চিরবিদায়ের আগে অসুস্থ শরীরে রবীন্দ্রনাথ যখন কলকাতায়, মা সুপ্রভা রায়কে ১৯৪১ সালের ৪ অগস্ট তারিখে শান্তিনিকেতন থেকে সত্যজিৎ রায় (তখন কলাভবনের ছাত্র) এক চিঠিতে লিখছেন: “রবীন্দ্রনাথের অবস্থা কাল নাকি খুব খারাপ হয়েছিল। কাগজে কিছুই লেখেনি তবে এখানে wire এসেছিল ‘conditiocausing great anxiety’। অনেকে চলে গেছেন।” পরের চিঠিতেই আবার লিখছেন, “এখানে অবনীবাবুর 70th birthday খুব ঘটা করে celebrate করা হবে।” কিন্তু অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ওই বছরের জন্মদিনটিতেই (৭ অগস্ট) প্রয়াত হন রবীন্দ্রনাথ।
কয়েক মাস আগে শান্তিনিকেতনে থাকাকালীন তাঁকে দেখতেও গিয়েছিলেন সত্যজিৎ। নিজের একটি লেখায় উল্লেখ করেছেন, “শেষবারের মতো যখন শান্তিনিকেতন ছেড়ে চলে আসছেন তখন আমরা তাঁর বাসটাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে।” (আনন্দবাজার পত্রিকা, ৮ মে ১৯৭৮)। ১৯৪০-এ কলকাতায় পড়াশোনার পাট চুকিয়ে সত্যজিৎ শান্তিনিকেতনে যান কলাভবনে ছবি আঁকা শিখতে। এর বছরকয়েক আগে কলকাতায় এক সাহিত্যসভায় তাঁর সঙ্গে দেখা হয় রবীন্দ্রনাথের, তিনি বলেছিলেন, “আমার আশ্রমে চলে এস না কিছুদিনের জন্য।” পরে মায়ের কাছে শুনেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের নাকি এটি অনেক দিনের ইচ্ছে। সত্যজিতের খুব একটা আগ্রহ ছিল তা নয়, কলকাতা ছেড়ে থাকতেই তাঁর ভাল লাগত না, যাওয়ার সময় বলেও গিয়েছিলেন মা’কে: “ভাল না লাগলে চলে আসব।”
শান্তিনিকেতনে গিয়ে সুপ্রভাদেবীকে লেখা তাঁর প্রথম চিঠিতেই সেই ভাল না-লাগা টের পাওয়া যায়: “জায়গাটা এত depressing— যে চিঠি লেখা দূরের কথা— কিছুই করতে ইচ্ছা করে না। নেহাৎ আঁকাগুলো তাড়াতাড়ি শেষ করতে পারলে পুজোর ছুটি হবার দিন পনের আগে বাড়ী যেতে পারব তাই আঁকছি।” (২৩ জুলাই ১৯৪০)। আর একটি চিঠিতে নিজের লখনউ যাওয়া বাতিল করে মা’কে কলকাতায় ফেরার কারণ জানাচ্ছেন: “Symphony concerts, ভাল Cinemas etc, miss করতে আমি চাই না।” (১৬ ডিসেম্বর ১৯৪০)।
কলকাতার এত আকর্ষণ সত্ত্বেও কিন্তু কলাভবনের প্রতি অনুরাগ ও সেই সঙ্গে শিল্পচর্চায় আসক্তি ক্রমশ গাঢ় হচ্ছিল তাঁর। ১৯৪১ সালের ৩১ জুলাই তারিখে লিখছেন: “মাষ্টারমশাইর underএ কাজ করতে খুব ভাল লাগছে।... আমি মহিষের একটা sketch করেছিলাম— সেই sketchটা থেকেই lino করছি— সেটা দেখে মাষ্টারমশাই চার-পাঁচবার ‘খুব ভাল হয়েছে, খুব ভাল হয়েছে’ বললেন।”
