Kolkata Karcha

কলকাতার কড়চা: বিনোদন, আবার বিপদও

পশু পাখি পাশা— সে কালের বাবুদের তিন নেশা। তবে বাবু হরিমোহন বাঘ-সিংহ নিয়ে রীতিমতো সার্কাসের দল গড়েছিলেন। শখের মালিক হলেও, সেই উনিশ শতকেই সার্কাসকর্মীদের জন্য নিয়মিত মাসোহারার ব্যবস্থাও করেছিলেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৪ জানুয়ারি ২০২৫ ১০:২৫
Share:

খাস আমহার্স্ট স্ট্রিটের বুকে লক্ষপতি বাবু বানিয়েছেন এক পশুশালা। রাতবিরেতে বাঘ-সিংহের গর্জনে পড়শিদের ঘুমের দফারফা। আছে নিরাপত্তার প্রশ্নও। বেজায় বিরক্ত হলেও, প্রভাবশালী মানুষটির বিরুদ্ধে সরাসরি আপত্তি করতে পারছেন না কেউ। তাই ইংরেজি সংবাদপত্রের সম্পাদককে চিঠি দিয়ে ‘ট্রুথ’ ছদ্মনামে এক পড়শি উগরে দিলেন আপত্তি। ঘিঞ্জি শহরের মাঝখানে এমন বিপজ্জনক পশুশালা রাখার বিরুদ্ধে সেই চিঠি প্রকাশিত হল ১৮৩০ সালের ২৬ জুলাই। নাম না করলেও সে কালের কলকাতাবাসীর বুঝতে অসুবিধা হয়নি, চিঠির তির ছোঁড়া হয়েছে রাজা রামমোহন রায়ের নাতি হরিমোহন রায়কে লক্ষ্য করে।

Advertisement

পশু পাখি পাশা— সে কালের বাবুদের তিন নেশা। তবে বাবু হরিমোহন বাঘ-সিংহ নিয়ে রীতিমতো সার্কাসের দল গড়েছিলেন। শখের মালিক হলেও, সেই উনিশ শতকেই সার্কাসকর্মীদের জন্য নিয়মিত মাসোহারার ব্যবস্থাও করেছিলেন। কৃষ্ণলাল বসাকের মতো সার্কাসে বাংলার ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করে তোলা ‘আর্টিস্ট’ পেশাদারিত্বের প্রথম স্বাদ পান হরিমোহনের কাছেই। তবে পাড়ার লোকের এই সমস্যা খুব বেশি দিন স্থায়ী হয়নি, ৮৫ নং আমহার্স্ট স্ট্রিটের পশুশালাটি বিক্রির বিজ্ঞাপন কাগজে বেরোয় বছর তিনেক পরেই।

বিনোদনের জনপ্রিয় মাধ্যম হলেও, শহরে জায়গা পাওয়া নিয়ে অতীতকাল থেকেই নানা সমস্যার মুখে পড়েছে সার্কাস। ‘প্রফেসর’ প্রিয়নাথ বসুর লেখায় পাওয়া যায় গ্রেট বেঙ্গল সার্কাসের জায়গা খোঁজার বিস্তারিত পরিকল্পনার কথা। বিশ শতকের কলকাতায় নিয়ম করা হয়, সার্কাসের তাঁবু খাটাতে জমির মালিক ও প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াও লাগবে পাড়ার লোকেদের ‘নো-অবজেকশন’। কারণ তাঁরাই পরে নানা আপত্তি তুলে প্রশাসনকে ব্যতিব্যস্ত করেন। আপত্তিও নানা ধরনের। সার্কাসের জন্য বাড়ির ছেলেপুলের লেখাপড়ায় বিঘ্ন হয়, খেলা দেখতে আসা বহিরাগত দর্শকেরা পাড়া নোংরা করে। বাঘ-সিংহের ডাকে ভয় পেয়ে বাড়ির গরু দুধ দেওয়া কমিয়ে দিয়েছে, এ-হেন অজুহাতও খাড়া করতেন অনেকে। দু’টো ‘ফ্রি পাস’ বা একটা ‘ফ্যামিলি পাস’ বিলিয়ে সে সব আপত্তি তুলে নেওয়ার ব্যবস্থাও করতেন সার্কাসের আয়োজকরা।

