সাত বছর বয়সে মা’র সঙ্গে শান্তিনিকেতনে পৌষমেলায় গিয়ে রবীন্দ্রনাথকে সেই প্রথম কাছ থেকে দেখা সত্যজিতের। সঙ্গে ছিল অটোগ্রাফের খাতা, “ভারী শখ আমার খাতার প্রথম পাতায় তাঁকে দিয়ে কবিতা লিখিয়ে নেব,” লিখেছেন (আনন্দবাজার পত্রিকা, ৮ মে ১৯৭৮)। উত্তরায়ণে অটোগ্রাফের খাতা সত্যজিৎ এগিয়ে দিলেও কবিতার অনুরোধ করেছিলেন সুপ্রভা রায়, কারণ সত্যজিৎ ছিলেন বেজায় মুখচোরা। রবীন্দ্রনাথ পরের দিন সকালে প্রথম পাতায় আট লাইনের একটি কবিতা লিখে সত্যজিৎকে দিয়ে বলেছিলেন, “এর মানে আরেকটু বড় হলে বুঝবে।” শেষ চার লাইন: “দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া/ ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া/ একটি ধানের শিষের উপরে/ একটি শিশিরবিন্দু।” তা বুঝেছিলেন বলেই বাঙালির দেশজ জীবনের শিকড় ছুঁতে পেরেছিলেন সত্যজিৎ তাঁর প্রথম ছবি পথের পাঁচালী-তে, বিশ্বময় পৌঁছে দিতে পেরেছিলেন সেই শিল্পবোধ, নিজস্ব চলচ্চিত্রভাষায়। জীবনপ্রান্তে এসে তাঁর এই শিল্প-পরিক্রমার কথা লিখেছিলেন সত্যজিৎ রায়, ১৯৯১-এর ১ অগস্ট দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায়, হোম অ্যান্ড দ্য ওয়র্ল্ড শিরোনামে। পাশ্চাত্য শিল্প-সাহিত্যে স্নাত সত্যজিতের মধ্যে শান্তিনিকেতন কী ভাবে গড়ে তুলেছিল পাশ্চাত্য আর প্রাচ্যের সম্মিলিত রূপ, ধরা আছে সে লেখায়। লিখছেন, পথের পাঁচালী তৈরির সময় প্রতি দিন গ্রামীণ জীবনের খুঁটিনাটি আবিষ্কারকালে “টেগোর’স লিটল পোয়েম ইন মাই অটোগ্রাফ অ্যালবাম কেম ব্যাক এগেন অ্যান্ড এগেন টু মাই মাইন্ড।” জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে তাঁর এমন আরও রচনা দুই মলাটে সঙ্কলিত করে, সত্যজিৎ রায় সোসাইটি-র সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ‘পেঙ্গুইন বুকস’ তাঁর জন্মমাসে ‘দ্য পেঙ্গুইন রে লাইব্রেরি’ থেকে প্রকাশ করছে বই রে মিসেলেনি। সঙ্গের ছবিটি— প্যারিসের এক বাগানে রবীন্দ্রনাথের ছবি হাতে দাঁড়িয়ে সত্যজিৎ— সেই বইয়েরই। সম্পাদক সন্দীপ রায় জানালেন, “ছবি তৈরি ও ছোটদের জন্য লেখালিখির পাশাপাশি ফিল্ম সোসাইটির পত্রিকা, সংবাদপত্র, সাময়িকপত্র, ফেস্টিভ্যাল কর্তৃপক্ষের অনুরোধে মাঝে মাঝেই লিখতে হত বাবাকে; প্রিয় মানুষজনের ফিল্ম, ফোটোগ্রাফি, পেন্টিং, অনুবাদ, গানের রেকর্ডের উপরেও। এই টুকরো টুকরো কথা বা গদ্য— তাতে ওঁর ভাবনার বৈচিত্রই ধরা পড়ে— সকলেই যাতে জানতে পারেন, সে জন্যেই এই বই।”
অন্য দিকে ‘সত্যজিৎ রায় জন্মশতবর্ষ উদ্যাপন কমিটি’-র উদ্যোগে ২ মে সত্যজিতের জন্মদিনে কলামন্দিরে সন্ধ্যা ৬টায় তাঁর জীবন ও শিল্প নিয়ে হচ্ছে প্রদর্শনী ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ‘সত্যের জিৎ’। প্রকাশিত হবে সত্যজিৎকে নিয়ে দেশ-বিদেশের বিশিষ্টজনের লেখায় ঋদ্ধ স্মরণ-সঙ্কলন। উদ্যাপন কমিটির পক্ষে কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায় জানালেন, সে দিন সন্ধ্যায় ‘সত্যজিৎ স্মারক বক্তৃতা’দেবেন আদুর গোপালকৃষ্ণন।
স্বমহিমায়
১৯৬৫ সালের ১ জানুয়ারি শুরু, গত অর্ধশতকেরও বেশি সময় ধরে নিরলস রবীন্দ্রচর্চায় ব্রতী কলকাতার টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউট। তার অনেক কাজের মধ্যে একটি— প্রতি বছর নিয়ম করে রবীন্দ্রগ্রন্থ প্রদর্শনীর আয়োজন। কবিপক্ষে রবীন্দ্রনাথের লেখা ও রবীন্দ্রনাথ বিষয়ক অনেক বই একত্র করে, প্রকাশকদের কাছ থেকে এ বিষয়ে তাঁদের প্রকাশিত বই এনে হয় এই প্রদর্শনী, থাকে বিক্রির ব্যবস্থাও। সোমেন্দ্রনাথ বসুর পরিকল্পনায় ১৯৭৩ সালে শুরু হয় এই বার্ষিক প্রদর্শনী, গোড়ায় হত কলকাতা তথ্যকেন্দ্রে, ১৯৮১ থেকে নিয়মিত হয়ে এসেছে ইনস্টিটিউটের নিজস্ব ঠিকানা— কালীঘাট পার্কের রবীন্দ্রচর্চাভবনে। অতিমারিতে দু’বছর বন্ধ থাকার পর ৪৮তম বর্ষে আবারও স্বমহিমায়, আগামী ১-১০ মে, দুপুর ৩টে থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত। ছবিতে ১৯৮৬ সালে রবীন্দ্রনাথের জন্মের ১২৫ বছরে ইনস্টিটিউটের প্রদর্শনী।
মানিক-গাথা
তাঁর সৃষ্ট ছবির আবহ সঙ্গীত ও গানগুলিই সাক্ষী ‘কম্পোজ়ার’ হিসাবে সত্যজিৎ রায়ের অনন্য প্রতিভার। সত্যজিৎ-শতবর্ষে তাঁকে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানাচ্ছে জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র মেমোরিয়াল ট্রাস্ট, হীরক রাজার দেশে ছবির তিনটি গানের পুনরুপস্থাপনার মধ্য দিয়ে। ‘আহা সাগরে দেখো চেয়ে’, ‘এ যে দৃশ্য দেখি অন্য’, ‘এইবারে দেখো গর্বিত বীর’— পাশ্চাত্য সঙ্গীতরীতিতে ‘ফোর-পার্ট হারমনি’ দিয়ে এই গানগুলির বৃন্দগায়ন সম্ভবত এই প্রথম, দাবি এই গান-ভিডিয়ো প্রকল্পের মুখ্য পরিকল্পক দেবাশিস রায়চৌধুরীর। গেয়েছেন এই সময়ের শিল্পীরা, সঙ্গীতায়োজনে নবারুণ বসু। রয়েছে এই গানগুলির হয়ে ওঠা নিয়ে সন্দীপ রায়ের সাক্ষাৎকারও। মানিক গাথা নামের ভিডিয়োটি দেখা যাবে জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র মেমোরিয়াল ট্রাস্টের ইউটিউব চ্যানেলে, ২ মে থেকে।
রবীন্দ্র-যাপন
