হাওড়া স্টেশনে ‘হুইলার’-এর স্টল থেকে উইলিয়াম গ্যালাচার-এর বই দ্য কেস ফর কমিউনিজ়ম কেনাই কাল হয়েছিল মৃণাল সেনের। তখন গীতা সেনের সঙ্গে পূর্বরাগ পর্ব চলছে, উত্তরপাড়া গিয়ে তাঁকে নিয়ে ফের কলকাতা পৌঁছতে হবে। এ দিকে পড়ায় মগ্ন হয়ে ভুল ট্রেনে উঠে পড়া, দেরি, ফেরার পথে হাওড়া ব্রিজ হেঁটে পেরোনোর সময় নদীবক্ষে সূর্যাস্তের প্রেক্ষাপটে কোন আলো লাগল চোখে... মৃণালের হাত পিছলে বই ভেসে গেল জলে। ‘গীতা’ ও ‘কমিউনিজ়ম’ জুড়ে যাওয়া এই ‘গল্প হলেও সত্যি’-তে রয়ে গিয়েছে হাওড়ার হুইলার বই-বিপণিও।
হাওড়া স্টেশনের ‘এ এইচ হুইলার অ্যান্ড কোং’ বইদোকান কে না চেনেন। দেশের তৎকালীন রাজধানীর কেন্দ্রীয় রেল স্টেশনের জন্য সেগুন কাঠের তৈরি এই স্টল ১৯০৪-০৫’এ আমদানি হয়েছিল ব্রিটেন থেকে। একটিও কব্জা বা নাট-বল্টু ব্যবহার না করে, স্লাইডিং প্যানেল দিয়ে তৈরি স্টলটিকে ২০১৮ সালে ‘হেরিটেজ’ শিরোপাও দিয়েছিল ভারতীয় রেল। তবে হুইলার-এর গল্পের শুরু ১৮৭০-র দশকে ইলাহাবাদে, এমিলি মরো-র উদ্যোগে। স্টেশনে যাত্রীদের মধ্যে বই ও পত্রপত্রিকার চাহিদা লক্ষ করেছিলেন তিনি। পরে আর্থার হেনরি হুইলার নামে তাঁর এক বন্ধু যখন নিজের বাড়ির লাইব্রেরির বই খালি করার কথা বলেন, মরো তখন স্টেশন চত্বরে একটি আলমারি বসিয়ে তা থেকে সেই বই কম দামে বিক্রি শুরু করেন। বন্ধুর নামে অংশীদারিতে ব্যবসা খোলেন লন্ডন ও ইলাহাবাদে, আলাদা অফিস নিয়ে। উত্তর ভারতের নানা স্টেশনে ছড়িয়ে পড়ে হুইলার, ক্রমে আসে বই প্রকাশনাতেও, প্রকাশ করে ‘ইন্ডিয়ান রেলওয়ে লাইব্রেরি’ সিরিজ়, যার মধ্যে ছিল রাডইয়ার্ড কিপলিং-এর লেখাও।
উনিশ শতকের শেষে হুইলার হয়ে উঠেছিল ব্রিটেন থেকে বই আমদানির বৃহত্তম সংস্থা। রেলপথের বিস্তার ও যাত্রী সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশীয় ভাষার বইপত্রেরও ঠিকানা হয়ে ওঠে সে, যাত্রাপথে পাঠ্য হিসেবে ভিন্ন রীতির সাহিত্যও ঠাঁই পায় স্টলে। তপন সিংহের স্মৃতিকথায় আছে রোজ সকালে ভাগলপুর স্টেশনে হুইলার-এর স্টলে ‘বনফুল’-এর বই পড়ার স্মৃতি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান বাহিনীর নৃশংসতার তথ্যের পাশাপাশি হিন্দি উর্দু বাংলায় ব্রিটিশ যুদ্ধ প্রচেষ্টার জোর প্রচার হত স্টল থেকে।
১৯২০-র দশকে মালিকানা আসে সংস্থার দীর্ঘ দিনের কর্মী টি কে বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে। এলাহাবাদের এই বাঙালি পরিবারের পরিচালনায় জয়েন্ট স্টক কোম্পানি হিসাবে নথিভুক্ত হয় হুইলার। কিন্তু রেলস্টেশনে বই ব্যবসায় একাধিপত্যে হাত পড়ে ১৯৬০-৭০’এর দশক থেকে। নতুন শতকে মোবাইল ফোন এসে রেলপথে বই-পত্রপত্রিকার চাহিদা কমেছে আরও। হাওড়া স্টেশনের হুইলার স্টল এখন জলের বোতল, খাবার, নরম পানীয়, রুমাল, হাওয়াবালিশ, লটবহর বাঁধার শিকলে ভরা (ছবিতে), বই-পত্রপত্রিকার সেই অমিত লাবণ্য কোথায়?
