পয়লা বৈশাখের অভিজ্ঞান কী কী? হালখাতা, মিষ্টিমুখ, মঙ্গল শোভাযাত্রা, নতুন কার্যারম্ভ... বাংলা বছরের ক্যালেন্ডারও তো। সে এক সময় ছিল যখন শিয়ালদহ, ধর্মতলা ঘুরে ঘুরে উৎসুক বাঙালি খোঁজ করতেন নববর্ষে কেমন বাংলা ক্যালেন্ডার এল, কোনটি পুনরাবৃত্তি আর কোনটি ছবিতে-তথ্যে একটু আলাদা, নজরকাড়া। বইপাড়ায় তো বটেই, শহরের পাড়ায় পাড়ায় ছোট-বড় দোকানে নববর্ষের খাতিরদারিতে বাঁধা ছিল নতুন বছরের ক্যালেন্ডার। সে উপস্থিতি ফিকে হয়েছে। এই প্রজন্ম কতই বা বাংলা ক্যালেন্ডার-প্রেমী সেও তর্কযোগ্য, আর কাজে লাগলেও তা আজকাল দেওয়ালে ঝোলাতে হয় না, স্মার্টফোনের অন্দরেই দিব্যি দেখা মেলে... এই সব বদলের মধ্যেও কেউ কেউ বাংলা বছরের অন্য রকম ক্যালেন্ডার গড়েন। তাদের রূপ-কথা ছড়িয়ে পড়ে সমাজমাধ্যমে, রসিকজন ছোটেন সংগ্রহ করতে।
যেমন ‘আনুষঙ্গিক’-এর নতুন ক্যালেন্ডারটি। ২০১৫ সালে সল্টলেকে এক চায়ের দোকানের আড্ডায় কিছু ছেলেমেয়ে ঠিক করেন, বিভিন্ন শিল্পমাধ্যমকে এক সঙ্গে গাঁথবেন। এই পরীক্ষামূলক প্রচেষ্টারই একটা ক্ষেত্র হিসাবে তাঁরা বেছে নেন বাংলা ক্যালেন্ডারকে। সেই শুরু। এক-এক বছর ওঁদের তৈরি ক্যালেন্ডারের থিম হয়েছে সুমনের ‘তোমাকে চাই’ গান, জীবনানন্দের বনলতা সেন কাব্যের কবিতা, মাতিস-এর আঁকা ছবি ‘খোলা জানালা’, দেশভাগ-কাঁটাতার, আরণ্যক। ১৪৩০ বঙ্গাব্দের বিষয় ‘নান্দনিক’: এক দিকে কালীঘাটের পট (ছবিতে বাঁ দিকে) ও মধুবনী শিল্পধারা, আবার অবনীন্দ্রনাথ-নন্দলাল-রামকিঙ্করের শিল্পকৃতির প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য। পয়লা বৈশাখে নন্দন-অ্যাকাডেমি চত্বরে ওঁদের ফেরি করা এই ক্যালেন্ডার বিকিয়েছে শতাধিক, মুখর ওঁদের ফেসবুক-পেজও।
সমাজমাধ্যমে জনপ্রিয় হয়েছে পরিচিত এক অলঙ্কার নির্মাতা ও বিক্রয় সংস্থার তৈরি নববর্ষ-ক্যালেন্ডারও— কালীঘাট পটচিত্রে সেজে ওঠা। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির বডলিয়ান লাইব্রেরি, ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট মিউজ়িয়ম, ক্লিভল্যান্ড মিউজ়িয়ম অব আর্ট-এ সংরক্ষিত কালীঘাট পট: কালী, দুর্গা, ষড়ভুজ শ্রীচৈতন্য, হনুমান-রাবণের যুদ্ধ, আবার হুঁকো হাতে বাবু, কেশপ্রসাধনরত বিবি... বঙ্গশিল্পধারার এক স্বতন্ত্র ধারার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য।
