উনিশ শতকের বাংলায় সতীদাহ প্রথার উচ্ছেদ রাজা রামমোহন রায়ের জীবনের অন্যতম সুমহৎ কীর্তি। তবে নেহাত এই কারণেই স্মর্তব্য নন তিনি। সমগ্র বিশ্বেই পরাধীন জাতির মধ্যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় তাঁর উদ্যম, গণতন্ত্রের স্তম্ভ হিসাবে সংবাদপত্রের ভূমিকাকে তুলে ধরা, বাংলায় গদ্যচর্চার মধ্যে দিয়ে ভাষার প্রাণপ্রতিষ্ঠা, সর্বোপরি নারীর স্বাধিকার রক্ষায় তাঁর অপরিসীম প্রয়াসের জন্যও তিনি চিরস্মরণীয়। আগামী কাল, ২২ মে তাঁর জন্মের সার্ধদ্বিশতবর্ষ পূর্তি।
তাঁকে নিয়ে চর্চা শুরু হয়েছিল তাঁর জীবদ্দশাতেই। জন্মশতবর্ষ, সার্ধশতবর্ষ, দ্বিশতবর্ষ; প্রয়াণশতবর্ষ ইত্যাদি সময়ফলকে তাঁকে নিয়ে আলোচনা বিস্তৃততর মাত্রা পেয়েছে। রবীন্দ্রনাথ, প্রফুল্লচন্দ্র, জগদীশচন্দ্র ব্রজেন্দ্রনাথ শীল হয়ে সমসময়ও প্রাণিত রামমোহনের ভাবনায়। বঙ্গীয় নবজাগরণের পথিকৃতের মর্যাদা পেয়েছেন, বাঙালির বিশ্বমানবত্বের দাবিকেও গতি দিয়েছেন রামমোহন।
কলকাতায় স্থায়ী ভাবে বসবাসের পর ১৮১৫ সালে তাঁর স্থাপিত আত্মীয় সভা বাঙালির অসাম্প্রদায়িক ধর্ম ও সংস্কৃতি-চেতনায় দীর্ঘমেয়াদি ছাপ ফেলেছিল। তার উত্তরসূরি হিসেবে ১৮২৮ সালে রামমোহন প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মসভা বা ব্রাহ্মসমাজ পরবর্তী কালে বাঙালির মনন-সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করেছিল গভীর ভাবে। গণতন্ত্র রক্ষায় তাঁর অপরিসীম উদ্যম, ধর্মচেতনায় সম্প্রদায়-বিদ্বেষের অনুপস্থিতির জন্য এই একুশ শতকের গণতন্ত্রেও তিনি সমধিক প্রাসঙ্গিক।
রামমোহনের সার্ধদ্বিশতবর্ষে শহর অনুষ্ঠানময়। সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের তিন দিন ব্যাপী উদ্যাপন শুরু আগামী কাল সকালে ময়দানে রামমোহন-মূর্তিতে মাল্যদানের মাধ্যমে। ২৪ মে অবধি রোজ সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় ২১১ বিধান সরণির উপাসনাগৃহে বক্তৃতা আলোচনা ও গান, থাকবেন জহর সরকার সুরঞ্জন দাস অরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। ভবানীপুরের ব্রাহ্ম সম্মিলন সমাজ মন্দিরে আজ ২১ মে সন্ধ্যায় সভা ‘সৃষ্টি পরিষদ’-এর উদ্যোগে, সভামুখ্য প্রসাদরঞ্জন রায়, বলবেন ঋতা ভিমানি। দেখানো হবে গৌতম ঘোষের তথ্যচিত্র রামমোহন। আগামী কাল সন্ধ্যা ৬টায় আইসিসিআর-এ রামমোহনের গান ও রচনায় তাঁকে স্মরণ, থাকবেন রীনা দোলন বন্দ্যোপাধ্যায় অনিরুদ্ধ সান্যাল অনিরুদ্ধ রক্ষিত প্রমুখ।
রামমোহন লাইব্রেরি অ্যান্ড ফ্রি রিডিং রুম-এর বর্ষব্যাপী রামমোহন জন্মসার্ধদ্বিশতবর্ষ উদ্যাপনের সমাপ্তি অনুষ্ঠান ২২-২৩ মে। ২২ মে স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ, ডাক বিভাগের সহযোগিতায় স্পেশ্যাল কভার প্রকাশ, ‘রাজা রামমোহন স্মারক বক্তৃতা’ দেবেন অনিতা অগ্নিহোত্রী।
রামমোহনের জীবনকৃতি নিয়ে প্রদর্শনী শুরু হচ্ছে আগামী কাল ২২ মে, প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডের ‘গ্যালারি চারুবাসনা’য়। জ্যোতির্ময় ভট্টাচার্যের রূপায়িত এই প্রদর্শনী ১৫ জুন পর্যন্ত, ২টো থেকে ৮টা। ছবিতে ১৮৯০-এর দশকে ক্যালকার্টা আর্ট স্টুডিয়োর রামমোহন-লিথোগ্রাফ।
