শান্তিনিকেতন ছেড়ে এসেছিলেন কলাভবনের শিক্ষা অসম্পূর্ণ রেখে। শিক্ষক নন্দলাল বসুকে আগেই জানিয়েছিলেন, চিত্রকর হওয়ার ইচ্ছা তাঁর নেই, ফলে কোর্স শেষ না করে যখন চলে এলেন, নন্দলাল বাধা দেননি, বরং বলেছিলেন, আড়াই বছরের শিক্ষানবিশিতেই সত্যজিৎ রায়ের আঁকার ক্ষমতার প্রভূত উন্নতি হয়েছে, জাপানি ক্যালিগ্রাফিক তুলি ব্যবহারেও তিনি রীতিমতো দক্ষ। এমনকি তাঁর কমার্শিয়াল আর্টিস্ট হওয়ার বাসনা শুনে তাঁকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। চল্লিশের দশকের গোড়ায় কলকাতায় ফেরেন সত্যজিৎ, এ শহরে তখন বোমাবর্ষণ চলছে জাপানের, তেমনই মুক্তি পাচ্ছে হলিউডের নতুন নতুন ছবিও। আশ মিটিয়ে ছবি দেখা, পাশাপাশি চাকরি খুঁজতে খুঁজতে পেয়েও গেলেন সত্যজিৎ, ব্রিটিশ বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠান ডি জে কিমার-এ।
সেখানে দিলীপকুমার গুপ্ত ওরফে ডি কে-র সঙ্গে কর্মসূত্রে ঘনিষ্ঠতা বাড়ল তাঁর, ডি কে পত্তন করলেন প্রকাশনা-প্রতিষ্ঠান সিগনেট প্রেস, সত্যজিৎকে দিলেন বইয়ের প্রচ্ছদ ডিজ়াইনের ভার। একই সঙ্গে বিজ্ঞাপনের লে-আউট আর বুক-ডিজ়াইন করতে লাগলেন সত্যজিৎ। অপুর পাঁচালি-তে (আনন্দ) লিখেছেন ‘বিশুদ্ধ বঙ্গীয় মোটিফের অলঙ্কৃত প্রচ্ছদ, হাতের লেখার ছাঁদে গ্রন্থ-নাম... কখনও-কখনও তুলি কিংবা কলমে আঁকা ছবি’র কথা।
ইতিহাসের সেই সন্ধিক্ষণ সত্যজিৎকে দুর্দান্ত গ্রাফিক ডিজ়াইনার করে তুলেছিল, অথচ তা নিয়ে আজও অদ্ভুত এক উদাসীনতা। শিল্পী সত্যজিৎকে সাধারণ্যে জ্ঞাত করে তুলতেই প্রকাশ পেল স্টারমার্ক-এর ‘রে (আন)কভারড’ ক্যালেন্ডার, শিল্পকর্ম জুগিয়েছে সত্যজিৎ রায় সোসাইটি। কিউরেটর সন্দীপ রায় জানালেন, “নানান ধরনের প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ থেকে বাবার শিল্পভাবনার আন্দাজ পাওয়া যাবে। বাছাই পর্ব থেকে নির্মাণ পর্যন্ত ছিলেন ডিজ়াইনার পিনাকী দে ও রিসার্চার ঋদ্ধি গোস্বামী। শতবর্ষের এই শ্রদ্ধার্ঘ্য বাবার কাজকে পৌঁছে দেবে সকলের কাছে।” ছবিতে বনলতা সেন-এর সত্যজিৎ-কৃত প্রচ্ছদ ও চিত্র-নাট্য পত্রিকার প্রচ্ছদ-খসড়া, ক্যালেন্ডার থেকে।
সত্যজিতের ছবির চিরচেনা কয়েকটি দৃশ্যে তাদের নতুন বছরের ডেস্ক ক্যালেন্ডারে পরিচালক সত্যজিৎকে প্রণতি জানিয়েছে ‘ফিপরেসি ইন্ডিয়া’ও। পথের পাঁচালী, অপরাজিত, অপুর সংসার, সমাপ্তি (তিন কন্যা), মহানগর, চারুলতা, নায়ক, গুপী গাইন বাঘা বাইন, অশনি সংকেত, সোনার কেল্লা, শতরঞ্জ কে খিলাড়ি, ঘরে বাইরে— বারোটি পাতায় বারোটি ছবির ‘সিগনেচার শট’। আরও প্রাপ্তি সত্যজিতের চলচ্চিত্রপ্রতিভা বিষয়ে বিশ্ববিশ্রুত শিল্প ও সিনেমা-ব্যক্তিত্বদের মন্তব্য— মিকেলেঞ্জেলো আন্তোনিয়োনি, আকিরা কুরোসাওয়া, ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলা, আর্থার সি ক্লার্ক, লিন্ডসে অ্যান্ডারসন, ইহুদি মেনুহিন, মকবুল ফিদা হুসেন থেকে লীলা মজুমদার, অমর্ত্য সেনের সত্যজিৎ-মুগ্ধতা।