বৈশাখের প্রথম দিনটিতে বইপ্রেমী যাঁরাই গিয়েছেন ‘তবুও প্রয়াস’ প্রকাশনার বিপণি ও বিপণন কেন্দ্র ‘লালন’-এ, হাতে পেয়েছেন ছোট্ট, সুদৃশ্য ক্যালেন্ডার। একই গড়নের চারটি ক্যালেন্ডার তৈরি করেছেন ওঁরা, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, যামিনী রায় ও নন্দলাল বসুর চিত্রকৃতি আক্ষরিক অর্থে ‘মাথায় রেখে’। ওঁদের ফেসবুক-পেজেও এই ক্যালেন্ডার নিয়ে আগ্রহ কম নয়। আসলে এই সবই প্রমাণ করে, বাঙালিয়ানার ক্রমাবনতি নিয়ে নানা মহলে যতই তর্ক থাক, মন-ছোঁয়া শিল্প আর নান্দনিকতার বোধ এখনও দোলা দেয় বাঙালির প্রাণে। ক্যালেন্ডার তো নিমিত্ত মাত্র। উপরে দ্বিতীয় ও তৃতীয় ছবিতে ওঁদের দু’টি ক্যালেন্ডার।
জন্মদিনে
মাইকেলের আগে নব্যবঙ্গের দীক্ষাগুরু হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজ়িয়ো (ছবিতে তাঁর আবক্ষ মূর্তি) সনেট রচনা করেছিলেন ইংরেজিতে, প্রায় ৩৩-৩৪টি। তাঁর একটি সনেটের অনুবাদ অনেক আগেই করেছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ‘ডিরোজিয়ো স্মরণ সমিতি’ বাকিগুলি বাংলায় অনুবাদের উদ্যোগ করলে বাংলার বিশিষ্ট কবিরা এগিয়ে আসেন— শঙ্খ ঘোষ, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, আলোক সরকার, রঞ্জিত সিংহ, দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়। এ বার ডিরোজ়িয়োর সনেটগুলির বঙ্গানুবাদ, ভারত-বীণা ও অন্যান্য সনেট-কবিতা (প্রকা: অক্ষরবৃত্ত) বইটি প্রকাশ পেল গত ১৮ এপ্রিল, ডিরোজ়িয়োর ২১৫তম জন্মদিন উপলক্ষে, দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পাদনায়। উপস্থিত ছিলেন রামকুমার মুখোপাধ্যায়, আশীষ লাহিড়ী প্রমুখ। মূল ইংরেজি কবিতার পাশাপাশি বঙ্গানুবাদ, টীকা, দেবীপ্রসাদ ও অলোকরঞ্জন-কৃত ডিরোজ়িয়োর কাব্যপ্রতিভার মূল্যায়ন।
আবহমান
কলকাতায় বসে মুখা নাচ এখন আর কতই বা দেখতে পাওয়া যায়! বিরল সেই মুখা নাচই পরিবেশন করলেন দিনাজপুরের সুদেব সরকার; গৌড়ীয় নৃত্যে তারেক সাহা, এ ছাড়াও গম্ভীরা, বাউল। গ্রামবাংলার নৃত্যশিল্পের বিরাট বিপুল পরম্পরার ধারকেরা এসেছিলেন শহর কলকাতায়, পূর্বাঞ্চল সংস্কৃতি কেন্দ্র (ইজ়েডসিসি)-এর নতুন বঙ্গাব্দের বরণে বৈশাখী উৎসবে, ইজ়েডসিসি-র অধিকর্তা আশীষ গিরির উদ্যোগে, যিনি নিজেও এক জন শিল্পী। ২ বৈশাখ উৎসবের উদ্বোধন হয়েছে রাজভবনে, পরের দু’দিন ভারতীয়ম মাল্টিপ্লেক্স-এ, কবিতা, রবীন্দ্রনৃত্য, অণুনাটক, পটের গান, ছৌ নাচ, পুরাতনী গান, হস্তশিল্প পিঠেপুলি-মিষ্টি, কী ছিল না! এই নিদাঘেও বঙ্গশিল্পের স্নিগ্ধতা।
সারস্বত
মহামহোপাধ্যায় কালীপদ তর্কাচার্যের উদ্যোগে তাঁর প্রথম নাটক মুদ্রিত। তাঁর লেখার প্রসাদগুণে মুগ্ধ শ্রীজীব ন্যায়তীর্থ ‘মহাকবি’ উপাধি দিয়েছিলেন তাঁকে। অধ্যাপক নিত্যানন্দ মুখোপাধ্যায় একাধারে সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত, কবি, ধর্মশাস্ত্র অনুবাদক; শতাধিক সংস্কৃত নাটক, এগারোটি মহাকাব্য ও বহু কবিতার রচয়িতা, রাষ্ট্রপতি পুরস্কারে