চার্লস ডয়েলি বা রবার্ট গ্রিন্ডলের আঁকা ছবির প্রিন্ট, ব্রিটিশ রেল কোম্পানির প্রচার-পোস্টার, দিল্লি দরবারে কার্জনের শোভাযাত্রার পুতুল সংস্করণ, অসিতকুমার হালদারের রবীন্দ্রনাথ বা জেকব এপস্টাইনের করা নেহরুর ব্যতিক্রমী ভাস্কর্য। এমন কিছু শিল্পকর্মের সাহায্যে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও ঔপনিবেশিকতা বিরোধী লড়াইয়ের ভিন্ন ব্যাখ্যা, দিল্লি আর্ট গ্যালারি (ডিএজি) ও ভারতীয় জাদুঘর, কলকাতার আয়োজনে— স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পূর্তি উপলক্ষে ‘মার্চ টু ফ্রিডম’ শিরোনামের প্রদর্শনীতে। আঠেরো-উনিশ শতক থেকে শুরু করে হাল আমলের নানা পরিচিত ও অল্প পরিচিত কাজকে আটটি শিরোনাম ও বিভাগে ভাগ করা হয়েছে— মুক্তির লড়াই, ব্যবসা-বাণিজ্য, ‘ভারত দেখো’, অতীত পুনরুদ্ধার, ভারত প্রদর্শন, ঔপনিবেশিক থেকে রাষ্ট্রীয়, দেশ গঠন, স্বাধীনতা।
এই বিভাগগুলি যেন এক গল্পের সুতোয় বাঁধা। এ দেশের বৈধ শাসক হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করার পেছনে ব্রিটিশদের উদ্দেশ্য ছিল বাণিজ্যিক স্বার্থসিদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যাওয়া। অন্য দিকে ব্রিটিশদের এ দেশে প্রথম যুদ্ধগুলি ছিল এদেশীয় বিভিন্ন রাজশক্তির বিরুদ্ধে। কিন্তু শাসকের আসনটি পাকা হতেই সে লড়াই হয়ে উঠল শাসকের বিরুদ্ধে প্রজাদের সহিংস বিদ্রোহ এবং অহিংস আন্দোলন। এই ঘটনাক্রমের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ভারতের অতীতকে চেনাল নতুন করে, অন্য দিকে রেলপথ সম্প্রসারণের ফলে বিশ্বের সামনে ‘জুয়েল ইন দ্য ক্রাউন’-এর রাজকীয় প্রদর্শন হল ১৯০৩ সালের দিল্লির দরবারে। অন্য দিকে এই প্রগতির ফলে স্বদেশকে আরও ভাল করে দেখার ও চেনার সুযোগ পেলেন দেশবাসীও। গড়ে উঠল জাতীয় পরিচয়ের গর্ব, যা জন্ম দিল সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতারও। মহাত্মা গান্ধী, নেহরু, পেরিয়ার, রবীন্দ্রনাথ-সহ রাজনীতি, শিল্প, সংস্কৃতি, ধর্ম, দর্শন, বিভিন্ন পরিসরের পুরোধারা এগিয়ে এলেন দেশ গঠনে। ত্যাগস্বীকার, সংগ্রামের পর দেশভাগের মূল্যে এল কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। কিন্তু দরিদ্র, দলিত, জনজাতিদের কাছে স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি কতটা রক্ষা করতে সফল হল দেশ? প্রতিটি শিল্পকর্মের পরিচয়লিপির শেষে দর্শকের উদ্দেশে এমন প্রশ্ন উৎসাহিত করে নতুন করে ভাবার।
দর্শকদের ও মূলত ছাত্রছাত্রীদের কথা ভেবে প্রদর্শনীর প্রতিটি বিভাগে একটি করে ইন্টারঅ্যাক্টিভ গেম বোর্ড রাখা আছে, যেখানে তারা নানা বিষয়ে নিজেদের জ্ঞান পরখ করতে পারবে। টাচস্ক্রিনে আঙুল ছুঁইয়ে দেশাত্মবোধক গান শোনার সুযোগও আছে। গত ২২ জুলাই ভারতীয় জাদুঘরে প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেছেন মাননীয় রাজ্যপাল, দেখার সুযোগ আগামী ১৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত, সোমবার ও জাতীয় ছুটি ছাড়া রোজ সকাল ১১টা থেকে বিকেল ৫টা। বিভিন্ন সপ্তাহান্তে রয়েছে প্রদর্শনীর বিষয়সূত্রে নানা অনুষ্ঠানও। অর্ঘ্য দাসের তোলা ছবিতে ১৯০৩-এর দিল্লি দরবার উপলক্ষে কার্জনের শোভাযাত্রা, পুতুলের মাধ্যমে উপস্থাপিত। ছবি সৌজন্য: ডিএজি
অভিযাত্রিক
ভগিনী নিবেদিতা ভারতের জাতীয় পতাকার রূপকল্পে ১০৮ প্রদীপের জপমালার কেন্দ্রে এঁকেছিলেন দধীচির অস্থিতে গড়া বজ্র, দু’পাশে লেখা ‘বন্দে মাতরম্’। স্কুলে প্রার্থনাসঙ্গীতও করেছিলেন এ গানকে। বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ-এ বিদ্রোহ-আবহের এ গান ক্রমে যদুনাথ ভট্টাচার্যের সুরসঞ্চারে হয়ে ওঠে দেশমাতৃকার বন্দনাগীতি; স্ফুট হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ওঙ্কারনাথ তিমিরবরণ হেমন্ত-সহ বহু বরেণ্যের হাতে: সাড়া ফেলেছে যাত্রা নাটক ছবিতে। একটি গান ও তার ঐতিহাসিক এই অভিযাত্রাকেই লিখেছেন দেবজিত্ বন্দ্যোপাধ্যায়, বন্দে মাতরম্ রূপ রূপান্তর (প্রকাশক: পত্রভারতী) গ্রন্থে, প্রকাশ পেল ১৩ অগস্ট। হিন্দুস্থান রেকর্ডস-এর নির্মাণে তাদের ইউটিউব চ্যানেলে লেখক-কণ্ঠে শোনা যাচ্ছে গানটি। ছবিতে ১৯৩৯ সালে আনন্দবাজার পত্রিকা ও হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড-এর প্রস্তুতিতে তৈরি এই গানের রেকর্ড-কভার।
জরুরি কাজ
স্বাধীনতার পঁচাত্তর পূর্তিতে মহিলা বিপ্লবীদের উজ্জ্বল ভুমিকার উন্মোচন। উইমেন ইন দি ওয়ার অব ফ্রিডম আনভেইল্ড বেঙ্গল ১৯১৯-১৯৪৭ (প্রকাশক: হাইফেন), বইটি স্বাধীনতা আন্দোলনে অকথিত অপঠিত বহু মহিলা বিপ্লবীর অনন্য ভূমিকার এক সঙ্কলন। লেখিকা মধুরিমা সেন লেখ্যাগারিক, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য লেখ্যাগারে দীর্ঘ দিন কর্মরত, সেখানকার ফোটো আর্কাইভে সংরক্ষিত মহিলা বিপ্লবীদের তথ্য ও ছবিই এ বইয়ের জরুরি উপাদান। ইতিহাসকে ফিরে দেখার পূর্বশর্ত যে সংরক্ষণ, মধুরিমা তাতেই গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁরই সম্পাদিত আর একটি বই ইন্ট্রোডাকশন টু আর্কাইভস অ্যান্ড মিউজ়িয়ম-এ লেখ্যাগার ও মিউজ়িয়মের আধিকারিকেরা দেশের ইতিহাস সংস্কৃতির নিদর্শন সংরক্ষণে প্রতিষ্ঠানগুলির ভূমিকা তুলে ধরেছেন। স্বাধীনতার মাসেই বই দু’টির প্রকাশ।
পুঁথি নিয়ে
মধ্যযুগের ইতিহাসের তথ্য সংগ্রহে সাহিত্যের দ্বারস্থ হতে হয়, অথচ পুঁথি পড়তে না পারার কারণে ছাপার বই-ই ভরসা। “এমন বই লিখুন, যাতে আমরাও পুঁথি পড়তে পারি,” এক ইতিহাসবিদের এমনই অনুরোধ ছিল অণিমা মুখোপাধ্যায়ের কাছে। বাংলার পুঁথি গবেষণায় অপরিহার্য নাম তিনি, জীর্ণ কীটদষ্ট পুঁথি ঘেঁটে মধ্যযুগের রাঢ়-বাংলার সমাজ সাহিত্য ইতিহাসের প্রামাণ্য দলিল নির্মাণে তাঁর দক্ষতা প্রশ্নাতীত। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, গবেষণা বিশ্বভারতীতে, সে কাজ করতে গিয়েই তত্ত্বাবধায়ক রূপে পান প্রবাদপ্রতিম অধ্যাপক ও পুঁথি বিশারদ পঞ্চানন মণ্ডলকে, পুঁথিচর্চার আগ্রহ নিবিড় হয় তাঁর সান্নিধ্যে। পুঁথি প্রাজ্ঞিক পঞ্চানন মণ্ডল: চর্চা ও চর্যা-সহ বহু গ্রন্থ ও প্রবন্ধের লেখক অণিমা মুখোপাধ্যায় আগামী কাল ২১ অগস্ট বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে পঞ্চানন মণ্ডল স্মারক বক্তৃতা দেবেন, ভূষিত হবেন তাঁর শিক্ষাগুরুর নামাঙ্কিত সম্মাননায়।
শব্দসৈনিক
দু’শো বছরের পরাধীনতাকালে যে ভাবে জেগে উঠেছিল প্রতিস্পর্ধী স্বর, তার প্রসারে অনন্য ভূমিকা ভারতজোড়া নানা পত্রপত্রিকার। শাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে দেশব্রতে শামিল হয়েছিলেন নিবেদিতপ্রাণ বহু সম্পাদক প্রকাশক মুদ্রণকর্মী। স্বাধীনতার পঁচাত্তর পূর্তিতে সেই অগ্রণী ‘সংবাদ-সেনানায়ক’ ও পত্রিকাগুলির ভূমিকাই প্রাক্-শারদ সংখ্যায় তুলে ধরেছে কোরক পত্রিকা (সম্পা: তাপস ভৌমিক)। ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে সাময়িকপত্র’ বিষয়ে একগুচ্ছ লেখা: বেঙ্গল গেজেট সংবাদপ্রভাকর হিন্দু পেট্রিয়ট গ্রামবার্ত্তাপ্রকাশিকা সঞ্জীবনী সোমপ্রকাশ কেশরী আর্য্যদর্শন বেঙ্গলী ইন্ডিয়ান মিরর যুগান্তর নারায়ণ বঙ্গবাণী ধূমকেতু স্বাধীনতা... কে নেই! আলাদা করে নজর কাড়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলার নানা জেলার সাময়িকপত্রের খোঁজ, নির্বাচিত তালিকা— প্রশংসনীয়।
চিত্রময়
১৯ অগস্ট ছিল বিশ্ব আলোকচিত্র দিবস, গত ১৬ অগস্ট থেকেই বিড়লা অ্যাকাডেমির পঞ্চম তল সেজে উঠেছে ৬০x৪০ মাপের বিরাট ক্যানভাসে সাজিয়ে তোলা ফোটোগ্রাফির সম্ভারে। ‘থার্ড আই’-এর সদস্যদের নিবেদন, সঙ্গে ২১ অগস্ট পর্যন্ত প্রতি সন্ধ্যায় ছ’শো ছবি দিয়ে সাজানো স্লাইড শো। সপ্তাহব্যাপী উদ্যাপন মায়া আর্ট স্পেস-এও, থ্রু দ্য গ্লাস ব্রাইটলি শীর্ষক অনুষ্ঠানে শহরের ষোলো জন বিশিষ্ট আলোকচিত্রীর কাজের প্রদর্শন, আরও প্রাপ্তি জয়ন্ত সাহা দেবদত্ত গুপ্ত জয়দীপ মিত্র ও শুভময় মিত্রের কথালাপ ও প্রেজ়েন্টেশনে ক্যামেরা রং-তুলি বৃষ্টি আর জীবনের গল্প: যথাক্রমে ২০, ২২, ২৪ ও ২৬ অগস্টে— সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায়।
ফিরে পাওয়া
