ফাইল চিত্র।
তারিখটা ছিল ৩০ নভেম্বর ১৯৫৮। পার্ক স্ট্রিট ও চৌরঙ্গির মোড়ে পাঁচ লক্ষাধিক মানুষের জমায়েত। উপস্থিত বিধানচন্দ্র রায়-সহ শহরের বিশিষ্ট নাগরিকরা। ১৩ ফুট পাদপীঠের উপর স্থাপিত ১১ ফুট ৪ ইঞ্চি উচ্চতার গান্ধীমূর্তির আবরণ উন্মোচন করলেন জওহরলাল নেহরু। আবহে তখন রামধুনের সুর, সদ্য উড়িয়ে দেওয়া শ্বেতকপোতের ঝাপটানি। তবে এই মূর্তি বসানোর আগে পেরিয়েছে অশান্তি উদ্বেগের একাধিক পর্ব। কিছু দিন আগেই পার্ক স্ট্রিটের এই কোণ থেকে জেমস উট্রামের ঘোড়সওয়ার-মূর্তি সরানোর পর সেই জায়গায় গান্ধীর মূর্তি বসানোর সিদ্ধান্ত নেয় রাজ্য সরকার। কিন্তু দাবি ওঠে, নেতাজির মূর্তি বসানো হোক সেখানে। দাবি না মানায় মূর্তি বসানোর কাজ চলাকালীন তার উপর রড-গাঁইতি নিয়ে আক্রমণ করে বিক্ষুব্ধরা। সামান্য ক্ষতির উপর দিয়ে রক্ষা পায় মূর্তিটি।
বসাতে গিয়ে আবার মূর্তির ডান পা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে নতুন সমস্যা। কলকাতায় তখন ব্রোঞ্জের আকাল। এ দিকে প্রধানমন্ত্রীর হাতে উদ্বোধনের দিন স্থির হয়ে গিয়েছে। শিল্পী দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী এক বেনজির সিদ্ধান্ত নিলেন। তাঁর প্রয়াত পিতা উমাপ্রসাদ রায়চৌধুরীর একটি আবক্ষ ব্রোঞ্জমূর্তি গড়েছিলেন দেবীপ্রসাদ, শেষে ‘মাই ফাদার’ নামের সেই মূর্তি গলিয়ে, সেই ব্রোঞ্জ দিয়ে কাজ শেষ করে প্রতিশ্রুতি রাখলেন অবনীন্দ্রনাথের শিষ্য।প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, চেন্নাইয়ের শিল্প মহাবিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যক্ষ দেবীপ্রসাদের হাতেই ব্রিটিশ আমলে তৈরি হয় এই শহরে আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ও সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরও দুটি মূর্তি। ইতিহাসবিদ কমল সরকারের সঙ্গে কথোপকথনে শিল্পী জানিয়েছিলেন, কলকাতায় তাঁর সেরা কাজ গান্ধী মূর্তিটি। ডান হাতের লাঠিতে ভর দিয়ে বন্ধুর পথ অতিক্রমকারী এই মূর্তি (ছবিতে) যেন ‘একলা চলো রে’ সুরবহ। দেবীপ্রসাদের গড়া ঠিক এই রকম আর একটি মূর্তি আছে চেন্নাইয়ের মেরিনা বিচে।
নামী শিল্পীদের হাতে তৈরি গান্ধী-মূর্তি ছড়িয়ে আছে বিশ্বের নানা শহরে। গান্ধীর প্রথম দিকের কর্মকাণ্ডের কথা মাথায় রেখে জোহানেসবার্গের গার্ডেন স্কোয়ারে কমবয়সি গান্ধীর অন্য রকম মূর্তিটি গড়েছিলেন টিঙ্কা ক্রিস্টোফার। লন্ডনের পার্লামেন্ট স্কোয়ারের মূর্তিটি তৈরি ভাস্কর ফিলিপ জ্যাকসনের হাতে। নিউ ইয়র্কে ম্যানহাটানে ইউনিয়ন স্কোয়ারে দেখা যায় কান্তিলাল পটেলের কাজ।
মেট্রো রেলের কাজের জন্য দেবীপ্রসাদ-নির্মিত গান্ধী মূর্তি ১৯৭৭-এ পার্ক স্ট্রিট মোড় থেকে স্থানান্তরিত হয় তার বর্তমান স্থান, মেয়ো রোড ও ডাফরিন রোডের সংযোগস্থলে। গান্ধীমূর্তির পাদদেশ হয়ে ওঠে দলমত নির্বিশেষে মানুষের প্রতিবাদ প্রকাশের ঠিকানা— শুধু কলকাতা নয়, দিল্লি মুম্বই চেন্নাইয়েও। অন্যায়ের বিরুদ্ধে অহিংস আন্দোলনের নতুন ভাষা হয়ে ওঠে গান্ধী মূর্তি। ৩০ জানুয়ারি আসছে, সেই ট্র্যাডিশন বহতা আজও।
দু’শো বছরে
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের মতে তাঁর সময় থেকেই ‘বঙ্গভাষার নবযুগ’, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় তিনি ‘আধুনিক বাংলা কাব্য সাহিত্যের প্রথম দ্বার মোচনকারী’। অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক, পত্রকাব্য, বাংলা চতুর্দশপদী ও ট্র্যাজেডিনাট্যের দিশারি, মহাকাব্য রচয়িতা... বাংলা ভাষা-সাহিত্যের পরিক্রমায় মাইকেল মধুসূদন দত্তের (ছবি) ভূমিকা অবিসংবাদী। ২৫ জানুয়ারি দু’শো বছরে পড়লেন তিনি। যশোরের সাগরদাঁড়ি মুখরিত ‘মধুমেলা’য়, নানাবিধ উদ্যাপন এই বাংলাতেও। রাজ্য সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের আয়োজনে ২৫ তারিখ মধুসূদন মঞ্চে হল আলোচনা, মধুসূদনের নাটক-পাঠ, নৃত্য-গীতি আলেখ্য। ‘কোরক’ প্রকাশ করেছে প্রবন্ধ-সঙ্কলন মাইকেল মধুসূদন (সম্পা: তাপস ভৌমিক),পাওয়া যাবে বইমেলায়। কবি স্মরণে স্মারক বক্তৃতা, গ্রন্থপ্রকাশ, কবিসম্মেলন করল ‘সুতরাং’ প্রকাশনী, বই-চিত্র সভাঘরে
সভাঘরে।
প্রতিষ্ঠাদিবসে
১৯৩৬ সালে শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মশতবর্ষেই পরিকল্পনা হয় ‘রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচার’-এর। আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠা ১৯৩৮-এর ২৯ জানুয়ারি, রামকৃষ্ণ মিশনের একটি শাখাকেন্দ্র হিসাবে। উত্তর ও মধ্য কলকাতার নানা ঠিকানা ঘুরে ক্রমে তা চলে আসে দক্ষিণ কলকাতায়, পরে ১৯৬১ সাল থেকে গোলপার্কের বর্তমান ঠিকানায়। এই শহর, রাজ্য ও দেশের অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান এই ইনস্টিটিউট, শ্রীরামকৃষ্ণ-ভাবধারা প্রচারের পাশাপাশি ব্যাপৃত সমাজ-সংস্কৃতি-ভাষা চর্চা, প্রকাশনা-সহ নানা কর্মকাণ্ডে। আগামী কাল ২৯ জানুয়ারি ৮৫তম প্রতিষ্ঠাদিবসে বলবেন জাপানের কিয়োটো ইউনিভার্সিটি অব অ্যাডভান্সড সায়েন্স-এর অধ্যাপক, এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব পাবলিক পলিসি অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ়, কলকাতা-র ভাইস প্রেসিডেন্ট গৌতম রায়। অনুষ্ঠান সন্ধ্যা সাড়ে ৫টায়, বিবেকানন্দ হল-এ।
বিশ্বের সুর