ভূষিত। শিক্ষাদান সংস্কৃত কলেজে, অবসরও সেখান থেকেই। তাঁর প্রতিষ্ঠিত সংস্থা ‘হাওড়া সংস্কৃত সাহিত্য সমাজ’ এই সারস্বতের শতবর্ষ উদ্যাপন করছে নানা অনুষ্ঠানে— সংস্কৃত নাট্য উৎসব, জাতীয় সংস্কৃত সম্মেলন, কৃতী ছাত্র শিক্ষক ও গুণিজন-সম্মাননা, গ্রন্থ প্রকাশ। গত ১০ এপ্রিল স্মারক বক্তৃতা দিলেন নির্মাল্যনারায়ণ চক্রবর্তী, সম্মানিত হলেন সুভাষ ভট্টাচার্য ও কুমারনাথ ভট্টাচার্য। নিত্যানন্দ মুখোপাধ্যায়ের শতবর্ষে ডাক বিভাগ প্রকাশ করেছে স্পেশাল কভার-ও, গত ১১ এপ্রিল কলকাতা জিপিও-তে।
নতুন রূপে
করোনাকাল থেকে বন্ধই ছিল এইচএমভি, অধুনা আরপিজি সারেগামা-র মেহগনি-স্মৃতির স্টুডিয়োটি। রেকর্ড, ক্যাসেট, সিডি, পেন ড্রাইভ, ইউটিউব... দেখাশোনার মাধ্যম পাল্টে পাল্টে যাচ্ছে, এফএম-ও যেন নতুন নেই আর। কিন্তু বাঙালির অধিকাংশ কালজয়ী শ্রবণের অপরিবর্তনীয় আঁতুড়ঘর, দমদমের কাঠের ফ্লোরের এই স্টুডিয়োটিই। গত ১৮ এপ্রিল নবরূপে খুলে গেল তা। নতুন মিক্সার, মাইক্রোফোন, কাঠের মেঝেতে নবতর ভাবনা— ঝাঁ চকচকে আয়োজন মনে করাচ্ছিল ‘পুরাতনকে বিদায় দিলে না যে, ওগো নবীন রাজা।’ প্রদীপ জ্বালালেন সন্দীপ রায়, ছিলেন সঙ্গীতায়োজক সিতাংশু মজুমদার। অনলাইনে ছিলেন সংস্থার কর্তারা।
অনুবাদে কবি
“এই কবিতাগুলো সব যেন আমি শুনতে পেতাম...” এ কথা উদয়ন বাজপেয়ীর। ২০১৮ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর হিন্দি কাব্যগ্রন্থ কেবল কুছ বাক্য, একান্নটি কবিতা নিয়ে। দীর্ঘ কাল ধরে নির্মাণ হয়েছে এই কবিতাগুলি, শুরু আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে। এ বার বাংলায় অনূদিত হল কাব্যগ্রন্থটি, অনুবাদ করেছেন সন্দীপন চক্রবর্তী, শুধুই কিছু কথা নামে (প্রকাশক: ঋত)। ভূমিকা লিখেছেন জয় গোস্বামী; অনূদিত কবিতা ছাড়াও বইয়ের পরিশিষ্টে রয়েছে কবি ও অনুবাদকের দীর্ঘ কথোপকথন। আজ, ২২ এপ্রিল বিকেল ৫টায় কলেজ স্ট্রিটে দে’জ়-এর বিদ্যাসাগর টাওয়ার-এর বইঘরে বইটির আনুষ্ঠানিক প্রকাশ করবেন কুমার সাহনি। উপস্থিত থাকবেন উদয়ন-সহ বিশিষ্টজন।
স্মৃতিতে তিনি
“কলকাতার পরিবেশে কাজ করে আমি আনন্দ পাই... মুম্বইয়ের শিল্পীদেরও দেখাতে চেয়েছিলাম কী রকম অবস্থায় আমরা কাজ করি...” শতরঞ্জ কে খিলাড়ি-র প্রিমিয়ার শোয়ে বলেছিলেন সত্যজিৎ রায় (ছবিতে সত্যজিতের করা এ ছবির সেট ডিজ়াইনের স্কেচ)। সত্যজিতের হিন্দি ছবি নিয়ে কলকাতায় গণমাধ্যমে উত্তেজনা, এবং সেই সূত্রেই এখনকার কলকাতায় হিন্দি ছবি তৈরির সম্ভাবনা নিয়ে লিখেছেন স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রাক্তন আধিকারিক অপূর্বকুমার চট্টোপাধ্যায়ের লেখায় নানা সভা বা ছবি-উৎসব উপলক্ষে