শারদোৎসব, দুর্গাপুজো তথা উৎসবের মরসুম এসে মনে করিয়ে দিয়ে যায়, এই বাংলায় শিশুসাহিত্যের ধারাটি এখনও অমলিন। শরতে, পুজোর মুখেই প্রকাশিত হয় কতশত ছোটদের পত্রিকা— কলকাতা আর জেলার শহরগুলি থেকেও। যেমন তাদের বাহারি রঙিন প্রচ্ছদ আর অলঙ্করণ, তেমনই লেখাও। গল্প, কবিতা, ছড়া; এ ছাড়াও প্রবন্ধ, বিশেষ রচনা, কার্টুন, খেলা আর বিজ্ঞানের লেখা, ছবি ভরা পাতায় পাতায়। আমপাতা জামপাতা ১৪২৯-এ (সম্পা: দেবাশিস্ বসু) সম্পাদকের কথা রূপ নিয়েছে স্বপ্নিল এক ছড়ার: “ধরো রোদ্দুর ঢালে সোনা/ খিদে নেই আর কারও ঘরে/ দেশে সুদিনের আনাগোনা/ আহা জল পড়ে পাতা নড়ে।” পবিত্র সরকার অনিতা অগ্নিহোত্রী মৃদুল দাশগুপ্ত শেখর বসু প্রমুখ লিখেছেন ছোটদের জন্য, যোগ্য সঙ্গতে এ কালের তরুণ লেখকেরা।
পারুল ডিঙিনৌকো-র (সম্পা: সুনির্মল চক্রবর্তী) সূচিপত্রটি মন-ভরানো, ‘ফিরে দেখা’ শিরোনামে বাংলা সাহিত্যের প্রণম্য লেখকদের গল্প কবিতা উপন্যাসে, আর এই সময়ের কলমে স্বাধীনতা পরিবেশ নদী মহাকাশ ভূত গোয়েন্দা ডাকাতের গল্প, রহস্যকাহিনিও। আলাদা করে বলতে হয় সুন্দর ছাপায় প্রবীণ-নবীন শিল্পীদের আঁকা ছবির কথা। নিখিল ভারত শিশুসাহিত্য সংসদের আলোর ফুলকি পত্রিকায় (সম্পা: আনসার উল হক, স্বপন পাল) চারশোরও বেশি পাতা জুড়ে শিশুসাহিত্য সম্ভার— লিখেছে কচি লেখকেরাও। ‘বইবার্তা’ বিভাগে একগুচ্ছ ছোটদের বইয়ের খবর, খুব কাজের। রঙবেরঙ (সম্পা: চন্দন নাথ) পত্রিকার শ্রদ্ধার্ঘ্য রামমোহন রায়, এবং নজরুল-কবিতা ‘বিদ্রোহী’ নিয়েও। গল্প কবিতা মনীষী-জীবনকথা ভ্রমণ খেলাধুলা নিয়ে লেখা, কী নেই!
জলফড়িং (সম্পা: কৃষ্ণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়) শারদ সংখ্যায় সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় ও ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের সাক্ষাৎকার, বাংলা সাহিত্যের মেয়ে গোয়েন্দাদের নিয়ে প্রবন্ধ; ছোটদের জন্য লিখেছেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায় ভগীরথ মিশ্র রতনতনু ঘাঁটী প্রমুখ। ছোটদের কচিপাতা-র (প্রধান সম্পা: সমর পাল) মিষ্টি প্রচ্ছদে থতমত মহিষাসুরের গোঁফ সেঁটে দিচ্ছে এক খুদে, অবাক চোখে েদখছেন মা দুগ্গা... আর ‘চিরকালের সেরা’ গল্প ও ছড়া বিভাগে উপেন্দ্রকিশোর রবীন্দ্রনাথ অবনীন্দ্রনাথ রজনীকান্ত যোগীন্দ্রনাথ সরকারকে ফিরে পড়তে কে না চাইবে! টগবগ উৎসব সংখ্যায় (সম্পা: রোহণ কুদ্দুস, দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়) গল্প কবিতা নভেলা নিবন্ধ, অমর মিত্র একরাম আলি যশোধরা রায়চৌধুরী-সহ বিশিষ্টজনের কলমে। চাঁদের হাসি (সম্পা: অশোককুমার মিত্র) আর ঝালাপালা চমকে দিয়েছে স্বাধীনতার পঁচাত্তরে, কত লেখা স্বাধীনতা ঘিরে! কিশোর দুনিয়া, খুশির হাওয়া, ছোটদের কলরব, উড়োজাহাজ, টুকলু, মায়াকানন, টাপুরটুপুর, ঋক নির্ভীক, শরৎশশী... মনে রাখার মতো এই পত্রিকারাও।
