ছবি: অমিতাভ চন্দ্র।
বারাণসী মানে শুধু মন্দির, গঙ্গার ঘাট, বাঙালিটোলা, রাবড়ি আর কচৌরি গলির গল্প নয়। সেখানেও ছিল গ্রাম থেকে আসা ছিন্নমূল মানুষ, পণপ্রথা এবং মেয়েদের যন্ত্রণা, দরকারে বাইজি বনে গিয়ে নিজস্ব রাত দখল। প্রথম সাড়া জাগানো উপন্যাস ‘সেবাসদন’-এ বারাণসীর কথকতায় কি এ ভাবেই ভবিষ্যতের সতর্কবাণী রেখেছিলেন মুনশি প্রেমচন্দ?
পবিত্র শহর বারাণসীতে এসে, রোজ গঙ্গাস্নান করেও লাভ হল না। যুবতী সুমন এক দিন রাগের চোটে স্বামীর ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল, সুন্দরীদের বাজারে নাম লেখাল। সোজা কথায়, বাইজি বনে গেল।
সুমন যে লেখাপড়া জানে না, এমন নয়। তার বাবা গ্রামাঞ্চলে থানার দারোগা ছিলেন, কিন্তু ঘুষ-টুষ খেতেন না। কলকাতা ও হরেক শহরে মেয়েদের লেখাপড়া শেখানো নিয়ে তোলপাড় চলছে, খবর পেয়েছিলেন। মেয়েরা লেখাপড়া শিখে আজকাল নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে! দুই মেয়ে সুমন ও শান্তাকে তিনি মেয়ে-স্কুলে ভর্তি করে দিলেন।
কিন্তু বিধি বাম। দারোগাবাবু হঠাৎ মারা গেলেন। দেখা গেল, টাকাপয়সা বিশেষ কিছু রেখে যেতে পারেননি। ঘুষ খেতেন না, কাজেই চাকরির টাকা খেতে-পরতে আর দুই মেয়েকে মিশনারি স্কুলে পড়াতে পড়াতেই শেষ হয়ে গিয়েছে।
গ্রামের ব্রাহ্মণ পরিবার। এই দুর্দৈবে আর কিছু না হোক, মেয়েদের তো পাত্রস্থ করতে হবে। লেখাপড়া জানা মেয়ে? দূর! লেখাপড়া জানা ছেলে ও তাদের পরিবার সাংঘাতিক দর হাঁকে। মেয়ে লেখাপড়া জানলে পণের পরিমাণ আরও বেড়ে যায়। শিক্ষিত ব্রাহ্মণরাও এর ব্যতিক্রম নয়।
অতএব, ব্রাহ্মণী বাধ্য হয়ে জাত মিলিয়ে মেয়েকে দ্বিগুণ বয়সি, দোজবরে গজধরপ্রসাদের সঙ্গে বিয়ে দিলেন। তাঁর ভাই, মানে সুমনের মামা পণের দাপটে অতিষ্ঠ হয়ে শেষে এই সম্বন্ধ এনেছেন। গজধর বারাণসী শহরে থাকে, মা-বাবা নেই, এক কারখানায় ছোটখাটো কোরানির কাজ করে মাসে পনেরো টাকা রোজগার করে। ব্রাহ্মণত্বের সিঁড়ি ভাঙা অঙ্কে তাঁদের থেকেও দুই থাক উঁচুতে। বিধবা ব্রাহ্মণী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘নিজের বাড়ি তো?’
