কিন্তু তিনিও ‘সংস্কারক’, হিন্দুধর্ম আবর্জনামুক্ত করার ‘নেতা’। একই সময়ে দুই সংস্কার আন্দোলনে দুই নেতৃত্ব, একটি ইতিহাসের মনোযোগ পেয়েছে, অন্যটি পায়নি। একটির বিশ্বজোড়া পরিচিতি জুটেছে, অন্যটি কেবল আঞ্চলিক (প্যারোকিয়াল) বিষয় হয়ে থেকেছে। উনিশ-বিশ শতকে এক বিশিষ্ট ইতিহাস ব্রাহ্ম সমাজকে ঘিরে। আর একুশ শতকে নিজের প্রবল উপস্থিতি জানান দিচ্ছে স্বামীনারায়ণ সমাজ, যখন ব্রাহ্ম সমাজ সর্বার্থে নির্বাপিত। তবে কি এর মধ্যে লুকিয়ে অন্য একটা গল্প? ইতিহাসচর্চার ঘরানাই ঠিক করে দেয়, কোন ইতিহাস আমরা কী ভাবে দেখি?
বিদ্যাসাগর ও হিন্দু সমাজ-সংস্কারের ইতিহাস রচনার সূত্রে আমেরিকার টাফটস ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ব্রায়ান হ্যাচার উনিশ শতকের ধর্ম-আন্দোলনের বিশেষজ্ঞ হিসেবে শ্রদ্ধেয়। নতুন বইটির ভাবনা কী ভাবে তাঁর মাথায় এল, তা-ও কম কৌতূহলজনক নয়। তাঁর নিয়মিত ভারত-সফরগুলির একটিতে, ২০১৩ সালে, দিল্লি থেকে তিনি আমন্ত্রণ পান সহজানন্দ ও স্বামীনারায়ণ সম্প্রদায় নিয়ে বক্তৃতা দিতে। অনিচ্ছা পেরিয়ে শেষে রাজি হন, এবং এই অভিজ্ঞতাই তাঁকে নতুন গবেষণার দিকে ঠেলে দেয়। ‘ধর্ম-সংস্কার আন্দোলন’ বিষয়ে অনেক প্রশ্ন এসে দাঁড়ায় সামনে। কাকে বলে সংস্কার? কোনটা আন্দোলন হিসেবে বরণীয় হয়, কোনটা হয় না? দুই নেতা এক সময়ে এক ধরনের কাজ করছিলেন— কোথায় তাঁদের পথ আলাদা হল? হ্যাচারের নতুন বই ভারতের ধর্ম-ইতিহাসের নতুন জিজ্ঞাসা তৈরি করবে, নিশ্চিত।
স্মৃতিমেদুর
বাবার ছেলেবেলার গল্প শোনালেন শাঁওলী মিত্র। ‘পঞ্চম বৈদিক’-এর ফেসবুক পেজ-এ, গত শনিবার ২২ অগস্ট, শম্ভু মিত্রের (১৯১৫-১৯৯৭) জন্মদিনে। ‘‘বাবা-মার মুখেই ওঁদের পুরনো দিনের গল্প শুনতাম,’’ স্মৃতিমেদুর শাঁওলীর স্বর, ‘‘জর্জমামারও (দেবব্রত বিশ্বাস) জন্মদিন ২২ অগস্ট। ওঁর রাসবিহারী রোডের বাড়িতে বিয়ের পর বাবা-মা ছিলেন কিছু দিন। অগস্ট, ১৯৪৬-এ দাঙ্গা চলছিল কলকাতায়, প্রখ্যাত গায়ক কলিম শরাফী এসে উপস্থিত হন ওই বাড়িতে। তখন শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি এবং জর্জ বিশ্বাস কেমন করে তাঁকে লুকিয়ে রেখেছিলেন সে গল্প শুনেছি কত বার। এঁদের পারস্পরিক শ্রদ্ধা, ভালবাসা ও বিশ্বাস এমন এক জায়গায় ন্যস্ত ছিল যার তুলনা বিশেষ দেখতে পাই না।’’ অগস্ট রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণমাস, যে-রবীন্দ্রনাথকে তাঁর নাট্যকলার ভিতর দিয়ে প্রাতিষ্ঠানিকতার বিরুদ্ধে বাঙালির লড়াইয়ের প্রধানতম আধেয় করে তুলেছিলেন শম্ভু মিত্রই। ‘‘আমাদের ফেসবুক পেজে শম্ভু মিত্র তৃপ্তি মিত্রকে নিয়ে এমন অনুষ্ঠান আরও করবেন শাঁওলীদি।’’ জানালেন অর্পিতা ঘোষ, ‘পঞ্চম বৈদিক’-এর তরফে।