চিরন্তন
বছরভর ক্যালেন্ডারে বিশেষ বিশেষ দিনগুলো জানা সকলের। আবার গুরুত্বের দিক দিয়ে বিশেষ হলেও অনেকগুলো দিন মনে থাকে না তত, যেমন ২৪ জানুয়ারি বিশ্ব শিক্ষা দিবস, ২০ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব সামাজিক ন্যায় দিবস, ২১ এপ্রিল বিশ্ব সৃষ্টিশীলতা ও উদ্ভাবনের দিন, ১৫ জুলাই বিশ্ব যুব দক্ষতা উদ্যাপনের। নতুন বছরের ডেস্ক ক্যালেন্ডারে সেই দিনগুলোকেই মনে করিয়ে দিয়েছে বাংলানাটক ডট কম, পাতায় পাতায় বাংলা ও বাঙালির লোকশিল্প-সংস্কৃতির এক-একটি নমুনার ছবি-সঙ্গতে— দক্ষিণ ২৪ পরগনার শোলাশিল্প, সবংয়ের মাদুর, পিংলার পটচিত্র, পুরুলিয়ার ছৌ, উত্তরবঙ্গের ভাওয়াইয়া, দক্ষিণ দিনাজপুরের কুশমন্ডির কাঠের মুখোশ (ছবিতে)। প্রতিটি মাসের উল্লেখযোগ্য উদ্যাপনগুলিও চিহ্নিত আলাদা করে। সংস্কৃতির লালন ও উদ্যাপনের মধ্য দিয়ে এ ভাবেই মানুষের বহুত্ব, মুক্তি, সহিষ্ণুতা, অধিকার রক্ষার বার্তা।
শহরকে চিনতে
ভারতীয় জাদুঘরের মমির বয়স কত? চিড়িয়াখানায় মোট কত প্রাণী? জিপিও কবে তৈরি হল, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল-ই বা কার তৈরি? ছুটির অবসরে, মা-বাবার সঙ্গে এ শহরের দর্শনীয় স্থানগুলো দেখতে গিয়ে ছোটদের কৌতূহলী মনে দোলা দেওয়া এ সব প্রশ্নের উত্তর বড়রা দিতে পারেন না অনেক সময়। সেই সব তথ্য-সহ কলকাতার ৭৫টি উল্লেখযোগ্য স্থানের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দু’মলাটে ধরেছেন পল্লব মিত্র, কলকাতার দর্শনীয় কেন্দ্র: কথায় ও ছবিতে (পারুল) বইয়ে। “এই বই পড়লে ছোটদের চোখে কলকাতার একটা স্পষ্ট ছবি ধরা পড়বে,” ভূমিকায় লিখেছেন সুরঞ্জন দাস। অতিমারি পেরিয়ে কল্লোলিনী তিলোত্তমা-দর্শনে এই গাইড বই কাজে দেবে।
উৎসব-সঙ্গীত
সঙ্গীত অধ্যাত্মপথের সহায়ক, ঐশী সান্নিধ্যের নিকটবর্তী হওয়ার মাধ্যম, মনে করতেন স্বামী বিবেকানন্দ। নিজেও ছিলেন চমৎকার গায়ক— কথামৃতের নানা জায়গায়, বিবেকানন্দ-জীবন জুড়েও ছড়িয়ে আছে নরেন্দ্রনাথ তথা স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গীতপ্রেম। ১২ জানুয়ারি তাঁর জন্মদিনে প্রতি বছর ‘বিবেকানন্দ মিউজ়িক ফেস্টিভ্যাল’ আয়োজন করে থাকে রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচার, গোলপার্ক। অতিমারি-আবহে এ বারের সঙ্গীত সম্মেলন আন্তর্জালিক। পাখোয়াজ সারেঙ্গি সরোদ সেতার তবলা কণ্ঠসঙ্গীত নিবেদনে পণ্ডিত উদ্ধবরাও শিন্ডে আপেগাঁওকর, আল্লারাখা কলাবন্ত, পণ্ডিত নরেন্দ্রনাথ ধর, পণ্ডিত পরিমল চক্রবর্তী, উস্তাদ ওয়াসিম আহমেদ খান, পণ্ডিত কুশল দাস, পণ্ডিত অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়, অনুব্রত চট্টোপাধ্যায়-সহ গুণী শিল্পীরা। শোনা যাবে ইনস্টিটিউট অব কালচার-এর ইউটিউব চ্যানেলে, আগামী বুধবার সকাল সাড়ে ৯টা থেকে।
স্মরণ-সম্মান
সুভাষচন্দ্রের সহযোগী হিসাবে ফরোয়ার্ড পত্রিকার সম্পাদনায় যুক্ত ছিলেন গোপাল হালদার, পরে জড়িয়ে পড়েন কমিউনিস্ট আন্দোলন, কৃষক আন্দোলন, গণনাট্য আন্দোলনেও। অধ্যাপনা করেছেন, লিখেছেন বাংলা ইংরেজি ও রুশ সাহিত্যের ইতিহাস, তেরোটি উপন্যাস, আত্মজীবনী রূপনারানের কূলে। স্বাধীনতা সংগ্রামী, শিক্ষক, লেখক, সম্পাদক, বহু পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত এই মননজীবনের স্মৃতিতে স্মারক সম্মান অর্পণ করে থাকে তথ্যসূত্র পত্রিকা (সম্পাদক: সুব্রত রায়চৌধুরী)। গত ২৯ ডিসেম্বর এক অনুষ্ঠানে ২০২১-এর সেই সম্মানে ভূষিত হলেন রবীন্দ্র-গবেষক বিজন ঘোষাল। দিলেন ‘গোপাল হালদার স্মারক বক্তৃতা’ও, ‘চিঠিপত্রে রবীন্দ্রনাথ’ বিষয়ে। একই সঙ্গে ‘সবিতা দেবী স্মারক সম্মান’-এ ভূষিত হলেন শিক্ষক-গবেষক প্রসূন মাঝি।
মঞ্চগানের ধারা
মূলত মঞ্চগানের প্রচার ও প্রসারের লক্ষ্যে ১৯৮৪ সালে ‘একাডেমি থিয়েটার’ প্রতিষ্ঠা দেবজিত্ বন্দ্যোপাধ্যায়ের। সঙ্গীত থিয়েটার যাত্রা সিনেমা-সহ সংস্কৃতি চর্চায় অনলস এই প্রতিষ্ঠানে আছে আশ্চর্য তোষাখানাও, সেখানে প্রায় ত্রিশ হাজার বই, সমসংখ্যক গানের রেকর্ড, পোস্টার ফোটোগ্রাফ বিলবোর্ড, দুষ্প্রাপ্য ক্যামেরা গ্রামোফোন, বাদ্যযন্ত্র। সঙ্গে মঞ্চগান কাব্যগান লোকগান যাত্রা-সিনেমার গানের পরিবেশন থেকেছে অব্যাহত। এ বার ৮-৯ জানুয়ারি রোজ রাত ন’টায় আন্তর্জালিক আয়োজন ‘তাঁহাদের কথা’— নিধুবাবুর পরম্পরায় পঞ্চকবির গীতধারায় গিরিশচন্দ্র জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ক্ষীরোদপ্রসাদ শিশির ভাদুড়ী হয়ে শম্ভু মিত্র উৎপল দত্ত অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় লালিত বাংলার মঞ্চগান। সহযোগিতায় ঋদ্ধি বন্দ্যোপাধ্যায় মিউজ়িক অ্যাকাডেমি। নাচ ভাষ্য কবিতা সঙ্গীতে বাংলা ও বহির্বিশ্বের শিল্পী সমন্বয়।
জীবনতীর্থ
