পুব দিকের সবুজ বনের মাথায় কাজলা কালো মেঘ আমার এত ভালো লাগছে কেন?... কারণ আর কিছুই নয়, একই সত্তার একটি চেতনার একপ্রান্ত হল ওই মেঘ, আর একদিকে আমি, তাই মেঘের সুখ আমাতে অথবা আমার দুঃখ মেঘে সঞ্চারিত হচ্ছে।” লিখছেন নন্দলাল বসু। তাঁর জীবন ও শিল্পবোধে শ্রীরামকৃষ্ণ রবীন্দ্রনাথ অবনীন্দ্রনাথ সকলের পরশ, প্রকৃতি ও মানুষকে দেখার অন্য চোখ তৈরি করে দিয়েছিলেন তাঁরা। মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে সম্পর্কও জরুরি প্রভাব এক, তাঁর সংস্পর্শে এসে গড়ে ওঠে বহু স্বদেশচিত্র। এই সবই ধরা অজস্র কার্ড-চিত্র, ছোট-বড় ছবিতে। শিল্প-ইতিহাসবেত্তা দেবদত্ত গুপ্ত শিল্পীর পোস্টকার্ড, স্কেচ কার্ড ও বড় ছবি-সহ প্রায় আশিটি চিত্রকৃতি নিয়ে কিউরেট করেছেন প্রদর্শনী ‘নন্দলাল বসু’, আগামী ২৭ জানুয়ারি শুরু হচ্ছে হিন্দুস্তান পার্কের ‘আকার প্রকার’ গ্যালারিতে। দেখা যাবে কালি-কলম, জলরং, পেনসিল, কলম, ছাপাই ছবির কাজ: গান্ধীজির আদর্শে প্রাণিত হয়ে ১৯৩০ সালে আঁকা এক মুসলিম বৃদ্ধের সুতো কাটার দৃশ্য (ছবিতে বাঁ দিকে), মহাত্মার লিনোকাট, ১৯৩৮-এর বিঠলনগর স্কেচে হরিপুরা কংগ্রেসের ছবি। ছবিগুলি কোনও প্রাতিষ্ঠানিক সংগ্রহ নয়, এসেছে কলকাতা ও শান্তিনিকেতনের নানা পারিবারিক সংগ্রহ থেকে, যাঁদের সঙ্গে নন্দলাল বসুর যোগাযোগ ছিল। বিশেষ প্রিভিউ ২৫ জানুয়ারি সন্ধে ৬টায়; প্রদর্শনী চলবে ফেব্রুয়ারিভর, ছুটির দিন ছাড়া রোজ বেলা ১২টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা।
অন্য দিকে, পনেরো বছর পর কলকাতায় শিল্পী কে এস রাধাকৃষ্ণনের ভাস্কর্য প্রদর্শনী ‘দ্য ক্রাউড অ্যান্ড ইটস অবতারস’, ইমামি আর্ট-এ গত ৯ জানুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে আর শিবকুমারের কিউরেশনে। শান্তিনিকেতনে কলাভবনে তাঁর দুই শিক্ষক, রামকিঙ্কর বেজ ও শর্বরী রায়চৌধুরীর মতোই, মানব অবয়ব নির্মাণ রাধাকৃষ্ণনের শিল্পকর্মের প্রধান বৈশিষ্ট্য; ১৯৯৬ সাল থেকে তাঁর ভাস্কর্যে ফিরে ফিরে আসে এক পুরুষ ও এক নারী— মুসুই আর মাইয়া নাম তাদের— শিল্পীর সাম্প্রতিকতম কাজ ‘দ্য ক্রাউড’-এ (ডান দিকের ছবি) প্রমাণাকৃতি পঞ্চাশটি ধাতব ভাস্কর্যের ভিড়েও যেন পুনরাবৃত্ত তাদেরই মুখ। ভিড়ের প্রতিটি মানুষই এগোতে চায়, ভিড় ছাড়িয়ে ব্যক্তির এগিয়ে যেতে চাওয়ার প্রতীক। রয়েছে ধাতব ৫০টি মূর্তির ক্ষুদ্র রূপ, দর্শক সেখানে ভিড়কে সাজিয়ে নিতে পারেন নিজের ইচ্ছে মতো। প্রদর্শনীর কিউরেটর, শিল্প-সমালোচক আর শিবকুমার শিল্পীর সাম্প্রতিক ভাস্কর্যকে ভাগ করেছেন তিন ভাগে: কোথাও একক মানব-অবয়ব মূর্ত নানা শরীরভঙ্গিমায়, কোথাও একই ভাস্কর্যে এসে মেশে একক ও সমষ্টির শরীর, কোথাও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অজস্র মানব-অবয়ব মিলে তৈরি করে অস্তিত্ব ও স্বপ্নের জাল। তিন রকমের কাজই দেখা যাবে। ইমামি আর্ট-এর এক তলা ও পাঁচ তলা মিলিয়ে এই প্রদর্শনী ১২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত, সকাল ১১টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা।