শিল্পে দেশভাগ
দেশভাগের ক্ষত আজও মিলিয়ে যায়নি দেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক স্মৃতি থেকে। ৭৩ বছর আগের সেই সংঘটনকে মনে রেখে কলকাতা সেন্টার ফর ক্রিয়েটিভিটি ও কলকাতা পার্টিশন মিউজ়িয়াম যৌথ ভাবে ১৭ অগস্ট আয়োজন করেছিল ওয়েবিনার— ‘রিমেমবারিং দ্য পার্টিশন: ইন দ্য শ্যাডো অব ১৯৪৭’। শিল্প ও শিল্পীর চোখ দিয়ে দেশভাগকে ফিরে দেখা। ছিলেন পলা সেনগুপ্ত, বিনায়ক ভট্টাচার্য, দেবাশিস মুখোপাধ্যায়, অমৃতা সেন, ঋতুপর্ণা রায়, রাজশ্রী মুখোপাধ্যায়, তাঁদের সঙ্গে কথা বললেন রিনা দেওয়ান। পলা বললেন তাঁর প্রথম বাংলাদেশ ভ্রমণের কথা, শেকড়ের খোঁজে গিয়েছিলেন ঢাকা থেকে বগুড়া, খুঁজে বার করেছিলেন মায়ের ফেলে আসা বাড়ি। তাঁর কাজেও সেই অভিজ্ঞতার ঠাঁই— নকশি কাঁথা, মেনু কার্ড, ঠাকুরের জায়গা, আলমারি। বিনায়কের কাজের ক্ষেত্র ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত। সাদা-কালোয় ফুটে উঠেছে কাঁটাতার, খণ্ডবিখণ্ড চাষের জমি, সীমানার ও পারের বাংলাদেশের শিশুদের ছবি। নজর কাড়ল দেবাশিস মুখোপাধ্যায়ের একটি সৃষ্টি— সাদা থান পর পর সাজিয়ে তার ওপরে ফুটিয়ে তোলা তাঁর ‘দিদা’র প্রতিকৃতি।
শিক্ষক
কলকাতা ও দিল্লিতে মেট্রো রেল পরিষেবা চালু হওয়ার নেপথ্যে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। মাটির স্বাস্থ্য, ভূগর্ভস্থ পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয়ে প্রশ্নাতীত ছিল তাঁর অভিজ্ঞতা, যা কাজে লেগেছে মেট্রোর টানেল খনন থেকে শুরু করে ন্যাশনাল হাইওয়ে, সোনালি চতুর্ভুজ গড়ে তুলে গোটা দেশকে যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে বেঁধে ফেলার মতো প্রকল্পে। পড়শি শহর ঢাকায় চলছে মেট্রো প্রকল্প, তারও পরামর্শদাতার ভূমিকা পালন করেছিলেন অধ্যাপক নীতিন্দ্রনাথ সোম (ছবিতে)। জন্ম ১৯৪১ সালে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে গবেষণা করতে পাড়ি দেন লন্ডনে। ১৯৬৮ সালে ইম্পিরিয়াল কলেজ থেকে পিএইচডি, গবেষণার বিষয় ছিল বল প্রয়োগে মাটির কণার গঠনতন্ত্রের পরিবর্তন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন সুদীর্ঘ চার দশক, ছিলেন