বেপরোয়া রদবদলে ও ভাঙচুরে ছোট-বড় গুদামঘরে হতশ্বাস (ছবিতে) এ স্থাপত্যটি আজ প্রায় চেনাই যায় না (ইনসেটে পুরনো বাড়িটি)।
সরলা দেবী জীবনের ঝরাপাতা-য় লিখছেন, তার উদ্যোগে প্রথম রবীন্দ্র-‘জন্মদিন উৎসব’ পালিত হয়। ইংরেজি তারিখ হিসাবে তা ৭ মে, ১৮৮৭। লিখছেন, “সেই বছর থেকে পরিজনদের মধ্যে তাঁর জন্মদিনের উৎসব আরম্ভ হল।” সে সময় সত্যেন্দ্রনাথের পরিবারের সঙ্গে একত্রে বাস করছিলেন রবীন্দ্রনাথ ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, ৪৯ নং পার্ক স্ট্রিটের বাড়িতে। এই বাড়িটির ‘বর্তমান অবস্থা’ কী, আমরা কি জানি? নন্দন-রবীন্দ্রসদনে যাওয়ার পথে ক্যালকাটা ক্লাব পেরোনোর সময় ক’জনের মনে হয়, এই চত্বরেই ছিল সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাড়াবাড়ি, যার চাতালে মঞ্চ বেঁধে ১৮৮৯-এ রাজা ও রাণী নাটকের প্রথম অভিনয়, ছিলেন মৃণালিনী দেবী জ্ঞানদানন্দিনী দেবী সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ নিজেও! ইন্দিরা দেবীর রবীন্দ্র স্মৃতি, অবনীন্দ্রনাথের ঘরোয়া-তেও উল্লেখ আছে এ বাড়ির।
আসলে জোড়াসাঁকোর বাড়ি আর এখন এক হোটেলে পাল্টে যাওয়া ১০ নং সদর স্ট্রিটের বাড়ি ছাড়া, এই পরিবারের কৃতী মানুষদের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা নানা বাড়িগুলি সম্পর্কে সচেতনতা নেই আদৌ। আমাদের ঔদাসীন্যে মুছে গেছে, হারিয়ে গেছে এই স্মৃতিসদনগুলি। ৪৯, ৫০ ও ৫২/২ পার্ক স্ট্রিটে ঠাকুর পরিবারের তিনটি বাড়ি ছিল, এই তিনটি ঠিকানার ‘বর্তমান অবস্থা’ সম্পর্কে পুরসভার হেরিটেজ তালিকা নীরব। ২০১৪ সালে ভেঙে ফেলা হয় মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের কন্যা ও জামাতা, স্বর্ণকুমারী দেবী ও জানকীনাথ ঘোষালের সানি পার্কের বাড়ি, যা সম্ভবত ছিল শহরের শেষ বাউহাউস স্থাপত্যের নিদর্শন। অবনীন্দ্রনাথের জীবদ্দশাতেই ভেঙে ফেলা হয়েছিল জোড়াসাঁকোর ৫ নম্বর বাড়ি, তাঁর প্রিয় দক্ষিণের বারান্দা। তাঁর শেষ জীবন কাটে বরাহনগরে গুপ্ত নিবাসে, এখন যা ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট-এর অধীনে। এই বাড়িটির আশু সংস্কার ও সংরক্ষণ প্রয়োজন।
এখনও সম্পূর্ণ মুছে না গেলেও, দ্রুত এক করুণ পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দ্বারকানাথ ঠাকুরের বিখ্যাত বেলগাছিয়ার বাগানবাড়ি। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ এই সম্পত্তি কান্দি-পাইকপাড়ার সিংহ পরিবারের কাছে বিক্রি হয়ে দেওয়ার পরেও বাংলা নাট্যচর্চা-সহ উনিশ শতকের ইতিহাসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই স্থানটির মাহাত্ম্য অমলিন ছিল। বেপরোয়া রদবদলে ও ভাঙচুরে ছোট-বড় গুদামঘরে হতশ্বাস (ছবিতে) এ স্থাপত্যটি আজ প্রায় চেনাই যায় না (ইনসেটে পুরনো বাড়িটি)। রবীন্দ্রনাথ ‘বিবিধ প্রসঙ্গ’ প্রবন্ধে লিখছেন, “নূতন বাড়ির চেয়ে যে বাড়িতে দুই পুরুষে বাস করিয়াছে সেই বাড়ির যেন বিশেষ একটা কী মাহাত্ম্য আছে! মানুষের প্রেম যেন তাহার ইঁটকাঠের মধ্যে প্রবেশ করিয়া আছে এমনি বোধ হয়।” এই ভাবনাকে সামনে রেখেই ঠাকুর পরিবারের নানা সদস্যের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা, শহরের ঐতিহ্যশালী বাড়িগুলি সংরক্ষণে এখনই সচেষ্ট হওয়া দরকার। যে স্থাপত্যগুলি এখনও দাঁড়িয়ে আছে, সরকার ও নাগরিক গোষ্ঠীর অংশগ্রহণে সেগুলির রক্ষণ, সংরক্ষণ, সদ্ব্যবহার হোক। ঐতিহ্যের জীবন্ত পাঠশালা হয়ে উঠবে কলকাতা।
দক্ষিণী ৭৫
এই গানের ইস্কুলের অনুষ্ঠানে শুরুর সময় পেরিয়ে ঢুকতে গেলে বিপদ। মহড়াকক্ষের দরজাও ঠিক সময়ে বন্ধ, দেরিতে এলে খুলবে না। সময়নিষ্ঠা ও সঙ্গীত-সাধন, দুই আদর্শেরই মূর্ত প্রতিষ্ঠান ‘দক্ষিণী’। ১৯৪৮ সালের পঁচিশে বৈশাখ যাত্রা শুরু শুভ গুহঠাকুরতার এই স্বপ্নের প্রতিষ্ঠানের, তাঁর সাঙ্গীতিক প্রজ্ঞা আর কঠোর পরিশ্রম সাকার করেছে সে স্বপ্ন। পঁচাত্তর বছরের উৎসব শুরু হল গত ১ মে, রবীন্দ্রসদনে। ২০২৪-এর মার্চ পর্যন্ত অনুষ্ঠিতব্য প্রধান অনুষ্ঠানগুলির নির্ঘণ্টও প্রকাশিত— কী নেই বছরভর সেই আয়োজনে: কলকাতার নানা মঞ্চে গীতিনাট্য, নৃত্যনাট্য, বর্ষামঙ্গল, রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মেলন, আরও কত কী। প্রকাশিত হয়েছে প্ল্যাটিনাম জয়ন্তী বর্ষ সাহিত্যপত্র, তার প্রচ্ছদ, অলঙ্করণ আর সুদৃশ্য ‘দক্ষিণী ৭৫’ লোগোটি (ছবি) করেছেন শিল্পী শুভব্রত নন্দী (মূল লোগোটি সত্যজিৎ রায়ের করা)। সুদেব গুহঠাকুরতার নেতৃত্বে সঙ্গীতপথে আগুয়ান দক্ষিণী, সঙ্গী শিল্পীগোষ্ঠী, শুভানুধ্যায়ীরা।
জল নিয়ে
বৈশাখের গোড়াতেই তাপমাত্রা বিয়াল্লিশ ডিগ্রি ছুঁয়েছে। পরিবেশবিদদের মতে, এ হল জলবায়ু পরিবর্তনেরই ফল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পরিস্থিতিতে বাঁচার অন্যতম উপায় জলাভূমি সংরক্ষণ। এর মধ্যেই চলে গেল বসুন্ধরা দিবস। কলকাতার ভবিষ্যৎ অস্তিত্বের জন্য জলাভূমির গুরুত্বের পাশাপাশি আর্থিক ভাবে দুর্বল নাগরিকদের উপর প্রতিকুল পরিবেশের প্রভাবের কথা মনে করিয়ে দিতে গত ২২ এপ্রিল পাটুলির দীনেশ মজুমদার মিলনগৃহে ‘জলাদর্শ কালেক্টিভ’ আয়োজন করেছিল অনুষ্ঠান ‘ফ্লোজ় বিয়ন্ড ব্যারিয়ারস’। বৃজি-পাটুলি মৎসজীবী সমবায় সমিতির সাহায্যে এলাকার জলাশয় পরিষ্কার করা হল। ছিল পরিবেশ-ভাবনা নিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান; আলোচনা, ছবি, খাবারও।
কারা-কথা