বিশিষ্ট কার্টুনিস্ট, বাংলা চিত্রকাহিনি বা কমিক্সের অন্যতম দিশারি প্রফুল্লচন্দ্র লাহিড়ী কার্টুন আঁকতেন ‘পিসিয়েল’ ও ‘কাফী খাঁ’ ছদ্মনামে। জাতীয়তাবাদী এই শিল্পীর পরিকল্পনা ও চিত্রাঙ্কণে মহাত্মা গান্ধী ও নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে নিয়ে দু’টি বই প্রকাশ পায়, ১৯৪৮ সালে সত্যের সন্ধানে (কংগ্রেস সাহিত্য সঙ্ঘ), ১৯৭০-এ সুভাষ আলেখ্য (এ মুখার্জি অ্যান্ড কোং)। ‘মহাত্মা গান্ধীর জীবন হইতে কয়েকটি ঘটনা’ আর ‘সুভাষচন্দ্রের জীবনের বাণীচিত্র’, এই ছিল উপজীব্য। কালক্রমে ‘হারিয়ে যাওয়া’ এই দু’টি গুরুত্বপূর্ণ বইকে নবরূপে পুনঃপ্রকাশ করেছে লালমাটি প্রকাশন, গান্ধী ও সুভাষ নামে। “গান্ধী ও সুভাষচন্দ্রের কার্টুন-চিত্রায়ণে প্রফুল্লচন্দ্র ‘গণতান্ত্রিকতা’র জাদু ঘটিয়েছেন,” ভূমিকায় লিখেছেন শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়। সঙ্গের ‘পিসিয়েল’-স্বাক্ষরিত ছবিটি বই থেকে নেওয়া।
এক থেকে বারো
টুয়েলভ অ্যাংগ্রি মেন, আমেরিকান কোর্টরুম ড্রামা, রেজিনাল্ড রোজ়-এর লেখা। টিভি-নাটক হিসেবে প্রথম প্রচারিত হয় ১৯৫৪ সালে, পরবর্তী কালে মঞ্চস্থও হয়। সিডনি লুমেট ওই একই নামে ছবিও করেন হলিউডে ১৯৫৭-তে, অভিনয়ে হেনরি ফন্ডা-সহ বিশিষ্ট চরিত্রাভিনেতারা (ছবিতে পোস্টার)। অপরিমিত হিংসার মলিনতা নিয়ে তৈরি এই নাটকটির নানা রূপান্তর ও মঞ্চায়ন ঘটেছে বিশ্ব জুড়ে। বাংলায় নাট্যরূপ দিয়েছিলেন প্রয়াত স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত নব্বইয়ের দশকেই, এক থেকে বারো নামে। সেই নাট্যরূপকে মঞ্চস্থ করতে চলেছে নান্দীকার: “এই সময়ের আঙ্গিকে সাজানোর চেষ্টা করেছি,” বলছেন তরুণ নির্দেশক সপ্তর্ষি মৌলিক। “নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের নিয়ে আমার আর বাবার (রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত) নিয়মিত নাট্যচর্চা থেকেই এই আয়োজন,” নান্দীকার-এর পক্ষে জানালেন সোহিনী সেনগুপ্ত। আগামী ২৫ অগস্ট সন্ধে সাড়ে ৬টায় অ্যাকাডেমি মঞ্চে প্রথম অভিনয়।
মাস্টারমশাই
বছর বাইশ আগে এক প্রবন্ধের পাণ্ডুলিপি পড়ে হইচই, এ তো সবার পড়া চাই! সুন্দরবনের ‘মাস্টারমশাই’ তুষার কাঞ্জিলালের লেখা ‘হু কিলড সুন্দরবনস’ ৬৪ পাতার ছোট্ট বই হয়ে বেরোল মৈত্রেয় ঘটকের উদ্যোগে, সবাই নড়েচড়ে বসলেন। ‘সুন্দরবনবাসীর প্রতি’ ইস্তাহার বার করে তুষারবাবুর দ্বীপে দ্বীপে আন্দোলন, রাজনৈতিক দলের বাধা, এই সবই হল ক্রমে, তত দিনে বইও ‘আউট অব প্রিন্ট’। ২০২০-তে প্রয়াত তুষারবাবুর ৯০তম জন্মদিনে, ১৮ অগস্টের সন্ধ্যায় রোটারি সদনে ‘তুষার কাঞ্জিলাল ফাউন্ডেশন’-এর উদ্যোগে প্রকাশ পেল হু কিলড সুন্দরবনস-এর নব সংস্করণ (প্রকা: সম্পর্ক), কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের হাতে। নিবিষ্ট সমাজসেবী অমল পণ্ডিতকে ‘যে জন সুজন’ সম্মানে ভূষিত করলেন অনিতা অগ্নিহোত্রী। ভাটির দেশ নিয়ে আলোচনাও হল, ছিলেন সুগত হাজরা অমিতেশ মুখোপাধ্যায় জয়ন্ত বসু।