অমর শতবর্ষ
লোভ দূরস্থান, শিল্পীর পার্থিব চাওয়া কিছু থাকতে নেই, চাই সংযম— বিশ্বাস করতেন অমর পাল (ছবিতে)। গান গেয়ে যা পেতেন তাতেই সংসার চলত। মাথা নিচু করেননি কারও কাছে, ছাত্রছাত্রীরা তাঁর কাছে পেয়েছে অশেষ স্নেহ ও অমূল্য শিক্ষা— বাংলা লোকগানের বিপুল সম্ভার, তার তত্ত্ব দর্শন ও গায়ন বুঝিয়ে দিতেন সহজ করে। ছাত্রদের বলতেন গানের ধারা ও কাঠামো ঠিক রেখে নিজস্ব গায়কিতে গাইতে, কণ্ঠসম্পদকে অবহেলা না করার কথা মনে করাতেন বার বার। তাঁর এই নিষ্ঠাই টেনেছিল সত্যজিৎ রায়কেও, যখন এক টেক-এই নির্ভুল রেকর্ড করেছিলেন ‘কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়...’ সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবর্ষের গায়ে গায়েই, গত ১৯ মে শতবর্ষ পূর্ণ হল শিল্পী অমর পালের। সমীর আইচ, প্রাণেশ সোম-সহ ওঁর ছাত্র ও শুভার্থীরা গান কথা স্মৃতিচারণে স্নিগ্ধ স্মরণানুষ্ঠান করলেন এ দিন বিড়লা অ্যাকাডেমিতে।
গানের ধারা
‘খ্রীষ্টে আর কৃষ্টে কোনো তফাত নাই রে ভাই...’ এন্টনি ফিরিঙ্গির গান। বাংলার অনন্যতা— দুশো বছর ধরে দক্ষিণবঙ্গে সঙ্গীতের ধারা ‘খ্রিস্টকীর্তন’, গুরু-শিষ্য পরম্পরায় আজও বহতা যা। খ্রিস্টভক্তের প্রার্থনাসঙ্গীত নয় এ, খোল করতাল হারমোনিয়াম যোগে, সুরে কথায় অভিনব বাইবেল আখ্যানগীত। দুই দশকের ক্ষেত্রসমীক্ষায় চার প্রজন্মের কীর্তনিয়াদের জীবনকথা, ক্যাথলিক-প্রোটেস্টান্ট মিলিয়ে প্রায় আড়াইশো কীর্তনিয়ার তথ্য, পূর্ণাঙ্গ তালিকা, ছবি নিয়ে শ্রীখ্রিস্টকীর্তন বই লিখেছেন সুরঞ্জন মিদ্দে (প্রকাশক: নান্দনিক), ‘সম্প্রীতি আকাদেমি’ আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রকাশ আজ বিকেল ৫টায়, বৌদ্ধ ধর্মাঙ্কুর সভায়। আলোচনা হবে কীর্তন ও ক্যারল নিয়ে, সুশীল সাহা ভূষিত হবেন ‘সম্প্রীতি সম্মান’-এ।
স্মরণার্ঘ্য
“এই নাটকটা আমাকে দেওয়া মায়ের উল্লেখযোগ্য উপহার।” ২০১৯-এ দর্শকদের বলেছিলেন রাণী কাদম্বিনী নাটকের নির্দেশক সোহিনী সেনগুপ্ত। দর্শকাসনে তখন বসে নাট্যকার স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত স্বয়ং, এ নাটকের সঙ্গীত ও আবহবিন্যাসও তাঁর। অতিমারিতে বন্ধ হয়ে যাওয়া নাটকটি ফের আগামী কাল ২২ মে, স্বাতীলেখার ৭৩তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে, দুপুর ৩টেয় অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসে। স্বাতীলেখা সেনগুপ্তের প্রয়াণের পরে এই প্রথম মঞ্চায়ন। উনিশ শতক শেষে এক বঙ্গতরুণীর দেশের প্রথম মহিলা চিকিৎসক হয়ে ওঠার যাত্রা, অভিনয়ে সোহিনী সেনগুপ্ত দেবশঙ্কর হালদারের সঙ্গে দলের তরুণ নাট্যকর্মীরাও। স্মরণে মননে সে দিন স্বাতীলেখা, এ প্রসঙ্গে রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত: “পরের প্রজন্মকে ওঁর সৃষ্টির মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা, এইটুকুই তো পারি!”