করাচি-ফেরত কাজী নজরুল ইসলাম ১৯২০-র কলকাতায় প্রথমে ওঠেন বন্ধু শৈলজানন্দর মেসে, পরে ৩২এ কলেজ স্ট্রিটে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিসে। কলকাতাই নজরুলের সাহিত্যতীর্থ, জীবনের বেশির ভাগটা থেকেছেন এ শহরে। বার বার ঠিকানা বদল হয়েছে, প্রতিটি বাড়িই বহু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সাক্ষী। ৩/৪ সি তালতলা লেনের বাড়িতে লিখেছিলেন ‘বিদ্রোহী’ কবিতা, ছিলেন ১১ নং ওয়েলেসলি স্ট্রিটের বাড়িতে (নীচে ছবিতে), সেখানেই ছিল সওগাত পত্রিকারও অফিস। ৬ নং হাজী লেনের বাড়ি নজরুল-প্রমীলার বিয়ের সাক্ষী, ৫০/২ মসজিদবাড়ি স্ট্রিটের বাড়ি দেখেছে নজরুলের প্রিয় পুত্র বুলবুলের মৃত্যু, ৮/১ পানবাগান লেনের বাড়ি কাজী সব্যসাচীর জন্মও। রাজেন্দ্রলাল স্ট্রিট, শ্যামবাজার স্ট্রিট, বাদুড়বাগান লেন, ক্রিস্টোফার রোড... কলকাতায় নজরুলের স্মৃতিধন্য বাড়িগুলির ছবি ও তথ্য দিয়ে ১৫টি পোস্টকার্ডের সেট প্রকাশ করেছে ‘কোয়েস্ট ওয়ার্ল্ড’, ছায়ানট কলকাতা-র নিবেদনে। ছবি তুলেছেন মাসুদুর রহিম রুবাই, তথ্য সংগ্রহ ও পরিকল্পনা সোমঋতা মল্লিকের।
গণমানুষের শিল্পী
লালনের গানে মানবতার জয়গান, হাসন রাজার উদ্দিষ্ট আপন বৈভবের রংমহল, আর শাহ আবদুল করিমের (১৯১৬-২০০৯) গানে উঠে এসেছে চলিষ্ণু জীবনের বাঁকে স্থায়ী আবাসের স্বপ্ন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁকে বলতেন ‘গণমানুষের শিল্পী’, তাঁকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন বিখ্যাত কাগমারি সম্মেলনে (১৯৫৭), গান গেয়ে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন মানুষকে। ’৭১-এ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া মানুষটির গান প্রেরণা দিয়েছে স্বাধীনতার। একুশে পদক, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি সম্মাননা-সহ বহু পুরস্কারপ্রাপ্ত এই গণশিল্পী দুই বাংলার শ্রদ্ধার্হ। তাঁকে নিয়েই পড়শি পত্রিকার (সম্পা: মৃদুল হক, সঞ্চিতা দত্ত) প্রথম সংখ্যা সেজে উঠেছে আনিসুজ্জামান, সুধীর চক্রবর্তী, কালিকাপ্রসাদ, কিরণচন্দ্র রায়, মৌসুমী ভৌমিক, মুস্তাফা জামান আব্বাসী, শাকুর মজিদ, সুমনকুমার দাশ-সহ বিশিষ্টজনের লেখায়। বড় আকর্ষণ শাহ আবদুল করিমের আত্মস্মৃতি, ধলমেলা, গাজি কালু ও চম্পাবতীর কিস্সা জঙ্গলে মঙ্গল, নির্বাচিত গান, জীবনপঞ্জি, সাক্ষাৎকার।
যত দিন...
আগে স্বাদ-গন্ধ ছিল না, এখন আছে দুই-ই। এখনও অবধি। আগে ছিল শুকনো কাশি, এখন কাশি-কফ-ঠান্ডা লাগা। আগে ভালই জ্বর, বুকে-ফুসফুসে সংক্রমণ, এখন ও দুটোই নেই, বা প্রায়-নেই। দুর্বলতা, হাসপাতালে ভর্তি, সেও বাড়াবাড়ির পর্যায়ে যায়নি— এখনও পর্যন্ত। জীবনে এক নতুন কাজ জুড়ল, ভাইরাসের, রোগ-অসুখের উপসর্গের এই সতত ভোলবদলের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া। যত দিন বাঁচি, তত দিন শিখি। যত দিন হাঁচি, তত দিনও!