যুক্তির পথে
“আমি নিজেকে হিন্দু, বাঙালি বা ভারতীয় ভাবি না...” প্রত্যয়ী উচ্চারণ শিবনারায়ণ রায়ের (ছবি)। যুক্তিবাদী মানুষটি স্রেফ মানবেন্দ্রনাথ রায়ের সহযোগীই ছিলেন না, র্যাডিক্যাল হিউম্যানিজ়ম-এর পাশাপাশি দর্শন শিল্প সাহিত্য-চর্চায় বিহার করেছেন স্বচ্ছন্দে, তাঁর লেখার অনুরাগী বার্ট্রান্ড রাসেলও। ২০০৮-এ প্রয়াণোত্তর তাঁর গুণগ্রাহীদের উদ্যোগে গড়ে ওঠে ‘শিবনারায়ণ রায় স্মারক সমিতি’, ২০১০ থেকে হয়েছে নানা অনুষ্ঠান, বার্ষিক স্মারক বক্তৃতা। নানা বছরে বলেছেন গোলাম মুরশিদ সৌরীন ভট্টাচার্য প্রবাল দাশগুপ্ত জয় গোস্বামী প্রমুখ। এ বছর বললেন সুরঞ্জন দাস, আজকের পরিপ্রেক্ষিতে গান্ধীজির শিক্ষাভাবনার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে, গতকাল ২০ জানুয়ারি শিবনারায়ণ রায়ের ১০৩তম জন্মদিনে, বই-চিত্র সভাঘরে। প্রকাশ পেল জিজ্ঞাসা পত্রিকার গৌরকিশোর ঘোষ সংখ্যাও। ছিলেন অচিন চক্রবর্তী-সহ বিশিষ্টজন।
নাট্য-মনন
পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির প্রথম প্রকাশনা সম্পাদক, ‘বহুরূপী’-র পত্রিকা, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের পত্রিকা ছাড়াও সম্পাদনা করেছেন যাত্রা আকাদেমির পত্রিকা। তাঁর মনন ঋদ্ধ করত বাঙালিকে, “তথ্যের প্রতি এক প্রকৃত গবেষকের অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি, স্বাদু গদ্যে তার পরিবেশন।” প্রয়াত প্রভাতকুমার দাস সম্পর্কে লিখেছেন তীর্থঙ্কর চন্দ, ‘নান্দীপট’ নাট্যগোষ্ঠীর বার্ষিক নাট্যপত্র ২০২২-এ (আমন্ত্রিত সম্পা: ভবেশ দাশ)। রয়েছে স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত ও শাঁওলী মিত্রকে নিয়ে বিভাস চক্রবর্তী ও রুশতী সেনের লেখা, পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাট্যকৃতি নিয়ে আলাপে মেঘনাদ ভট্টাচার্য। ‘পুরনো থেকে কুড়নো’ অংশে বিজয় তেন্ডুলকরকে নিয়ে আলোচনা, দীপেন্দু চক্রবর্তীর ‘ফ্যাসিবাদী পিরান্দেলোর মুখ ও মুখোশ’, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্রেশট-রূপান্তর। আর ২০১৮ সালের অগস্টে শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় ও পবিত্র সরকারের কথালাপ— অবশ্যপাঠ্য প্রতিটি নাট্যশিক্ষার্থীর।
লেখকের বিশ্ব