বিভাগীয় প্রধানও। ইন্ডিয়ান জিয়োটেকনোলিজক্যাল সোসাইটি-র প্রেসিডেন্ট ও দ্য ইনস্টিটিউশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স-এর সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিভিশনস-এর চেয়ারম্যান পদও অলঙ্কৃত করেছিলেন তিনি। গত ৩১ জুলাই কলকাতায় প্রয়াত হলেন ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভূবিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদ।
সৌভ্রাতৃত্ব
সঙ্কটেই বেশি প্রয়োজন সৌভ্রাতৃত্ব। লকডাউন ইস্তক শহরের থিয়েটার হলগুলো বন্ধ, আনলক পর্বেও সেগুলি একই আঁধারে। বহু মানুষের জীবন-জীবিকা নাটকের প্রদর্শন-নির্ভর, করোনাবন্দি জীবনে তাঁদের সঙ্গে যোগ হয়েছে অভিনয়শিল্পী ও আনুষঙ্গিক ক্ষেত্রের কর্মী। এঁদের পাশে দাঁড়াতেই কলকাতার বেশ কয়েকটি নাট্যদল ও বৃহত্তর নাট্য-পরিবারের সদস্যদের সম্মিলিত উদ্যোগ ‘সৌভ্রাতৃত্ব’। আছেন অমিতাভ দত্ত, বিমল চক্রবর্তী, শেখর চক্রবর্তী, দেবশঙ্কর হালদার, কৌশিক সেন, বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায়, কিশোর সেনগুপ্ত, সীমা মুখোপাধ্যায়, বিলু দত্ত, ঈশিতা মুখোপাধ্যায়, অরূপ বাউল— আরও বহু নাম। নামগুলো জরুরি নয়, যতটা জরুরি হাত বাড়িয়ে দেওয়ার কাজটা, বলছেন ওঁরা। মার্চেই তহবিল গড়ে অনুদান সংগ্রহ, হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ, খোঁজ— কে কেমন আছেন, মুখ ফুটে সাহায্যের কথা বলতে পারছেন না কারা। বিপন্ন কলাকুশলীদের সাহায্য শুরু মার্চ থেকেই, জুন থেকে ফ্রিল্যান্স নাট্যাভিনেতাদেরও পাশে। চলতি অগস্ট অবধি ওঁদের সাহায্যের পরিমাণ তেরো লক্ষ টাকারও বেশি। অর্থ সব কথা বলে না, ‘ভরসা ও ভালবাসায় থিয়েটারের একত্রতা’ই এ শহরের সবচেয়ে বড় পাওয়া।
অনাড়ম্বর
বিধায়ক, মন্ত্রী, সাংসদ— অনেক কেতাদুরস্ত পরিচয় ছিল তাঁর। কিন্তু সে সবে বড় আগ্রহ ছিল না, আড়ম্বর প্রকাশেও ছিল আপত্তি। বরং সগর্বে উচ্চারণ করতেন: ‘পার্টি হোলটাইমার’। ৬ অগস্ট প্রয়াত হলেন বামপন্থী শ্রমিক নেতা শ্যামল চক্রবর্তী। তাঁকে ঘিরে যে কথাগুলো উঠে আসছে, তা যেন এক বিগতপ্রায় যুগের। শোনা যায়, বহু সাংবাদিকের সঙ্গে ব্যক্তিগত সখ্য থাকা সত্ত্বেও কখনও পার্টি সংক্রান্ত টুকরো খবরও তাঁর কাছ থেকে ফাঁস হয়নি। কমিউনিস্টসুলভ শৃঙ্খলা বলতে যা বোঝায়, ছিলেন তার মূর্ত রূপ। সাদামাঠা জীবন, চাকরিজীবী স্ত্রীর মৃত্যুর পর সংসারে এসেছে অনটনও। মেয়ে উষসী জানিয়েছেন কল্লোল নাটক দেখতে গিয়ে বাবা তাঁর কানে ফিসফিস করে বলেছিলেন, “লড়াইটাই আসল। প্রতিরোধটাই জরুরি। জেতা-হারাটা নয়।” জীবনের শেষ সংগ্রাম পর্যন্ত বোধ হয় এই মন্ত্রেই ভর করেই সকলের মনে থেকে গেলেন লড়াকু এই রাজনীতিক।