মামা বললেন, ‘আরে, শহরে ক’টা লোকের নিজের বাড়ি আছে? সবাই ভাড়ায় থাকে।’
ছেলেটা সুন্দর দেখতে? মামা বললেন, ‘লাখে একটা এমন মেলে। তা ছাড়া শহরে কেউ খারাপ দেখতে নয়। সকলের সুন্দর চুলের ছাঁট, চমৎকার জামাকাপড় পরে। না দেখলে বুঝবি না।’
ফাল্গুন মাসে গজধরের সঙ্গে সুমনের বিয়ে হয়ে গেল। তার পরই গ্রামের শিক্ষিত কন্যের প্রথম শহরে আগমন। এ কী! বাড়ি তো নয়, ছাউনির মতো ছোট ছোট দুটো ঘর, ঘরের দেওয়ালে চারা ও বিভিন্ন লতানে গাছ জন্মেছে। রোদ্দুর, আলো-হাওয়ার বালাই নেই। সামনে কাঁচা নর্দমার গন্ধে অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে আসে। তবু ফি-মাসে কড়কড়ে তিনটি করে টাকা গুনাগার দিতে হয়।
দুপুরে পুরুষদের অনুপস্থিতিতে, আশপাশের মহিলারা নতুন বিয়ে হয়ে আসা এই সুন্দরী মেয়েটির সঙ্গে গল্প করতে আসে। অবস্থাপন্ন বাপের বাড়িতে কেনা সিল্কের শাড়ি পরে সুমন তাদের সঙ্গে গল্প করে। স্বামীর সঙ্গে দোকানে গিয়ে কোন হাল ফ্যাশনের শাড়ি, গয়না কেনা যায়, মেয়েরা সে সব নিয়ে সুমনের কাছে পরামর্শ চায়। আর সুমনের শরীর রাগে জ্বলে যায়। সকলের স্বামীরা বৌদের মাঝে মাঝে কিছু তো কিনে দেয়। আর হাড়কিপটে গজধর! দোকানের জিলিপি আনালে, ডালে বেশি ঘি দিলেও তার গজগজানি শুরু হয়ে যায়, ‘এত নষ্টের বাতিক কেন? কী ভাবে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দুটো টাকা রোজগার করতে হয়, যদি জানতে!’
এই বাড়ির পাশেই উকিলবাবু পদম সিংহের কোঠাবাড়ি। পদম সিংহের স্ত্রী মাঝে মাঝেই হাতছানি দিয়ে সুমনকে ডাকে। চক-মেলানো মেঝে, বাথরুমে সুগন্ধি। সুমন সেখানে গিয়ে খুব আরাম পায়। কিন্তু সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসতে হয়। গজধর জানতে পারলেই রাগ করে, ‘ও সব বড়লোকের বাড়িতে কেন? যত্ত সব লুচ্চা, লফঙ্গা!’
পদম সিংহের পাশেও আর একটা কোঠাবাড়ি। বোলিবাই-এর। বোলিবাইও সুমনকে হাতছানি দেয়, বন্ধুত্ব পাতাতে চায়। কিন্তু গজধরের কড়া নিষেধ, ‘ও একটা নাচনেওয়ালি। ওর বাড়ি একেবারে নয়।’
নাচনেওয়ালি? কিন্তু প্রায়ই তো বোলির সঙ্গে ভোরের গঙ্গাস্নানে দেখা হয়, ঘাটের ভিড় কাটাতে তাকে সাহায্য করে, দু’জনে গল্প করতে করতে ফেরে। বোলির বাড়িতেও এক দিন গিয়েছিল সে। সুন্দর সাজানো গোছানো বাড়ি, ঘরে তানপুরা।
এক বিকেলে মন্দিরে গিয়ে সুমন হতবাক! সাধুসন্ত ও দর্শনার্থীর ভিড়ে পা রাখার জায়গা নেই। মন্দিরের চাতালে, শিবলিঙ্গের সামনে নাচছে বোলি। বোলি যদি খারাপ মেয়ে হয়, তা হলে মন্দিরে কী ভাবে নাচে? সাধুসন্ত থেকে পুণ্যার্থী দর্শক, সকলে তার নাচ দেখে এত ধন্য ধন্য করে কেন?