নাগরিক বঙ্গজীবনকে আতশকাচের তলায় রেখে এক অনিন্দ্য আখ্যানবিশ্ব তৈরি করেছিলেন রমাপদ চৌধুরী। খারিজ, বনপলাশীর পদাবলী, লালবাঈ-এর মতো উপন্যাসে, ‘ভারতবর্ষ’, ‘দিনকাল’, ‘আমি, আমার স্বামী ও একটি নুলিয়া’ ইত্যাদি ছোটগল্পের ভূমিতে তাঁর কলম ঘুরেছে ইতিহাস ও সমাজের অলিন্দে। তাঁর স্মরণে দিনব্যাপী ‘জন্মশতবর্ষ আলোচনাচক্র’ আয়োজন করেছে সাহিত্য অকাদেমি, আজ অকাদেমি প্রেক্ষাগৃহে শুরু সকাল ১০টায়, থাকবেন সমরেশ মজুমদার পবিত্র সরকার হর্ষ দত্ত সুবোধ সরকার প্রমুখ। জীবনের বাঁক বদল, সাহিত্যচর্চার নানা স্তর, লেখকের সমসময় নিয়ে বলবেন তপন বন্দ্যোপাধ্যায় স্বপ্নময় চক্রবর্তী প্রচেত গুপ্ত তিলোত্তমা মজুমদার-সহ বিশিষ্টজন; দেখানো হবে লেখককে নিয়ে রাজা মিত্রের তথ্যচিত্র।
চিত্র-ভাষ
ফোটোগ্রাফি ক্লাব অব ইন্ডিয়া (পিসিআই)-এর উদ্যোগে শুরু হয়ে গিয়েছে পঞ্চম আন্তর্জাতিক আলোকচিত্র প্রদর্শনী, ২৩ জানুয়ারি পর্যন্ত চলবে আইসিসিআর-এ। ষোলোটি দেশের দু’হাজারেরও বেশি আলোকচিত্রের এই প্রদর্শনী কুয়াশার কলকাতাকে রোদেলা করে তুলছে প্রতি দিন। চলছে প্রতিযোগিতা, আছেন বিচারকমণ্ডলীও। “অভিজ্ঞ ও শিক্ষার্থী দু’রকম ফোটোগ্রাফারদের নিয়েই পিসিআই, এখানে বিশিষ্ট আলোকচিত্রীদের নিয়ে হয় কর্মশালা, উৎসাহ দেওয়া হয় ছবির মধ্য দিয়ে সমাজচিত্র তুলে ধরায়,” আয়োজকদের তরফে জানালেন সব্যসাচী নাথ। প্রদর্শনীর শুরুতেই ছিল আলোচনা, জলবায়ুর অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন জীবনে ও বিশেষত উপকূল-অদূরবর্তী কলকাতায় কোন সঙ্কট ঘনিয়ে তুলছে তা নিয়ে। ছবি যে হাজার শব্দেরও বেশি বাঙ্ময়, বুঝিয়ে দেয় এ প্রদর্শনী।
বড় পর্দায়
শীতশহরে বড় পর্দায় ছবি দেখার মজাই আলাদা। আর তা যদি হয় বাছাই তথ্যচিত্র ও দেশ-বিদেশের কাহিনিচিত্রের সমাহার, তবে তো কথাই নেই। ইজ়েডসিসি-র সঙ্গে একত্র উদ্যোগে, এফএফএসআই-এর সহায়তায় বিধাননগর ফিল্ম সোসাইটি আয়োজন করছে একাদশ ‘উইন্টার ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’, ঐকতান (ইজ়েডসিসি) প্রেক্ষাগৃহে। ২৩ থেকে ৩০ জানুয়ারি, বিকেল ৪.১৫, ৫টা ও সন্ধ্যা ৭টায় তিনটি করে ছবি। বাংলার তথ্যচিত্র নির্মাতাদের ৮টি ছবি, সেই সঙ্গে বাংলাদেশ নেপাল শ্রীলঙ্কা মিশর কাজ়াখস্তান মরক্কো পর্তুগাল জার্মানি ইকুয়েডরের কাহিনিচিত্র, ভারতের কোঙ্কনি ও মালয়ালম ভাষার ছবিও। সকলের জন্য অবারিতদ্বার এ উৎসব।
দুই ক্যালেন্ডারে
যোগেন চৌধুরীর শিল্পকর্ম নিয়ে মুগ্ধতা জানাচ্ছিলেন শর্মিলা ঠাকুর, ২৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যায়, চারুবাসনা গ্যালারিতে। একটি টেবিল ক্যালেন্ডার প্রকাশ করলেন তিনি সেখানে, শিল্পীর বিভিন্ন মুহূর্তের ছবি তুলেছেন অরিজিৎ মৈত্র— তপন সিংহ ফাউন্ডেশন-এর তত্ত্বাবধায়ক। ২০০৮-এ তপনবাবুর জীবৎকালেই শুরু হয় এই ফাউন্ডেশন, চলচ্চিত্র নাটক শিল্পকলা সঙ্গীত নিয়ে কর্মশালা ও চর্চার আয়োজনে মগ্ন, গত কয়েক বছরে প্রকাশ করেছে শঙ্খ ঘোষ উস্তাদ আলি আকবর খান ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ছবি দিয়ে ক্যালেন্ডারও। একই সন্ধ্যায় ওই সংস্থার আরও একটি টেবিল ক্যালেন্ডারের উদ্বোধন করলেন শর্মিলা, মৃণাল সেনের আসন্ন শতবর্ষ উপলক্ষে, তাতে চলচ্চিত্রকারের মগ্ন মননের নানা মুহূর্ত (ডান দিকের ছবি) ক্যামেরায় ধরেছেন প্রতাপ দাশগুপ্ত। মৃণালবাবুর ফিল্মগুলির যথাযোগ্য রেস্টোরেশন ও প্রদর্শনের কথা মনে করিয়ে দিলেন শর্মিলা ঠাকুর। ছবিতে বাঁ দিকে যোগেন চৌধুরীর চিত্রকৃতি, ক্যালেন্ডার থেকে।
কালি-কলমে
গ্রীষ্মের দুপুরে ঝিমোচ্ছে উত্তর কলকাতা। গলির মোড়ে তেমাথায় বিশ্রামরত টানা-রিকশাচালক, পথের নেড়ি, দু’পাশের ঘেঁষাঘেঁষি বাড়ি, তার দেওয়াল আর বারান্দার জাফরি-ঘুলঘুলি, মাথার উপরের তারগুলোও (সঙ্গের ছবি)। এই চিরাচরিত, আবহমানই তো ঐতিহ্য, ‘পেন অ্যান্ড ইঙ্ক’ মাধ্যমে তাকেই ধরে রাখেন সন্দীপ চট্টোপাধ্যায়। জার্মানির মিউনিখ থেকে পেপার টেকনোলজির পাঠ, পেশায় ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার। নেশা কিন্তু পেন অ্যান্ড ইঙ্ক-এ ছবি আঁকা, এবং শুধু তাকেই আঁকা যা ‘হেরিটেজ’। এই ধারাতেই তিনি এঁকেছেন হাম্পি-পুরী-কোনার্ক-মহাবলীপুরমের মন্দির, রাজস্থানের কেল্লা, ত্রিপুরার প্রাসাদ, অজন্তার গুহাচিত্র-সহ প্রাচীন ভারতের শৈল্পিক বিস্ময়গুলিকে। তাঁর ছবির প্রদর্শনী হয়েছে ইংল্যান্ডের সাসেক্স থেকে কলকাতার রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচার গোলপার্ক, আইসিসিআর-এও। এ বার ‘ফ্রিউইংস’-এর উদ্যোগে তাঁর প্রদর্শনী ‘হেরিটেজ অব ইন্ডিয়া’-র উদ্বোধন ২৩ জানুয়ারি বিকেল ৫টায় অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসে— ২৯ জানুয়ারি পর্যন্ত, দুপুর ১২টা থেকে রাত ৮টা।
আলপনায়
আলপনায় বিধৃত মানুষের ইচ্ছা পূরণের প্রার্থনা, নান্দনিক বিশ্বাস। ব্রত-আলপনায় পিটুলিগোলার শুভ্র টানে আঁকা হয় প্রার্থিত বস্তু, অন্তরের নান্দনিক বোধের প্রেষণায় আঙুলের টানে জন্ম নেয় কলমিলতা-শঙ্খলতা-খুন্তিলতার সহজ ছন্দোময় আলপনা। আধুনিক কালে আলপনার নবজন্ম শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মবিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানসজ্জায়, সুকুমারী দেবী নন্দলাল বসু গৌরী ভঞ্জ যমুনা সেন-সহ বহু জনের মননঋদ্ধ তা। এই ধারাতেই কাজ করছেন সুধীরঞ্জন মুখোপাধ্যায়, চার পাশের দৃশ্যবস্তুকে আলপনার মণ্ডনধর্মী সৌন্দর্যে রূপ দেন তিনি। বিশ্বভারতীর প্রাক্তন শিক্ষক সুধীরঞ্জনের আলপনা কর্মশালা আজ, নিউ টাউন ডাউনটাউন মলের ‘কারু’ শিল্পবিপণিতে। আগামী কালও দর্শকদের সামনে আলপনা আঁকবেন তিনি, সঙ্গী তরুণ শিল্পীকণ্ঠে রবীন্দ্রগান, সকাল ১১টা থেকে।