—ফাইল চিত্র।
গত বছর শীতের শুরুতেই কাশিতে ভুগতে শুরু করেছিলেন রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের এক কর্তা। কিছুতেই সারছিল না অসুখ। দিন কয়েক উত্তর-পূর্বে পাড়ি দিতেই দিব্যি সুস্থ হয়ে গেলেন! চিকিৎসককে জিজ্ঞাসা করে জেনেছেন, মহানগরীর বাতাসের দূষণ গ্রাস করেছিল তাঁকে!
দেশের রাজধানী শহর বাতাসের দূষণে জেরবার। এ রাজ্যের রাজধানীর অবস্থাও যে ভাল নয় তা নিজেকে দিয়েই বুঝেছেন দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের ওই কর্তা। তিনি বলেন, বর্ষা বিদায় নিতেই কলকাতার বাতাসে ক্রমশ বাড়ছে দূষণ। কেন? ওই কর্তার ব্যাখ্যা, কলকাতা সাগরের কাছাকাছি হওয়ায় বর্ষার প্রভাব বেশি। হাওয়াও জোরালো ভাবে বইতে থাকে। তা না হলে দিল্লির পরিস্থিতি হত কলকাতারও।
এখন যা আছে সেটাও কম নয়। গত ৩০ অক্টোবর কলকাতায় মার্কিন কনস্যুলেটে বসানো বায়ুদূষণ মাপক যন্ত্রে ধরা পড়েছিল বাতাসের বিষের মাত্রা। সে দিন বাতাসে ভাসমান সূক্ষ্ম ধূলিকণার গড় পরিমাণ ছিল ১৫৩। রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের তথ্য বলছে, নভেম্বরের প্রায় প্রতি দিনই শহরের বাতাসে ভাসমান ধূলিকণার মাত্রা এ রকমই থাকছে। যা বাতাসে ধূলিকণার সহনমাত্রার চেয়ে বেশি।
পরিবেশকর্মীরা বলছেন, জনস্বাস্থ্যের নিরিখে বাতাসের দূষণই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষণাপত্র ‘ল্যানসেট’ থেকে জানা গিয়েছে, বিশ্ব জুড়ে ধূমপান এবং অনাহারের থেকে বেশি মৃত্যু হয়েছে বায়ু দূষণে। খাস কলকাতার দূষণ নিয়ে আগেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)। তারা বলছে, প্রবীণ নাগরিকেরা যেমন এর শিকার হচ্ছেন তেমনই শিশুদের ফুসফুস, শ্বাসনালিও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বক্ষরোগ বিশেষজ্ঞদের অভিজ্ঞতা, বর্ষা পেরোতেই চেম্বারে শ্বাসকষ্টের রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায়। অনেকেই চিরতরে হাঁপানির রোগী হয়ে যান।
দিল্লির দূষণের পিছনে উত্তর-পশ্চিম ভারতের চাষের খেতের ধোঁয়াকে দায়ী করছেন পরিবেশবিদেরা। কলকাতার এই বেহাল দশার পিছনে দায়ী কে?
পরিবেশকর্মীরা বলছেন, শহরের দূষণে অন্যতম দায়ী ডিজেলচালিত গাড়ির ধোঁয়া। যার মধ্যে কিছু পুরনো বাস এবং মূলত পণ্যবাহী গা়ড়িই বেশি। যেগুলি মূলত সরকারি। পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্তের কথায়, ‘‘কলকাতা ডিজেলচালিত গাড়ির রাজধানী। তার উপরে পুরনো গাড়ির বৃদ্ধাশ্রম হয়ে উঠেছে এই শহর।’’
পাশাপাশি বিভিন্ন ভাগা়ড়ে যে ভাবে জঞ্জাল পুড়ছে তাতেও বাতাসে বিষকণা মিশছে। রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের এক কর্তা মেনেও নিয়েছেন এই সমস্যার কথা। তিনি বলছেন, ধাপায় ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে ভাগাড় বন্ধ করে উদ্যান তৈরি হচ্ছে। তার পাশের একটি ভাগা়ড়েই নিত্য দিন মিথেন গ্যাস থেকে আগুন জ্বলছে। বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ের পাশে প্রমোদনগর ভাগাড় থেকে যে ভাবে ধোঁয়া বেরোয় তাতে ওই রাস্তা দিয়ে যাতায়াত প্রাণান্তকর হয়ে ওঠে। দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের একটি সূত্র বলছে, নির্মাণস্থল, ভাঙাচোরা রাস্তা কিংবা রাস্তা সারাইয়ের পিচ গলানোর ধোঁয়াও বাতাসে বিষ বাড়িয়ে যাচ্ছে।
রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের এক শীর্ষ কর্তা বলছেন, পরিবহণ দফতর এবং পুরসভাগুলি একটু সক্রিয় হলেই বায়ু দূষণের সমস্যা অনেকটা কমতে পারে। যেমন নির্মাণস্থলগুলি ঢেকে রাখা, রাস্তা যথাযথ ভাবে সারাই করা কিংবা রাস্তায় জল ছিটালেই ধুলো কমানো সম্ভব। পুরনো গা়ড়ি এবং কলকারখানার ধোঁয়াকেও নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন নয়। ‘‘এ নিয়ে আমরা বারবার নির্দেশিকা পাঠিয়েছি। কিন্তু কে শোনে কার কথা!’’— আক্ষেপ ওই পর্ষদ-কর্তার। তা হলে উপায় কি? এমনটা কি চলতেই থাকবে?
পর্ষদের চেয়ারম্যান কল্যাণ রুদ্র বলছেন, ‘‘আদালতের নির্দেশে বায়ুদূষণ রুখতে অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করা হয়েছে। সেটা যাতে ঠিক ভাবে মানা হয় সেই চেষ্টাই করা হবে।’’