বাংলা বেঁচে রয়েছে তার নিজস্ব হস্তশিল্প ও শিল্পীদের মধ্যে দিয়ে। গ্রামীণ হস্তশিল্পীদের উন্নতি মানে পরোক্ষে গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নতি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিকল্পনা অনুসারে দক্ষিণ কলকাতার ঢাকুরিয়ায় দক্ষিণাপণের পাশে পড়ে থাকা জমিতে শুরু হয়েছিল একটি হস্তশিল্প কেন্দ্র নির্মাণের কাজ। দুর্গাপুজোর আগে এখানেই সূচনা হয় সৃষ্টিশ্রী-র। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদ্যোগে পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দফতরের আনন্দধারা প্রকল্পের অধীনে বিভিন্ন পঞ্চায়েতে যে সমস্ত স্বনির্ভর গোষ্ঠী কাজ করছে, এখানে মিলবে তাদের নির্মিত সামগ্রী। শাড়ি, ব্যাগ, গয়না, ঘর সাজানোর জিনিস, মসলন্দ মাদুর, ছো মুখোশ, ডোকরা, তামার প্রদীপ, বাবুই ঘাস ও খেজুর পাতার ম্যাট-ট্রে, বেত-কাঠ-কাপড়-পাথর-মোষের শিং-ঝিনুক-গালা-শোলার জিনিস থেকে শুরু করে তুলাইপাঞ্জি, কালোনুনিয়া চাল, আচার, গয়না বড়ি, আমসত্ত্ব, ঘি, নাড়ু মায় নুডলস— সবই রয়েছে এখানে। রয়েছে ক্যাকটাস, ফুল-ফলের গাছ, অর্কিড, জৈব সার, বাহারি ফুলের টবও। দশ টাকার ‘সিড পেন’ ব্যবহারের পর মাটিতে ফেলে দিলে তা থেকেই জন্ম নেবে গাছ, বিক্রি হচ্ছে খুব। এ বাড়ির চতুর্থ তলে হচ্ছে একটি ফুড কোর্ট। আর এখানেই থাকার ব্যবস্থা হয়েছে শিল্পীদের। ওঁদের যাতায়াত খরচও দিচ্ছে সরকার। সারা বাংলা এখানে এখন এক ছাদের নীচে। লাটাগুড়ি পথের সাথী বা ঝাড়গ্রাম অরণ্য সুন্দরী মহাসঙ্ঘ থেকে কাজের প্রশিক্ষণ নিয়ে এখানে এসেছেন মঞ্জুদেবী বা মল্লিকা সেনরা। আমতার সরমা মোদক, ডোমজুড়ের সুমিত্রা দে এসেছেন শতরূপা মহাসঙ্ঘ থেকে। জলপাইগুড়ির মঞ্জু রওতিয়া, দার্জিলিঙের মনোরমা চামলিং, প্রীতিসা রাই বা কোচবিহারের অনিমা বর্মণরা বেশ খুশি কারণ এখন এখানে ক্রেতারা আসছেন আগ্রহ নিয়ে। সাত দিন থেকে এক মাস পর এঁদের জায়গায় আসবেন জেলার অন্য শিল্পীরা। এ ভাবেই চলবে বছরভর, সৃষ্টিশ্রীতে স্থান পাবেন সকলেই। সে দিন এখানে দেখা মিলল স্থানীয় ক্রেতা শিল্পী রায়চৌধুরী, নিখিল এবং দীপিকা ভৌমিকের সঙ্গে। হাতের নাগালেই মেলার মতো মেলা জিনিস পেয়ে আনন্দিত তাঁরা। শুধু স্থানীয়রাই নন, সৃষ্টিশ্রী-র সন্ধান পেয়ে ডেনমার্ক হংকং বা অস্ট্রেলিয়া থেকেও এখানে হাজির হয়েছেন বেন্তে, মার্টিন মিলার, কুশি পাটকা বা কাল্লে পারখনেনরা (সঙ্গের ছবি)। নতুন ভাবনায় বাংলার গ্রামীণ শিল্পকে বিশ্বের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছে সৃষ্টিশ্রী।
শিল্পিত লেপ
