একদিন রবিদাদা সকলকে ডেকে বললেন, “আমার জন্মদিনটা যখন এত ঘটা করে হয়, অবনের কেন হবে না? তোমরা এবার ওর জন্মদিনটা ঘটা করে করবে।” বাবার কথা-য় লিখেছেন উমা দেবী। বাবা, মানে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুনে চেঁচামেচি জুড়লেন, এ সব কেন! “সেই বছর জন্মাষ্টমীর আগেই শ্রাবণী পূর্ণিমায় রবিদাদা চলে গেলেন। তাঁর কথামত জন্মাষ্টমীর দিনে রবিদাদার লাল বাড়ীতে বাবার জন্মদিন পালন করেছিল ছাত্রছাত্রীরা। সেই থেকে বাবা যতদিন বেঁচেছিলেন জন্মাষ্টমীর দিন তাঁর জন্মদিন পালন করা হতো,” লিখেছেন উমা। ৭ অগস্ট রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণ, অবনীন্দ্রনাথেরও জন্মদিন; প্রিয় ‘রবিকা’র বিচ্ছেদবিধুর দিনটি থেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন নিজের জন্মদিনের অনুষঙ্গ। বরং জন্মাষ্টমীতে জন্মদিন পালন নিয়ে বলতেন, “এমন দিনে জন্মেছি যে, ও দিনটি কেউ ভুলবে না।” অবনীন্দ্রনাথের প্রিয়, তাই তাঁর জন্মদিনে শান্তিনিকেতনের পদ্মফুলে ঝুড়ি বোঝাই করে এক বার কলকাতায় পাঠিয়েছিলেন রানী চন্দ। আচার্য থাকাকালীন এক বার জন্মাষ্টমীতে শান্তিনিকেতনে পালিত হয়েছিল অবনীন্দ্র-জন্মদিন, সিংহসদনে— মালাচন্দন অর্ঘ্য গানে। আর জীবনপ্রান্তে বেলঘরিয়ার বাড়িতে রানীর দেওয়া নীল রেশমি মলাটের, চিনে কাগজের খাতায় লিখেছিলেন, “এই জন্মাষ্টমীতে বসে আছি তো বসেই আছি... কার জন্যে বসে বসে কার কথা ভেবে ভেবে আছি এই গুপ্তনিবাসে সে কথা প্রকাশ নিষেধ, লেখাও নিষেধ।”
৭ অগস্ট আসছে, জন্মাষ্টমীও ক’দিন পরেই, ২০২২-এর কলকাতায় অবনীন্দ্রনাথ স্মরণে নানা আয়োজন। গতকাল ৫ অগস্ট সন্ধ্যায় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল-এর উদ্যোগে হয়ে গেল দার্শনিক অধ্যাপক অরিন্দম চক্রবর্তীর বক্তৃতা, ‘দ্য নেশন অ্যান্ড ইটস আর্ট’ শিরোনামে। আনন্দ কুমারস্বামী, নিবেদিতার সঙ্গে ‘ন্যাশনালিস্ট ইন্ডিয়ান আর্ট’ প্রসঙ্গে সমোচ্চারিত হলেও, ন্যাশনাল আর্ট-এর ধারণার বিপ্রতীপেই অবনীন্দ্রনাথ বলে গিয়েছেন তাঁর বিখ্যাত ‘বাগেশ্বরী বক্তৃতামালা’য়, উঠে এল বক্তার কথনে। বাগেশ্বরী বক্তৃতার শতবর্ষ উপলক্ষে আজ ৬ অগস্ট বিকেল ৫টায় রবীন্দ্র সদনে অনুষ্টুপ পত্রিকা ও প্রকাশনের উদ্যোগেও বলবেন অরিন্দমবাবু, বিষয়-শীর্ষক ‘একি লাবণ্যে: অবন ঠাকুরের ছবিলেখার দর্শন’। থাকবেন মনসিজ মজুমদার ও সব্যসাচী বসু রায়চৌধুরী, প্রকাশিত হবে অনুষ্টুপ পত্রিকার আদিবাসী ভারত বিশেষ সংখ্যা, জয়ন্ত সেনগুপ্তের বাংলা প্রবন্ধগ্রন্থও।