দিন কয়েক বাদে পদম সিংহের স্ত্রী দুপুরে সুমনকে ডাকে। আজ সন্ধ্যায় অনেক রইস আদমি আসবেন, উকিলবাবুর বাড়িতে মেহফিল বসবে। দুই সখি পর্দার আড়াল থেকে দেখে, বোলি নাচছে আর গাইছে। সুমনের কণ্ঠে এর থেকেও ভাল সুর, কিন্তু উপায়? তাকে কিপটে, কথায় কথায় গঞ্জনা দেওয়া গজধরের সঙ্গেই বাকি জীবনটা কাটাতে হবে! গুদামঘরের কথা মনে পড়ে সুমনের। তার গুদাম যত সাজানো গোছানো হোক না কেন, খদ্দের সেই এক জন। আর বোলি? নিজেই নিজের গুদাম সাজিয়ে স্বাধীন, নিজের স্বাচ্ছন্দ্যে ও সম্মানে থাকে। নাচ-গানে বিভোর থাকতে থাকতে কখন যে রাত এগারোটা বেজে গিয়েছে, খেয়াল নেই সুমনের।
ঘরের দরজা বন্ধ। ভিতরে ঘুমে অচেতন গজধর। সুমন বারংবার দরজা নাড়ে, কান্নাকাটি করে। অন্ধকার রাস্তায় কুকুরের ঘেউঘেউয়ে তার ভয় লাগে না বুঝি? কিন্তু অবাধ্য বৌকে গজধর আজ শিক্ষা দিয়েই ছাড়বে, দরজা সে খুলবে না কিছুতেই।
সেই রাতেই ঘর ছাড়ল সুমন। উকিলবাবু এবং বোলির বাড়িতেই না-হয় দিন কয়েক ঠাঁই নেবে সে। তার পর নিজের ব্যবস্থা নিজেই করে নেবে।
*****
এত ক্ষণ আসলে একটা গল্প বলছিলাম। বারাণসীর গল্প মানে তো শুধু বিশ্বনাথ মন্দির, গঙ্গার ঘাট, বাঙালিটোলা, রাবড়ি আর কচৌরি গলির গল্প নয়। সেখানেও ছিল গ্রাম থেকে ছিন্নমূল হয়ে শহরে আসার গল্প, পণপ্রথা এবং মেয়েদের যন্ত্রণার গল্প। দরকারে বাইজি বনে গিয়ে নিজস্ব রাত দখলের গল্প। ইংরেজ নাট্যকারের মতো তারা বিবাহ প্রথাকে ‘বৈধ বেশ্যাবৃত্তি’ বলতে পারেনি ঠিকই, কিন্তু এক জনের মালিকানার গুদামঘর আর বহু জনকে নিজের খেয়ালে গুদাম ভাড়া দেওয়ার তফাত উপলব্ধি করেছিল। ইবসেনের নায়িকার মতো তারাও কেউ কেউ পুতুলখেলার ঘর ভেঙে বেরিয়ে এসেছিল।
এই গল্পের লেখক বারাণসীর ছেলে মুনশি প্রেমচন্দ। এটি ১৯১৮ সালে প্রকাশিত, তাঁর জীবনের প্রথম সাড়া জাগানো উপন্যাস ‘সেবাসদন’-এর থিম। বাঙালি অবশ্য প্রেমচন্দ বলতেই ‘হিন্দি ভাষার শরৎচন্দ্র’ ভাবে। সত্যজিৎ রায়ের কল্যাণে ‘সদ্গতি’ আর ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’ জানে। প্রয়াত নাট্যনির্দেশক নীলকণ্ঠ সেনগুপ্ত যে প্রেমচন্দের ‘কফন’ অবলম্বনে ‘দানসাগর’ নামে একটি নাটক নামাতেন, সে-ও অনেকের স্মৃতিতে আছে। এত কাশী কাশী আউড়েও এই উপন্যাস আজ অবধি বাংলা ভাষায় অনূদিত হয়নি। সাহিত্য বিষয়ে বাঙালি বরাবর ভ্রান্ত, আত্মগর্বিত ও আত্মধ্বংসী জাতি। মনে করে তারাই দুনিয়ার একমাত্র সাহিত্যপ্রেমী, নোবেল ও বুকার পুরস্কার নিয়ে অহরহ মাথা ফাটায়।
কিন্তু প্রতিবেশী হিন্দি, উর্দু, অহমিয়া, তেলুগু, কন্নড় সাহিত্য নিয়ে মাথা ঘামাতে নারাজ।
হাল আমলে আমেরিকার টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা সুচল সিঙ্ঘভি এই উপন্যাস ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন, তার পরই দুনিয়া জুড়ে সাহিত্যপ্রেমী জনতার তোলপাড়। কে বা জানত সাধুদের আশ্রমে, মন্দিরে উচ্চাঙ্গ নাচগানের এই সংস্কৃতি? বারাণসী একদা লখনউয়ের নবাবের অধীনে ছিল, ফলে রামনগরে রাজাদের প্রাসাদে নাচগানের আসর স্বাভাবিক। কিন্তু বার্ধক্যের বারাণসীতে মন্দিরে ও সাধু আখড়ায় সসম্মানে নাচত, গাইত এই সব বহুবল্লভা নারী? আদৌ সম্ভব?