চিত্রকর সত্যজিৎ
‘‘তাঁর রঙের ব্যবহার ছিল পরিমিত। সাদা-কালোর ওপরেই জোর দিতেন বেশি। বলতেন, রং দিলেই যে ছবি সাংঘাতিক জায়গায় পৌঁছে যায় তা কিন্তু নয়। পরের দিকে অবশ্য শঙ্কু-র ছবিতে রং নিয়ে প্রচুর খেলা করেছেন।’’ আলোচনা করছিলেন দেবাশীষ দেব, সত্যজিৎ রায়ের ইলাস্ট্রেশন বিষয়ে, আনন্দমেলা-র পাতায় আঁকা বারীন ভৌমিকের ব্যারাম (সঙ্গের ছবিতে তারই একটি অলঙ্করণ) প্রসঙ্গে বললেন, ‘‘এখানে চরিত্রটাকে নিয়ে যে সন্দেহ আর টেনশন, সেই রহস্যময়তা আনতে কাটআউট করে তাতে রং দিয়েছেন, কম রং দিয়েই গ্রাফিক্সের মজাটা বাড়িয়ে দিয়েছেন।’’ গত ১৫ অগস্ট সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত হল ‘চিত্রকর সত্যজিৎ’ শীর্ষক ফেসবুক লাইভ আলোচনা। ছেলেবেলা থেকে ছবি আঁকার অভ্যেস, আঁকা শিখতে ও শিল্পকলার ইতিহাস জানতে শান্তিনিকেতনে যাওয়া, তার পর কলকাতায় ফিরে কমার্শিয়াল আর্টের দুনিয়ায় নিজের বিস্ময়কর প্রতিভাকে মেলে ধরা সত্ত্বেও কোথাও যেন অনালোচিতই থেকে গিয়েছেন চিত্রকর সত্যজিৎ রায়। এই সূত্রে তাঁর আঁকায় ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মেলবন্ধনের কথা উল্লেখ করে চিন্ময় গুহ বললেন তাঁর ছবির সৌন্দর্যতত্ত্ব নিয়ে— কী ভাবে দর্শকের ‘দেখার দৃষ্টি’ তৈরি করে দিয়েছিলেন তিনি। চল্লিশ-পঞ্চাশ-ষাটের দশকে আন্তর্জাতিক পরিসরে বিভিন্ন সৃষ্টির নির্যাসকে কী ভাবে নিজের চিত্রভাবনায় আত্তীকরণ করেছিলেন সত্যজিৎ রায়, নমুনা পেশ করে বোঝালেন পিনাকী দে। আর সন্দীপ রায়— সত্যজিতের দিনযাপনের সঙ্গী— বললেন, আঁকার সময়ে জি সি লাহা-র ‘ড্রয়িং ব্লক’ ব্যবহার করতেন তিনি, ‘‘কখনও টেবিলের ওপর কাজ করতে দেখিনি, পা ভাঁজ করে হাঁটুর ওপর বোর্ড রেখে আঁকতেন... শান্তিনিকেতনের অভ্যেস।’’ সত্যজিৎ রায়ের শতবর্ষে এই আয়োজন সত্যজিৎ রায় ফিল্ম সোসাইটি বেঙ্গালুরু ও কলকাতার সত্যজিৎ রায় সোসাইটির, সঙ্গের ছবিটি তাদের সৌজন্যেই।
ঠাকুরবাড়ির গান