কফি হাউসের বই-চিত্র সভাঘরে অন্যতর এক বই প্রকাশ অনুষ্ঠান হয়ে গেল গতকাল, ৫ মে। লেখিকা বেল্লাপু অনুরাধা এক সময় বন্দি ছিলেন হাজারিবাগ সেন্ট্রাল জেলে, বন্দিজীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই লেখেন ১৭টি ছোট গল্প, আত্মকথন— তেলুগু ভাষায়। তার ইংরেজি অনুবাদ প্রিজ়ন নোটস অফ এ উওম্যান অ্যাক্টিভিস্ট-এর বাংলা রূপ কারাগার থেকে বলছি: বন্দি মেয়েদের কথা। রাজবন্দিদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তৈরি সংগঠন ‘কমিটি ফর দ্য রিলিজ অব পলিটিক্যাল প্রিজ়নার্স’-এর পশ্চিমবঙ্গ শাখা বইটির প্রকাশক। ছিলেন সত্তর দশকের রাজবন্দি, মানবাধিকার আন্দোলনের কর্মী কৃষ্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘রাজবন্দির সে কাল এ কাল’ বিষয়ে বললেন সংগঠনের সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি, মানবাধিকার কর্মী সুজাত ভদ্র।
বিচিত্র পথে
নাটক প্রথম প্রেম, শেখর চট্টোপাধ্যায় সফল চলচ্চিত্রজগতেও। বসন্ত বিলাপ, মৌচাক, মর্জিনা আবদাল্লা, দেবী চৌধুরানী ছবির চিত্রনাট্য লিখেছেন, অভিনয় করেছেন গান্ধী, ভুবন সোম ছবিতে, তাঁর পরিচালিত ছবি পেয়েছে জাতীয় পুরস্কার। চিত্রনাট্যকার, অভিনেতা, নির্দেশক, লেখক শেখর চট্টোপাধ্যায়ের জন্মশতবর্ষ শুরু হল গতকাল, ৫ মে। আন্তর্জাতিক ব্রেশট সোসাইটি-র সদস্য, সঙ্গীত নাটক অকাদেমি সম্মানে ভূষিত শেখরবাবু তৈরি করেছেন নাট্যদল থিয়েটার ইউনিট ও ইউনিটি থিয়েটার, মঞ্চস্থ করেছেন পন্তু লাহা, আরটুরো উই, আজ যুদ্ধ ঘোষণার দিন-এর মতো নাটক। ইন্দুমতী সভাগৃহে গতকাল সন্ধ্যায় এসেছিলেন বিশিষ্টজন। ছিল ওঁর ছবির অংশ, নাটকের ভিডিয়ো, গান, অডিয়ো সাক্ষাৎকার; বিবেক গুহ সম্পাদিত বই শেখর চট্টোপাধ্যায়: জীবন ও নাট্যভাবনা— কবিতা, ছবি, ডায়েরির পাতায় সাজানো।
প্রথম দেখা
গ্রামের পড়ুয়ারা যাতে স্কুলছুট না হয়, এ যদি হয় উদ্দেশ্য, তবে বিধেয়ও থাকে কিছু, যেমন তাদের এমন জায়গা ঘুরিয়ে দেখানো যেখানে চার দিকে ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর বইয়ের দোকান। সে কাজটিই করল শুধু সুন্দরবন চর্চা পত্রিকা। সুন্দরবনে গোসাবার বালি দ্বীপের বিজয়নগরে বিবেকানন্দ ফার্মারস ক্লাবে রয়েছে ‘শুধু সুন্দরবন চর্চা লাইব্রেরি’, গ্রামের ছেলেমেয়েরা বই ও পত্রিকা পড়ে, বাড়ি নিয়ে যায়। লাইব্রেরির পঁচিশ খুদে সদস্য গত ২ মে ঘুরে দেখল বইপাড়া, প্রেসিডেন্সির মিউজ়িয়ম, লাইব্রেরি— এই প্রথম। লালমাটি প্রকাশনীর ‘বর্ণ-বইমহল’-এ তারা যোগ দিল অনুষ্ঠানে, উপহার পেল বই।
কালবেলা
প্রকাশক পরিচয়েই সর্বাধিক পরিচিত তিনি। আবার প্রকৃত রসিকজন জানেন তাঁর কবিতার কথা, এমনকি থিয়েটারে লাইটিং ডিজ়াইন নিয়ে তাঁর কাজের কথাও। এত সব কাজ ও পরিচিতির মধ্যে নবীন কিশোরের আলোকচিত্রী সত্তাটি তত আলোচিত নয়। অথচ ক্যামেরা হাতে, বিষয় ও ভাষা নিয়ে তাঁর পরীক্ষানিরীক্ষা দীর্ঘ। সাম্প্রতিক কিছু ছবিতে উঠে এসেছে চার পাশের জীবন, যাপন, হিংসার বয়ান— প্রান্তিক বলে সচরাচর চোখে পড়ে না যাদের। ইমামি আর্ট ও ‘চ্যাটার্জি অ্যান্ড লাল’-এর যৌথ উদ্যোগে ইমামি আর্টে চলছে নবীন কিশোরের আলোকচিত্র প্রদর্শনী ‘ইন আ ক্যানিব্যাল টাইম’, চার পর্বে বিন্যস্ত (ছবিতে তারই একটি)। ২৮ এপ্রিল শুরু হয়েছে, চলবে ২৫ জুন পর্যন্ত। শুরুর দিনটিতে ছিল অনুষ্ঠানও, শিল্পীর সঙ্গে কথালাপে ছিলেন রঞ্জিত হসকোটে।
চন্দনরাগে
“গোপাল কহে পুরী আমার তাপ নাহি যায়/ মলয়জ চন্দন লেপ তবে সে জুড়ায়...” কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামীর শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত-তে আছে, মাধবেন্দ্র পুরী তাঁর আরাধ্য গোপালের জন্য নীলাচল থেকে চন্দন নিয়ে বৃন্দাবন ফেরার পথে রেমুণা-তে গোপীনাথ বিগ্রহে সেই চন্দন লেপন করেন, পালন করেন আরাধ্যের আদেশ। স্কন্দপুরাণ-এর উৎকলখণ্ডে আছে, পুরীর রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নকে অক্ষয়তৃতীয়ায় শ্রীবিগ্রহে চন্দন লেপনের আদেশ দেন স্বয়ং জগন্নাথ। গ্রীষ্মে শ্রীবিগ্রহে চন্দন লেপনের এই বৈষ্ণব পরম্পরা মেনে বাগবাজারের কালীপ্রসাদ চক্রবর্তী স্ট্রিটে গৌড়ীয় মিশনে অক্ষয়তৃতীয়ার দিন থেকে শুরু হয়েছে শ্রীকৃষ্ণের ‘চন্দনশৃঙ্গার’। একুশ দিন ব্যাপী মহোৎসবে চন্দন লেপনের পর প্রতি দিন নানা বেশে সেজে উঠছেন শ্রীকৃষ্ণ, যেমন— নটবর, রাজাধিরাজ, খটদোলী, চক্রনারায়ণ, নৌকেলী, রাসমণ্ডল বেশ ইত্যাদি (ছবিতে গোমতীকৃষ্ণ বেশ)। প্রতি দিন সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত বিগ্রহ দর্শন করা যাবে, শোনা যাবে শ্রীমদ্ভাগবত-কথা, সঙ্কীর্তন, চন্দনযাত্রা মাহাত্ম্যকথা, দেখা যাবে আরতি, নৃত্য। এই সব কিছুই আগামী ১৩ মে পর্যন্ত।
দিশারি
১৯৮৩ সালে পথ চলা শুরু ‘প্রতিক্ষণ’-এর, প্রিয়ব্রত দেব তখন পঁয়তাল্লিশ। আর অতিমারির ঠিক আগে ২০২০-র বইমেলায় যখন তাঁর প্রত্যক্ষ ক্রিয়তায় বেরোচ্ছে অনেকগুলো বই, তখন তিনি ‘অশীতিপর’, যে শব্দটি কদাপি মানায়নি, মানায় না তাঁকে। প্রতিক্ষণ পত্রিকা ও প্রকাশনা এই কয়েক দশকের সময়কালে ভাষা-সাহিত্য-গ্রন্থ প্রকাশনা’সহ বাংলার মননজগতে রেখেছে এক বিপুল প্রভাব: স্বপ্ন দেখার ও দেখানোর, আন্তর্জাতিক গুণমানের একের পর এক কাজে সে স্বপ্ন সম্ভব করার। জীবনপ্রেমী, কর্মিষ্ঠ, রসিক, লেখকবৎসল মানুষটি চলে গেলেন গত ১৩ এপ্রিল; বাংলা আকাদেমি সভাঘর ২ মে সন্ধ্যায় ভরিয়ে দিয়েছিলেন ওঁর গুণমুগ্ধজন। স্মরণ সে তো অবশ্যই, সঙ্গে ছিল আগামীর অঙ্গীকারও— ওঁর করে দেওয়া, দেখিয়ে যাওয়া পথে সসম্মান চলার।