মুক্তমনা
স্বাধীনতার পরের বছর প্যারিসের সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে যান অরুণ মিত্র (ছবি), উদ্দেশ্য ফরাসি সাহিত্য নিয়ে গবেষণা। দেশে ফিরে যোগ দেন ইলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে, ফরাসি ভাষা-সাহিত্যের অধ্যাপনায়। একই সঙ্গে বাঙালি ও আন্তর্জাতিক বোধ ধারণ করা মানুষটির ১১৩তম জন্মদিন পালন করছে ‘মুক্তমন’— আগামী ৪ নভেম্বর শুক্রবার সন্ধে ৬টায়, জীবনানন্দ সভাঘরে। রবীন্দ্র পুরস্কার, সাহিত্য অকাদেমি, ফরাসি সরকারের সম্মাননায় ভূষিত এই কবি ও গদ্যশিল্পীর জন্মদিন আগামী ২ নভেম্বর, তারই উদ্যাপন-অনুষ্ঠান, শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় পবিত্র সরকার পঙ্কজ সাহা প্রতুল মুখোপাধ্যায় চিন্ময় গুহ-সহ বিশিষ্টজনের উপস্থিতিতে। অতিমারির কারণে গত দু’বছর এই অনুষ্ঠান হয়েছিল আন্তর্জালে, এ বার অনুকূল পরিস্থিতিতে স্বজন-বন্ধুদের এই উদ্যোগ।
সাহিত্যে স্বাধীনতা
স্বাধীনতার পঁচাত্তর পূর্তিতে কলকাতায় সাহিত্য অকাদেমির আয়োজনে গত ১৫-১৬ অক্টোবর হল আলোচনাচক্র, জরুরি এক বিষয়ে: ‘বাংলা সাহিত্য ও ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম’। বিভিন্ন অধিবেশনে আলোচনা হল ১৯৪৭-এর আগে ও পরে বাংলা সাহিত্যে স্বাধীনতা ও জাতীয়তাবাদের প্রভাব, ১৯৪৭-এর প্রেক্ষাপটে সমসাময়িক লেখক চিন্তক ও স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সংযোগ-সম্পর্ক নিয়ে; সাহিত্য হাতিয়ার না কি দর্পণ, উঠল সে প্রশ্নও। ছিল ফিল্মস ডিভিশন প্রযোজিত দু’টি তথ্যচিত্রের প্রদর্শন— ইন্ডিয়া ইন্ডিপেন্ডেন্ট ও ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডম। উদ্বোধন অনুষ্ঠান, সমাপ্তিপর্ব-সহ বিভিন্ন অধিবেশনে বললেন রঞ্জন চক্রবর্তী, শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়, কে শ্রীনিবাসরাও, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, প্রাক্তন বিচারপতি অশোক কুমার গঙ্গোপাধ্যায়, অভ্র ঘোষ, সুবোধ সরকার, সুমিতা চক্রবর্তী, গোপা দত্ত ভৌমিক, শিবাজীপ্রতিম বসু, তপোধীর ভট্টাচার্য প্রমুখ।
জীবন-নাট্য
শহরে সুখবর, মুম্বইয়ের নাট্যগোষ্ঠী ‘আনন্দম’-এর নতুন ও সঙ্গীতবহুল নাটক কাননবালা থেকে কানন দেবী, আগামী ৫ নভেম্বর অ্যাকাডেমি মঞ্চে সন্ধ্যা ৬টায় ও ৬ নভেম্বর মধুসূদন মঞ্চে বিকেল ৫.৪৫-এ। হতদরিদ্র ঘরে জন্মানো সহায়সম্বলহীন কন্যা কাননবালার আশ্চর্য উত্তরণের কাহিনি... রুপোলি পর্দায় কিংবদন্তি উপস্থিতি, প্রমথেশ বড়ুয়ার সঙ্গে শেষ উত্তর ছবিতে গাওয়া ‘তুফান মেল’ বা ‘আমি বনফুল গো’, মুক্তি ছবিতে ‘আজ সবার রঙে’, আজও উজ্জ্বল বাঙালির স্মৃতিতে। ‘শ্রীমতী পিকচার্স’-এর প্রতিষ্ঠাতা, দাদাসাহেব ফালকে সম্মানে ভূষিতা কাননদেবীকে নিয়ে এই নাটকের নির্দেশক লাকি মুখোপাধ্যায়। কলকাতায় দু’টি নাট্যানুষ্ঠান থেকে সংগৃহীত অর্থ ‘আনন্দম’ তুলে দেবে ক্যানসার রোগাক্রান্তদের সাহায্যার্থে।
ছবির কথা
শোলার শিল্পকর্ম কত পুরনো শিল্পরীতি, তা নিয়ে বাঁচেন কী ভাবে শিল্পীরা; অসমের মুগা সিল্কের কাজ কী ভাবে জীবন্ত সংস্কৃতি হয়ে উঠেছে; সুন্দরবনের মানুষের উত্তাল প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই, আবার সঙ্ঘবদ্ধ জীবনযাপন; রবীন্দ্রনাথের স্বাধীনতার স্বপ্নের পাশাপাশি কী ভাবে গড়ে উঠেছিল বিশ্বভারতীর স্বপ্ন... এমন বহু বিষয় নিয়ে অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে দীর্ঘ কাল ধরে একের পর এক ছবি করে গিয়েছেন কানুগোপাল দাস— কে জি দাস নামে বিশিষ্ট প্রামাণ্যচিত্রকার হিসেবে সকলের কাছে পরিচিত যিনি। ফিল্মস ডিভিশনের এই পরিচালককে সম্মাননা জ্ঞাপন করতে তাঁর ছবির রেট্রোস্পেকটিভ আয়োজন করেছিল সুতানুটি শর্টস ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল কমিটি ও এস পি অ্যাকাডেমি, গত ১৫ অক্টোবর সন্ধ্যায় নন্দন-৩’এ। তাঁর ছবি নিয়ে বললেন গৌতম ঘোষ স্বপন মল্লিক ও শ্রীলেখা মুখোপাধ্যায়। শোনা গেল পরিচালকের নিজের কথাও।
প্রদীপ্ত স্বর
ঈষৎ ঢেউ খেলানো, শরতের সাদা মেঘের মতো কেশের সৌম্য মূর্তিটি থেকে চুঁইয়ে পড়ত এক ধরনের তারুণ্য। প্রবীণ বয়সেও যাঁর কণ্ঠে নজরুলের ‘কামাল পাশা’ রক্তে দোলা দিত দুই বাংলার ভাষা-অনুরাগীদের। মেঘনাদবধ কাব্য, ছিন্নপত্র থেকে আবোল তাবোল-এর শব্দের দ্যোতনাও মরমি হয়ে উঠত তাঁর বোধে। বাংলা কবিতার সম্ভার কণ্ঠে নিয়ে সারা দুনিয়া পাড়ি দিয়েছেন প্রদীপ ঘোষ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও তাঁর শ্রোতা, অগ্রজপ্রতিম গুরু কাজী সব্যসাচীর সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। এই প্রদীপশিখার বর্ণময় বিচ্ছুরণ নিয়ে দেবযানী আইচের তথ্যচিত্র আকাশ প্রদীপ সম্প্রতি প্রদর্শিত হল নন্দন-৩ প্রেক্ষাগৃহে। শিল্পীর প্রয়াণের দু’বছর বাদে, কন্যা পৃথার কাছে এ যেন পিতৃতর্পণ।
মহাজীবন
১৮৯৮ সালের ২৮ জানুয়ারি কলকাতা পৌঁছলেন মার্গারেট এলিজ়াবেথ নোবল। ফেব্রুয়ারিতে প্রথম দক্ষিণেশ্বরে যাত্রা, ১১ মার্চ স্টার থিয়েটারে এক সভায় শহরের বিশিষ্টজনের সঙ্গে তাঁর পরিচয় করিয়ে দিলেন স্বামী বিবেকানন্দ, পরে সারদা দেবী-সকাশে, এবং ২৫ মার্চ দীক্ষা-শেষে নাম হল ‘নিবেদিতা’, এক মহাজীবনের যাত্রা শুরু। ভগিনী নিবেদিতার কলকাতা আগমনের ১২৫ বছরের লগ্ন সমাগত, তা-ই উদ্যাপন করল ‘রামকৃষ্ণ সারদা মিশন সিস্টার নিবেদিতা হেরিটেজ মিউজ়িয়ম অ্যান্ড নলেজ সেন্টার’, গতকাল ২৮ অক্টোবর মহীয়সীর জন্মদিনে, ফণীভূষণ বিদ্যাবিনোদ যাত্রামঞ্চে। ছিলেন ভারত সরকারের কয়লা মন্ত্রকের যুগ্মসচিব ও আর্থিক উপদেষ্টা নিরুপমা কোতরু, সারদা মঠ ও রামকৃষ্ণ সারদা মিশনের সহকারী সাধারণ সম্পাদক প্রব্রাজিকা জ্ঞানদাপ্রাণা, প্রব্রাজিকা ভাস্বরপ্রাণা, দেবাঞ্জন সেনগুপ্ত, নীলাঞ্জনা দাশগুপ্ত প্রমুখ। ছবিতে বোসপাড়া লেনে সংগ্রহশালায় নবরূপে সেজে ওঠা নিবেদিতার ঘর, ডেস্কে কর্মরত তিনি।
প্রত্যাবর্তন
১৯৬৩-র অক্টোবরে প্রথম প্রকাশ বাংলা তথা ভারতের প্রথম কল্পবিজ্ঞান পত্রিকা আশ্চর্য!-এর শারদ সংখ্যা। আকাশ সেন ছদ্মনামে অদ্রীশ বর্ধনের সম্পাদনা, প্রধান উপদেষ্টা প্রেমেন্দ্র মিত্র। শুভেচ্ছা জানিয়ে বিমল কর লিখেছিলেন, “বাংলা দেশে এ-রকম কাগজ আগে আর কখনও কেউ প্রকাশ করেছেন বলে জানি না...আপনাদের কাগজের যাঁরা পাঠক তাঁরা যদি সহানুভূতিসম্পন্ন হন তবে যে শুধু কাগজটি বাঁচবে তা নয়, ক্রমে ক্রমে বাংলা সাহিত্যে যা ছিল না যা নেই সেই ‘সাইন্স ফিকশান’ গড়ে উঠবে।” সেই সংখ্যায় লিখেছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী সমরজিৎ কর শ্রীধর সেনাপতি প্রমুখ, অনুবাদ করেছিলেন অদ্রীশ বর্ধন, মনোরঞ্জন দে... তিনশোরও বেশি পৃষ্ঠার পত্রিকা, মূল্য আড়াই টাকা। ষাট বছরের মুখে এই অক্টোবরে ‘কল্পবিশ্ব পাবলিকেশন’ পুনঃপ্রকাশ করল সেই সংখ্যাটি (ছবিতে প্রচ্ছদ)। শুধু পত্রিকার গল্পই নয়, তার বিজ্ঞাপন ও অলঙ্করণগুলিও ফিরিয়ে আনা হয়েছে হুবহু। বাংলার কল্পবিজ্ঞান-সাহিত্য ও ইতিহাসে এই ফিরে আসা, ফিরিয়ে আনাও দামি খুব।
নয়ে ছয়ে
গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজের ১৯৯৬ সালের প্রাক্তনী ওঁরা। পাশ করার পর পেরিয়ে গিয়েছে পঁচিশ বছরেরও বেশি সময়, তবু বছরে এক বার একত্র হন সকলে, আনন্দ-সম্মিলনের সঙ্গী হয় শিল্প প্রদর্শনীও। কোভিড হেতু গত দু’বছর সম্ভব হয়নি তা, এ বছর মহাসমারোহে পঞ্চম বারের প্রদর্শনী, ত্রিশ জন শিল্পী-সতীর্থের চারকোল, তেলরং, জলরং, অ্যাক্রিলিক, টেম্পেরা, মিশ্র মাধ্যমের শিল্পকৃতি নিয়ে। প্রদর্শনীর নামেও চমক, ‘আমরা নয়-ছয়’। সেই যে ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’-র গানে ছিল ‘কত কী করার আছে বাকি’... তা-ই ওঁদের শিল্পচর্চার প্রেরণা, আনন্দ যাপনেরও। অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসে আজ ২৯ অক্টোবর প্রদর্শনী উদ্বোধন করবেন শিল্পী সমীর আইচ ও চন্দ্র ভট্টাচার্য, চলবে আগামী ৪ নভেম্বর পর্যন্ত, দুপুর ১২টা থেকে রাত ৮টা।