লেডি ল্যান্সডাউনের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান জোড়াসাঁকোয়, সেখানে বাল্মীকিপ্রতিভা-র অভিনয়ে হাত-বাঁধা বালিকা সাজলেন ছোট্ট একটি মেয়ে— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভ্রাতুষ্পুত্রী, হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যা অভিজ্ঞা দেবী। আগেও তার অভিনয় দেখা গিয়েছে কালমৃগয়া-য়। সেখানে অন্ধমুনির সামনে লীলা চরিত্রে যে গান গেয়েছিল, ‘…তাহা শুনিলে পাষাণ হৃদয়ও বিগলিত হয়’, লিখেছিলেন মন্মথনাথ ঘোষ, সাপ্তাহিক ভারতবন্ধু-তে। অভিজ্ঞার মূল অধিকার রবীন্দ্রসঙ্গীতে, তাঁর প্রতিভায় বিস্মিত রবীন্দ্রনাথ থেকে অবনীন্দ্রনাথ, প্রমথ চৌধুরী। কিন্তু বিয়ের এক মাসের মধ্যে মাত্র বাইশ বছর বয়সে মারা যান অভিজ্ঞা। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঘরোয়া-তে লিখেছেন, “এখনো ‘মায়ার খেলা’র গান যদি কাউকে গাইতে শুনি, তার গলা ছাপিয়ে কতদূর থেকে আমাদের সেই বোনটির গান যেন শুনি।” এই বিরল প্রতিভাকে নিয়েই ‘অন্য-মনস্ক’ সংস্থার তথ্যচিত্র অভিজ্ঞা দেবী: এক অশরীরী সঙ্গীত প্রকাশ পেল ইউটিউবে। পরিচালনায় অনিন্দিতা চক্রবর্তী। তথ্যচিত্রটির আধার ‘ঠাকুরবাড়িতে রবিঠাকুরের গানের দল’ বিষয়ে পীতম সেনগুপ্তের তথ্যানুসন্ধান। অন্য দিকে, ‘ঠাকুরবাড়ির গান’-এর তিন প্রজন্মের ধারার মধ্য দিয়ে উনিশ শতকের বাংলা গানের বিবর্তনকে ধরেছে নেতাজিনগর কলেজের বাংলা বিভাগ ও আইকিউএসি-র আন্তর্জাতিক ওয়েব-আলোচনাচক্র। গতকাল ২৩ জুলাই সেখানে বললেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্বভারতীর দুই গবেষক সুকান্ত চক্রবর্তী ও অভিজিৎ মজুমদার। গাইলেন গানও।
কলকাতার উষা
পার্ক স্ট্রিটের ট্রিংকাজ়-এ দক্ষিণ ভারতীয় মেয়েটি গান ধরেছিলেন, ‘পুরানো সেই দিনের কথা...’ বিলিতি সুরে মন-মাথা ঝাঁকানো, স্যুট-বুট পরা বাঙালি বাবুরা লুফে নিয়েছিলেন সে গান। রমণীয় কলকাতার অভিজাত সান্ধ্য আসরে রবীন্দ্র-গানকে হাত ধরে নিয়ে এসেছিলেন উষা আইয়ার, আজকের উষা উত্থুপ। চেন্নাই-দিল্লি-মুম্বই সব শহর ঘুরে কলকাতাই যে হয়ে উঠবে তাঁর কপালের টিপ, ভালবাসার ঠিকানা, আশ্চর্য কী! মঞ্চ, রেডিয়ো, এল পি রেকর্ড, ক্যাসেট, সিডি হয়ে আজকের ডিজিটাল পরিসর, উষার দীর্ঘ সঙ্গীতপথ আসলে মিউজ়িকেরই ইতিহাস ও বিবর্তন। বাংলা জানতেন না, কিন্তু ‘ওই মালতীলতা দোলে’ বা ‘এল বরষা যে সহসা’-র মতো এক-একটা বাংলা গানের সুর তাল রোম্যান্স দোলা দিয়ে যেত তাঁর কে এল সায়গল থেকে ফ্রাঙ্ক সিনাত্রা শোনা কানে। পার্ক স্ট্রিটের রেস্তরাঁয় তাঁর গানে বুঁদ উত্তমকুমার, সুপ্রিয়া দেবী, অমিতাভ বচ্চন, কবীর বেদী থেকে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়, সুখস্মৃতি উষার। আসতেন