Advertisement

পার্ক সার্কাসের ময়দানেও বড় সার্কাসের আসর বসত, এই এলাকার বহু মানুষ তখন শহরের শ্বেতাঙ্গ পরিবারগুলিতে রান্নার কাজ করতেন। কিন্তু প্রতি বছরই পার্কের সার্কাসের তাঁবু গোটানোর সময় সেই কর্মীদের একটা অংশ সাহেব-বাড়ির কাজ ছেড়ে সার্কাসের দলে ভিড়ে যেতেন। সার্কাস কর্তৃপক্ষ অভিযুক্ত হতেন গৃহকর্মী ভাঙিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়ে।

জাঁকিয়ে না হলেও শীত পড়েছে। বড়দিন আর ইংরেজি নববর্ষের ছুটি মিলিয়ে ভিড়ে থিকথিক জাদুঘর, চিড়িয়াখানা থেকে ইকো পার্ক। রঙবাহারি বিনোদনের গন্তব্যের সঙ্গে সার্কাসও তাঁবু ফেলে শীতের শহরে। তবে আমাদের সে খেয়াল থাকে না। মনের দূরত্ব প্রতিফলিত হয় ভৌগোলিক অবস্থানেও। শহরের কেন্দ্রে আর জায়গা হয় না সার্কাসের, তারা সরে যায় সিঁথি বা পাটুলিতে। ছবিতে কলকাতার সার্কাসে বাঘের খেলা, নব্বই দশকে।

শোভা-শতক

বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এসে মঞ্চে অভিনয় করতে চাইলে প্রচুর বাধার মুখোমুখি হতে হত মেয়েদের, বারে বারেই বলতেন শোভা সেন (ছবি): পুরুষাধিপত্য ও রাজনৈতিক শাসনে চল্লিশের দশকের থিয়েটারে নিজের অন্তর্ভুক্তি ও অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে, তাঁর বিভিন্ন সাক্ষাৎকার, লেখালিখিতে। পরাধীন দেশে আইপিটিএ থেকে স্বাধীনতার পর এলটিজি/পিএলটি-তে নিজের অভিনয়ের ব্যাপ্তি প্রমাণ করেছেন। ফিল্মেও তাঁর নিত্য আনাগোনা, কে ভুলতে পারে ঋত্বিক ঘটকের প্রথম ছবি নাগরিক-এ তাঁর অভিনয়! পিএলটি ও ফোরাম ফর ফিল্ম স্টাডিজ় অ্যান্ড অ্যালায়েড আর্টস-এর উদ্যোগে ‘শতবর্ষে শোভা সেন’ শিরোনামে উৎসব আগামী ৮, ৯ ও ১০ ডিসেম্বর, তিন দিনই সন্ধ্যা ৬টায় তপন থিয়েটারে তাপস জ্ঞানেশ সভাকক্ষে দেখানো হবে শোভা সেন অভিনীত ভগিনী নিবেদিতা, মা, পদ্মানদীর মাঝি; ছবি নিয়ে বলবেন অসিত বসু অংশুমান ভৌমিক ও গৌতম ঘোষ।

উৎসব-নাট্য

জাতীয় স্তরে নাট্যমেলা আয়োজনই কম কথা নয়, আন্তর্জাতিক স্তরে তো চ্যালেঞ্জটা আরও বড়। শীতের শহরে সেই উদ্যোগই করেছে ‘বাঘাযতীন আলাপ’, পার্থপ্রতিম দেবের নেতৃত্বে। গতকাল থেকে অ্যাকাডেমি মঞ্চে দলের আয়োজনে চলছে কলকাতা আন্তর্জাতিক বাংলা নাট্যোৎসব, উদ্দেশ্য বাংলা নাট্যধারার বৈচিত্র তুলে ধরা। পাঁচটি বাংলা নাটক থাকছে উৎসবে, ঘরের কাছের নান্দীকার ও সায়ক ছাড়াও থাকছে আমেরিকা অস্ট্রেলিয়া ও দুবাইয়ের নাট্যদল। গতকাল সন্ধেয় হয়ে গেল স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত নির্দেশিত মাধবী, আজ দুপুর ৩টে ও সন্ধে সাড়ে ৬টায় এমিরেটস বেঙ্গল নাট্যগোষ্ঠীর অনন্তম ও এপিক অ্যাক্টরস ওয়ার্কশপের নিরস্ত্র; আগামী কাল দুপুর ও সন্ধ্যায় কথক অস্ট্রেলিয়া-র লায়লা ও সায়কের ধর্মাবতার।