লেপ তৈরির ঐতিহ্য শুধু ভারতে কেন, পৃথিবী জুড়েই সুপ্রাচীন। ভারতে লেপ ও অন্যান্য বস্ত্রশিল্পের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে ২০১৮ সালে তৈরি হয় ‘কুইল্ট ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশন’। শিল্প হিসেবে লেপকে ফিরিয়ে আনা, তাকে বাণিজ্যসফল করে তোলা, বয়নশিল্পীদের এক মঞ্চে নিয়ে আসা, ভারতীয় লেপকে আন্তর্জাতিক আঙিনায় পৌঁছে দেওয়া ইত্যাদি তাদের উদ্দেশ্য। এই পরিকল্পনাতেই এই বছর জানুয়ারিতে চেন্নাইয়ে আয়োজিত হয় প্রথম আন্তর্জাতিক লেপ প্রদর্শনী। যোগ দেন ১১টি দেশের ১৬১জন শিল্পী, আসে ২৯০টি লেপ। পুরস্কারপ্রাপ্ত ১৮টি লেপ এ বার প্রদর্শিত হবে ৬-১১ ডিসেম্বর কলকাতা সেন্টার ফর ক্রিয়েটিভিটিতে, ‘থ্রেডস দ্যাট বাইন্ড’ শীর্ষকে। গুজরাতের ভুজ আর রাজস্থানের বারমেরের শিল্পীদের কাজের অসামান্য নিদর্শন এগুলি। সঙ্গে তারই একটির অংশ।
মূকাভিনয়
ভাষার জন্মের বহু আগে, সেই আহরণ ও শিকারের যুগ থেকেই নাকি মূকাভিনয় শিল্পের চল। পরে এই প্রকাশমাধ্যমের শৈল্পিক বিকাশ ঘটে চিন, জাপান ও ভারতে। বৈদিক যুগের শৌভিকরা মূকাভিনয় করতেন। কথাকলি ও ভরতনাট্যমেও মূকাভিনয়ের উৎস পাওয়া যায়। অধুনা এই নির্বাক নাটক মূলত মাইম ও প্যান্টোমাইম দু’ভাবে পরিবেশিত হয়। যে নামেই ডাকা হোক, এই বিশ্বে তার ব্যঞ্জনা বহুল। এই মুহূর্তে প্রান্তবাসী, নিপীড়িত, ক্ষুব্ধ মানুষের না-বলা কথা ও যন্ত্রণার অন্যতম প্রকাশমাধ্যম মূকাভিনয়। মূকাভিনয় শিল্পের পরিচিত মুখ যোগেশ দত্ত। তাঁর প্রতিষ্ঠিত সংগঠন ‘পদাবলী’র ৪৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ও ৪১তম মূকাভিনয় উৎসবের সূচনা ৬ ডিসেম্বর সন্ধে ৬টায়, যোগেশ মাইম আকাদেমি মঞ্চে। উদ্বোধনে উৎসবের আচার্যের ভূমিকায় থাকবেন জহর সরকার। পদাবলী সম্মানে ভূষিত হবেন চপল ভাদুড়ি। এ বছরের উৎসব খালেদ চৌধুরীর স্মৃতিতে উৎসর্গিত, চলবে ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত। থাকবে কর্মশালা, মূকাভিনয় উপস্থাপনা, স্মারক বক্তৃতা।
ডানপিটে মানা
‘‘... ছোটবেলায় যখন সিমলেপাড়ায় বন্ধুদের সঙ্গে দুষ্টুমি করে বেড়াতাম,... কুস্তির আখড়ায় কুস্তি করতাম— তখন মনের কোনও অংশেই সংগীতশিল্পী হওয়ার কোনও বাসনা ছিল না। কিন্তু কীভাবে যেন সংগীত-ই একদিন আমায় আপন করে নিল।’’ সিমলেপাড়ার ডানপিটে মানাই এক দিন হয়ে উঠলেন ‘মান্না দে’— সর্বভারতীয় স্তরে এক অসামান্য কণ্ঠশিল্পী (১৯২০-২০১৩)। প্রথমে কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে, পরে উস্তাদ দবীর খান, উস্তাদ আবদুল রহমান খান, উস্তাদ গোলাম মুস্তাফা খান প্রমুখের কাছে তালিমপ্রাপ্ত মান্নার সঙ্গীতযাত্রা শুরু মুম্বইয়ে কাকার সহকারী হিসেবে। ক্রমশ হিন্দি, গুজরাতি ছবিতে নেপথ্যে গেয়ে সুখ্যাত হওয়ার পর আসেন বাংলা গানে। সেখানেও তাঁর জয়যাত্রা অব্যাহত থাকে। স্মরণীয় এই শিল্পীর বৈচিত্রময় জীবন ও সঙ্গীতকৃতি নিয়ে এক সুগ্রথিত প্রদর্শনী (বিন্যাস: স্বপন সোম) গগনেন্দ্র প্রদর্শশালায় দেখা যাবে ৫-১২ ডিসেম্বর, রোজ ২-৮টা। বাংলা সঙ্গীতমেলার (৪-১২ ডিসেম্বর) অপরিহার্য অঙ্গ এই প্রদর্শনীটির আয়োজনে রাজ্য সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ।
গ্রাফিক নভেল