রামকৃষ্ণ মিশনের সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী মেধসানন্দ কিন্তু বারাণসীর ঐতিহ্য নিয়ে তাঁর দুই খণ্ডের মূল্যবান আকরগ্রন্থ, ‘বারাণসী অ্যাট দ্য ক্রসরোডস’-এ এই দিকটায় চমৎকার আলো ফেলেছেন— “সরস্বতী পুজোর দিন বাগীশ্বরী মন্দিরে সাধু কিনারামের আখড়ায়, চৈত্র মাসে শীতলাঘাটের শীতলামন্দিরে, কার্তিকে পঞ্চগঙ্গা ঘাটে, দশাশ্বমেধ ঘাটের কালীমন্দিরে বাইজিরা নিজে থেকেই বিনা পারিশ্রমিকে নাচগান করতে আসতেন...” জানাচ্ছেন তিনি। আরও বলছেন, বারাণসীর ইমামবাদী বাইজির থেকেই গান শিখে নগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বাংলায় প্রথম টপ্পা গানের প্রচলন করেন। বাঙালি কালী মির্জা বা কালিদাস চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গীতশিক্ষায় নাড়া বাঁধা বারাণসীতেই। অঘোর চক্রবর্তীর ধ্রুপদ বা মহেশচন্দ্র সরকারের মতো প্রবাদপ্রতিম বীণাবাদকের শিক্ষাও ওই শহরে। কত্থক নাচ ও ছয় মাত্রার দাদরা তালেরও চমৎকার বিকাশ ঘটেছিল এই শহরে। আওরঙ্গজেবের আমলে মন্দির ধ্বংসেই ইতিহাস শেষ হয়ে যায় না। মেধসানন্দ জানিয়েছেন, পরে আকবরের নবরত্নসভার অন্যতম সঙ্গীতকার মিঞা তানসেনের বংশধরেরা অনেকেই বারাণসীকে নিজেদের বাসভূমি হিসেবে বেছে নেন। তৈরি হয় সেনীয় ঘরানা।
বাইজি এবং সঙ্গীতের সুরস্রষ্টাদের মধ্যে ছিল না জাতপাত। প্রতিভাবান ছাত্রছাত্রী পেলে রবিশঙ্করের জন্মনগরী প্রথম থেকেই ধর্ম ও জাতপাতের গণ্ডি ভেঙে শিক্ষা দিয়েছে। আর দিন কয়েক বাদে, শীতের কলকাতাতেও উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের হরেক আসর বসবে। তখন যাবতীয় বিভ্রম ঝেড়ে বাঙালির যেন মনে পড়ে, এর পিছনেও উত্তরবাহিনী গঙ্গানগরীর চমৎকার অবদান ছিল। বারাণসী মানে শুধু গঙ্গার ঘাটে ফি-সন্ধ্যায় পিতলের ভারী প্রদীপ ও গেরুয়া চাদরে গঙ্গারতি নয়, নব্য হিন্দুত্বের পীঠস্থান নয়, বরং আরও বেশি কিছু।
*****
বাংলায় কাশীবাসিনী নায়িকার অভাব কস্মিনকালেও নেই। ‘পথের পাঁচালী’র হরিহর, সর্বজয়া থেকে ‘দ্রবময়ীর কাশীবাস’, বিভূতিভূষণ একাই লা জবাব। শরৎচন্দ্রের ‘পল্লীসমাজ’-এর রমাও শেষে জেঠাইমার সঙ্গে বিশ্বেশ্বরের চরণে আশ্রয় নিতে যায়। বিংশ শতকের শুরুতেই নায়িকাদের এই ভাবে কাশী পাঠানোর পথিকৃৎ স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। ‘চোখের বালি’র বিনোদিনীকে তিনি সটান কাশী পাঠিয়ে দেন।
প্রেমচন্দের কাশী এ রকম অগতির গতি নয়। সেখানে বরং নগরীর টানে, রোজগারের আশায় গ্রামের মানুষ ছুটে আসে। বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে হিন্দির এখানেই হালকা অমিল। মিল-অমিলের এই উচ্চাবচতাই তো ভারতীয় সাহিত্যের অন্যতম মাত্রা।
সাড়া জাগানো উপন্যাসটির আর একটি অসাধারণ বৈশিষ্ট্য, প্রেমচন্দ এটি প্রথমে লিখেছিলেন উর্দু ভাষায়। জনসমাজে উর্দুকে আজকাল বেশির ভাগ সময়ে বিজাতীয় ও মুসলমানি ভাষা মনে করা হয়। অথচ উর্দু না থাকলে হিন্দির এই রমরমা সম্ভব হত না। আত্মজীবনীতে প্রেমচন্দ নিজেই লিখে গিয়েছেন, বারাণসীর লমহী গ্রামের জন্মভূমিতে তাঁর লেখাপড়ার শুরু এক মৌলবি সাহেবের কাছে উর্দু ও ফারসি শিখে। পাঁচ-সাত বছর এই ভাবে প্রাথমিক শিক্ষার পরে বারাণসীর কুইন্স কলেজে ভর্তি ও ইংরেজি শিক্ষা। এখনকার বারাণসীর প্রচার প্রসার দেখলে মনে হয়, সেখানে যেন অনাদি অনন্তকাল ধরে সকলে হাটে-মাঠে-ঘাটে সংস্কৃত ভাষায় কথা বলত। জনজীবনে অন্য কোনও ভাষার অস্তিত্ব ছিল না।
অথচ, বারাণসীর উর্দু কাগজগুলিই প্রেমচন্দের লেখা ছাপত। ১৯১৬ সালে তিনি গোরখপুরের নর্মাল স্কুলের শিক্ষক। কয়েকটি ছোট গল্পের বই ও দু’-তিনটি উপন্যাস ছাপা হয়েছে, কিন্তু লেখক হিসাবে কল্কে পাননি। এ বার যোগী আদিত্যনাথের শহরেই তিনি লিখে ফেললেন কাশীর পটভূমিকায় উর্দু ভাষার উপন্যাস ‘বাজ়ার-ই-হুসন’ বা সুন্দরীদের বাজার। কিন্তু প্রকাশকের গড়িমসিতে সে লেখা বহু দিন ছাপাখানার আলো দেখল না। তখন লেখক নিজেই সেটি হিন্দিতে লিখলেন। উর্দুর চেয়ে বেশ নিরামিষ ভঙ্গিতে নাম দিলেন ‘সেবাসদন’। সদন সিংহই তো উপন্যাসের নায়ক। কাশীতে ডালমন্ডির লালবাতি এলাকায় বাইজি সুমনের প্রেমে পড়ে, কিন্তু পরিবারের চাপে বিয়ে করে সুমনের বোন শান্তাকে। পরিশেষে সে বাইজির সন্তানদের জন্য এক হস্টেল তৈরি করে, সুমন হয়ে ওঠে সেই স্কুল ও হস্টেলের প্রধান শিক্ষিকা।
বই ছেপে বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গেই হু হু করে বিক্রি। স্বাধীনতার ঢের আগে, ১৯৩৮ সালে এই গল্প নিয়ে সিনেমা। নায়িকার ভূমিকায় এম এস শুভলক্ষ্মী। উপন্যাসের এহেন জনপ্রিয়তার কারণ? প্রেমচন্দের জীবনীকার প্রকাশচন্দ্র গুপ্ত লিখছেন, “এর আগে হিন্দি উপন্যাসের প্রধান উপজীব্য ছিল অলৌকিক ঘটনা বা দুঃসাহসিক অভিযান। কিন্তু এই উপন্যাসে লেখক রূঢ় ও তিক্ত বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছেন। বাস্তব জীবনের কোনও ঘটনাকে ছোট করেননি, কাউকে দোষও দেননি।” হাল আমলে হিন্দি ও উর্দু সাহিত্যের অন্যতম ইতিহাসকার, বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বসুধা ডালমিয়ার মত অবশ্য অন্য। ভারতীয় সমাজ তখন দেশগঠন, পরিবারে নারীর সম্মান, আর্যসমাজ, পণপ্রথা ও জাতপাতবিরোধী আন্দোলন, অনেক কিছু নিয়ে ভাবিত। হিন্দি উপন্যাসে এই প্রথম তার প্রতিফলন।
প্রতিফলন, অবশ্যই। প্রেমচন্দের আগে আধুনিক হিন্দি সাহিত্যকে যিনি নিজের পায়ে দাঁড় করান, সেই কবি এবং নাট্যকারও বারাণসীর সন্তান—ভারতেন্দু হরিশচন্দ্র। ভারতেন্দু নিয়মিত কাশীর বাইজি মহল্লায় যেতেন, প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে এক বার বলেছিলেন, কী ভাবে রুচিসম্মত ভঙ্গিতে কথা বলতে হয়, সঙ্গীতের আরাধনা করতে হয়, সেগুলি শিখতে যাই। তাঁর নাটকেই কাশী সম্পর্কে বলা হল প্রাচীন প্রবাদ, ‘আধি কাশী ভাট ভান্ডেরিয়া ব্রাহ্মণ আউর সন্ন্যাসী/ আধি কাশী রান্ডি মুন্ডি রাঁঢ় খাঙ্গি খাসি।’ মানে কাশীবাসীদের অর্ধেক গায়ক ভাণ্ডারী ব্রাহ্মণ এবং সন্ন্যাসী। বাকি অর্ধেক নেড়ামাথা বিধবা ও যৌনকর্মী।
সে যে কোনও বড় শহরে ও বাণিজ্যকেন্দ্রে ভণ্ড সন্ন্যাসী ও সোনা গাজির মহল্লা থাকবে, কলকাতা জানে। কিন্তু বারাণসীর বৈশিষ্ট্য অন্যত্র। কাশীর রাজপরিবারের পরই সমাজে সম্মানের পাত্রী ছিলেন ভাল নাচ-গান জানা, সুরসিক কথোপকথনে পারদর্শী নগরনটীরা। আদি বিশ্বেশ্বর মন্দিরে তওয়াইফ বা বাইজিরা একদা নাচগান করতেন।
রসেবশে থাকা ধর্মনগরীর এই কৃষ্টি নষ্ট হল কী ভাবে? ঔপনিবেশিক আলোয় খ্রিস্টানি পাপবোধের গোঁড়ামি এর অন্যতম কারণ। কলকাতা টাঁকশালের তৎকালীন অধিকর্তা, এশিয়াটিক সোসাইটির ডিরেক্টর জেমস প্রিন্সেপকে অনেকেই চেনেন। ব্রাহ্মী ও খরোষ্ঠী লিপির থেকে প্রাচীন মুদ্রা-বিশেষজ্ঞ এই তরুণ গবেষক না থাকলে ভারতে যে অশোক নামে ‘দেবানাং প্রিয়দর্শী’ এক রাজা ছিলেন, আমরা কস্মিনকালেও জানতে পারতাম না।
এহেন প্রিন্সেপ কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির দায়িত্ব নেওয়ার আগে বারাণসী টাঁকশালের অধিকর্তা ছিলেন, ওই নগরীর রূপে মুগ্ধ হয়ে তিনি গঙ্গার ঘাট, শ্মশান অনেক কিছুর চমৎকার ছবি এঁকেছিলেন। বারাণসীর বাইজি এবং তওয়াইফরাও তাঁর দৃষ্টি এড়ায়নি। ১৮২৯ সালে বারাণসীতে ডালমন্ডি এলাকার বাইজিদের নিয়ে প্রিন্সেপের রিপোর্টে প্রথম লাইন: ‘দি উইচিং ইনফ্লুয়েন্স অব দি আর্টস অ্যান্ড গ্রেসেস অব দিজ় উইমেন ইজ় অ্যাজ় মাচ অ্যাকনলেজড অ্যান্ড অ্যাজ় পাওয়ারফুল অ্যাজ় এভার’, অর্থাৎ শিল্প ও সৌন্দর্য নিয়ে এই মহিলাদের শয়তানি প্রভাব এখনও আগের মতোই স্বীকৃত। শয়তানি প্রভাব? আম্রপালী, বসন্তসেনার মতো বারবিলাসিনীদের নিয়ে এমন কথা ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি ভারতীয় চেতনা।
বারাণসীর দশাশ্বমেধ ঘাটের এই ছবি এঁকেছিলেন জেমস প্রিন্সেপ।