বৈঠকি

ভারতীয় রাগসঙ্গীতের রসকে অঙ্গনওয়াড়ি আঙ্গিকে ধরে রাখার দায়বদ্ধতা থেকেই যাত্রা শুরু সুতানুটি পরিষদ চোরবাগান অঞ্চলের, ১৯৯৩-এ। তিন দশক ধরে চলছে তাদের আয়োজনে মজলিশ: গোয়েঙ্কা বাড়ি, মার্বেল প্যালেস-সহ বহু জায়গায়। এ বার বৈঠক কৈলাস বোস স্ট্রিটে লাহা বাড়িতে, আজও যেখানে শোনা যায় ইতিহাসের অনুরণন, আলি আকবর খান বিসমিল্লা খান ভীমসেন জোশী বিরজু মহারাজ বালমুরলীকৃষ্ণ থেকে রাশিদ খান জ়াকির হুসেনের স্মৃতি। আগামী ১১-১২ জানুয়ারি এ বাড়িই জমজমাট হবে পণ্ডিত অভয় রুস্তম সোপোরি ও প্রবীণ গোড়খিণ্ডীর সন্তুর-বাঁশি যুগলবন্দি, পণ্ডিত রাজেন্দ্র গঙ্গানি ওয়াসিম আহমেদ খান কুমার বসু সমর সাহা অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ গুণী শিল্পীর পরিবেশনায়।

উত্তরাধিকার

“শিক্ষক হিসাবে কলাভবনের ছাত্রছাত্রীদের জীবনে প্রতিষ্ঠার কথা নিয়ে কিছু বলার থাকে না... উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম সব জায়গায় তুমি তোমার প্রতিষ্ঠানের এক জন না এক জনকে পাবেই।” রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন শান্তিনিকেতনের কলাভবনের প্রাক্তনীদের সম্পর্কে: “শান্তিনিকেতন যা দিয়েছে তা হল ‘শোভন সুন্দর রুচি’, সেটাই আমাদের উন্মোচিত উত্তরাধিকার।” এই পরম্পরারই বাহক কলাভবনের প্রাক্তনী সংগঠন ‘নন্দন শান্তিনিকেতন’-এর সদস্যরা, কাছে-দূরে যে যেখানে আছেন সেখানেই। কলকাতায় আইসিসিআর-এ ২ থেকে ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত চলছে তাঁদের আয়োজনে ২৩তম আন্তর্জাতিক শিল্প প্রদর্শনী, রোজ দুপুর ৩টে থেকে রাত ৮টা। রয়েছে পঞ্চাশেরও বেশি প্রবীণ-নবীন শিল্পীর সাম্প্রতিক চিত্রকৃতি, প্রদর্শনীর নামটিও রেখেছেন তাঁরা— ‘উন্মোচিত উত্তরাধিকার’।

ছয় দশক ধরে

রবীন্দ্রসৃষ্টির বিরাট বিশ্বের কতটুকুই বা দৈনন্দিন জীবনে ছুঁয়ে থাকি আমরা? খণ্ডিত, বিক্ষিপ্ত, অসম্পূর্ণ সেই পরিচয়ের বাইরে গিয়ে পূর্ণ রবীন্দ্রনাথকে তুলে ধরায় প্রয়াসী টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউট, গত ছয় দশক ধরে। বছরের প্রথম দিনটিতে ষাট বছর পূর্ণ হল এই প্রতিষ্ঠানের। রবীন্দ্রচর্চা পাঠক্রম, বক্তৃতা সেমিনার বইপ্রকাশ গ্রন্থমেলা ও প্রদর্শনীর আয়োজন-সহ নানা কাজে সতত নিয়োজিত এই প্রতিষ্ঠান। ষাট বছর পূর্তি উপলক্ষে গত ১ জানুয়ারি কালীঘাটে রবীন্দ্রচর্চা ভবনে অভ্র বসু বললেন ‘প্রয়োজনের সুখ, অপ্রয়োজনের আনন্দ’ নিয়ে। এ মাসেই আরও দু’টি বক্তৃতা, আগামী ১৩ জানুয়ারি সন্ধ্যায় অভ্র ঘোষ বলবেন ‘অরাজনৈতিক রবীন্দ্রনাথের রাজনীতি’ নিয়ে, ২০ জানুয়ারি ‘রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর জীবনদেবতা’ প্রসঙ্গে রজত কান্ত রায়।