নারীরা, শিশুদের নিয়ে মায়েরাও। বার-নাইট ক্লাবফেরত কলকাতার ভুরু-কুঁচকানো মূল্যবোধ পাল্টে গিয়েছিল তাঁর গানে। মাদ্রাজি এক মেয়ের অচেনা এক ভাষা-শহর-সংস্কৃতির বাধা ঠেলে এগিয়ে যাওয়ার প্রশংসা করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। গানই তাঁর সবর্স্ব, একই নিষ্ঠায় গেয়েছেন হরে রাম হরে কৃষ্ণ বা সাত খুন মাফ-এর গান, অজস্র বিজ্ঞাপনী জিঙ্গলও। তাঁর সঙ্গীতজীবনের পঞ্চাশ পূর্তিতে প্রচুর গল্প করলেন, গান গাইলেন উষা। অনলাইন অনুষ্ঠানটির আয়োজনে ছিল অ্যাডভার্টাইজ়িং ক্লাব কলকাতা।
গান-আলাপ
আজীবন রবীন্দ্রনাথে ডুবে থাকা এক জন শেষ শয্যায় শুনতে চেয়েছিলেন ‘তুমি নির্মল করো’। কোন গান যে কোন বেদনার উপশম নিয়ে আসতে পারে, আমরা হয়তো নিজেরাও জানি না। এই অতিমারি-ধ্বস্ত সময়ে কি গান শুশ্রূষা হয়ে উঠতে পারে? যে রবীন্দ্রসঙ্গীতের কাছে আমরা হরেক বিপন্নতায় আশ্রয় প্রার্থনা করি, এই ত্রাসে কি আমাদের ত্রাতা হবে সে? বা নজরুলগীতি, অতুলপ্রসাদি? সে কথা মাথায় রেখেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট অব পারফর্মিং আর্টস অ্যান্ড মিউজ়িক (ভূতপূর্ব বেঙ্গল মিউজ়িক কলেজ) আয়োজন করেছে আন্তর্জাতিক ওয়েবিনার— ‘আজকের পরিস্থিতিতে বিভিন্ন ধরনের বাংলা গানের তাৎপর্য’। বলবেন বাংলাদেশের দুই প্রখ্যাত শিল্পী— ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক লাইসা আহমেদ লিসা ও ‘ছায়ানট’ সংস্থার উপসভাপতি খায়রুল আনাম শাকিল, সঙ্গে কলকাতার রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের নূপুর গঙ্গোপাধ্যায়। সঞ্চালনায় রাজশ্রী ভট্টাচার্য। ২৬ অগস্ট, সন্ধে ছ’টায় দেখা যাবে বেঙ্গল মিউজ়িক কলেজের ফেসবুক পেজে।
শিল্প গ্যালারি
শিল্পবস্তু বা অলঙ্কৃত চিত্র দুই চোখের তারাকে সরাসরি যে ভাবে চমৎকৃত করে, ডিজিটাল পর্দার এ পার হতে দেখলে কি তার সেই সম্মোহন অটুট থাকে? এই সব তর্কবিতর্কের মাঝেই স্বাধীনতা দিবসের গোধূলিবেলায় উন্মোচিত হল ডিজিটাল শিল্প গ্যালারি আর্টওয়েভ ইন্ডিয়া ও তাদের ওয়েবসাইট আর্টওয়েভইন্ডিয়া ডট কম। এই ওয়েব-পরিসরটি খ্যাতনামা ও নবীন চিত্রকর, আলোকচিত্রী, ভাস্কর, সেরামিক শিল্পী, স্থপতি, গ্রাফিক আর্টিস্ট, শিল্পলেখক, সমঝদারদের মিলনমেলা। ‘আর্কাইভ’ বিভাগে আছে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভারতমাতা ও শাহজাহানের মৃত্যু ছবি দু’টি নিয়ে প্রবাসী ও মডার্ন রিভিউ পত্রিকায় প্রকাশিত ভগিনী