ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী
বরাবরের মতো চক্ষুদানই বটে! তবু চোখ ফোটার লক্ষণ কই?
উৎসবের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে এটাই বোধহয় এ বছর কোটি টাকার প্রশ্ন। মল মাসের গেরো পার করে দেবীপক্ষে পৌঁছনোর আগেই শুরু হয়েছিল বোতাম টিপে বা সশরীরে পুজো উদ্বোধনের হিড়িক। অতিমারি-ধ্বস্ত দেশে মণ্ডপের ভিড়ে অনেকেই অশনি সঙ্কেত দেখছেন। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাজার-শপিংমল-জুতোজামার দোকানে দূরত্ববিধি বা মাস্ক-বিধি উড়িয়ে ঘেঁষাঘেঁষি আর ঠেসাঠেসির বাড়বাড়ন্ত। ডাক্তারবাবুরা সভয়ে ত্রাহি-ত্রাহি রব তুলেছেন। আবার সোশ্যাল মিডিয়ার রসিক বাঙালির শ্লেষ, ডাক্তার-নার্সরা নির্ঘাত দীর্ঘ দিন অক্লান্ত পরিশ্রমের পরে ছুটির লোভে সবাইকে পুজোয় আনন্দ করতে বারণ করছেন! সেলুলয়েডের আদি ‘ফেলুদা’-কে নিয়ে পুজোর মুখে দুশ্চিন্তা কিছুটা কাটিয়ে সবে আশার আলো দেখছে আমবাঙালি! ও দিকে আবার নেটপাড়ার মিম-ভাঁড়ারে তাঁর গদিতে বসে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন স্বয়ং মগনলাল মেঘরাজ। ‘পূজা মার্কেটিং কোরছেন... কোরেন... লেকিন আপনার সেফটির গ্যারান্টি হামি দিতে পারব না, সাফ বলে দিলাম।’
সত্যিই এ এক অদ্ভুত দুর্গাপুজো বটে! থিম-সম্ভার নিয়ে হইচই ছাপিয়ে যে মণ্ডপে সব থেকে ভিড়, সে-ই ভাইরাসের পয়লা নম্বর ‘সুপারস্প্রেডার’ বলে আঙুল উঠছে নিরুপায় ভাবেই। বড়িশা ক্লাবে সন্তান কোলে পরিযায়ী শ্রমিক মায়ের দুর্গা হওয়ায় কাটাছেঁড়া চলছে অবশ্য। পুজো শুরুর আগেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি ভাইরাল।
তবে এ উলটপুরাণে ভিড় নয়, ভিড় এড়ানোর কসরতে কে কতটা দড় সেইটেই মুনশিয়ানা। এ বিষয়ে প্রথম ভেবেছিল, শোভাবাজার রাজবাড়ির গোপীনাথ-ভবন! সন্তোষ মিত্র স্কোয়ার, দেবদারু ফটকেরাও সে-পথেই হেঁটেছে। এ বার ম্যাডক্স স্কোয়ারের আড্ডা থেকে বাগবাজারের সিঁদুরখেলা, সব ২০২১-এর জন্য তোলা। ইউটিউব, ফেসবুক লাইভ, স্মার্টফোনে, আইফোনে ঢুকে পড়ে বাঘা পুজো কমিটিই উৎসুক জনতাকে বাড়ি-বন্দি রাখতে উৎসাহী। রাজপথে পুলিশের ভিড় সামলানোর ব্যারিকেড বসতে দেখেও সন্ত্রস্ত বহু সচেতন নাগরিক।
এই টানাপড়েনের মধ্যেও কেউ কেউ অবশ্য চোখ ফোটানোরও চেষ্টা করছেন। যেমন সাম্প্রতিক এক সকালে অভিনব চক্ষুদানের আগে তুলি হাতে ভাবছিলেন শিল্পী সুশান্ত পাল। টালা প্রত্যয়-এর পুজো প্রাঙ্গণে সে দিন ঢাকের আবহে মাস্ক আর হেডশিল্ডের বর্মে সজ্জিত ছিলেন শিল্পী। এর নাম নিউ নর্ম্যাল! মায়ের সামনে আসতেও রণসাজ— ভাবতে ভাবতে জীবাণুমুক্ত করার প্রকাণ্ড চলমান যন্ত্রগাড়ির দিকে তাকিয়ে দেখছিলেন সুশান্ত। গাড়ির গায়েই ক্রমে বিরাট একটি চোখ ফুটিয়ে তুললেন তিনি (ছবিতে)। কলকাতার এই পল্লিতে পুরোদমে চলছে কাছের-দূরের পাড়ার জীবাণুনাশের এই প্রকল্প। জীবাণুমুক্ত করার চলমান যানের নীচে ধুয়ে যাবে বিপদের ক্লেদ। সেই সঙ্গে ‘লোকহিত’ অ্যাপের মাধ্যমেও লোকজনকে ঠেকানোর কসরত এ বার টালা প্রত্যয়-এর।
এত দিন যে-দিকে তাকিয়ে দেখেননি, সে দিকেও চোখ ফুটছে বহু উদ্যোক্তার। হরিদেবপুরে বিবেকানন্দ পার্ক অ্যাথলেটিক ক্লাব যেমন, এ দুঃসময়ের উৎসবে নিয়ে এসেছে পাড়ার জন্য কোভিড অ্যাম্বুল্যান্স! দক্ষিণ কলকাতার যোধপুর পার্ক থেকে উত্তরের কাশী বোস লেন, দমদম পার্ক থেকে সুরুচি সঙ্ঘ, বেহালা নূতন দল— কাজ-হারানো দুঃস্থ বাড়তি ব্রাত্যদের পাশে থাকারও নাছোড় অঙ্গীকার।
ভার্চুয়াল না রিয়েল, সশরীরে না বাড়ি বসে— কী ভাবে হবে ২০২০-এর প্যান্ডেল-দর্শন! আধো ভয়ে, ভক্তিতে, আশায় দুর্গার মুখোমুখি চোখে থাকছেই আশঙ্কারও ছবি। উৎসব নিচু তারে বাঁধা থাক।
ছবিতে শারদীয়া
লকডাউনে শহরের আর্ট গ্যালারি বন্ধ ছিল, প্রদর্শনী হয়েছে অনলাইন। আনলক-পর্বে বাস্তবে পা, দক্ষিণ কলকাতার ‘দেবভাষা বই ও শিল্পের আবাস’-এ প্রদর্শনী চলছে মধ্য-সেপ্টেম্বর থেকে। গৌরী ধর্মপাল কক্ষে চন্দনা হোরের ছবির প্রদর্শনী বার্নিং ইন সলিচিউড, মণীন্দ্র গুপ্ত কক্ষে পার্থপ্রতিম গায়েনের ভাস্কর্যে দশভুজার রূপ, শেখর রায়ের আঁকা নিসর্গচিত্র। এ মাসে তুষার চৌধুরী কক্ষে বিমল কুণ্ডুর লক্ষ্মীশ্রী— ছবি ও ভাস্কর্যে পেঁচা, সম্প্রতি হল শুভাপ্রসন্নের পোস্টকার্ডে আঁকা ছবির প্রদর্শনী ‘স্মৃতির কলেজ স্ট্রিট’। শারদোৎসব উপলক্ষে ১৬ অক্টোবর থেকে চলছে ১৪ জন শিল্পীর সরাচিত্র প্রদর্শনী। সরাচিত্রে ফুটে ওঠে বাংলার লোকায়ত সংস্কৃতি, শিল্পীদের রঙে-রেখায় সেই ঐতিহ্যেরই আরাধনা। প্রদর্শনী ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত (২৪-২৬ অক্টোবর বাদে), দুপুর ৩টে থেকে রাত সাড়ে ৮টা। ছবি ই-প্রচারপত্র থেকে।
আব্বাস উৎসব
কোচবিহারে জন্ম। ছোটবেলা থেকেই গলায় অক্লেশে তুলে নিতেন চাষি ও মাঝিমাল্লাদের গান। কাজি নজরুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগে ১৯৩০-এর কলকাতায় গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে প্রথম রেকর্ড। বাকিটা ইতিহাস। আল্লা ম্যাঘ দে, বন্ধু কাজল ভ্রমরা, ফান্দে পড়িয়া বগা-সহ অজস্র স্মরণীয় গান আব্বাসউদ্দিন আহমদকে (১৯০১-১৯৫৯) দিয়েছে ‘পল্লিগীতি সম্রাট’-এর শিরোপা। ২৭ অক্টোবর তাঁর জন্মদিন উপলক্ষে ফেসবুকে ২৭-২৯ অক্টোবর তিন দিনের ‘আন্তর্জাতিক আব্বাস উৎসব’ আয়োজন করেছেন লোকগবেষক তপন রায় প্রধান। থাকবেন আব্বাসউদ্দিনের দৌহিত্রী নাশিদ কামাল, এ ছাড়াও শিল্পী সুখবিলাস বর্মা, তপন রায়-সহ দুই বাংলার বিশিষ্ট লোকসঙ্গীতশিল্পীরা।
পুজোর আর্কাইভ
এ শহরে প্রতি দিনই হয়ে চলেছে অজস্র সৃষ্টি, কিন্তু সে সবের বেশির ভাগই বাঁচিয়ে রাখার উপায় বা সচেষ্টতা নেই তেমন। বঙ্গসংস্কৃতির বহমান ধারাকে ধরে রাখার তাগিদ থেকেই ২০১৮ সালে শুরু হয়েছিল ডিজিটাল আর্কাইভ ‘রূপসায়র ক্যাফে’। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের গবেষক সৈকত সরকার একক উদ্যোগেই সে কাজ করে চলেছেন। আর্কাইভে বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপুজো না থাকলেই নয়, তাই লকডাউনেই তৈরি হয় ‘রূপসায়র পুজোর দরবার’। কুড়িটিরও বেশি ওয়েবিনারে উঠে এসেছে প্রতিমা শিল্পী, মণ্ডপ শিল্পী, আবহসঙ্গীত ও আলোকসজ্জা শিল্পী, পুজোর আলোকচিত্রীদের কথা। নিজেদের কাজ ও অভিজ্ঞতা নিয়ে সেখানে কথা বলেন শিল্পীরা। সংগ্রহের ভান্ডার এতই বিচিত্র, কলকাতার দুর্গাপুজো নিয়ে যে কারও আগ্রহ উসকে দেবে। ভবিষ্যতের গবেষকদেরও কাজে লাগবে।
উৎসবের পুতুল
পুজোর মুখে আজ ও আগামী কাল, ১৯-২০ অক্টোবর সন্ধে ছ’টা থেকে তপন থিয়েটারে ‘ধূমকেতু পাপেট থিয়েটার’-এর উদ্যোগে, ভারত সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রকের সহযোগিতায় হচ্ছে ষষ্ঠ জাতীয় পুতুল নাটক উৎসব। সেপ্টেম্বর-শেষে বাংলা, বিহার ও ওড়িশার পুতুল নাটকশিল্পীদের নিয়ে অনুষ্ঠান হয়েছে, ১১ অক্টোবর অনলাইন উৎসবও। এ বার কলকাতার মঞ্চে নানা পুতুল নাটক দলের পরিবেশনা। উদ্বোধনে থাকবেন পদ্মশ্রী সুরেশ দত্ত। তাঁর ক্যালকাটা পাপেট থিয়েটার ও আয়োজক ধূমকেতু তো বটেই, থাকবে তাল বেতাল পাপেট থিয়েটার, ডলস থিয়েটার, রঙতাল থিয়েটার, বঙ্গ পুতুল, বর্ধমান দ্য পাপেটিয়ার্স, সত্যনারায়ণ পুতুল নাট্য সংস্থা, রামপদ ঘোড়ইয়ের বেণীর পুতুল নাচ।
শিল্পরূপেণ
সাধারণের মধ্যে তিনি দেখতে পান অসাধারণকে। রোজকার তুচ্ছ নগণ্য যে জিনিসগুলো শিল্প-পরিসরের ত্রিসীমায় আনতে বাধো বাধো ঠেকে আমাদের, সে সব দিয়েই প্রতি বছর একটি দুর্গাঠাকুর গড়েন বনহুগলির রাইমোহন ব্যানার্জি রোডের বাসিন্দা হরিসাধন বিশ্বাস। বিরাট প্রতিমা নয়, মিনিয়েচার শিল্প। রবারের পাইপ, গেঞ্জির কাপড়, খবরকাগজের টুকরো, তেজপাতা, ফুলের পাপড়ি, বীজ, ইলেকট্রিক তার, ময়দা, ট্যাবলেট, চামড়ার টুকরো থেকে পেঁয়াজের খোসা— এ সবই তাঁর ঠাকুর গড়ার উপকরণ। ২০০৪ থেকে শুরু, এ পর্যন্ত বানিয়েছেন সতেরোটি দুর্গা। বাড়িতে পাইপ বা অন্যত্র ‘লিকেজ’ আটকাতে ব্যবহৃত হয় রজনের তৈরি যে বস্তুটি, তা দিয়েই এ বছর আড়াই ইঞ্চির দুর্গাঠাকুর বানিয়েছেন শিল্পী (ছবিতে)। আছেন লক্ষ্মী-সরস্বতী-কার্তিক-গণেশ, মহিষ ও অন্য বাহনগুলিও অপরূপ। ফি-বছর পুজোর আগে কাজে বসা, রোজ কয়েক ঘণ্টার নিষ্ঠায় পনেরো-কুড়ি দিনে তৈরি হল এ বারের ঠাকুর।
ভাবের পূজা
পুরীর পণ্ডিত সভা তাঁকে ‘বিদ্যানিধি’ উপাধি দিয়েছিল। উনিশ ও বিশ শতকের বাংলা ও ওড়িশার সারস্বত সমাজের অন্যতম পুরোধা ছিলেন আচার্য যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি (১৮৫৯-১৯৫৬)। বিজ্ঞান চর্চা, শিক্ষকতা, বাংলায় স্কুলপাঠ্য বিজ্ঞান-বই রচনা, গণিত, জ্যোতিষ ও জ্যোতির্বিদ্যার সাধন, ‘বাঙ্গলা শব্দকোষ’ প্রণয়ন, লাইনোটাইপ উদ্ভাবন— তাঁর বহুমুখী প্রজ্ঞার সাক্ষী তৎকালীন বঙ্গসমাজ। প্রবাসী, মডার্ন রিভিউ, ভারতবর্ষ-সহ সে-কালের বিখ্যাত পত্রপত্রিকায় বহু প্রবন্ধ লিখেছেন তিনি। ১৩৫৩ থেকে ১৩৭৬ বঙ্গাব্দের মধ্যে লেখা, দুর্গাপূজা বিষয়ক তাঁর চোদ্দোটি প্রবন্ধ একত্র করে শ্রীশ্রীদুর্গা (প্রকাশক: টেরাকোটা) সঙ্কলনগ্রন্থটি প্রকাশিত হল সম্প্রতি। রয়েছে প্রবাসী-তে প্রকাশিত যোগেশচন্দ্রের ন’টি প্রবন্ধ, এ ছাড়াও ভারতবর্ষ, শনিবারের চিঠি, এমনকি ১৩৫৫ বঙ্গাব্দের শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা-য় প্রকাশিত প্রবন্ধও। সঙ্গের আকর্ষণ দুর্গাপট ও বিভিন্ন সংগ্রহালয়ে সংরক্ষিত মহিষাসুরমর্দিনীর ছবি। “আমরা ভাবের পূজা করি, মূর্তির পূজা করি না... আমরা দুর্গার মূর্তি বলি না, বলি দুর্গার প্রতিমা, গুণ ও কর্মের প্রতিমা।”— লিখে গিয়েছেন আচার্য। পুজোর আগে এ এক অনন্য প্রাপ্তি।
সুখের লাগি
কলকাতার পথে ঝাঁ চকচকে দোতলা বাস নেমেছে— উপলক্ষ পুজোর শহর ভ্রমণ। ও দিকে তারাওয়ালা বিলাসী হোটেল ডাকছে দু’রাত্তির-তিন দিনের নিরালা হাতছানিতে। রেস্তরাঁকুল বিজ্ঞাপনাকুল: জম্পেশ খেয়ে যান, কোভিডকে রুখতে আমরা আছি। সিনেমাহল খুলেছে নতুন-পুরনো বাংলা আর হিন্দি ছবি নিয়ে, নাটকের দল ফেসবুকে চাতকপাখি: নাটক দেখতে আসবেন? এত আবেদন নিবেদন সব কলকাতার সুখের লাগি।