বিশ্বভারতী পত্রিকা-য় ১৩৪৯ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ-ভাদ্র সংখ্যায় বেরিয়েছিল অবনীন্দ্রনাথের গল্প ‘মাসীমা’; পরে ‘বনলতা’ ও ‘হাতে খড়ি’ গল্প দু’টি। এরাই পরে হয়ে ওঠে বই, মাসি। জোড়াসাঁকো ছেড়ে আসার বেদনায় প্রকৃতির প্রলেপ, দুঃখ থেকে উত্তরণের যাত্রা ধরা আছে মাসি-তে। স্বল্পালোচিত এই অবনীন্দ্র-বইটি নতুন করে প্রকাশ করেছে ‘খসড়া খাতা’, তন্ময় দাশগুপ্তের ভাবনায়, পার্থ দাশগুপ্তের প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণে, রবীন্দ্রনাথ দাশের সেরিগ্রাফিতে। ছবিতে জন্মদিনে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, চেয়ারে বসে।
পাহারাদার
১৯৩৬, রবীন্দ্রনাথের প্রতিকৃতি আঁকতে শান্তিনিকেতনে এলেন অতুল বসু। ক’দিন ধরে আঁকা চলল, ছবি দেখে তৃপ্ত কবি বললেন, “আমাকে তুমি পেলে কী ভাবে?” অনুজের প্রতি অগ্রজেরও আশিসচিহ্ন রয়ে গেল, রঙিন পেনসিলে আঁকা নিজের একটি ছবি অতুল বসুকে উপহার দিলেন: এ ক’দিন তুমি এক প্রকার পাহারা দিয়ে আমার ছবি আঁকলে, আমি তোমায় দিলুম এক পাহারাদারের ছবি। আর শিবকুমার এ ছবিতে খুঁজে পান ‘দুই শিল্পীর করেসপনডেন্স’। সেই ছবি— ‘পাহারাদার’— এ বার অতুল বসুর পরিবারসূত্রে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করেছে ৯/২ ফার্ন রোডের ‘দেবভাষা বই ও শিল্পের আবাস’, ৬ থেকে ৮ অগস্ট, দুপুর বারোটা থেকে রাত ৮টা অবধি। একটি ছবি নিয়েই (ছবিতে) অনন্য এই প্রদর্শনী, ‘উজ্জ্বল উদ্ধার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ১৯৩৬’। আজ সন্ধ্যা ৬টায় সূচনায় গণেশ হালুই ও যোগেন চৌধুরী। প্রকাশিত হবে প্রদর্শনীগ্রন্থও।
নিবিড় পাঠ
চিত্রাঙ্গদা, শ্যামা ও চণ্ডালিকা— রবীন্দ্রনাথের এই তিন নৃত্যনাট্য বাঙালির অন্তরসম্পদ। কবির জীবদ্দশায় শান্তিনিকেতন কলকাতা বা অন্যত্র রবীন্দ্র-উপদিষ্ট রূপে তাদের পরিবেশনার তথ্য ও ইতিহাস ধরা আছে বহু সারস্বতের লেখায়; রবীন্দ্র-প্রয়াণের পর থেকে একুশ শতকেও নানা ধারায় ও আঙ্গিকে— পূর্ণাঙ্গ শাস্ত্রীয় শৈলী থেকে সমকালীন ব্যাখ্যানে, বহু অদলবদলে পরিবেশিত হয়েছে তারা। সাত-সাড়ে সাত দশকের এই পরিবর্তন-বিবর্তনকেই তুলে ধরেছেন বিশিষ্ট সঙ্গীতশিল্পী ও শিক্ষক ইন্দ্রাণী সেন— রবীন্দ্র-নৃত্যনাট্য: সেকাল থেকে একাল (সিগনেট প্রেস) গ্রন্থে। রবীন্দ্রযুগে নৃত্যনাট্য-উপস্থাপনা ও মঞ্চাভিনয়, রবীন্দ্রোত্তর কালে তার ক্রমবিবর্তন, বেতার-টিভি-সিনেমা-রেকর্ডে তার ছাপ, উঠে এসেছে সবই। তথ্য, বিরল ছবি, পাঠ-পরামর্শের সমাহারে নিবিড় সন্দর্ভ, সুখপাঠ্য। বাইশে শ্রাবণ-আবহে প্রকাশ পাবে ৯ অগস্ট সন্ধ্যায়, শহরে এক অনুষ্ঠানে।
সল্টলেক নিয়ে