শতবর্ষে

অষ্টাদশ শতকে অটোমানদের সঙ্গে যুদ্ধে রাশিয়ার জয়ে জাতিগত পরিচয়ে তুর্কি ও গ্রিক বহু মানুষ ঘরছাড়া হন, গ্রিকদের একটা অংশ আশ্রয় নেন কলকাতায়। সঙ্গে যোগ দেন ইজিয়ান সাগর অঞ্চল থেকে আসা স্বজাতিও। এঁদের জন্য আলাদা উপাসনাগৃহ নির্মাণের অনুমতি মেলে ওয়ারেন হেস্টিংসের আমলে, মধ্য কলকাতার আমড়াতলা স্ট্রিটের সেই গির্জা নির্মাণে হেস্টিংসের ব্যক্তিগত অনুদানও ছিল। সেন্ট জন’স গির্জার জন্য আঁকা ‘লাস্ট সাপার’ ছবিতে গ্রিক চার্চের যাজক ফাদার পার্থেনিয়োর আদলে জিশুকে এঁকেছিলেন শিল্পী জোহান জোফানি। বিশ শতকের শুরুতে নানা কারণে গির্জা উঠে আসে কালীঘাট এলাকায়। ঐতিহ্যবাহী ডোরিক কলাম ও পেডিমেন্ট শোভিত গ্রিক অর্থোডক্স চার্চের (ছবিতে) ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয় ১৯২৪-এ, উপাসনার জন্য খুলে যায় পরের বছর নভেম্বরে। এ শহরে শতবর্ষের ইতিহাস ধরে আছে গির্জাটি।

শহর ও সিনেমা

সত্তরের দশকে তিনটি ছবি করলেন মৃণাল সেন (ছবি), পরিবর্তনশীল এক শহর ও সমাজের সাক্ষী যেন সেই ‘কলকাতা ট্রিলজি’। শহরের গড়া ও ভাঙা, ফের গড়ে ওঠার ঐতিহাসিক শক্তিগুলি প্রাণ পেল এই সময়ের ছবিতে, নতুন এক চিত্রভাষার সঙ্গে আমাদের আলাপও করাল, কোরাস ছবিতে যেন তারই চূড়ান্ত রূপ। এ ছবিতে বিপ্লবের প্রতিশ্রুতিকে ছুঁয়ে যায় মিথ, গ্রাম-শহরের খেটে খাওয়া মানুষেরা ‘দখল নেয়’ শহরের। কী করে শহুরে রূপান্তরের ফসল হয়ে ওঠে সিনেমা, সিনেমাও আবার কী করে শহরকে তৈরি করে, এ ক্ষেত্রে যেমন সত্তরের দশকের কলকাতা— তা নিয়েই ক্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপের ‘সিটি লাইটস’ বক্তৃতামালার তৃতীয় অধিবেশনে বলবেন সংস্কৃত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং মহানির্বাণ ক্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপের সদস্য সমতা বিশ্বাস। পার্ক স্ট্রিটের গ্যোয়টে ইনস্টিটিউট-ম্যাক্সমুলার ভবনে আগামী ১০ জানুয়ারি, শুক্রবার, বিকেল সাড়ে ৫টায়।

শ্রদ্ধাঞ্জলি

ওঁর ক্লাসে ছাত্রছাত্রীরা ধন্দে পড়ে যেত: নোট তো নেওয়া দরকার, কিন্তু স্যর ওদিকে পড়াতে পড়াতে যে চমৎকার ছবিটা এঁকে চলেছেন, তা তো উপভোগ করা যাবে না! কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের প্রবাদপ্রতিম শিক্ষক ছিলেন অরুণকুমার শর্মা। তাঁর গবেষণাগার ‘বিশ্বের বৃহত্তম ক্রোমোজ়োম সংসার’ নামে ভূষিত; স্ত্রী অর্চনা শর্মার সঙ্গে লেখা বই ক্রোমোজ়োম টেকনিকস বিশ্বের সম্পদ। গত ৩১ ডিসেম্বর বিভাগের উদ্যোগে পালিত হল অধ্যাপক অরুণকুমার শর্মার জন্মশতবার্ষিকী, দেখানো হল শুভা দাস মল্লিক পরিচালিত তথ্যচিত্র দ্য ক্রোমোজ়োম ম্যান। মাস্টারমশাইয়ের প্রতি শ্রদ্ধায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগ গত বছর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরের সম্মেলনও করেছে, সঙ্গী ছিল প্রাক্তনী সংসদ, মাইকোলজিক্যাল সোসাইটি, বটানিক্যাল সোসাইটি অব বেঙ্গল। তৈরি হয়েছে সংগ্রহশালাও।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement