ছবি কুনাল বর্মণ।
পুনরাবৃত্তি: কবিরাজ জেঠামশাইয়ের কাছ থেকে জেঠিমার জন্য ওষুধ নিয়ে আসে শশিকান্ত। জেঠিমাকে জানায় পরের দিন সকালেই কবিরাজমশাই এসে তাঁক দেখে যাবেন। পরদিন ভোরবেলা পুলিশ এসে ধরে নিয়ে যায় শশিকান্তকে। দক্ষিণেশ্বরে বন্ধু ঈশানের গোপন বিপ্লবী আস্তানায় যাওয়ার জন্যে সে পুলিশের সন্দেহের আওতায় পড়েছে। শশিকান্ত থানায় বলে যে, তার সঙ্গে বিপ্লবী কার্যকলাপের কোনও যোগাযোগ নেই। সে কথা সমর্থন করে তার বন্ধু ঈশানও। পুলিশ নানা প্রশ্ন করে এবং মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেয় শশিকান্তকে। বা়ড়িতে আসার পর কাকা উমানাথের কাছে নানা কথা শুনতে হয় তাকে। দাদা নীলমণির প্রসঙ্গে বৌদি বিভাবতীর কাছে উষ্মা প্রকাশ করতেও ছাড়ে না উমানাথ। অন্য দিকে শশির বন্ধু হরপার্বতী কংগ্রেসে যোগ দেয়। সে মহাত্মা গান্ধীর কার্যকলাপে আস্থাশীল। শশীর সঙ্গে মতামত মেলে না তার।
আজ সভা ডাকা হয়েছে কলকাতার পার্ক সার্কাসে। আসন্ন কংগ্রেস অধিবেশনে কার কী ভূমিকা থাকবে, সেই নিয়ে আলোচনা সভার উদ্দেশ্য। মুখ্য ভূমিকা আগেই ঠিক হয়ে গেছে। এখন শুধু আরও কিছু কর্মী বাড়িয়ে দল ভারী করাই লক্ষ্য। অধিবেশনে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত হয়েছেন সুভাষচন্দ্র বসু। তিনি হেমন্তকুমার বসুকে সহকারী হিসেবে বেছে নিয়েছেন। হেমন্তবাবু জানেন যে, বিভিন্ন প্রদেশ থেকে আগত কংগ্রেসের বিশাল সংখ্যক নেতা ও কর্মীদের সামলানো তাঁদের দু’জনের পক্ষে সম্ভব নয়। চাই আরও সুযোগ্য ও সুশিক্ষিত কর্মীর সক্রিয় সহযোগিতা।
সভায় এই কথাটা উত্থাপন করাতে, জগমোহন বসু হরপার্বতীকে দেখিয়ে বলে উঠল, “আপনি এই ছেলেটিকে সঙ্গী হিসেবে নিতে পারেন।”
বঙ্কিম মুখোপাধ্যায় সভায় উপস্থিত ছিলেন। তিনি বললেন, “আপনি নির্দ্বিধায় হরপার্বতীকে নিতে পারেন। ও নিঃসন্দেহে উপযুক্ত। দেখবেন, সুভাষবাবুও খুশি হবেন তার কাজে।”
হরপার্বতী মৃদু আপত্তি করল। বলল, “আমি কেন... আরও অনেকে তো আছে।”
“দায়িত্ব নিতে শেখো, হরপার্বতী। হতে পারে, তুমি সদ্য যোগ দিয়েছ কংগ্রেসে। এখনও সবটা বুঝে উঠতে পারোনি। তা সত্ত্বেও নেতৃত্ব যখন তোমাকে চাইছে, তখন বুঝতে হবে, তারা তোমার মধ্যে বিশেষ কিছু দেখেছে। তোমার আপত্তি করা ঠিক নয়,” বললেন জগমোহন।
ভূপেন্দ্রনাথ বসু এত ক্ষণ কিছু বলেননি। তাঁর শরীরটা বিশেষ ভাল নেই আজ। একটু জ্বর-জ্বর ভাব আছে। মাথাটাও বেশ ভারী হয়ে আছে সকাল থেকে। নতুন ঠান্ডা পড়ছে, সেই ঠান্ডাটাই লেগে গেছে। ভেবেছিলেন, আসবেন না। বাড়ি থেকেও বেরোতে বারণ করা হয়েছিল তাঁকে। তাও মনের জোরে চলে এসেছেন। হরপার্বতীকে বললেন, “জগমোহন ঠিকই বলেছে। তোমাকে নেতৃত্বের দরকার। দল কোয়ান্টিটির থেকে কোয়ালিটিকে গুরুত্ব দেয় বেশি। তোমার মধ্যে সেই কোয়ালিটি আছে। তা ছাড়া, এটা কংগ্রেসের অন্য রকম অধিবেশন। এখানে মোতিলাল নেহরুর নেতৃত্বে স্বাধীন ভারতের সংবিধানের খসড়া প্রস্তুত হবে। সারা ভারতের মান্যগণ্য মানুষেরা আসবেন। পার্ক সার্কাস ময়দানে সারা ভারতের শিল্পী, কলাকুশলীদের শিল্প প্রদর্শনী হবে। এলাহি ব্যাপার। কারও একার পক্ষে এ সব সামলানো সহজ নয়। আমাদের সকলেরই কোনও না কোনও কাজ থাকবে ওই সময়ে। তবে তোমাকে যে কাজ দেওয়া হচ্ছে, তা আমাকে দিলে আমি গর্বিত হতাম। সর্বাধিনায়ক সুভাষচন্দ্র বসুর কাছাকাছি থাকতে পারাটা কি কম সৌভাগ্যের ব্যাপার?”
“আমি কোনও কাজে কখনও পিছিয়ে আসিনি। আজও আসব না। দল আমার কাছে যেটুকু চায়, তা আমি উজাড় করে দেব— এ আমি কথা দিচ্ছি,” বলে উঠে দাঁড়াল হরপার্বতী। তাকে এ বার বেরোতে হবে। মায়ের খুব জ্বর। মাকে কথা দিয়ে এসেছে যে, ফেরার পথে ব্রজ ডাক্তারের থেকে ওষুধ নিয়ে ফিরবে। সভার কাজও শেষ হয়েছিল।
হরপার্বতী ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সকলেই উঠে পড়লেন। জগমোহন সঙ্গে সঙ্গে হাঁ-হাঁ করে উঠলেন। বললেন, “এ কী! এ কী কাণ্ড! সকলে এক সঙ্গে উঠে পড়লেই হল! উপরে যে ফুলকপির পুর দেওয়া শিঙাড়া তৈরি হচ্ছে, সেগুলোর সদ্ব্যবহার কে করবে? হরপার্বতীর না-হয় বিশেষ কাজ আছে। কিন্তু আপনাদের তো উঠলে চলবে না।”
জগমোহনের কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বসে পড়লেন হেমন্ত বসু। বলে উঠলেন, “আমার কোনও কাজ নেই। তা ছাড়া সত্যি কথাটাই বলি জগাদা, আমার খিদেও পেয়েছে খুব।”
বঙ্কিম মুখোপাধ্যায় বললেন, “আমি আগে থেকেই শিঙাড়া ভাজার গন্ধ পেয়েছি। তাই তো চেয়ার ছেড়ে উঠিইনি।”
সকলেই এ কথায় হেসে উঠল, ভূপেন্দ্রনাথ ছাড়া। তিনি সত্যিই আজ জ্বরে কাবু। কোনও রকমে বললেন, “শিঙাড়া পরে এক দিন খাব’খন। আজ আমি আসি জগা।”
“আসুন দাদা...” বলে ভূপেন্দ্রনাথ ও হরপার্বতীকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে, শিঙাড়ার খোঁজখবর করতে উপরে উঠলেন জগমোহন।
পথে বেরিয়ে হনহন করে হেঁটে চলল হরপার্বতী। তার গন্তব্য বাগবাজার স্ট্রিটে ব্রজ ডাক্তারের ডিসপেনসারি।
ব্রজ ডাক্তারের নাম আসলে দক্ষিণারঞ্জন চট্টোপাধ্যায়। বন্ধু বলে, হরপার্বতীর বাবা তাকে তাঁর ডাকনামেই ডাকেন। হরপার্বতীর বাড়ির লোকেদের কাছে তাই তিনি ব্রজ ডাক্তার। হরপার্বতী তাকে ব্রজকাকা বলে সম্বোধন করে।
দর্জিপাড়ায় জগমোহনের বসতবাড়ি থেকে বাগবাজার স্ট্রিটের ব্রজ ডাক্তারের ডিসপেনসারির দূরত্ব হাঁটাপথে দশ থেকে বারো মিনিট। হরপার্বতী দ্রুত হেঁটে অনেক কম সময়ে পৌঁছে গেল। ডাক্তারখানায় ভিড় ছিল। ঋতু পরিবর্তনে এখন ঘরে ঘরে জ্বর। হরপার্বতীকে বসতে হল খানিক ক্ষণ। রোগীর সংখ্যা কমলে, ব্রজ ডাক্তার হরপার্বতীর কাছ থেকে তার মায়ের জ্বরের লক্ষণগুলো জেনে নিয়ে ওষুধ দিয়ে দিলেন। বুঝিয়ে দিলেন, কী ভাবে খেতে হবে। তার পর এটা-সেটা কথাবার্তার পর হরপার্বতী যখন বাড়ি যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াল, তখন ব্রজ ডাক্তার তাকে বললেন, “শুনলুম, তুমি নাকি কংগ্রেস পার্টিতে যোগ দিয়েছ। বেশ তো পড়াশোনার জগতে ছিলে, আবার ও দিকে কেন? জলে থেকে কুমিরের সঙ্গে লড়াই করে লাভ
আছে কোনও?”
হরপার্বতীর এই প্রশ্নের কোনও উত্তর দিতে ইচ্ছে করছিল না। সে বলল, “এ বিষয়ে পরে কথা বলব ব্রজকাকা, এখন আসি।”
“এসো, সাবধানে যেয়ো...” বলে একটু হাসলেন দক্ষিণারঞ্জন। বাড়ির পথে হরপার্বতী শুধু কংগ্রেসের আসন্ন অধিবেশনের কথা ভাবতে লাগল। তাকে যা দায়িত্ব দেওয়া হল, তা পালন করতে সে পারবে তো? এখনও পর্যন্ত কোনও কাজে সে হারেনি। এখানেই বা হারবে কেন?
বাড়িতে পৌঁছে দেখল, মায়ের জ্বর বেড়েছে। মাকে ওষুধ খাইয়ে, হরপার্বতী নিজের ঘরে প্রবেশ করল। দেরাজ থেকে খাতা ও কলম নিয়ে তার কাজের একটা রূপরেখা তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সে জানে, অধিবেশনের আগেই সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে তার দেখা হচ্ছে। তার আগে নিজেকে একটু গুছিয়ে নেওয়া দরকার।
পরদিনই হেমন্ত বসু হরপার্বতীর বাড়িতে এসে হাজির। বললেন, “চলো হে, তাঁর সঙ্গে তোমার আলাপ করিয়ে দিই।”
হরপার্বতী বুদ্ধিমান যুবক। বুঝল, হেমন্তবাবু কার কথা বলছেন। তবু কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে রইল হেমন্ত বসুর দিকে।
“বুঝলে না তো, কার কথা বলছি?”
হরপার্বতী মাথা নাড়ল। বুঝলেও সে হেমন্ত বসুর কাছ থেকেই নামটা শুনতে চায়।
হেমন্ত বসুর মুখে মৃদু হাসি। বললেন, “আমাদের নেতা সুভাষ বসুর কথা। তোমার ব্যাপারে তাঁর সঙ্গে আমার কথা হয়ে গেছে। এখন তোমাকে নিয়ে গিয়ে তাঁর সামনে হাজির করলেই, আমার কাজ শেষ।” একটু থেমে আবার বললেন, “নাও, প্রস্তুত
হয়ে নাও।”
হেমন্ত বসু মোটর গাড়ি এনেছিলেন। সেই গাড়িতে হরপার্বতী উঠতেই, গাড়ি এলগিন রোড অভিমুখে যাত্রা করল। হরপার্বতীর ভিতরে এক অদ্ভুত উত্তেজনা কাজ করছিল। এর আগে এক বার বৌবাজারে সুভাষ বসুকে সে সামনাসামনি দেখেছিল। তাও খুব অল্প ক্ষণের জন্য। আজ আবার। দ্বিতীয় বার।
লম্বা অলিন্দ পেরিয়ে একটি ঘরে প্রবেশ করল ওরা দু’জন। একটি হাতলওয়ালা চেয়ারে সুভাষচন্দ্র বসে আছেন। পরনে ধুতি ও সাদা পিরান। চোখে গোল ফ্রেমের চশমা। তাঁকে ঘিরে অনেক লোক। সম্ভবত আসন্ন অধিবেশন সংক্রান্ত আলোচনাই চলছে। হেমন্ত বসু হরপার্বতীকে দেখিয়ে সুভাষচন্দ্রকে বললেন, “এই যে, এই ছেলেটির কথাই তোমাকে বলেছিলাম।”
সুভাষচন্দ্র হরপার্বতীর দিকে তাকালেন খানিক ক্ষণ। তার পর বললেন, “তোমাকে আগে কোথায় যেন দেখেছি।”
হরপার্বতী সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল, “বৌবাজারে উপেনদার ‘বিজলী’র অফিসে। তাও কয়েক মুহূর্তের জন্য। মনে থাকার কথা নয়।”
“আমার মনে থাকে,” বলে স্বহস্তে লেখা একটি নির্দেশনামা দিলেন হরপার্বতীকে।
হরপার্বতী নিদের্শনামাটি নিয়ে পড়তে শুরু করেছে, এমন সময় শুনতে পেল, সুভাষচন্দ্র বলছেন, “তোমার কাজটা হবে হাওড়া স্টেশন থেকে। হেমন্তকে দায়িত্ব দিয়েছি শিয়ালদায়। প্রচুর স্বেচ্ছাসেবক ও গুপ্তবাহিনী থাকবে। তাদের কাজ তারা করবে। তুমি শুধু খেয়াল রাখবে কোনও শৃঙ্খলা ভঙ্গের ঘটনা যেন না ঘটে।”
“গুপ্তবাহিনী?” প্রশ্ন করল হরপার্বতী।
সুভাষচন্দ্রের মুখে মৃদু হাসি। বললেন, “এদের কাজ মূলত স্বেচ্ছাসেবকদের সাহায্য করা। তবে তোমার দায়িত্ব কিন্তু খুব বেশি। ভাল কথা, তুমি ঘোড়ায় চড়তে পারো?”