নন্দনে, কিংবা তাঁর বিশপ লেফ্রয় রোডের বাড়িতেও লেখকের সত্যজিৎ-দর্শনের স্মৃতি। অশোক ভট্টাচার্য লিখেছেন অপু-ট্রিলজির আর্থ-সামাজিক বিশ্লেষণ, চিকিৎসক শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কলমে ‘পেশেন্ট’ সত্যজিৎ রায়কে নিজের গল্প পড়ে শোনানোর কাহিনি। এই সব নিয়েই ‘ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি’ (সিএফএস)-এর বুলেটিন বিশেষ সংখ্যা ‘১০০-তে সত্যজিৎ’, ভারতে ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলনের ৭৫ বছর উপলক্ষে সম্প্রতি প্রকাশিত।
ছবির দর্শন
লন্ডনের চেলসি কলেজ অব আর্ট অ্যান্ড ডিজ়াইন-এ থাকাকালীন ফোটোগ্রাফির হাতমকশো পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল ডিজিটালের পাশাপাশি অ্যানালগ আঙ্গিকের সঙ্গেও। স্টার ট্রেক-এর সেটে বা হাইড পার্কের প্রদর্শগুলির ছবি তোলা, ক্রমে তাবড় প্রদর্শনী ও আলোকচিত্র-উৎসবে যোগদান... হাসনাইন সুমার ফিরে তাকাননি আর। আলোকচিত্র শুধু এক প্রযুক্তিগত শিল্প নয় তাঁর কাছে, হয়ে উঠেছে জীবনদর্শনের সমশব্দ। কোভিড-অতিমারি তাঁকে বুঝিয়েছে জীবন ও শিল্পের গুরুত্ব, সেই ভাবনা থেকেই তাঁর নতুন ‘শো’টিকে সমগ্র মানবতার প্রতি উৎসর্গ করেছেন এই শিল্পী। নামটিও সুপ্রযুক্ত, ‘রাইজ়িং ফ্রম দ্য ডার্ক’— অ্যানালগ ফোটোগ্রাফি ও ডার্করুম টেকনিক যার গোড়ার কথা। যতীন দাস রোডের গ্যাঞ্জেস আর্ট গ্যালারিতে গত ১৩ এপ্রিল শুরু হয়েছে এই প্রদর্শনী, চলবে এক মাস। ডিজিটাল নেগেটিভে ধরা আলো-অন্ধকারের রূপকল্প ফুটে উঠেছে ফোটোগ্রাফিক পেপারে: দিল্লির লাল কেল্লা, হুমায়ুনের সমাধি থেকে কলকাতার মসজিদের জলাধার, মুক্তপক্ষ পায়রা (ছবিতে)। প্রদর্শনীটি কিউরেট করেছেন জর্জিনা ম্যাডক্স।
সম্পর্ক
সম্পর্কের নানা স্তর— ব্যক্তিগত থেকে প্রাতিষ্ঠানিক। ব্যতিক্রম নয় রবীন্দ্রনাথ-আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সম্পর্কও— কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্বভারতীর আদানপ্রদান তার একটি দিক, অন্য দিকে ঠাকুরবাড়ি ও মুখোপাধ্যায় পরিবারের ব্যক্তিগত নানা যোগাযোগ। রবীন্দ্রনাথ ও আশুতোষ দু’জনেরই বিশেষ ভাবনার জায়গা জুড়ে ছিল শিক্ষাদর্শ ও শিক্ষা ব্যবস্থা: শিক্ষা ও জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্রের মতো প্রসঙ্গ। এই সব কিছুকেই গেঁথেছেন রীনা ভাদুড়ী, তাঁর সমুদ্র-হিমাদ্রির মহাসঙ্গমে/ ঠাকুরবাড়ি আশুতোষ পরিবার সংযোগ বইয়ে (প্রকাশক: রোহিণী নন্দন)। আগামী কাল, ২৩ এপ্রিল আশুতোষ মেমোরিয়াল হল-এ বইটির আনুষ্ঠানিক প্রকাশ, থাকবেন জাস্টিস চিত্ততোষ মুখোপাধ্যায়, চিত্তব্রত পালিত, ভদন্ত বুদ্ধপ্রিয় মহাথের প্রমুখ।