বিশ্বের সুরে ফিরছে শহর। ‘বাংলানাটক ডট কম’-এর আয়োজনে গল্ফ গ্রিন সেন্ট্রাল পার্কে বিশ্বসঙ্গীতের গানের আসর ‘সুর জঁহা’, আগামী ৩ থেকে ৫ ফেব্রুয়ারি। থাকছে দেশ-বিদেশের গানদল: উত্তর আয়ারল্যান্ডের বেলফাস্ট-এর ফোক ব্যান্ড ‘মাডাগান’, মিশরের গান ও দরবেশ-নাচের দল ‘মউলাইয়া’; সঙ্গে রাজস্থানের সুফি ও কাওয়ালি গানের প্রতিনিধি মীর শিল্পীরা, তাঁরা গাইবেন মীরাবাই-কবীর-বুল্লে শাহ-আমির খুসরো-খাজা গুলাম ফরিদের গান। বাংলা লোকগানের সম্ভার— রীনা দাস বাউল, বিয়ের গানে মুর্শিদাবাদের সায়রা বানু, সলাবৎ মাহাতোর দরবারি ঝুমুর শোনাবেন অর্পিতা চক্রবর্তী, বাংলা কাওয়ালিতে মুর্শিদাবাদের জলঙ্গীর ছোটে গোলাম। বাংলার লোকগানকে সপ্রাণ রেখেছেন যে তরুণ শিল্পীরা, থাকবেন তাঁরাও, ‘ফোকস অব বেঙ্গল’-এ।
শিল্প-প্রবাহ
শিল্পী ও রসিকজনের সেতু আর্ট গ্যালারি, এই অনলাইন আস্ফালনের সময়েও স্রষ্টা ও সৃষ্টিকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। এমনই এক গ্যালারি মায়া আর্ট স্পেস। যাত্রা শুরু ২০১৩-তে; প্রদর্শনী, সেমিনার, আর্ট অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্স, শিল্পমেলায় জমজমাট। ‘বেঙ্গল মাস্টার্স’ থেকে শুরু করে এ কালের শিল্পচর্চার হদিস দিয়েছে এই গ্যালারি, প্রকাশ করেছে শিল্প-বই। সাম্প্রতিকতম আয়োজন শিল্প প্রদর্শনী ‘প্রবাহ’— শিল্পীদের অধিকাংশই তরুণ, প্রথিতযশা শিল্পীদের তত্ত্বাবধানে গড়েছেন মজবুত বনিয়াদ। অমিত অরুণাংশু ছন্দক দেবাশিস জ্যোতির্ময় খোকন পল্লব প্রদীপ রচিতা শেখর সৌরভ সুদীপ স্বপন উপমার চিত্র, ভাস্কর্য, সেরামিক্স, আলোকচিত্র নিয়ে বার্ষিক প্রদর্শনী শুরু হয়েছে ২১ জানুয়ারি। ৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত, দুপুর ২টো-রাত ৮টা।
আত্মপ্রকাশ
“বাংলায় যখন লিখি বা কথা বলি, তখন আমার মনের মধ্যে ধরে রাখা এক স্মৃতির দেশের সঙ্গে কথা বলি... এসব কথা ইংরিজিতে পেশাদারি রচনায় সচরাচর প্রকাশ পায় না।” স্মৃতি সত্তা সংলাপ (প্রকাশক: নির্ঝর) গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন দীপেশ চক্রবর্তী। নানা সময়ে লেখা তাঁর বাংলা রচনাগুলিকে গেঁথে গড়া এ বই— প্রতি দিনের সত্তার মাঝে রয়ে যাওয়া পুরনো কথা, তাদেরও ইতিহাসের আখ্যান হয়ে ওঠার এক যাত্রা যেন। প্রকাশ পাবে আগামী ৩ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা সাড়ে ৫টায় মহাবোধি সোসাইটি সভাঘরে, থাকবেন শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় ও সব্যসাচী ভট্টাচার্য। থাকবে লেখকের সঙ্গে বই-বিষয়ক আলোচনাও। আশীষ লাহিড়ীর অনুবাদে বিশিষ্ট ভারতত্ত্ববিদ ওয়েন্ডি ডনিগার-এর শান্তিনিকেতনের চিঠি: আমার শিক্ষাজীবন বইটিও প্রকাশিত হবে এই অনুষ্ঠানে।
স্মৃতিময়
তাঁর সংগ্রহশালা ইতিহাসবস্তুর সমাহার, এমন দাবি করেন না অপূর্ব কুমার পান্ডা। অবিভক্ত বাংলার মধ্যবিত্ত জীবনের ফেলে-আসা, ভুলে যাওয়া নানা কিছুকে শ্রমে ও আদরে সংগ্রহ করেছেন তিনি, এক ঐতিহাসিকতা অজানতেই লগ্ন সে কাজে। পালকি, গ্রামোফোন, ইঙ্ক ব্লটার বা ডিপ পেন কী, ছোট্ট ছেলেকে তা বোঝাতে গিয়ে ছবি দেখাতে বা আঁকতে হচ্ছিল, সেখানেই লুকিয়ে ছিল ভবিষ্যতের সংগ্রহের বীজ। মুদ্রা, অটোগ্রাফ, পুরনো আলোকচিত্র সংগ্রহ করতেনই তিনি, এ বার শুরু হয় বাঙালির একদা-দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিসপত্রের চয়ন। গান্ধীর ছবি আঁকা সিঁদুরকৌটো, নারকেল কুরুনি (ছবিতে), আমসত্ত্বের ছাঁচ, কাঠের দোয়াতদান, দুধ-বদনা, পেতলের পানের বাটা, গরুর গলার কেঠো ঘণ্টা, ক্ষুর শানানোর কাচের হোন, গোলোকধাম খেলার ছক, টি-শেপের চামড়ার ফুটবল-সহ অগণিত সংগ্রহ। এই সব নিয়েই গীতাঞ্জলি মেট্রোর কাছে নিউ সোনালি পার্কের ‘ইতিকথা’ বাড়িতে ‘তারার ছায়ায়’ নামে সংগ্রহশালা খুলছেন তিনি, সঙ্গে একটি লাইব্রেরি ও আর্কাইভও। আগামী কাল ২৯ জানুয়ারি সকাল সাড়ে ১০টায় উদ্বোধন, বিশিষ্টজনের উপস্থিতিতে।
ছড়ার ছবি
গত বছর জানুয়ারিতে প্রয়াত হয়েছেন নারায়ণ দেবনাথ, তাঁর স্মরণে অভিনব এক ক্যালেন্ডার প্রকাশ করেছে এস পি কমিউনিকেশনস প্রিন্টিং প্রেস। বাংলার প্রচলিত, জনপ্রিয় ও শিশুতোষ নানা ছড়ার সঙ্গে নারায়ণ দেবনাথের ক্যালিগ্রাফি আর অলঙ্করণে সমৃদ্ধ ক্যালেন্ডারটি। বাঁটুল, হাঁদাভোঁদা, নন্টে-ফন্টের মতো জনপ্রিয় কমিক্স চরিত্র সৃষ্টির পাশাপাশি নারায়ণ দেবনাথ যে অজস্র গ্রন্থ-অলঙ্করণ ও ক্যালিগ্রাফির সম্ভারও রেখে গিয়েছেন, এই প্রজন্মের অনেকেরই অজানা তা। সেই অজানা নারায়ণ দেবনাথকেই সকলের কাছে পৌঁছে দেওয়ার আন্তরিক প্রয়াস— চাঁদ উঠেছে ফুল ফুটেছে, হাট্টিমা টিম টিম, আয়রে আয় টিয়ে, আদুড় বাদুড় চালতা বাদুড়, খোকা যাবে শ্বশুরবাড়ি, খোকা গেছে মাছ ধরতে, তাঁতির বাড়ি ব্যাঙের বাসা (ছবিতে), এমন হরেক প্রচলিত বাংলা ছড়ার শিল্পী-কৃত অলঙ্করণ ও ক্যালিগ্রাফি দিয়ে সাজানো ক্যালেন্ডার। মূল সঙ্কলনটি বেরিয়েছিল সত্তর দশকের গোড়ায়। বিশদ তথ্য সুচিত্র ডট কম ওয়েবসাইটে।
হাসির ছলে
পশু থেকে মানুষ, রাতের অন্ধকারে সবাই বেরিয়েছে— খাবারের সন্ধানে, বেঁচে থাকার ন্যূনতম প্রচেষ্টায়, সম্পত্তি অর্থ বা ক্ষমতা বাগানোর লিপ্সায়। সকলে জড়ো হয় একটা কাঁঠাল গাছের নীচে, তা-ই হয়ে ওঠে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের ক্ষেত্র, সাক্ষীও। এই নিয়েই মনোজ মিত্র রচিত ও নির্দেশিত নাটক নৈশভোজ। আশির দশকের মাঝামাঝি লেখা এ নাটক গ্রন্থাকারে বেরোয় ১৯৮৬ সালে, সে বছরেই জানুয়ারিতে প্রথম অভিনয় রবীন্দ্র সদনে। সাড়ে তিন দশক পরে আবারও শহরের মঞ্চে ‘সুন্দরম’-এর এই নাট্যপ্রযোজনা, নবপর্যায়ে চতুর্থ অভিনয় আগামী কাল ২৯ জানুয়ারি মিনার্ভা থিয়েটারে, সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায়। সমসময়ের আদর্শহীন রাজনীতি, চটুল সামাজিকতার দিকে আঙুল তোলে এই নাটক, হাসির ছলে।