হরপার্বতী অবাক হয়ে গেল এই প্রশ্নে। বলল, “না, ওই সাইকেল পর্যন্তই বিদ্যে।”
“ঠিক আছে, অসুবিধে হবে না। গাড়ির ব্যবস্থাও থাকবে। হাওড়া স্টেশন থেকে পার্ক সার্কাস ময়দান— অনেকটা পথ কি না...” বলেই অন্য কাজে মন দিলেন সুভাষচন্দ্র।
হেমন্ত বসু হরপার্বতীকে নিয়ে বিদায় নেওয়ার উদ্যোগ করতেই, সুভাষচন্দ্র কাগজপত্র থেকে মুখ তুলে, বললেন, “একটু বসে যাও, হেমন্ত। তোমার সঙ্গে কথা আছে।”
“আমি বরং আসি...” হরপার্বতী বলল।
হেমন্ত বসু বললেন, “এক সঙ্গেই বেরোব। তুমি বসে যাও একটু।”
ঘরের কোণে একটি সোফায় বসল হরপার্বতী। ভাল করে ঘরের চার পাশে দেখল। অদূরে এক বিদেশি ভদ্রমহিলা তার চোখ টানল। বিদেশিনি হলেও মহিলা ভারতীয় ধরনে শাড়ি পরেছেন। লক্ষ করলে দেখা যায়, সিঁথিতে সিঁদুরও দিয়েছেন।
হরপার্বতী বেশ অবাক হল। আরও অবাক হল মহিলার পাশে বসা এক যুবতীকে দেখে। শ্যামলা রঙের এই যুবতীকে সে যেন কোথায় দেখেছে... কিন্তু কোথায় তা কিছুতেই মনে করতে পারছে না। মনের গহ্বরে খুঁজেই চলেছে... কোথায়... কোথায়...
এলগিন রোডের বাড়ি থেকে যখন বেরিয়ে এল হরপার্বতী, তখন বেশ বেলা হয়েছে। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে, হেমন্ত বসু হরপার্বতীকে জিজ্ঞেস করল, “কিছু যেন চিন্তা করছ মনে হচ্ছে।”
“না, ও কিছু নয়,” বলে খানিক ক্ষণ চুপ করে থেকে হরপার্বতী বলল, “আচ্ছা, হেমন্তদা, ওই বিদেশি ভদ্রমহিলা কে?”
হেমন্ত বসু মৃদু হেসে উত্তর দিলেন, “ওঁর নাম এডিথ এলেন গ্রে। উনি আমাদের যতীনদার স্ত্রী। বর্তমান নাম নেলী সেনগুপ্ত। জন্মসূত্রে ইংরেজ হলেও নেলীদি আমাদের স্বাধীনতার জন্য ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।”
বাইরে বেরিয়ে হেমন্ত বসু বললেন, “আমি তোমাকে খানিকটা রাস্তা লিফট দিতে পারি।”
হরপার্বতী বলল, “তার দরকার হবে না, হেমন্তদা। আমি বাসেই যাব।”
হেমন্ত বসুর মোটরগাড়িটি বেরিয়ে যাওয়ার পর হরপার্বতী আবার ভাবতে শুরু করল, মেয়েটি কে? কেন তাকে তার এত চেনা চেনা মনে হল? সে কোথায় দেখেছে তাকে?
ক্রমশ