প্রায় প্রতি চিঠিতেই ‘মাস্টারমশাই’ অর্থাৎ নন্দলাল বসুর কথা, পাশাপাশি শিক্ষার্থী-বন্ধু পৃথ্বীশ নিয়োগী, সকল সুরিয়া, দিনকর কৌশিক প্রমুখ, বিশিষ্ট চৈনিক শিল্পী Ju Peon... এঁদের সংস্পর্শ আর সত্যজিতের প্রতিভার নানা হদিস— চিঠিগুলি প্রকাশ পাচ্ছে এ বারের শারদীয়া সন্দেশ-এ। সম্পাদক সন্দীপ রায় জানালেন: “ঠাকুমাকে লেখা বাবার চিঠি বেরচ্ছে এই প্রথম... শান্তিনিকেতনের চিঠিগুলি এর পর ধারাবাহিক ভাবে সন্দেশ-এই বেরবে, বিভিন্ন সংখ্যায়। আরও অনেক চিঠি লিখেছেন ঠাকুমাকে, অজন্তা-ইলোরা-খাজুরাহো ও বিলেত থেকে। সে-সমস্ত চিঠিপত্র সটীক সম্পাদনায় গ্রন্থিত করার ইচ্ছে আছে।”
এই সমস্ত চিঠিপত্র ছাড়াও সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে শারদীয়া সন্দেশ-এ প্রকাশিত হচ্ছে তাঁর দু’টি চিত্রনাট্য— সমাপ্তি (তিন কন্যা) এবং একটি না-তোলা বিজ্ঞাপন-ছবির। প্রকাশিত হচ্ছে সোনার কেল্লা ছবির শুটিং করার পরেও বাদ-যাওয়া অংশের স্থিরচিত্র ও চিত্রনাট্য। সঙ্গের ছবিটি ১৯২১ সালের, মা সুপ্রভাদেবীর কোলে সদ্যোজাত সত্যজিৎ। ছবি সৌজন্য: সন্দীপ রায়
মঞ্চভাষার শিল্পী
একদা বঙ্গরঙ্গমঞ্চের অভিনেতাদের অভিনয়ের দাপটেই বুঁদ হতেন দর্শক, মঞ্চের শিল্পভাষা তৈরি হত না। শিশির ভাদুড়ী সীতা নাটক থেকে মঞ্চকে শিল্পিত করার চেষ্টা শুরু করেন। এই প্রেক্ষিতেই বাংলা থিয়েটারে, বিশেষত ‘বহুরূপী’র রক্তকরবী-র সূত্রে মঞ্চশিল্পে খালেদ চৌধুরীর (ছবিতে) অনন্যতা নিয়ে বলছিলেন শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়: “মঞ্চ সাজাতেন না তিনি, নাটকের সারবস্তুকে তাঁর শিল্পভাষায় মঞ্চে উপস্থাপন করতেন, নাটকের মূল সুরকে বেঁধে দিতেন দৃশ্যরূপে।’’ সিনে গিল্ড, বালি-র উদ্যোগে ৩ অক্টোবর ফেসবুক লাইভে ‘সত্যপ্রকাশ ঘোষ স্মারক বক্তৃতা’-র বিষয় ছিল ‘শতবর্ষে খালেদ চৌধুরী: থিয়েটারে দৃশ্যসঙ্গীত’। সঙ্গী সত্যজিৎ রায় ফিল্ম সোসাইটি, বেঙ্গালুরু।
সাহিত্যপ্রাণ
কর্পোরেট জগতের উচ্চপদে কেটেছে কর্মজীবন, কিন্তু সঙ্গী ছিল নিবিড় সাহিত্যচর্চা। কবিতা, অনুবাদ, প্রবন্ধ, উপন্যাস, সব ক্ষেত্রেই অবাধ বিচরণ অমিতাভ চৌধুরীর। জন্ম ১৯৪৬-এ অবিভক্ত বাংলার টাঙ্গাইলে, ইঞ্জিনিয়ারিং ও ও ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পড়াশোনা কলকাতায়। ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’-সহ বেশ ক’টি কাব্যগ্রন্থ আছে তাঁর, অনুবাদ করেছেন নেরুদা, রিলকের কবিতাও। তাঁর অনুবাদ মন জয় করেছিল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের। মুম্বই থেকে প্রকাশ করতেন পত্রিকা কবিতা রিভিউ, লিখেছেন সাহিত্য-সমালোচনার বই, ইউরোপীয় নাটকের আলোচনাগ্রন্থ। কর্কট রোগে অসুস্থ ছিলেন, চলে গেলেন ২৮ সেপ্টেম্বর।
অধিকন্তু
জন্মশতবর্ষে সত্যজিৎ রায়কে ঘিরে জন-অরণ্যে উদ্যাপনও কম নয় বড়। সমাজমাধ্যমে লক্ষ ‘মিম’-এর গায়ে হীরক রাজা বা সোনার কেল্লা-র ছোঁয়া। দুই বাঙালি বিজ্ঞানীর তৈরি কোভিড টেস্ট কিট বাণিজ্যিক ব্যবহারের ছাড়পত্র পেল, তার নামও তো ‘ফেলুদা’! নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন কলেজের কিছু প্রাক্তনীর গড়া শিক্ষা সংস্থা ‘আলো’ সত্যজিতের জন্মশতবর্ষে ও প্রতিদ্বন্দ্বী-র ৫০ বছরে সম্প্রতি এক অনলাইন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ করেছিল ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়কে। উদ্দেশ্য, গ্রামবাংলার ছাত্রছাত্রীদেরও সত্যজিতের সৃষ্টিতে আগ্রহী করে তোলা। নরেন্দ্রপুরের শেরউড এস্টেট প্রকাশ করেছে অন্বেষা পত্রিকার (সম্পা: শ্রীপর্ণা মিত্র ও সিতাংশু কুমার রায়) ‘সত্যজিৎ ১০০’ সংখ্যা। আছে সত্যজিতের দৃষ্টিতে রবীন্দ্রসাহিত্য, সত্যজিতের সৃষ্টিতে বাস্তব বনাম অলৌকিক, তাঁর চলচ্চিত্রে পাশ্চাত্য সঙ্গীতের ব্যবহার, ছবির পরিচয়লিপি নিয়ে একগুচ্ছ লেখা। কলকাতার একটি আবাসনের এই সত্যজিৎ-চর্চা প্রশংসনীয়।
ভারতের সুফি
গানবাজনা নাকি পছন্দ করতেন না নাক্শবন্দি সুফিরা। রক্ষণশীল বলে চিহ্নিত এই সুফিদের অন্য একটি দিক তুলে ধরলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক অমিত দে। ২৭ সেপ্টেম্বর অনলাইন আলোচনায় জানালেন, নাক্শবন্দিরাও বিভিন্ন সময় ‘সামা’ বা সুফি সঙ্গীতের আয়োজন করেছেন, কিন্তু এই আগ্রহ ছিল অনেকাংশে পরিস্থিতি-নির্ভর। সুফিদের মধ্যে চিশতিরা পরিচিত উদারমনস্ক হিসেবে, আবার কাদরিদের সম্পর্কে তেমন তথ্য পাওয়া যায় না। জানা যায়, সম্রাট আকবর ‘সুলহ এ-কুল’ কথাটি সংগ্রহ করেছিলেন কাদরিদের কাছ থেকেই। বোঝা গেল, ভারতের সুফিদের মধ্যেও ছিল বিভিন্ন স্তর, যা উপেক্ষিত থেকে গিয়েছে জাতীয়তাবাদী বা বামপন্থী ইতিহাসবিদদের ব্যাখ্যাতেও। এই বিভিন্নতা ও ব্যাপকতাই উঠে এল আলোচনায়। অনুষ্ঠানের আয়োজক ‘ভয়েজেস ইনটু দ্য পাস্ট: অতীত প্রবাহ’। গবেষক-ছাত্রদের এই অনলাইন প্ল্যাটফর্মটি ভারতীয় ইতিহাসের আলোচনায় সমৃদ্ধ করে চলেছে ইতিহাসপ্রেমীদের।
অজানা অজিতেশ
“সবচেয়ে বড়ো কথা, সরকারি অর্থসাহায্যে এখানে সরকারকে সমালোচনা করতে হয় না। এখানে কেউ অ্যামেচার নেই। প্রতিদিনের ভাতের গ্রাসের সঙ্গে এখানে শ্রম যুক্ত। পবিত্র এ শ্রম।” যাত্রাশিল্প নিয়ে লিখেছিলেন অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯৩৩-১৯৮৩)। এমন ভাবনার টুকরো আরও আছে তাঁর, সযত্নে সেগুলি গ্রন্থিত করেছেন প্রভাতকুমার দাস। সদ্য প্রকাশিত হয়েছে তাঁর যাত্রা-পথে অজিতেশ বইটি (প্রকাশক: ঋত)। শুরুতেই ভূমিকায় নাম-প্রবন্ধটি রচনার অভিজ্ঞতাও জানিয়েছেন লেখক: অজিতেশের ‘পর্যুদস্ত যাত্রাজীবনের এই আলেখ্য— কত যে বেদনাদায়ক ঘটনার সমাহার, লেখার সময় আমারই চোখ অশ্রুভারাক্রান্ত হয়েছে।’ এই বইয়ে রয়েছে অজিতেশের অপ্রকাশিত পত্রগুচ্ছ ও জীবনপঞ্জিও। সব শেষে প্রভাতকুমার উল্লেখ করেছেন রত্না বন্দ্যোপাধ্যায়ের অজিতেশের শেষ ঠিকানা (প্রকাশক: থীমা) বইটির কথা, যেটি না পড়লে অজিতেশ সম্পর্কে জরুরি অনেক কথা জানাই হত না তাঁর। নাটক, যাত্রা, চলচ্চিত্র— প্রতিটি শিল্পমাধ্যমেই জনপ্রিয় ও প্রশংসাধন্য এই অভিনেতার অকালে চলে-যাওয়া প্রতি আশ্বিনেই মনে পড়ে আমাদের, ১৯৮৩-র ১৪ অক্টোবর অষ্টমী পুজোর ভোররাতে তাঁর আচমকা মৃত্যু। জন্মও আশ্বিনে, ৩০ সেপ্টেম্বর। ছবিতে থানা থেকে আসছি নাটকে তৃপ্তি মিত্রের সঙ্গে অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়।
আশি পেরিয়ে
১৯৪০ সালে এই শহরে শুরু হয়েছিল আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ় দু ক্যালকাটা। শুধু ফরাসি শেখার জায়গা নয়, এই প্রতিষ্ঠান বই, পত্রপত্রিকা, সিডি, সিনেমার ডিভিডির সংগ্রহশালা, সাংস্কৃতিক কেন্দ্রও। ২০০৭ সালে প্রতিষ্ঠানের নামে ‘কলকাতা’ শব্দটি পাল্টে ‘বেঙ্গল’ করা হয়। উদ্দেশ্য, নামে ও কাজে সমগ্র বাংলাকেই ধারণ করা। ভারতে আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ়-এর ১৪টি কেন্দ্র রয়েছে, প্রাচীনতার দিক থেকে কলকাতারটি দ্বিতীয়। ২৫ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় এক অনলাইন অনুষ্ঠানে উদ্যাপিত হল তাদের ৮০তম বার্ষিকী। আলোচনার বিষয় ছিল ‘ফেবল্স অ্যান্ড ইকোলজি’।
নোবেল ও শহর
কলকাতার সঙ্গে নোবেল-যোগ নতুন নয়। হাতে-কলমে ব্ল্যাক হোলের অস্তিত্ব প্রমাণ এ বছর পদার্থবিদ্যায় নোবেল দিয়েছে রজার পেনরোজ়কে, তাঁর তত্ত্বের পিছনেও ১৯৫৫-র কলকাতায় পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক অমলকুমার রায়চৌধুরীর ‘রায়চৌধুরী ইকোয়েশন’-এর অবদান। রজার বহু বার এসেছেন কলকাতায়। তাঁর নোবেল-প্রাপ্তিতে এ শহরও খুশি।