নির্ভীক
“আমার বলার অধিকার/ কেড়ে নিতে পারেনি কো/ বলদর্পী নির্বোধ গোঁয়ার/ তাদের করেছি অস্বীকার...” জরুরি অবস্থার সময় প্রেসিডেন্সি জেলে লিখেছিলেন গৌরকিশোর ঘোষ (ছবিতে)। আগামী ২০ জুন জন্মশতবর্ষের সূচনা আপসহীন নির্ভীক এই লেখক সম্পাদকের (জন্ম ১৯২৩), ‘গৌরকিশোর ঘোষ জন্মশতবর্ষ উদ্যাপন কমিটি’র বর্ষব্যাপী উদ্যাপনেরও শুরু। ইতিমধ্যে তৈরি ওয়েবসাইট ‘গৌরকিশোর ঘোষ ডট কো ডট ইন’, ফেসবুক পেজ ‘গৌরকিশোর ঘোষ রূপদর্শী’। শতবর্ষ উদ্বোধন অনুষ্ঠান সোমবার সন্ধ্যা ৬টায় রবীন্দ্র সদনে, বলবেন মেধা পাটকর, শতবর্ষ বক্তৃতায় সুগত বসু। স্মারক গ্রন্থ প্রকাশ করবেন ব্রাত্য বসু, প্রদর্শিত হবে শৈবাল মিত্রের তথ্যচিত্র রূপদর্শী। অন্য দিকে ‘ফ্রেন্ডস অব ডেমোক্রেসি’র উদ্যোগে ২৪ জুন অবনীন্দ্র সভাগৃহে গৌরকিশোর ঘোষ স্মারক বক্তৃতা, ‘জরুরি অবস্থার সেকাল একাল’ নিয়ে বলবেন সুগত বসু ও দীপঙ্কর ভট্টাচার্য।
ইতিহাস ছুঁয়ে
ব্রিটিশ ভারত, ১৯২২। দেশে টাকাপয়সা জোগান ও দেখাশোনার কাজ করত কারেন্সি অফিস। সে বছরই কলকাতার কারেন্সি অফিসের কর্মীরা প্রতিষ্ঠা করেন ‘কারেন্সি ইউনিয়ন’, পরে তা গড়ে ওঠে বম্বে, মাদ্রাজেও। সূচনাপর্বে সংগঠনের সভাপতি ছিলেন বিপিনচন্দ্র পাল। ১৯৩৫ সালে তৈরি হল রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক, কারেন্সি ইউনিয়নও নাম পাল্টে হল ‘রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক এমপ্লয়িজ় অ্যাসোসিয়েশন’। স্বাধীনতার আগে ও পরে দেশের ইতিহাসের সাক্ষী এই সংগঠন এ বছর পালন করছে তাদের শতবর্ষ, ১৯২২-এর কারেন্সি ইউনিয়ন-এর শিকড় ছুঁয়ে। এআইটিইউসি এবং তৎকালীন ‘ইম্পিরিয়াল ব্যাঙ্ক’-এর ইউনিয়নের পরে তৃতীয় প্রাচীনতম এই সংগঠন প্রস্তুত হচ্ছে শতবর্ষ উদ্যাপন অনুষ্ঠানের জন্য, তারই অঙ্গ হিসেবে গত ৮ জুন সংবর্ধিত হলেন সংগঠনের প্রাক্তন সভাপতি ও সম্পাদকেরা।
আবিষ্কার
রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সহশিল্পী এক বিদেশিনি! এই শহরেরই ঘটনা, ১৯৮২ সালের। হেমন্তের গানের বিশেষ অনুরাগী ব্রিটিশ সঙ্গীতশিল্পী জ্যানেট ফে সিমান্স কলকাতায় এলে, রবীন্দ্র সদনের অনুষ্ঠানে কলকাতা শুনেছিল দ্বৈতকণ্ঠে ‘ওগো নদী আপন বেগে’, ‘পুরানো সেই দিনের কথা’, ‘আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ’, ‘ওরা অকারণে চঞ্চল’... জ্যানেট একা গেয়েছিলেন ‘প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে’, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আরও কয়েকটি। অনুষ্ঠানটির লাইভ রেকর্ডিংটি ছিল ‘হেমন্ত মুখোপাধ্যায় স্মরণ কমিটি’র সভাপতি তুষার তালুকদারের ব্যক্তিগত সংগ্রহে, তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় ও স্মরণ কমিটির সম্পাদক সৌম্যেন অধিকারীর উদ্যোগে গত ১৬ জুন শিল্পীর জন্মদিনে তা-ই প্রকাশিত হল সে কি ভোলা যায় সিডি আকারে।
সঙ্গীত দিবসে
লোকসঙ্গীত শিল্পীদের সঙ্গে নিবিড় যোগ ‘বাংলানাটক ডট কম’ সংস্থার। গ্রামবাংলার শিল্পীদের দেশ-বিদেশের উৎসব ও শিল্পীদের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছে তারা, ‘ইউরোপিয়ান ব্রডকাস্টিং ইউনিয়ন’ এবং ‘ওমেক্স’-এর মাধ্যমে বাংলার লোকসঙ্গীতকে পৌঁছে দিয়েছে বিশ্বের দরবারে। আগামী ২১ জুন বিশ্ব সঙ্গীত দিবস, লোকসঙ্গীতে কলকাতা মাতাবে তারা। জ্ঞান মঞ্চে অনুষ্ঠান বিকেল ৫টা থেকে রাত সাড়ে ৮টা, থাকবেন বাংলার বাউল, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি ও ঝুমুর শিল্পীরা, সঙ্গী হবেন জয়সলমেরের মাঙ্গানিয়া সঙ্গীতের দল। বিশিষ্ট ‘এথনোমিউজ়িকোলজিস্ট’, রেডিয়ো ও রেকর্ড প্রযোজক দেবেন ভট্টাচার্যের জন্মশতবর্ষ পূর্ণ হল গত বছর, তাঁর স্মরণে নিবেদিত হবে সঙ্গীত-শ্রদ্ধার্ঘ্য, থাকবেন মৌসুমী ভৌমিক।
সেতুবন্ধন
ভাষা আলাদা, সংস্কৃতিও, তবু তো সেতু বাঁধা যায়। চলচ্চিত্র প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে সেই চেষ্টাই করে সিনে-চর্চা গোষ্ঠী ‘সিনেমাথেক কলকাতা’। দিল্লির মেক্সিকো দূতাবাসের সহযোগিতায় এ বার তাদের আয়োজন দু’দিন ব্যাপী মেক্সিকান চলচ্চিত্র উৎসব, নন্দন-৩’এ, আগামী ২০-২১ জুন। েদখানো হবে তিনটি ছবি: লেয়োনা, প্যান-আমেরিকান মেশিনারি, অ্যাট ডন। রয়েছে মেক্সিকান চলচ্চিত্র নিয়ে আলোচনাও, থাকবেন গৌতম ঘোষ। অন্য দিকে, বইয়ের মধ্য দিয়ে সেতুবন্ধনের কাজ দৃঢ় হল আরও— কলকাতায় মেক্সিকোর কনসাল সুমিত মজুমদার সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে ২১টি বই তুলে দিলেন ন্যাশনাল লাইব্রেরির মুখ্য গ্রন্থাগার ও তথ্য আধিকারিকের হাতে। অক্তাভিয়ো পাজ়, রোসারিয়ো কাস্তেলানোস, লুই ভিলোরো-সহ খ্যাত লেখকদের সাহিত্যসম্পদ।
মহোৎসবে
১৮৮৫-র গ্রীষ্মে গলায় একটা ব্যথা অনুভব করেন শ্রীরামকৃষ্ণ, কর্কটরোগের সে-ই সূত্রপাত। সে বছর পানিহাটিতে দণ্ডমহোৎসব তথা চিঁড়া উৎসবের দিন পড়েছিল ২৫ জুন, শ্রীরামকৃষ্ণ যাবেন উৎসবে, অসুস্থতা সত্ত্বেও, বলেছিলেন “একটু সামলে চললেই হবে।” কোথায় কী সামলানো, উৎসবময় পেনেটিতে মণি সেনের বৈঠকখানার পাশে রাধাকৃষ্ণ মন্দিরের প্রশস্ত উঠানে কীর্তনদলে মিশে ভাবাবেশে মহানৃত্য, তার বর্ণনা আছে স্বামী সারদানন্দের শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলাপ্রসঙ্গ গ্রন্থের ‘পাণিহাটির মহোৎসব’ অংশে। শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে নতুন নয় এই মহোৎসব, প্রথম আসেন ১৮৫৮ সালে, ১৮৮৫ পর্যন্ত সাতাশ বছরে নিয়মিত যোগ দিয়েছেন শ্রীচৈতন্য-নিত্যানন্দের স্মৃতিধন্য এ উৎসবে। আনন্দ করেছেন, ভাববিহ্বল ও সমাধিমগ্ন হয়েছেন, দই-চিঁড়া-ফলের মালসা ভোগ (ছবিতে যেমন, এখনকার) দিয়েছেন, প্রসাদ পেয়েছেন। পাঁচশো বছর ছাড়ানো দণ্ডমহোৎসবের আবহে সেই বিবরণীই প্রকাশিত হল সদ্য, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পেনেটীর মহোৎসবে পুস্তিকায় (প্রকাশক: ডিআরএসটেক সুখচর), শেখর কুমার শেঠের সম্পাদনায়।
কৌতুকমুখ
সংবাদপত্রে বাংলা ভাষায় ব্যঙ্গচিত্র বা কার্টুনের প্রথম প্রকাশ মনে করা হয় ১৮৭২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি— অমৃতবাজার পত্রিকা-য়। সেই হিসাবে এ বছর খবরকাগজে বাংলা কার্টুন প্রকাশের সার্ধশতবর্ষ, উদ্যাপনীয় অবশ্যই। সুদীর্ঘ এই সময়ে বাংলা সংবাদপত্র, সাময়িকী, বই সমৃদ্ধ হয়েছে কার্টুনে, রূপে আঙ্গিকে অনেক বদলেছে বাংলা কার্টুনশিল্পধারাও। প্রীতম চট্টোপাধ্যায় ও সুশান্ত রায়চৌধুরী, দুই তরুণ কার্টুনিস্টের পরিকল্পনা ও রূপায়ণে সম্প্রতি প্রকাশিত হল আটটি পোস্টকার্ডের সেট— আত্মপ্রতিকৃতিতে বাংলার ব্যঙ্গশিল্পীরা। শিরোনামেই স্পষ্ট, এতে রয়েছে আট শিল্পীর আত্মপ্রতিকৃতি— কার্টুন-ক্যারিকেচারের ধারা মেনে। ‘কাফি খাঁ’ তথা প্রফুল্লচন্দ্র লাহিড়ী (ছবিতে) শৈল চক্রবর্তী রেবতীভূষণ ঘোষ চণ্ডী লাহিড়ী অমল চক্রবর্তী সুফি সুকুমার রায়চৌধুরী দেবাশীষ দেব— আট ব্যঙ্গচিত্রীর কৌতুকমুখ। পাওয়া যাবে বইপাড়ায়, ফেসবুকে ‘কার্ট বুড়ো’ পেজে মিলবে তার সুলুকসন্ধান।
জীবন-পাঠ
আত্মজীবনী কারও কাছে ক্লান্তিকর তথ্যভার, কারও কাছে বিচিত্র জীবনরহস্যের চাবিকাঠি। তা সে যতই আলো বা কালো হোক, সাহিত্যের এই ধারাটির প্রতি পাঠকের আগ্রহ কম নয়। এক বঙ্গভূমি ও বাংলা ভাষাতেই আত্মজীবনী-আত্মকথার বিরাট ভাঁড়ার, চৌহদ্দি বাড়িয়ে ভারত বা গোটা বিশ্বকে ডেকে আনলে তা অসীম সাহিত্যবৈভবের শামিল। দুই বৃহদায়তন খণ্ডে এমনই কিছু আত্মজীবনীর স্বতন্ত্র পাঠের প্রয়াস করেছে আলোচনার কাগজ ছাপাখানার গলি (সম্পাদক: দেবাশিস সাহা)। প্রথম খণ্ড জুড়ে সাহিত্যিকদের আত্মজীবনী-বীক্ষণ, দ্বিতীয় খণ্ডে সমাজকর্মী রাজনীতিবিদ সঙ্গীতজ্ঞ চিত্রকর ভাস্কর অভিনেতা চলচ্চিত্রকার ক্রীড়াবিদদের জীবনকথা ফিরে দেখা। শতাধিক আত্মকথা-স্মৃতিকথার এই আলোচনা-উদ্যোগ সাধুবাদযোগ্য।