নিবেদিতার শিল্প সমালোচনা। পাশাপাশি রয়েছে আধুনিক বিশ্বের শিল্পভাবনা নিয়ে মূল্যবান আলোচনা— বিপণন জগতের শিল্পচেতনা, একুশ শতকের শিল্পভাষ্য নিয়ে নিবন্ধ। ভিডিয়ো গ্যালারিতে রেমব্রান্ট থেকে রামকিঙ্কর বেজকে নিয়ে তথ্যচিত্র, লিয়োনার্দো দা ভিঞ্চি ও পাবলো পিকাসোকে নিয়ে বিবিসির ডকুমেন্টারির লিংক। শুভব্রত নন্দীর তত্ত্বাবধানে তৈরি এই শিল্প-পরিসরের পরামর্শদাতা রূপে যুক্ত যোগেন চৌধুরী, অভিজিৎ দাশগুপ্ত, মৃণাল ঘোষ, সুশোভন অধিকারী, বিমল কুণ্ডু প্রমুখ। ‘অনলাইন প্রদর্শনী’ বিভাগে আছে গণেশ হালুই (ছবিতে তাঁরই আঁকা একটি), যোগেন চৌধুরী, অমল চাকলাদার, জয়শ্রী চক্রবর্তী সমীর আইচ-সহ বিশিষ্ট শিল্পীদের আঁকা ছবি। ওয়েবসাইটে প্রদর্শনীটি দেখা যাবে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত।
বিস্ময়ে তাই
অগস্টের ১৮ আর ২২, প্রয়াণদিন ও জন্মদিনে তিনি ভেসে উঠেছেন সামাজিক মাধ্যমে। ‘ভেসে উঠেছেন’ বলা অন্যায়, বাঙালির মনোভূমে তিনি চিরজীবী। ছক ভাঙাই তাঁর ছক, তা বলে ব্যাকরণ ভাঙার ছদ্মগোসাঁই নন। রবীন্দ্রগানের অমিয়-পেয়ালা ঠোঁটে তুলেছিলেন গণগানের আসঙ্গে। রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের ছোট্ট অগোছালো ঘরটিকে করে তুলেছিলেন নতুন-কিছু-ভাবা মানুষের ছাউনি। চিঠির উত্তর দিতেন নিয়ম করে, পারলে সঙ্গে কিছু এঁকে। গান শিখতে আসা শিক্ষার্থীদের নিজের দু’চাকায় পৌঁছে দিতেন বাড়ি। খ্যাতির তুঙ্গ অবস্থাতেও তিনি সর্ব-ছাড়া, উত্তমকুমার তাঁর অনুষ্ঠান-ঘোষণায় নাম উল্লেখ না করে বলেন ‘এ বার আসছেন এক বিতর্কিত শিল্পী’... তিনি দেবব্রত বিশ্বাস। এখন আপাতত সংক্রমণকাল, তাই সবই অনলাইন। তাঁর ১০৯তম জন্মদিনে দেবব্রত বিশ্বাস স্মরণ কমিটি ও টেগোর সোসাইটি কলকাতা এক ওয়েবিনারে তাঁকে স্মরণ করল গান, কবিতা, স্মৃতিচারণে। ‘বিলেতে বাঙালি’-র উদ্যোগে ‘আমাদের জর্জদা— বর্ষায়’ অনুষ্ঠানে দেবব্রত বিশ্বাসের বাড়ি থেকে গান শোনালেন অরুণ গঙ্গোপাধ্যায়। মিলে গেল কলকাতা থেকে ঢাকা, লন্ডন, টরন্টো, হিউস্টন। ৩০ অগস্ট সন্ধে ৭টায় ‘ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি হিস্ট্রি স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন’-এর ফেসবুক-পেজে প্রিয়দর্শী চক্রবর্তী বলবেন ‘রুদ্ধ সঙ্গীতের শৃঙ্খলমুক্তি’ নিয়ে। অননুকরণীয় মাধুর্য ও গাম্ভীর্যের এই জর্জ-সংক্রমণ নিশ্চিত ভাবেই বাঙালির চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত।