বন্দুক প্রথম বার ছুড়তে গিয়ে নিজে উল্টে পড়া বা হতভম্ব হয়ে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। তবে এক বর্ষণমুখর বিকেলে কোচবিহারের দেওয়ান কালিকাদাস দত্তের কিশোর পুত্র চারুচন্দ্রের অভিজ্ঞতা অন্য রকম। একটা ছোট রাইফেল নিয়ে মজা করতে গিয়ে বাড়ির অতিথিকে কেউ বলেছিল, “আসুন ঘোষ সাহেব, আপনিও মারুন।” কোনও দিন বন্দুক ধরেননি, কারণ দেখিয়ে অতিথি গোড়ায় রাজি হচ্ছিলেন না। বারংবার অনুরোধে বন্দুক ধরলেন, তার পর নিশানা করার কায়দা দেখিয়ে দিতেই এক বার নয়, বার বার লক্ষ্যভেদ! নিশানা ছিল দেশলাইকাঠির মাথা! পরবর্তী জীবনে আইসিএস, বিশ্বভারতীর উপাচার্য ও পন্ডিচেরির আশ্রমে কর্মকাণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা চারুচন্দ্র দত্ত এ ঘটনার উল্লেখ করে স্মৃতিকথায় লিখেছেন, অমন লোকের যোগসিদ্ধি হবে না তো কি তোমার আমার হবে!
সে দিনের সেই অতিথি— শ্রীঅরবিন্দ। ভারতমনীষী এই মহাযোগীর জন্মের সার্ধশতবর্ষ পূর্তি আগামী ১৫ অগস্ট। থিয়েটার রোডের (এখন শেক্সপিয়র সরণি) ৮ নম্বর বাড়িতে তার জন্ম, সেখানেই অরবিন্দ- জন্মশতবর্ষে প্রতিষ্ঠা শ্রীঅরবিন্দ ভবনের। সমাধিবেদিতে স্থাপনের জন্য রাজ্যের প্রতিনিধিদের হাতে শ্রীমা তুলে দিয়েছিলেন তাঁর পূত দেহাবশেষ (ছবিতে ১৯৭৩ সালের ১৫ জানুয়ারি দমদম এয়ারপোর্টে তা নিয়ে এ এল ডায়াস ও শঙ্করপ্রসাদ মিত্র)। পূর্ব ভারতে অরবিন্দ চর্চায় অগ্রণী এই প্রতিষ্ঠান— গবেষণা, আলোচনা, প্রকাশনা-সহ বহুবিধ কর্মকাণ্ডে। এ বছর দিনটি বিশেষ: ভারতের স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর ও শ্রীঅরবিন্দের জন্মসার্ধশতবর্ষের সানন্দ উদ্যাপন। ১৫ অগস্ট ভোর ৪টে ৫২ মিনিটে শ্রীঅরবিন্দের জন্মমুহূর্ত স্মরণে সমবেত শঙ্খধ্বনি, সকালে আলিপুর জাজেস কোর্ট মিউজ়িয়মে ও ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সামনে অরবিন্দ-মূর্তিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য, ছাত্রছাত্রীদের ব্যান্ডবাদনে ‘বন্দে মাতরম্’, সকাল ১১টায় মূল অনুষ্ঠানে মাননীয় রাজ্যপালের উপস্থিতিতে শ্রীঅরবিন্দকে নিয়ে ডাক বিভাগের ‘স্পেশাল কভার’ উদ্বোধন, বাংলা, ইংরেজি ও সংস্কৃতে উল্লেখযোগ্য কাজের জন্য শ্রীঅরবিন্দ পুরস্কার ঘোষণা। দুপুরে আলিপুর সংশোধনাগারে অরবিন্দের স্মৃতিধন্য কারাকক্ষে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন, সন্ধ্যায় অরবিন্দ ভবনে জয়ন্তী প্রার্থনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