দৈনন্দিনতার ‘তুচ্ছ আমি’ থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা স্ফুট গীতাঞ্জলি-তে; গীতিমাল্য-তে সে মুক্তির ‘অন্তর্গূঢ় আয়োজন’, আর গীতালি-তে যেন ‘এবার আমি মিলল এসে তুমির মধ্যে’— শঙ্খ ঘোষের ভাবনায় এ ভাবেই ধরা রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি পর্বের গান। এই পর্যায়ের গান নিয়েই অনুষ্ঠান ‘যাত্রাপথের আনন্দগান’, গান ও পাঠে দেবারতি সোম, স্বপন সোম, প্রণতি ঠাকুর— ৩ মে সন্ধে সাড়ে ৬টায় রবীন্দ্র সদনে, ‘বৈতালিক’-এর দু’দশক পূর্তিতে। অন্য দিকে, প্যারীচরণ সরকার, বাদল সরকার, শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিকীর্ণ মানিকতলার বাড়িটিতে শুরু হয়েছিল ‘রবিছন্দম’-এর পথ চলা, পৌঁছল চল্লিশে। চার দশকে প্রায় হাজার ছাত্রছাত্রীর ঠিকানা এই কলাকেন্দ্র; রবীন্দ্রচিঠির গান, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের গান, লোকায়ত রবীন্দ্রসঙ্গীত, রঙ্গব্যঙ্গ গীতি প্রাণ পেয়েছে এ প্রতিষ্ঠানের নিবেদনে। চার দশক ছোঁয়ার বছরটি ওঁরা পালন করবেন কর্ণধার অলক রায়চৌধুরীর নেতৃত্বে, ২ মে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায়, মিনার্ভা থিয়েটারে।
জরুরি কাজ
কথার বেগ থামিয়ে দেওয়াই কাজ নয় যতিচিহ্নের, বাক্যের গতি নিয়ন্ত্রণ করে শেষে এক ‘কাঙ্ক্ষিত বোধগম্যতায়’ পৌঁছে দেয় সে, বোধশব্দ পত্রিকার কথামুখে লিখেছেন সম্পাদক সুস্নাত চৌধুরী। বাংলায় যতি বা বিরামচিহ্নের ‘কী কেন কবে কোথায় কখন কীভাবে’-তেই নিবেদিত পত্রিকার এই সংখ্যাটি— সমাচার দর্পণ বঙ্গদর্শন ও রবীন্দ্রনাথের চিঠিতে যতিচিহ্ন-কথা, যোগেশচন্দ্র বিদ্যানিধি রাজশেখর বসু শিশিরকুমার দাশ সুকুমার সেন থেকে জ্যোতিভূষণ চাকী সুভাষ ভট্টাচার্য হয়ে এই সময়ের লেখক গবেষকদের যতিচিহ্ন নিয়ে সময়োপযোগী অনুসন্ধান। যতিচিহ্নের ব্যবহারবিধি, আন্তর্জাতিক চিন্তকদের যতিচিহ্ন-ভাবনা সমন্বিত প্রবন্ধের তর্জমার পাশে বিশেষ আকর্ষণ হিরণ মিত্রের যতিচিত্রকথা। জরুরি কাজ।
বই-বিশ্ব
সোনার কেল্লা-য় তোপসের হাতে টিনটিন ইন টিবেট, জটায়ুর হাতে হিন্দি শেখার গাইড-বই। অরণ্যের দিনরাত্রি-তে বইয়ের তাকে দেখা যায় আগাথা ক্রিস্টির দ্য মিরর ক্র্যাকড ফ্রম সাইড টু সাইড, আগন্তুক-এ অনিলার হাতে ক্রিস্টিরই পার্ল অ্যাট এন্ড হাউস। জয় বাবা ফেলুনাথ-এ অম্বিকা ঘোষাল পড়েন রাইভ্যালস অব শার্লক হোমস। শঙ্কু-কাহিনিতে ডক্টর জেকিল অ্যান্ড মিস্টার হাইড, ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন বা দ্য টাইম মেশিন, ফেলুদার প্রিয় বই আরণ্যক বা কালীপ্রসন্ন সিংহের মহাভারত... সত্যজিতের লেখায় আর ছবিতে বহু চরিত্রই তুখোড় পড়ুয়া। গল্প আর ছবি জুড়ে থাকা সেই সব বইয়ের সন্ধানই দিয়েছেন ঋত্বিক মল্লিক, বইয়ের অনুষঙ্গে সত্যজিৎ (প্রকাশক: পত্রলেখা) বইয়ে। ছোট্ট বই, কিন্তু তথ্যে লেখায় দুর্দান্ত। সত্যজিৎপ্রেমীর কাছে খুলে দেবে নতুন এক বই-বিশ্ব।
প্রকৃতির ভাস্কর্য
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের প্রশস্ত বাগানে প্রাকৃতিক কারণে শুকিয়ে যাওয়া গাছগুলিকে শিল্পরূপ দেওয়ার পরিকল্পনা করেন কর্তৃপক্ষ, তা রূপ পায় শান্তিনিকেতন কলাভবনের শিল্পশিক্ষক সঞ্চয়ন ঘোষ ও সুতনু চট্টোপাধ্যায়ের পরিচালনায় ছাত্র-ভাস্করদের নিয়ে এক মুক্তাঙ্গন ভাস্কর্য কর্মশালায়। প্রকৃতির সমান্তরাল এক নতুন শিল্পরূপ গড়েছেন তাঁরা— প্রকৃতিভাস্কর্যের শর্ত মেনে ‘কার্ভিং’, ‘ইনস্টলেশন’, ‘অ্যাসেমব্লেজ়’-এর মিশ্রণে। কোথাও প্রাণের ঢেউ ছন্দহিল্লোলে আকাশপানে উঠে গিয়েছে সুউচ্চ বৃক্ষ বেয়ে, কোথাও গাছ জুড়ে খেলা করছে অজস্র ফড়িং (ছবিতে), গাছের কোটর থেকে মাথা নাড়াচ্ছে পেঁচা, সবই তৈরি শুকনো ডাল দিয়ে। একটি গাছে কাটা ডাল জুড়ে এক বিরাট পাখির বাসা, নীচ থেকে প্রকাণ্ড সাপ পেঁচিয়ে উঠছে বাসায় রাখা ডিম খেতে। কোথাও গাছ বেয়ে চলন্ত পিঁপড়ের সারি, হেলে পড়া গাছ জুড়ে ব্যাঙের ছাতা, বসে আছে মস্ত ব্যাঙও। ভিক্টোরিয়ার বাগানের এই প্রাকৃতিক সংগ্রহালয় দর্শকদের জন্য খুলে দেওয়া হল গত ২৬ এপ্রিল।
প্রতিনিধি
দেশ জুড়ে আধুনিক তথা সমসাময়িক শিল্প-পরিসরের নব ‘আবিষ্কার’ যে শিল্পকৃতি ও শিল্পীরা, তাঁদের তুলে ধরতেই দিল্লিতে এই মুহূর্তে চলছে ত্রয়োদশ ‘ইন্ডিয়া আর্ট ফেয়ার’। বাছাই আন্তর্জাতিক চিত্রকৃতির পাশে সেখানে সগৌরব ঠাঁই এই সময়ে দেশের নানা প্রান্তে ঘটে চলা চিত্রকৃতির, প্রদর্শনীর পাশাপাশি চলে শিল্পী-কথা, শিল্প-উপস্থাপন, কর্মশালা, নানা শিল্প প্রকল্প। ২৯ এপ্রিল থেকে ১ মে-র এই শিল্পযজ্ঞে ডাক পেয়েছে কলকাতার আর্ট গ্যালারি ইমামি আর্ট, ‘গ্যালারি’ ও ‘ফোকাস’ বিভাগে। প্রদর্শনীতে রয়েছে যোগেন চৌধুরী অরুণিমা চৌধুরী অঞ্জন মোদক (উপরে তাঁর চিত্রকৃতি) সোমা দাস ঘনশ্যাম লতুয়া-সহ বারো জন প্রবীণ-নবীন শিল্পীর কাজ। আবার কলকাতার এই শিল্পশালাই তুলে ধরেছে হায়দরাবাদের শিল্পী থোটা বৈকুণ্ঠমের শিল্পকৃতিও— সযত্নে।
মননের মেলা
সত্যজিতের জন্মদিন সমাগত, পঁচিশে বৈশাখও জাগ্রত দ্বারে। শহর কলকাতা প্রস্তুতি নিচ্ছে দুই উদ্যাপনের, সেই সময়ই পড়শি দেশেরও এক টুকরো উৎসব হাজির মহানগরে। বাংলাদেশের ঢাকার গ্রন্থ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘যুক্ত’ তিন দিনের গ্রন্থমেলার আয়োজন করেছে যোগেশ মাইম অ্যাকাডেমিতে, আগামী ৪ থেকে ৬ মে, প্রতি দিন সকাল ১১টা-রাত ৯টা। ‘যুক্ত’-র বই পাওয়া যাবে বিশেষ ছাড়ে। তিন দিনই সন্ধ্যা ৬টা থেকে আলোচনা, মন মেলানোর সংলাপও: প্রথম দিন রবীন্দ্রবিশ্ব নিয়ে আলাপ, প্রয়াত প্রিয়জনদের স্মরণ, সেই সঙ্গে অমর মিত্রকে সম্মাননাও; দ্বিতীয় দিন ‘যুক্ত’-র নবতম প্রয়াস জনগল্প ’৭১ ও জন-ইতিহাস নিয়ে কথা, শেষ সন্ধ্যায় বাংলাদেশের সাহিত্য-পাঠ নিয়ে দুই বাংলার ভাবনা। এই সবই বিশিষ্টজনের উপস্থিতিতে।