সল্টলেক উপনগরীতে বসবাস শুরু হয় ১৯৭০-এ। এই পরিকল্পিত উপনগরীর বেড়ে ওঠা নিয়ে চর্চা হয়নি তত, যদিও ব্যক্তিগত সংগ্রহ, সংবাদপত্র, সরকারি নথিতে ছড়িয়ে রয়েছে তার নানা তথ্য। সল্টলেকের বাসিন্দাদের সাক্ষাৎকার, সল্টলেক থেকে প্রকাশিত খবরকাগজ, পুরনো ছবি, মানচিত্র, সল্টলেক সংক্রান্ত সাহিত্য ও গবেষণাধর্মী বই একত্র করে ‘ইনস্টিটিউট অব ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ় কলকাতা’ (আইডিএসকে) একটি আর্কাইভ তৈরির কাজ শুরু করে গত বছর। এই সংগ্রহের ভিত্তিতে আগামী ১০ ও ১১ অগস্ট এক প্রদর্শনী ও আলোচনাসভার আয়োজন আইডিএসকে-র সল্টলেক ক্যাম্পাসে। গবেষক ও ইতিহাসমনস্ক মানুষকে আগ্রহী করে তুলতেই এই উদ্যোগ।
বিশ্বের বাছাই
ভাল ছবি দেখতে উন্মুখ শহরবাসীর জন্য সুখবর, সত্যজিৎ রায় ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট-এর মূল প্রেক্ষাগৃহে ১১ থেকে ১৩ অগস্ট আসছে ‘এমআইএফএফ ইন কলকাতা’। নব্বইয়ের দশকে কেন্দ্রীয় তথ্য-সম্প্রচার মন্ত্রক থেকে ফিল্মস ডিভিশন-এর উদ্যোগে শুরু হয় ‘মুম্বই ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’ (এমআইএফএফ), অ্যানিমেশন ছোট ছবি ও তথ্যচিত্রের আন্তর্জাতিক ফিল্মোৎসব— ছবির মধ্য দিয়ে নানা দেশের ভাব ও ভাবনার বিনিময়ভূমি। ২০২০ ও ’২২ এমআইএফএফ-এর নির্বাচিত কিছু ছবি নিয়ে এ বারের আয়োজন ফিল্মস ডিভিশন-এর, সঙ্গী এসআরএফটিআই। ক্লোজ় টু লাইট, ব্রাদার ট্রোল, অতসী, অ্যাডমিটেড-এর পাশে মরাঠি চলচ্চিত্রকার নাগরাজ মঞ্জুলে-র ছবি অ্যান এসে অব দ্য রেন।
উৎসবনাট্য
থিয়েটার সময়ের কথা বলে। বিভাস চক্রবর্তী রচিত আত্মহত্যার সুরতহাল নাটকে ধরেকয়ে চাকরি চায় না বসন্ত নামের যুবকটি, বরং হয় আত্মহননোদ্যত। ব্রাত্য বসুর আপাতত এইভাবে দুজনের দেখা হয়ে থাকে নাটকে এক পুরুষ ও নারীর বিচ্ছেদ, তবু কি ছেড়ে যাওয়া যায়? দু’টি নাটক হয়ে গেল গতকাল ৫ অগস্ট, অ্যাকাডেমিতে— নাট্যদল ‘আভাষ’-এর জন্মদিনে। দলের কুড়ি পূর্তিতে তিন দিনের উৎসবে চারটি নাটক: আজ ৬ অগস্ট সন্ধ্যা ৬টায় মধুসূদন মঞ্চে মোহন রাকেশের হিন্দি নাটক থেকে লহরীর রাজহংস, ৭ তারিখে এই মঞ্চেই শরদিন্দু-কাহিনি অবলম্বনে ব্যোমকেশ কলোনী। উৎসবে ‘খালেদ চৌধুরী সম্মাননা’য় ভূষিত হবেন প্রভাতকুমার দাস। রয়েছে শেখর সমাদ্দারের দু’টি গ্রন্থের প্রকাশ, সব ক’টি নাটকও তাঁরই নির্দেশনা।
সময়ের ভাষ্য
এই শহরের আনাচ-কানাচে এখনও যে আদরে সেজে ওঠে শিল্প-পরিসরের আশ্চর্য সব নিদর্শন, শহরবাসী কি খেয়াল রাখেন তার? বাংলাদেশের বিশ্রুত চিত্রসাংবাদিক ও সমাজকর্মী শহিদুল আলমের তোলা বাছাই ছবির প্রদর্শনী চলছে এমামি আর্ট-এ। চার দশকেরও বেশি শিল্পযাত্রার নানা বাঁকে স্রেফ ফোটোগ্রাফিই নয়, ইতিহাস, সংস্কৃতি, পরিবেশ, এবং সর্বোপরি স্বাধীন দেশে নাগরিকের অধিকার আন্দোলন— সব কিছুরই পরিবর্তনভাষ্য ধরেছেন এই শিল্পী। ইনা পুরির সযত্ন কিউরেশনে মধ্য-জুনে শুরু হওয়া এই প্রদর্শনী— সিঞ্জড বাট নট বার্নট— চোখ ও মনের ভাবনারসদ। দেখার সুযোগ এ মাসের ১৮ তারিখ অবধি, ইমামি আর্ট-এর ওয়েবসাইটে করা যাবে ‘ভার্চুয়াল’ সফরও। নীচের ছবিটি— অন্য চোখে দেখা— ১৯৯২ সালে ঢাকার প্রথম মেয়ে-ফোটোগ্রাফারদের ‘কালেক্টিভ’।
স্মরণীয় সংগ্রহ
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে ও স্বদেশি পণ্য প্রচারের পক্ষে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভার প্রচারপত্র দেখতে পেলে কেমন হয়? কিংবা ১৭৫৭-র দ্য লন্ডন ক্রনিকল-এ ছাপা পলাশির যুদ্ধের খবর; ১৮৫৭-৫৮’র দি ইলাস্ট্রেটেড লন্ডন টাইমস-এ সিপাহি বিদ্রোহের সংবাদ! স্বদেশি পণ্যের বিজ্ঞাপন, স্বদেশি শিল্প প্রতিষ্ঠানের শেয়ার সার্টিফিকেট, ব্রিটিশ জমানায় ভারতীয় ব্যাঙ্কের চেক, পরাধীন ভারতে নাটকের বুকলেট, বিপ্লবী ও দেশনেতাদের সই, গান্ধীর অহিংস আন্দোলন ঘোষণার দিনের অমৃতবাজার পত্রিকা, আলিপুর বোমা মামলার সংবাদ-কর্তিকা, ১৯৪৭-এর ১৫ অগস্টের সংবাদপত্র... এই সব ও আরও অনেক কিছু— পুরনো দুষ্প্রাপ্য মুদ্রা, স্ট্যাম্প, বই, নথি, ফোটোগ্রাফ, বিপ্লবীদের অস্ত্র, চিঠি, কারাগারের ছাপওয়ালা বই, দেশলাইবাক্সের মোড়ক (ছবিতে)— শহরের বাইশ জন সংগ্রাহকের অনবদ্য সম্ভার নিয়ে প্রদর্শনী কল অব ফ্রিডম গোর্কি সদনে, ‘কলকাতা কথকতা’ ও রুশ বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি কেন্দ্রের উদ্যোগে। উদ্বোধন ১০ অগস্ট বিকেল ৪টেয়, ১১-১২ অগস্ট দুপুর ৩টে-সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত।
তাঁত-সূত্র
শাড়ি কি শুধু বস্ত্রখণ্ড এক? বিজ্ঞান, সংস্কৃতি, মিথের আশ্লেষে তারও আছে এক দীর্ঘ ইতিহাস। সেই বিবর্তন, এবং শাড়ির অভিযাত্রায় বাংলার অবদান নিয়ে হবে প্রদর্শনী। বাংলার নানা প্রান্ত থেকে আসবেন তাঁতশিল্পীরা তাঁদের সম্ভার নিয়ে; কথা বলে, দেখে সংগ্রহ করা যাবে তা। বস্ত্র, বয়ন ও আনুষঙ্গিক শিল্পধারা নিয়ে ভারতে কাজ করে চলেছেন যে গবেষক ডিজ়াইনার শিল্পীরা, তাঁরা কথা বলবেন হ্যান্ডলুম ও সহ-শিল্পের নানা দিক ও আঙ্গিক নিয়ে। থাকবে তাঁত, আগ্রহীজন পেতে পারেন সুতো কাটার অভিজ্ঞতাও। এই সবই আগামী ৭ থেকে ৯ অগস্ট আইসিসিআর প্রাঙ্গণে, কলকাতার টেক্সটাইল স্টাডিজ় সংস্থা ‘সূত্র’-র উদ্যোগ ‘হ্যান্ডলুম সূত্র’তে, দুপুর ১টা থেকে রাত ৮টা। স্বাধীনতার পঁচাত্তর ও ৭ অগস্ট ‘জাতীয় হ্যান্ডলুম দিবস’ ঘিরে চেতনার প্রসারেই এ আয়োজন।