নতুন প্রাপ্তি
১৪ মে চলে গেল তাঁর জন্মদিন, শুরু হল মৃণাল সেনের জন্মশতবর্ষের সূচনাও। চলচ্চিত্রপথে তাঁর সহ‘কর্মী’ সত্যজিৎ রায়ের নামাঙ্কিত ‘রায় মিউজ়িয়ম’ রূপ পায়নি এখনও, সেই আক্ষেপের পাশে শুভ সংবাদ— উত্তরপাড়ার ‘জীবনস্মৃতি ডিজিটাল আর্কাইভ’ মৃণাল সেনের জীবন, দর্শন ও চলচ্চিত্র বিষয়ে একটি আর্কাইভ ও মিউজ়িয়ম তৈরির কাজ সম্পন্ন করেছে, সাত বছরের শ্রমে। ‘মৃণাল মঞ্জুষা’ নামের এই সংগ্রহালয়টিতে রয়েছে তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহের চারশোরও বেশি বই ও পত্রিকা, শুটিংয়ের স্থিরচিত্র, তৈলচিত্র; প্রদর্শনী-কক্ষে রয়েছে তাঁর ব্যবহৃত কলম, চশমা, ধূমপানের পাইপ, পোশাক। এ ছাড়াও তৈরি হয়েছে তথ্যচিত্র আমি মৃণাল সেনকে দেখিনি (নির্মাণ: অরিন্দম সাহা সরদার)। শতবর্ষ উদ্যাপনের অঙ্গ হিসেবে ১৪ মে থেকে আর্কাইভ ও মিউজ়িয়ম খুলে গিয়েছে, সকলের জন্য।
তোপসে-সন্ধ্যা
ফেলুদার পঞ্চাশ বছর তো বটেই, সঙ্গে তোপসেরও কিন্তু পঞ্চাশ বছর, খানিক অনুযোগের সুরেই বলেছিলেন সত্যজিৎ রায়ের তোপসে— সিদ্ধার্থ চট্টোপাধ্যায়। জটায়ুর আগমন আরও পরে। ফেলুদাগল্পের পাঠক বই পড়তে পড়তে নিজেকে তোপসের আসনেই বসান অবধারিত, কিন্তু বাস্তবে তাকে নিয়ে হইচই কম। সে আক্ষেপ মেটাবে এখন সত্যজিৎ পত্রিকা (সম্পাদক: সোমনাথ রায়), তাদের বার্ষিক অনুষ্ঠান ‘রে কুইজ়’-এর আসরে সংবর্ধিত হবেন সিদ্ধার্থবাবু, আজ নন্দন-৩’এ, বিকাল ৫টায়। থাকবেন সন্দীপ রায় বরুণ চন্দ প্রমুখ। অতিমারিতে দু’বছর বন্ধ ছিল রে কুইজ়, সগৌরবে ফিরছে আবারও, এ বার ১৮তম বর্ষে। পত্রিকা সম্পাদকের সাজিয়ে দেওয়া প্রশ্নমালায় কুইজ় সঞ্চালনা করবেন শুভ্রজিৎ দত্ত।
নতুন দুই
১৯৭৩-এ মুক্তি পেয়েছিল সত্যজিৎ রায়ের ছবি অশনি সংকেত, বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে সেরার শিরোপা ‘স্বর্ণভল্লুক’ জয়ী একমাত্র ভারতীয় ছবি। “কাহিনিটিতে ১৯৪২-৪৩ সালের মন্বন্তরের বর্ণনা ছিল। বাবা তাঁর চিত্রনাট্য লেখার সময় গল্প থেকে একচুলও সরে আসেননি। ছবিটিতে গঙ্গাচরণের চরিত্রে সৌমিত্রকাকুর অভিনয় ভোলার নয়...” ‘সম্পাদকের কথা’য় লিখেছেন সন্দীপ রায়, তাঁর সম্পাদনায় ছবিটির চিত্রনাট্য, বিজ্ঞাপন, পোস্টার, বুকলেট, স্কেচ, শুটিং স্টিল-সমেত সদ্য প্রকাশ পেল অশনি সংকেত সম্পূর্ণ (প্রকাশক: পত্রভারতী) বইটি। রয়েছে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সন্ধ্যা রায় ববিতা প্রমুখের সাক্ষাৎকার, বিভূতিভূষণের কাহিনিও। এই বইটির সঙ্গে সত্যজিতের জন্মদিনে পত্রভারতী প্রকাশ করল ব্যঙ্গদর্শনে সত্যজিৎ (সঙ্কলক: চন্দ্রনাথ ও মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়)। সত্যজিৎকে নিয়ে দুই বাংলার কবি ও কৌতুকচিত্রীদের লেখায় রেখায় সেজে উঠেছে বইটি। নারায়ণ দেবনাথ চণ্ডী লাহিড়ী অনুপ রায় দেবাশীষ দেব-সহ বিশিষ্ট শিল্পীদের আঁকা ছবির সঙ্গে বহু কবির সরস পদ্যের সমাহার। নীচের ছবিতে দু’টি বইয়ের প্রচ্ছদ।
বিচিত্র বিস্ময়
সাংস্কৃতিক বিনিময়ের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে সমাজের বিভিন্ন অংশের মধ্যে সদ্ভাব গড়ে তোলায় জাদুঘরের গুরুত্ব অপরিসীম। সে কথা মনে করিয়ে দিতে প্রতি বছর ১৮ মে পালিত হয় আন্তর্জাতিক জাদুঘর দিবস। এ বছর তুলে ধরা হচ্ছে দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়নের লক্ষ্যে জাদুঘরের ভূমিকার কথা। সেই উপলক্ষে গত ১৬-২০ মে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন ছিল ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ােল। গ্যালারি বা বাগানে এই ক’দিন ছিল না প্রবেশমূল্য, বিশেষ প্রদর্শবস্তু হিসেবে দেখা গেল আনন্দমঠ লেখার সময় বঙ্কিমচন্দ্রের ব্যবহৃত ডেস্ক (ছবিতে), নেতাজির কলম। ছিল মিউজ়িয়ম নির্মাণকালীন তোলা ৩২টি ছবির প্রদর্শনী; রাতের মিউজ়িয়ম দেখার নতুন অভিজ্ঞতা, সঙ্গে ভূতের গপ্পো; ‘বিপ্লবী ভারত’ বিষয়ে ছোটদের মিউজ়িয়ম সফর, গল্প বলা, নাচ, ম্যাজিক, কার্টুন কর্মশালা। কলকাতার বহুবর্ণ অস্তিত্ব নিয়ে প্রোজেকশন ম্যাপিং শো-ও জুড়ল তালিকায়। অনুষ্ঠান ফুরিয়েছে, প্রদর্শবস্তুগুলি দেখার সুযোগ থাকছে এখনও।
দায়বদ্ধ
চলে গেল ১৯ মে। একুশে ফেব্রুয়ারির মতোই এও ভাষা শহিদ দিবস— ১৯৬১ সালের এই দিনে বরাক উপত্যকায় শিলচরে বাংলা ভাষা রক্ষার দুর্মর তাগিদে তৎকালীন অসম সরকারের গুলিতে ঝরে যায় কতগুলি প্রাণ। এ শহরে ১৯ মে নামের একটি পত্রিকা (সম্পাদক: শান্তনু গঙ্গারিডি) প্রকাশিত হয়ে আসছে ২০০৮ সাল থেকে, বছরে একটি সংখ্যাই, ১৯ মে তারিখে। অন্য দিকে, ১৯৯৫ সাল থেকে প্রকাশিত, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের নামকরণ করা পত্রিকা একুশ শতাব্দী-ও (পূর্বতন সম্পাদক সাগর বিশ্বাস) এই প্রজন্মের সম্পাদকদের দায়বদ্ধতায় নিশ্চিত করছে এ শহরে ১৯ মে স্মরণ। দুই পত্রিকার উদ্যোগে এ দিন বিকালে ভাষা শহিদ স্মরণ অনুষ্ঠান হয়ে গেল অবনীন্দ্র সভাঘরে— বিশিষ্টজন-সঙ্গে, কথায় গানে পত্রিকা প্রকাশে।