বাঙালির ছেলেবেলার অনেকটা জুড়ে আছেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি, গোঁসাইবাগানের ভূত, পটাশগড়ের জঙ্গলে থেকে পাতালঘর, শীর্ষেন্দুর কিশোরসাহিত্যের মণিমুক্তোদের বয়স বাড়ে না। সেই প্রজন্মটা ছড়িয়ে গিয়েছে দেশে-বিদেশে, তবু সেই সব বইয়ের স্মৃতি এখনও তরতাজা। কিন্তু আজকের কচিকাঁচারা সেই স্বাদ পাবে কী করে? ছুটে-চলা সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে এসেছে শীর্ষেন্দু-সাহিত্যের গ্রাফিক নভেল। স্টারমার্ক প্রকাশনা সংস্থা আগেই বার করেছে ইংরেজিতে দ্য গোস্ট অব গোঁসাইবাগান, দ্য বক্সার, দ্বিভাষিক চক্রপুরের চক্করে। এ বার প্রকাশিত হল ইংরেজি গ্রাফিক নভেল: পাগলা সাহিবস গ্রেভ (পাগলা সাহেবের কবর থেকে)। ছবি এঁকেছেন হর্ষমোহন চট্টরাজ, স্ক্রিপ্ট করেছেন শুভরূপ ভট্টাচার্য। সম্পাদকীয় তত্ত্বাবধানে অরুন্ধতী গুপ্ত। সম্প্রতি সাউথ সিটি মল-এর ‘স্টারমার্ক’ বই-বিপণিতে লেখকের উপস্থিতিতে বেরোল এই বই।
আনন্দমোহন স্মরণ
ময়মনসিংহের এক উজ্জ্বল পুত্র গণিতজ্ঞ, আইনজ্ঞ ও রাজনীতিবিদ আনন্দমোহন বসু (১৮৪৭-১৯০৬)। তিনি ছিলেন ভারতের প্রথম র্যাঙ্গলার (কেমব্রিজে গণিতে প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ)। দেশে ফিরে তিনি বিভিন্ন সামাজিক রাজনৈতিক সংগঠনে যুক্ত হওয়ার পাশাপাশি সিটি স্কুল ও কলেজ গড়ে তোলেন। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে তাঁর ভাষণগুলি আজও অমর। কথায় গানে উনিশ শতকের এই মনীষীর প্রতি স্মরণ অনুষ্ঠান আয়োজিত হবে ৮ ডিসেম্বর প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডের সূর্য সেন মঞ্চে, সন্ধে ৬টায়। গানে ভারতবর্ষীয় ব্রহ্মমন্দির সঙ্গীত শিক্ষা কেন্দ্রের শিল্পীরা। সঙ্গে আলোচনা। অনুষ্ঠানের সভাপতি যাদবপুর বিদ্যাপীঠের প্রধান শিক্ষক পরিমল ভট্টাচার্য। আয়োজনে আনন্দমোহন বসু মেমোরিয়াল সোসাইটি।
অভিনব শিল্প
প্লাস্টিক ব্যবহারে দূষণ নিয়ে বিশ্ব জুড়ে মানুষের কপালে চিন্তার ভাঁজ! তাই অন্যের দিকে আঙুল না তুলে, যত্রতত্র ওষুধের ফয়েল স্ট্রিপ না ফেলে, প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে ভাস্কর্য ভাবনা, বলছিলেন স্বশিক্ষিত শিল্পী বিমান নাগ। ছোটবেলায় হরিণঘাটার দুধের বোতলের ছিপি, কাঠের ছিলকা, কাপড়, কাগজ প্রভৃতি দিয়ে কোলাজ গ্রিটিংস কার্ড তৈরি করতেন। বানাতেন সরস্বতী প্রতিমা। মাধ্যমিকে ওয়ার্ক এডুকেশন পরীক্ষায় হরিণঘাটার দুধের ছিপি দিয়ে সরস্বতী ঠাকুর বানিয়ে স্কুলে সবচেয়ে কম নম্বর প্রাপ্তি, কারণ পরীক্ষক বিশ্বাসই করতে চাননি এই সৃজন তাঁর। সেই বছরে গড়িয়ার মিতালী সঙ্ঘের দুর্গাপুজোয় নবদুর্গার সঙ্গে তাঁর তৈরি হরিণঘাটার দুধের ছিপির দুর্গাও প্রদর্শিত হয়, প্রশংসার পাশাপাশি শিল্পভবন থেকে প্রদর্শনীর ডাক আসে। পরবর্তীতে দুধের ছিপির অভাবে ওষুধের ফয়েল ও স্ট্রিপ দিয়ে ভাস্কর্য সৃজন প্রচেষ্টা (সঙ্গের ছবি)। বর্তমানে পেশায় লোকো পাইলট অর্থাৎ ট্রেন চালক। ইতিমধ্যে দেশ বিদেশে শিল্পীর ৩০টি দলগত প্রদর্শনী হয়েছে। অ্যাকাডেমিতে সম্প্রতি হয়ে গেল তাঁর একক প্রদর্শনী।
পাঠচক্র
অমর্ত্য সেনের সুগভীর ও সুগঠিত চিন্তাগুলি কল্যাণমূলক অর্থনীতি কিংবা সামাজিক চয়ন চর্চাক্ষেত্রের জটিল তত্ত্বায়নের আঙিনা ছাড়িয়ে সামাজিক ও রাজনৈতিক দর্শনক্ষেত্রে পরিব্যাপ্ত। সমকালীন বিশ্বে সমাজ-রাজনীতি বিষয়ে ওয়াকিবহাল এমন অনেকেই আছেন যাঁদের কল্যাণমূলক অর্থনীতি কিংবা সামাজিক চয়ন তত্ত্বের গভীরে গিয়ে অধ্যয়নের সুযোগ ঘটেনি; এই ধরনের উৎসাহীদের অমর্ত্য সেনের সমাজ দর্শন জানতে বুঝতে আগ্রহ থাকার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। অথচ এ দেশের উচ্চশিক্ষার পঠনপাঠনের পরিসরে তাঁর রচনাবলির প্রভাব যতটা প্রগাঢ় হওয়া উচিত ছিল তা হয়নি। অপরিচয়ের কারণ এখানে ছাত্রছাত্রীদের অনাগ্রহ নয়, আস্বাদনের প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ না ঘটা। এ রকম উপলব্ধি থেকেই একটি পাঠচক্র শুরু করার পরিকল্পনা করেছে ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ় কলকাতা (আইডিএসকে) ও প্রতীচী। বৈঠকগুলি হবে একান্তর শনিবার, ২০২০ সালের প্রথম ভাগ থেকে, আইডিএসকের সল্টলেক ক্যাম্পাসে।
সেরা চিরসবুজ
‘‘আমরা বড়োরাই ছোটোদের কাছ থেকে ছেলেবেলাটা প্রতিনিয়ত কেড়ে নিচ্ছি।’’ লিখেছেন রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়, লেখা ও ছবি সংবলিত তাঁর এই রচনাটি ঠাঁই পেয়েছে ১০-এর সেরা চিরসবুজ লেখা-য়— ছোটদেরকে ছেলেবেলা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্যেই যেন তৈরি সঙ্কলনটি। শিশু কিশোর আকাদেমি থেকে প্রকাশিত ত্রৈমাসিক ‘চিরসবুজ লেখা’-র পূর্ণ হয়েছে দশ বছর, তারই বেশ কিছু রচনা সংগ্রহ করে সঙ্কলনটি সাজানো হয়েছে। প্রধান সম্পাদক অর্পিতা ঘোষ। সূচনালগ্নে প্রধান সম্পাদক ছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, তাঁর ‘প্রথম সম্পাদকীয়’টি দিয়েই শুরু হয়েছে এ-সঙ্কলন। গল্প, অনুবাদ গল্প, পুরাণ, বিজ্ঞান, পরিবেশ, ভ্রমণ, নাটক, সিনেমা, প্রবন্ধে ঠাসা এ-বইয়ের পাতায় পাতায় ছবি। সম্পাদকমণ্ডলীর প্রারম্ভিক রচনাটিতে শিশুসাহিত্যের প্রাসঙ্গিক রূপরেখা, সঙ্গে জানানো হয়েছে, সঙ্কলনটিতে ‘‘চারপাশের মানুষজন চেনানোর চেষ্টা আছে, ঐতিহ্য সম্পর্কে শ্রদ্ধা জাগানোরও প্রয়াস আছে।’’
দুই কিশোর
আমির আর হাসান। সত্তর দশকের আফগানিস্তানে দুই কিশোরের বন্ধুত্ব, বিশ্বাসঘাতকতা, বিচ্ছেদ আর প্রায়শ্চিত্তের কাহিনি। রুশ আগ্রাসনে জর্জরিত আফগানিস্তান থেকে শুরু করে আমেরিকা, পাকিস্তান হয়ে ফের তালিবান শাসনে বিধ্বস্ত আফগানিস্তান— দুই মহাদেশ, তিন দেশ এবং দুই প্রজন্ম ধরে ডালপালা মেলেছে মার্কিন আফগান লেখক খালেদ হোসেইনির প্রথম উপন্যাস ‘দ্য কাইট রানার’। গোটা বিশ্বে সাড়া ফেলা এই উপন্যাস অবলম্বনে সিনেমা হয়েছে, নাটকও হয়েছে বিদেশে। এ বার বাংলা ভাষায় নাটক মঞ্চস্থ করতে চলেছে সদ্য তৈরি ‘কাব্যকলা মনন সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী’ এবং ‘দেবান্তরা আর্টস’। নাট্যরূপ দিয়েছেন অন্তরা চট্টোপাধ্যায়। যুগ্ম পরিচালনায় প্রসেনজিৎ বর্ধন ও সুমিতকুমার রায়। প্রথম অভিনয় ৩ ডিসেম্বর সন্ধে সাড়ে ৬টায় মোহিত মৈত্র মঞ্চে।
বিজ্ঞান সমাগম
হিগ্স বোসন আবিষ্কারের দৌলতে ইউরোপিয়ান অর্গানাইজ়েশন ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ বা সার্নের নাম এখন আর কারও অজানা নয়। কিন্তু জানেন কি সূর্যের শক্তির উৎস নিউক্লিয়ার ফিউশনকে কী করে আগামী দিনে শক্তির প্রয়োজনীয়তা মেটানোর কাজে ব্যবহার করা যায় সেই নিয়ে কোথায় কাজ হচ্ছে? আমেরিকার লিভিংস্টোন আর হ্যানফোর্ডের সঙ্গে ভারতের কোথায় অভিকর্ষজ তরঙ্গ শনাক্ত করবার জন্য গবেষণাগার তৈরি হচ্ছে? হাওয়াই দ্বীপের মওনা কিয়াতে এই মুহূর্তে বিশ্বের সব থেকে বড় যে অপ্টিক্যাল টেলিস্কোপ তৈরি হচ্ছে তার যন্ত্রাংশ তৈরি হচ্ছে ভারতের কোন গবেষণাগারে? এই সব প্রশ্নের উত্তর আর তার সঙ্গে এই সমস্ত গবেষণা প্রকল্পের হাজারো তথ্য, মডেল ইত্যাদি নিয়ে ‘বিজ্ঞান সমাগম’ নামের প্রদর্শনী মুম্বই ও বেঙ্গালুরুর পরে এ বার এসেছে সায়েন্স সিটিতে। ভারত সরকারের পরমাণু শক্তি বিভাগ ও বিজ্ঞান-প্রযুক্তি বিভাগের উদ্যোগে এবং জাতীয় বিজ্ঞান সংগ্রহালয় পরিষদের সহায়তায় আয়োজিত প্রদর্শনী চলবে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
শারদ বহুরূপী
শ্যামানন্দ জালানকে চিঠিতে গিরিশ কারনাড ‘হয়বদন’ সম্পর্কে লিখছেন, ‘‘হয়বদন লেখার সময় আমার মনে একটা হাল্কা চালের মজাদার হাসির গল্প লেখা ছিল। দুঃখটাও হাল্কা ধরনের হবে, সত্যিকার নয় অনেকটা ওপর থেকে গায়ে মাখানো।’’ বহুরূপী পত্রিকার ২০১৯ সালের শারদ সংখ্যায় (সম্পাদক প্রভাতকুমার দাস) এই চিঠিটি প্রকাশিত হয়েছে গিরিশের স্মরণে ক্রোড়পত্রে। তাতে রয়েছে প্রয়াত কারনাডের দু’টি নাটকের অনুবাদ সম্পর্কে শঙ্খ ঘোষের বক্তব্য। ‘যযাতি’ নাটকটির বঙ্গানুবাদও প্রকাশিত হয়েছে। সম্প্রতি প্রয়াত রুদ্রপ্রসাদ চক্রবর্তী, সলিল বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অমিত মৈত্রের স্মরণে প্রকাশিত হয়েছে একগুচ্ছ নিবন্ধ। জন্মশতবর্ষে খালেদ চৌধুরীর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য লিখেছেন মৃণাল ঘোষ। রয়েছে ‘নটীর পূজা— মঞ্চে, ফিল্মে’ শীর্ষক নিত্যপ্রিয় ঘোষের একটি অতি প্রয়োজনীয় লেখা।
তথ্যচিত্রকার
কৃষিবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর। করছিলেন গবেষণা। তরুণ শান্তনু সাহার হঠাৎ কী খেয়াল হল, সব ছেড়েছুড়ে মাতলেন পারফর্মিং আর্টে। গ্রুপ থিয়েটারে অভিনয়ের পাশাপাশি টানল তথ্যচিত্র নির্মাণ। মনে হল, আর পাঁচটা বিষয়ের পাশে নাট্যব্যক্তিত্ব, শিল্পীদের ডকুমেন্টেশন করে রাখা বেশি জরুরি। বিভাস চক্রবর্তী, অশোক মুখোপাধ্যায়, মায়া ঘোষ, বহুরূপী থেকে সুবোধ দাশগুপ্ত। অনেক কাজ সম্পূর্ণ, প্রদর্শিত ও প্রশংসিত। কিছু কাজ অল্প বাকি। কোথাও সরকারি সাহায্য পেয়েছেন। কোথাও নিজেকেই উদ্যোগী হতে হয়েছে। সাড়া ফেলেছে ওঁর ‘বিহাইন্ড দ্য কার্টেন— আ জার্নি উইথ বিভাস চক্রবর্তী’। যে ভাবে বিভাসের কাজের সময়কাল ধরা হয়েছে, তাতে এ-হেন নির্মাণ আক্ষরিক সিনেমা হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি এই তথ্যচিত্র প্রদর্শিত হল মার্কিন মুলুকের নিউ জার্সিতে। এগিয়ে এসেছে প্রতিবেশী দেশ। শান্তনুর সৌজন্যে ঢাকা, হবিগঞ্জ ও সিলেটের আগ্রহীরা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পেলেন এক বাঙালি নাট্যব্যক্তিত্বের অসাধারণ যাত্রাপথ।
আবৃত্তির ব্যান্ড
নতুন প্রজন্ম বাংলা ভাষা চর্চা থেকে কি দূরে চলে যাচ্ছে? বিশেষত কবিতার নির্জন ও বহুস্তরীয় জগৎ কি তাদের জটিল বোধ হয়? এই ভয় সৃষ্টি হওয়ার আগেই তাকে জয় করার অঙ্গীকার করেছে আবৃত্তির ব্যান্ডগুলি। আধুনিক উপস্থাপনশৈলীতে যন্ত্রসঙ্গীতের ব্যবহারে তারা তরুণদের কবিতার প্রতি আগ্রহী করে তুলছে। ২০০৩ সালে শোভনসুন্দর বসুর ভাবনায় জন্মেছিল আবৃত্তির ব্যান্ড ‘বৃষ্টি’। পরে পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে প্রায় ৪০টি আবৃত্তির ব্যান্ড তৈরি হয়। মহুল, কবিতা কানেকশন, কথক, উড়ান, আলেখ্য তাদের অন্যতম। ব্যান্ডগুলিকে একত্র করে তাদের সম্মানিত করা হবে আইসিসিআর-এর সত্যজিৎ রায় অডিটোরিয়ামে, ৬ ডিসেম্বর। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের দিনে সম্প্রীতির সুর বাঁধা হবে আবৃত্তির ভিন্ন পরিবেশনায়।
লেগেছে আগুন
সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন ‘জাগুন জাগুন পাড়ায় আগুন বাড়ে হু হু’— ‘পাড়ায়’ শব্দটির বদলে ‘বাজারে’ বললেই মধ্যবিত্ত ছ্যাঁকা খেয়ে উঠবেন। অল্পস্বল্প শীতের সকালে সব্জি বাজারে গেলে ঠান্ডা আর গায়ে লাগবে না। বলতেই ককিয়ে উঠলেন বেহালার সরকারহাটের জম্পেশ বাজারু রাজীব ভট্টাচার্য। ‘এখন ব্যাগের আধখানা ভরতেই ৩০০ টাকা বেরিয়ে যায়।’ উত্তরের হাতিবাগান বাজারে অবশ্য দরদাম করেন না এমন ক্রেতাও আছেন। এ প্রশ্ন তুলতেই লেকমার্কেটের সব্জি বিক্রেতা মধুবাবুর আর্তনাদ, ‘প্রায় ষাট ভাগের কাছে ব্যবসা পড়ে গিয়েছে মশাই!’ অভিঘাত পড়েছে ভাতের হোটেলে, কেটারিং ব্যবসায়। তাঁদের কথায়, ‘সব্জির দাম যে ভাবে বাড়ছে, খাবারের সে ভাবে দাম বাড়ানো কি যায়?’ চিকিৎসকরাও চিন্তায়। ‘সব্জির বদলে মাছ-মুরগি সস্তা। কিন্তু তরকারি খাওয়াটাও তো জরুরি।’ তবে মাছ-মাংসের চাহিদা যে বেড়েছে এমন নয়। সরকারি ন্যায্যমূল্যের গাড়ি থেকে বাজারে বাজারে বিক্রির সামান্য ব্যবস্থা হয়েছে বটে, কিন্তু তা নেহাতই সিন্ধুতে বিন্দু। গাড়ি দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়ছেন ক্রেতারা। সত্যিই জরুরি অবস্থা চলছে সব্জি বাজারে। এই মাত্র সেখানে এসেছে এঁচোড়, ‘মাত্রো ১২০ টাকা।’ আর বলার কিছু রইল?
কল্পনির্ঝর
স্বল্পদৈর্ঘ্যের কাহিনিচিত্রের উৎসব এ দেশে বিরল। শর্ট ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল বলতে এখানে মুখ্যত তথ্যচিত্র, আর তার সঙ্গে কাহিনিচিত্রের সমাহার বোঝায়। সে দিক থেকে ‘কল্পনির্ঝর ইন্টারন্যাশনাল শর্ট ফিকশন ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’ দীর্ঘকাল ধরেই ব্যতিক্রমী, তথ্যচিত্র ব্যতিরেকেই স্বল্পায়তন কাহিনিচিত্র (অ্যানিমেশন ছবি-সহ) দেখার সুযোগ করে দেয় এ-শহরের দর্শককে, প্রতি শীতে। এ বারেও ১৭তম সে-উৎসব ৩-৭ ডিসেম্বর নন্দনে। যথারীতি বাছাই-করা ভিন্দেশি ছবি জড়ো করা হয়েছে উৎসবের জন্যে, তাতে আছে এ-বছর বার্লিন ফেস্টিভ্যালে দেখানো বেশ কিছু ছবিও। আছে জার্মানি, ফ্রান্স, ইটালির ছবি। ‘‘তবে বিশেষ দ্রষ্টব্য স্পেনের সাম্প্রতিক ২৭টি ছবি, যাতে ধরা আছে হালফিল সমাজজীবন।’’ জানালেন উৎসব-অধিকর্তা রাজু রামন। সঙ্গে স্পেনের ছবি ‘ডেকাডেন্ট’-এর স্থিরচিত্র। আছে ভারতীয় ছবির প্রতিযোগিতা ও পুরস্কার। উদ্বোধন করবেন অরিন্দম শীল। আয়োজনে কল্পনির্ঝর ফাউন্ডেশনের সঙ্গে গ্যোটে ইনস্টিটিউট, ম্যাক্সমুলার ভবন।
ঘরের পাশে আরশিনগর
পিতৃতান্ত্রিক পরিকাঠামোয় বেড়ে ওঠা জীবনে, এটা নয় সেটা নয়-এর বাধানিষেধের মাঝে কখনও কল্পনাই করিনি মা-কেন্দ্রিক একটা বৈষম্যহীন পরিবার সম্ভব।’’ লিখছেন সুপর্ণা লাহিড়ী বড়ুয়া, তাঁর ‘বদলে যাচ্ছে খাসি মায়েদের গল্প’ (মনফকিরা) বইয়ে। ঘরের পাশের ‘আরশিনগর’কে চিনতে জানতে অনেকটা সময় খরচ করতে হয়েছে তাঁকে। বিহারের দানাপুরে জন্ম, বাবার বদলির চাকরির সুবাদে শৈশব জামশেদপুর, ধানবাদ বিভিন্ন জায়গায় কেটেছে। বিজ্ঞানের স্নাতক, পরে ইনফরমেশন অ্যান্ড লাইব্রেরি সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা। মা মানসী লাহিড়ীর নিজস্ব ‘মহিলা’ ত্রৈমাসিকে সম্পাদনায় হাতেখড়ি। পরে বিভিন্ন ইংরেজি ও হিন্দি পত্রিকায় সাংবাদিকতার ফাঁকেই কলকাতার বিভিন্ন দৈনিকে বাংলায় প্রকাশিত হয় ঝাড়খণ্ড আন্দোলন, বিহারের জাহানাবাদ ও মাওবাদী এলাকা নিয়ে নিবন্ধ। বাবার মৃত্যুর পর ১৯৯৭-এ ডিব্রুগড়ে অসমিয়া ‘প্রত্যয়’ দৈনিকে যোগ দেন। কাজের সুবাদে পরিচয় হয় অসমের ভূমিপুত্র ভাস্কর বড়ুয়ার সঙ্গে, পরে তিনিই জীবনসঙ্গী হন, যিনি সে সময় সমবায়ের মাধ্যমে অসমিয়া জনজাতিকে একত্র করে কৃষি-সহ বিভিন্ন কাজে উন্নয়নের দিশা দেখাচ্ছিলেন। মহিলাদের নিয়ে দৈনিক পত্রপত্রিকায় লেখালিখি করতে করতেই আঞ্চলিক ভাষা পাঠ ও পোশাকে নিজেকে তাঁদের এক জন করে নিলেন। যোগ দিলেন স্থানীয় নানা আন্দোলনে, মিশলেন উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মেয়েদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে। মুদৈ গ্রামের উপজাতি পরিবারের পুত্রবধূ গুয়াহাটিবাসী এ-হেন সুপর্ণা সম্প্রতি কলকাতায় এসেছিলেন তাঁর লেখা দ্বাদশ বই ‘বদলে যাচ্ছে খাসি মায়েদের গল্প’ প্রকাশ উপলক্ষে। তাঁর অন্যান্য বই অসমিয়া ‘অর্ধ আকাশের সংগ্রাম’, ‘বিহারের নারী এবং সংগ্রাম’, ‘নারীর পৃথিবী নারীর সংগ্রাম’, ‘মণিপুরের মেয়েরা: সংগ্রাম ঘরে বাইরে’, ‘ডাইনি হত্যার উৎস সন্ধানে’ ইত্যাদি আমাদের কাছে সেই আরশিনগরের ছবিটা তুলে ধরে।
ছাত্রীদের দেওয়ালচিত্রে সচেতনতার পাঠ
ঘরে বাইরে সর্বত্র মহিলা ও শিশুদের প্রতি হেনস্থার নানা চিত্র রোজই সামনে আসছে। তাঁদের সুরক্ষা, অধিকার, প্রতিবাদ করে রুখে দাঁড়ানোর দিশা দেখানোর ভাবনা থেকেই ২৪ বছর আগে জন্ম নেয় ‘স্বয়ম’, বলছিলেন প্রতিষ্ঠাতা কর্ণধার অনুরাধা কপূর। লা মার্টিনিয়ার ফর গার্লস-এর প্রাক্তনী অনুরাধা নারী সুরক্ষার ভাবনায় স্কুলের অধ্যক্ষা রূপকথা সরকারকে প্রস্তাব দেন যৌথ ভাবে কিছু করার জন্য। আজকের ছাত্রীরা আগামীতে নানা পরিস্থিতির শিকার হতে পারে, তাই তাদের জানা উচিত কী ভাবে নিজেরাই নিজেদের সুরক্ষিত করবে। এই ভাবনার প্রেক্ষিতে অধ্যক্ষা মত দিতেই হেনস্থার শিকার দু’শো জন মহিলাকে নিয়ে ছ’টি এবং স্কুলের অষ্টম-দ্বাদশ শ্রেণির ৩০ জন ছাত্রীকে নিয়ে একটি কর্মশালা হয়। সিদ্ধান্ত, স্কুলের বাইরের দেওয়ালে নানা চিত্রমালার মাধ্যমে সচেতনতার পাঠ দেওয়া হবে। সুমন্ত মুখোপাধ্যায়, রিমেল বারগী, অনুপ প্রামাণিক এই শিল্পী ত্রয়ীর সঙ্গে স্কুলের ছাত্রীরা সমান তালে সহযোগিতায় তিন সপ্তাহে ১৬০ ফুট দেওয়ালের প্রায় সিংহভাগ জুড়ে ফুটিয়ে তুললেন দেওয়ালচিত্র (সঙ্গের ছবি)। ২৫ নভেম্বর ‘ইন্টারন্যাশনাল ডে এগেনস্ট ভায়োলেন্স অন উইমেন’ উপলক্ষে স্কুলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে দেওয়ালচিত্রটির আনুষ্ঠানিক উন্মোচন হল। বিশেষ অতিথি ছিলেন উষা উত্থুপ। ১০ ডিসেম্বর মানবাধিকার দিবস পর্যন্ত রয়েছে স্বয়মের হরেক কর্মকাণ্ড।