অতঃপর সচ্চরিত্র দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের প্রভাব যত বেড়েছে, সঙ্গীত তত বাইজি মহল্লা থেকে বিযুক্ত হয়েছে। কলকাতায় শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর সন্দর্ভ লিখলেন হিন্দু সঙ্গীত নিয়ে, মহারাষ্ট্রে বিষ্ণু নারায়ণ ভাতখণ্ডে রাগরাগিণীগুলির যথাযথ নোটেশন প্রকাশ করলেন, চার খণ্ডে তাঁর বইয়ের নামই ‘হিন্দুস্থানি সঙ্গীত পদ্ধতি।’ নারীর অধিকার নিয়ে বাঙালি কখনও আর এক মরাঠি চিৎপাবন ব্রাহ্মণ, পালুস্করের নাম করে না। বাইজি মহল্লায় ধ্রুপদী সঙ্গীতের চর্চা হত, মেয়েরা আস্তে আস্তে সঙ্গীতের মঞ্চেও ঠাঁই করে নিলেন। তখনও পুরুষ গায়করা বসে গাইতেন, মেয়েরা দাঁড়িয়ে। পালুস্করই প্রথম মেয়েদের দিলেন সঙ্গীতমঞ্চে বসার অধিকার। তিনি না থাকলে শুভা মুদগল থেকে কৌশিকী চক্রবর্তী, কাউকেই আজও আমরা মঞ্চে বসে গাইতে দেখতাম না। মেয়েদের রাত দখলের ইতিহাস শুধু স্লোগানে থাকে না, আরও অনেক জায়গায় নিঃশব্দে রয়ে যায়।
*****
কিন্তু প্রেমচন্দের এই প্রথম সাড়া জাগানো উপন্যাসের আরও একটা বৈশিষ্ট্য আছে। ডালমন্ডি থেকে বাইজিদের তুলে দেওয়া হবে, তা নিয়ে পুরসভায় নানা মুনির নানা মত। বাবু বিঠলদাসের নেশা সমাজ সংস্কার। বন্যাত্রাণ, গ্রামোন্নয়ন ইত্যাদি হরেক কাজে ব্যস্ত। ডালমন্ডি থেকে বাইজি মহল্লা তুলে দেওয়ার খাতিরে তিনি সুমনের কাছেও আসেন। তার পর—
বিঠলদাস: তোমার মতো ব্রাহ্মণ মেয়েদের জন্য তো লজ্জায় হিন্দুদের সকলের মাথা কাটা যায় সুমন।
সুমন: সে কী, একটু আগে আমার মুজরো দেখে বেশ কয়েক জন বেরোল। সকলেই হিন্দু। মাথা হেঁট করে নয়, সবাইকে তো দেখলাম খুশিমনে মাথা উঁচু করে বেরোতে। এখানে আমার মতো আরও অনেকে আছে। তা হিন্দুরা যদি নিজে থেকে লজ্জা, সঙ্কোচ না রাখে, আমার মতো অবলা মেয়েমানুষ এই গুরুদায়িত্ব নেবে কেমন করে?
রইস আদমি, জমিদারতনয় কুমার অনিরুদ্ধ সিংহ জানান, বাইজি মহল্লা থেকেই তিনি সঙ্গীত ও রুচিশীলতা অভ্যাস করেছেন। কিন্তু উন্নয়নবাদী বা বাইজিবাদী, কাউকেই ভোট দেবেন না। তিনি নিরপেক্ষ থাকবেন এই ভোটাভুটিতে। তিনি একই সঙ্গে সুরদাস ও মোৎজ়ার্টের রসগ্রহণ জানেন, এই তর্কে তাঁর কী আসে যায়? শেঠ বলভদ্রদাস বলেন, ‘আমরা আমাদের সঙ্গীতে গর্বিত। শুনুন ভাই, অবহেলায় যদি কিছু নষ্ট হতে বসে, তাকে শিক্ষা ও সহানুভূতি দিয়ে উদ্ধার করতে হয়। তওয়াইফদের বৃত্তি নিষিদ্ধ করে দিলেই যে দেশের সব দুঃখদারিদ্র উধাও হয়ে যাবে, এতে আমার বিশ্বাস নেই।’
পুরসভায় ইংরেজ শাসক মনোনীত সেই সদস্যদের মধ্যেই ছিলেন রমেশ দত্ত নামের এক বঙ্গসন্তান। তিনি ও স্থানীয় পত্রিকার সম্পাদক প্রভাকর রাও ডালমন্ডি থেকে বাইজিদের এই পাপপল্লি উঠিয়ে দিতে চান। প্রভাকর বলেন, ‘বুঝতে পারছি, ওখান থেকে বাইজিদের হঠিয়ে দিলে সেখানকার ব্যবসায়ীদের অসুবিধা হবে, বাজারে আগের মতো লোক হবে না। কিন্তু সামাজিক কুপ্রথা বন্ধ করতে এই ক্ষতি আমরা মেনে নিতেই পারি। সমাজ গঠনে টাকা অন্তরায় হবে কেন?’
অনিরুদ্ধ সিংহের উত্তর, ‘আপনি তো সব সময় সম্পাদকীয় লেখার ধান্দায় থাকেন। আজ তওয়াইফদের হঠিয়ে দিতে চাইছেন, কাল আবার শহর থেকে নাচগান হঠিয়ে দেওয়ার জন্য কলম ধরবেন।’ বিশ শতকের প্রথম পাদে লেখা, বারাণসীভিত্তিক এই হিন্দি উপন্যাস সমাজসংস্কারক থেকে সাংবাদিক কাউকেই রেয়াত করেনি। সেখানেই একুশ শতকীয় মুগ্ধতা।
সবচেয়ে বড় মুগ্ধতা অন্যত্র। বাইজি উচ্ছেদ ও নগর উন্নয়নের এই প্রকল্পে পুরসভার তর্কবিতর্কে আস্তে আস্তে চলে আসে সাম্প্রদায়িকতার রং। ডালমন্ডির চকে সবচেয়ে বড় আতর ও সুগন্ধির দোকান এক মুসলিমের। তিনি কোনও রাখঢাক না রেখে বলেন, ‘তওয়াইফদের বেশির ভাগই তো মুসলমান। হিন্দু ভাইদের ধান্ধাটা বুঝতে পারছেন তো? এই শহরকে ওঁরা মুসলমানহীন করতে চান।’ ব্যবসায়ী চিমনলাল পাল্টা বলেন, ‘ডালমন্ডির বেশির ভাগ ঘরবাড়ি, রিয়াল এস্টেটের মালিক আমরা, হিন্দুরা। অথচ মুসলিম ভাইয়েরা আমাদের ঘাড়ে এমন চেপে বসেছেন যে, হিন্দুরা এক দিন তাঁদের হাতের পুতুলে পরিণত হবে। কিছু হিন্দু আবার দেশের লজ্জা, সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী হিসেবে নাম কেনার লোভে ওই খতরনাক মুসলমানদের সমর্থন দিয়ে চলে।’
তাঁর প্রথম সাড়া জাগানো উপন্যাসে কি এ ভাবে বারাণসী নগরীর কথকতায় ভবিষ্যতের সতর্কবার্তা দিয়ে গিয়েছিলেন লেখক? এখানেই সাহিত্যের জিত! একুশ শতকেও যে উচ্ছেদ এবং উন্নয়ন বিতর্ক এক রকম থেকে যাবে, অসহায় মেয়েরা উন্নয়নের নামে ক্ষমতাবানদের কূটকচালির শিকার হবেন, একশো বছরেরও আগে তা যেন আয়নার মতো তুলে ধরেছিল এই উপন্যাস।
*****
প্রেমচন্দের পুরো উপন্যাসটিই কাল্পনিক। স্বায়ত্তশাসনের প্রথম স্বাদ পাওয়ার পর তখন উত্তর ভারতের বারাণসী থেকে বরেলী, লখনউ, কানপুর-সহ বহু শহরেই নগর উন্নয়নের পরিকল্পনা নিয়ে হইচই হচ্ছিল। সাহিত্য তার যুগের মাটিতেই গাঁথা থাকে। ডালমন্ডির বাইজি সুমন তাই নাচ-গান করেও শরীরী সতীত্ব হারায়নি। অত্যাচারী স্বামী গজধরের সঙ্গেও শেষে তার দেখা হয়। সে তখন গজানন্দ নাম নিয়ে সন্ন্যাসী। প্রেমচন্দ কাউকে দায়ী করেন না, শুধু সমাজ-বাস্তবতার চমকপ্রদ বর্ণনা দিয়ে যান।
ডালমন্ডি থেকে বাইজিদের উৎখাত করা হয় স্বাধীনতার পরে ১৯৫২ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর উদ্যোগে। ‘রেসপেক্টেবল প্রস্টিটিউট’ কথাটা জাঁ পল সার্ত্রের ফরাসি নাটকের নাম হতে পারে। কিন্তু এ দেশে আলোকপ্রাপ্ত কংগ্রেস, সোশ্যালিস্ট, কমিউনিস্ট, বিজেপি, সকলে পুরুষতন্ত্রের নীরব ধ্বজাধারী। গত ১৪ অগস্ট ও ৪ সেপ্টেম্বর আর জি কর কাণ্ডের বিরুদ্ধে শহরে যে প্রতিবাদী রাত দখল হয়েছিল, সেখানে সোনাগাছি, হাড়কাটা গলি, ওয়াটগঞ্জের যৌনকর্মীরা যথেষ্ট সংখ্যায় উপস্থিত ছিলেন। কলকাতার ভাবী প্রেমচন্দদের সে কথা ভুললে চলবে না।