কারাবাসী বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষের সঙ্গে জড়িয়ে কত ঐতিহাসিক সংঘটন-স্মৃতি: ক্ষুদিরাম বসুর ফাঁসি, প্রফুল্ল চাকীর আত্মবলিদান, বারীন ঘোষ ও তাঁর সঙ্গীদের বিপ্লবী আন্দোলন... এ সবের ভিতর থেকেই জেগে উঠল এক নতুন মানুষ— ঋষি অরবিন্দ। এই অভিযাত্রা নিয়ে অভিজিৎ দাশগুপ্ত তৈরি করেছেন তথ্যচিত্র দ্য ট্রান্সফরমেশন, হিন্দিতে নয়া জনম, অরবিন্দ সোসাইটি ও সুকৃতি ফাউন্ডেশন-এর যৌথ উদ্যোগে। তথ্যচিত্রসূত্রে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মানে ভূষিত অভিজিৎবাবু ছবি নির্মাণে নির্ভর করেছেন সেই সময়ের তথ্য, নথি, সাময়িকপত্র, অরবিন্দ-রচনার উপর। দূরদর্শনে ন্যাশনাল নেটওয়ার্কে ১৪ ও ১৫ অগস্ট দেখা যাবে ছবিটি।
স্মরণে, মননে
স্বাধীন ভারতের পঁচাত্তর, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর একশো পঁচিশ— দুই ঐতিহাসিক সংঘটনের সমাপতন এ বছরকে করেছে বিশেষ উদ্যাপনীয়। নেতাজি রিসার্চ বুরো নেতাজি ভবনে তা পালন করছে ৫ থেকে ১৪ অগস্ট, বিবিধ কর্মকাণ্ডে। ২০১৯-এর ৫ অগস্ট-উত্তর কাশ্মীরের এষণা চলেছে কৃষ্ণা বসু নামাঙ্কিত আলোচনাচক্রে; শরৎচন্দ্র বসু স্মারক বক্তৃতায় প্রকটিত অভিবাসন নিয়ন্ত্রণের অগণতান্ত্রিক রূপ। প্রমিতা মল্লিক ও ‘বৈকালী’-র সঙ্গীতার্ঘ্য, আইএনএ’র সংগ্রাম-আধারিত অংশুল চতুর্বেদীর উপন্যাস আ বার্ড ফ্রম অ্যাফার নিয়ে আলাপ পেরিয়ে, আজ সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় ‘ম্যাকমাহন লাইন থেকে বাংলাদেশ’ নিয়ে বলবেন সম্রাট চৌধুরী। আগামী কাল সন্ধ্যা ৬টায় নেতাজি: সুভাষচন্দ্র বোস’স লাইফ, পলিটিক্স অ্যান্ড স্ট্রাগল (পিকাডর ইন্ডিয়া) গ্রন্থপ্রকাশ (ছবিতে প্রচ্ছদ)— কৃষ্ণা বসুর লেখার ইংরেজি অনুবাদ ও সম্পাদনায় সুমন্ত্র বসু।
বহুস্রোতা
বাংলা ভাষার বিবর্তনমূলক একটি অভিধান তৈরির কাজে যুক্ত তিনি, সে সূত্রেই বলছিলেন অধ্যাপক সুকান্ত চৌধুরী— প্রত্যহ তিনি সম্মুখীন বাংলা ভাষার অজস্র ধারার: হুতোম থেকে সুধীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ থেকে নবারুণ। সাহিত্য, সাহিত্যিক ও সময়ভেদে একটি ধারা মিশে যাচ্ছে ভিন্ন কোনও স্তরে; গুরুতে মিশছে চণ্ডাল, কথ্যে লেখ্য, শিষ্টে অশিষ্ট। মূল স্রোতের বাইরে যখন এ ভাবেই চলে আসে ভাষা, তখনই “সে চোখে পড়ে, মনে দাগ ফেলে, কাজ আদায় করে নেয়।” এল যন্ত্রমেধার প্রসঙ্গও, মানুষকে ব্যবহার করতে হচ্ছে যন্ত্র ও আন্তর্জাল; যন্ত্রের সংশ্লেষের গুণ আর মানুষের বিশ্লেষণের, একে অন্যের পরিপূরক, যন্ত্র দশটা গন্ধমাদন নিয়ে আসতে পারলেও, বিশল্যকরণী খুঁজে বার করার কাজ মানুষের হাতেই। বিশিষ্ট ভাষাবিদ সুভদ্র কুমার সেনের স্মৃতিতে আয়োজিত স্মারক বক্তৃতা হয়ে গেল গত ৭ অগস্ট সন্ধ্যায় বাংলা আকাদেমি সভাঘরে, বিষয়: ‘শব্দের সালতামামি’।
সুরমূর্ছনা
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো শিল্পী অভিনেতার পছন্দ ছিল তাদের কাজ, সময় বার করে চলে আসতেন সুরের টানে। এই সময়ে কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের বড় স্ট্রিং অর্কেস্ট্রার দল তারাই— ‘কলকাতা ইয়ুথ অঁসম্বল’ (কেওয়াইই)। শহরের সুরমহলে চর্চিত এ প্রতিষ্ঠানের পুরোধা অমিতাভ ঘোষের নেতৃত্বে অন্য রকম এক বৃন্দবাদন-সন্ধ্যার আয়োজন আজ ১৩ অগস্ট বিকেল সাড়ে ৫টায় মধুসূদন মঞ্চে— একশো জন বেহালাশিল্পীর পরিবেশনা, বাঁশি সেতার তবলা পাখোয়াজের সঙ্গত-সমাহারে। শোনা যাবে পাশ্চাত্য ও ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, কালজয়ী কিছু গানের ভোকাল সিম্ফনিও। শিল্পীরা— ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, গবেষক, এমনকি পুলিশ আধিকারিক— হবেন সুরমগ্ন।
শতবর্ষ পরে
ঠিক একশো বছর আগে, ১৯২২ সালের ১৬ অগস্ট রামমোহন লাইব্রেরি হল-এ নৃত্যগীতে ‘বর্ষামঙ্গল’ অনুষ্ঠিত হয়েছিল স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের প্রত্যক্ষতায়। শতবর্ষ পরে সেই দিনেই, আগামী মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে ৫টায় রামমোহন লাইব্রেরি অ্যান্ড ফ্রি রিডিং রুম আয়োজন করেছে অনুষ্ঠান ‘শতবর্ষে বর্ষামঙ্গল’— ইতিহাসেরই সিংহাবলোকন। অন্য দিকে, রবীন্দ্রনাথের পল্লি-পুনর্গঠন ভাবনার মূর্ত রূপ শ্রীনিকেতনের শতবর্ষ পূর্তিতে, সেই সঙ্গে বাইশে শ্রাবণ স্মরণেও সুজয়প্রসাদ চট্টোপাধ্যায় ও ‘এসপিসিক্রাফ্ট’-এর উদ্যোগে গত ৬ অগস্ট আইসিসিআর-এ হল দু’টি নিবেদন: ‘শতবর্ষে শ্রীনিকেতন’ ও ‘তবুও শান্তি তবু আনন্দ’— স্তোত্রপাঠ বাচিক পরিবেশনা গীতি-অর্ঘ্যে; অপর্ণা সেন প্রমিতা মল্লিক উমা দাশগুপ্ত মমতাশঙ্কর ও বিজয়লক্ষ্মী বর্মণকে সম্মাননা অর্পণের স্নিগ্ধতায়।
তারও ৭৫
এলগিন রোডের বৈভব নেতাজি ভবন, সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিধন্য বৈতানিক-ও। ১৯৪৮-এর ৭ অগস্ট জোড়াসাঁকোয় শুরু তার, রবীন্দ্রশতবর্ষ থেকে আজকের ঠিকানায়। রবীন্দ্রচর্চায় মগ্ন পঁচাত্তর বছরের এই অভিযাত্রা উপলক্ষে তাদের ন’দিন ব্যাপী অনুষ্ঠান চলছে গত ৭ অগস্ট থেকে, নিজস্ব মঞ্চে। বিশিষ্ট শিল্পী ও সংস্কৃতি চর্চা প্রতিষ্ঠানের সদস্যদের গান, অভিনয়, আবৃত্তি, নৃত্য পরিবেশনা হয়েছে, সুদেব গুহঠাকুরতা অজয় চক্রবর্তী পূর্ণিমা ঘোষ স্বপনকুমার ঘোষ-সহ গুণিজনের উপস্থিতিতে। আগামী কাল সন্ধ্যা ৬টা-৮টা গীতবিতান দক্ষিণী ইন্দিরা সুরঞ্জনী রবীন্দ্রভারতী সোসাইটির সম্মেলক নিবেদন, ১৫ অগস্ট একই সময়ে স্মারক বক্তৃতা, পলি গুহের নির্দেশনায় স্বাধীনতার উদ্যাপনে নৃত্যানুষ্ঠান।
ভারতচিত্র
আইসিসিআর, অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস আর নজরুলতীর্থ— শহরের তিন শিল্প-প্রদর্শশালায় এক অভিনব প্রদর্শনী— হিন্দুস্তান ফাইলস: ভারতবর্ষ ১৭৫৭-১৯৫০। স্কেচ, ছবি, ফোটো, নথি, পাণ্ডুলিপি, চিঠির মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ-অধ্যুষিত ভারতের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা, পরাধীনতার যন্ত্রণা, মুক্তির লড়াই ও আনন্দছবি স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছরে এ কালের দর্শকদের সামনে তুলে ধরাই উদ্দেশ্য। দেখা যাবে উইলিয়াম বেইলি, চার্লস ডয়েলি, জেমস ফ্রেজ়ার, টমাস ও উইলিয়াম ড্যানিয়েলের আঁকা ছবি; টিপু সুলতান ওয়ারেন হেস্টিংস কর্নওয়ালিস থেকে রামমোহন রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিদীপ্ত নথি ও চিত্র, স্বাধীনতা সংগ্রামের স্মৃতিবহ আলোকচিত্র। বিদেশের নিলাম থেকে বহু গুরুত্বপূর্ণ নথি সংগ্রহ করেছেন গণেশপ্রতাপ সিংহ, তাঁর উদ্যোগে ও ‘ভিরাসত আর্ট’ প্রকাশনার প্রয়াস— আইসিসিআর-এ উদ্বোধন আগামী কাল বিকেল ৫টায়; ৩০ অগস্ট পর্যন্ত। নীচে ছবিতে হেস্টিংসের ইমপিচমেন্ট।
তর্পণ
“শাঁওলীদির প্রিয় উপন্যাস রবীন্দ্রনাথের ঘরে বাইরে, বহুরূপী-র প্রযোজনাটিতে বিমলা চরিত্র করতেন তিনি। তাঁর প্রেরণাতেই সমসময়ের পরিপ্রেক্ষিতে নতুন ভাবে নাট্যরচনা করেছি,” বলছিলেন ‘পঞ্চম বৈদিক’-এর কর্ণধার অর্পিতা ঘোষ, তাঁরই নির্দেশনায় ২২ অগস্ট শম্ভু মিত্রর জন্মদিন উপলক্ষে মঞ্চস্থ হবে ঘরে বাইরে, অভিনয়ে অনির্বাণ ভট্টাচার্য অর্ণ মুখোপাধ্যায় সোহিনী সরকার। অ্যাকাডেমি মঞ্চে নাট্যদলটির ১৬-২২ অগস্টের উৎসব শাঁওলী মিত্র (ছবিতে) স্মরণে: ‘তর্পণ’। ১৭ অগস্ট সন্ধ্যায় শাঁওলীরই গদ্য ও নাটক থেকে নির্বাচিত সঙ্কলনের পাঠ-অভিনয় ‘দিদৃক্ষা’, নতুন প্রকাশনা ‘সপর্যা’ থেকে বেরোবে নাথবতী অনাথবৎ। শাঁওলীকে নিয়ে থাকছে তথ্যচিত্রও: ছিন্ন স্মৃতি, ভাবনা ও বিন্যাসে দেবেশ চট্টোপাধ্যায়। দেবেশেরই আলোচনা উৎসবের প্রথম দিন তৃপ্তি মিত্র নাট্যগৃহে: ‘অভিনেতার স্মৃতি ও অনুভূতি’। এ ছাড়াও মঞ্চস্থ হবে নটধা নাট্যদলের অথৈ, সংসৃতি-র নাটক ১৯৮৪? ও শের আফগান, পঞ্চম বৈদিক-এর অচলায়তন, কারুবাসনা, ভিট্টন ও আমোদিত রোদ্দুর।
পাশে থাকা
‘মৃত্যুতে মানুষ মুছে যায় না/ সে থাকে, সে থাকে’… বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায় গানে সুরে ছকভাঙা স্মরণ। শোক ছাপিয়ে ভালবাসার টানে আরও অনেকের পাশে থাকার সঙ্কল্প আসলে। অকালপ্রয়াত রায়া দেবনাথের নামাঙ্কিত স্মারক বক্তৃতায় এই দেশ ও রাজ্যের প্রান্তিক মেয়েদের কর্মক্ষেত্রের সঙ্কট নিয়ে সম্প্রতি বললেন অনিতা অগ্নিহোত্রী: কোভিডকালে মেয়েদের কাজের পরিসর ছোট হয়ে আসছে, ক্ষুণ্ণ হচ্ছে মৌলিক অধিকার। রায়া দেবনাথ স্মৃতিরক্ষা সমিতি-র বার্ষিক পত্রিকা ‘আই রাইজ়’-এও উঠে এসেছে মেয়েদের অধিকারের কথা।