ফাইল চিত্র।
আমার জন্মই তো এই কলকাতা শহরে। আমাদের বাড়ির বয়সও তিনশো ছুঁয়ে গেল। ভেবে অবাক হই, এই বাড়িতে আমার ছেলেকে নিয়ে সাতপুরুষ বসবাস করল। দর্জিপাড়ার এই অঞ্চলের অনেক পুরনো বাসগৃহই এখন ফ্ল্যাট বা ছোট আবাসনে রূপান্তরিত। পাড়ায় পাড়ায় রকের আড্ডার বিলুপ্তি ঘটছে, পরিবর্তে এসেছে কয়েকটি চেয়ার নিয়ে মোড়ের মাথার সান্ধ্যকালীন জমায়েত। এখন আর পাড়ার বয়োজ্যেষ্ঠরা ছোটদের শাসন করেন না, যা আমাদের কৈশোরে অবশ্যম্ভাবী ভয়ের কারণ ছিল।
এখন ভিস্তিওয়ালা আসে না, কিন্তু রাস্তা, গলি, উত্তর কলকাতার তস্য গলি নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। মাঝেমধ্যে ব্লিচিং পাউডার ছড়ানো হচ্ছে, স্থানীয় পুরসভার অফিস থেকে পুরপিতার সৌজন্যে বাড়িতে জমা জল আছে কি না তার পরিদর্শন হচ্ছে, এই অতিমারির সময়ে পুরসভার স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রতিষেধকও পাওয়া গিয়েছে। মোটের উপরে সন্তোষজনক এই পাওয়া, যা সাধারণ নাগরিক আশা করেন।
কিন্তু যে নতুন আবাসন পুরনো বাড়ি ভেঙে তৈরি হচ্ছে, তার নিকাশি যথাযথ হচ্ছে কি না, সে দিকে পুরসভার দৃষ্টি দেওয়া একান্ত জরুরি। বিশেষত গত দু’বছর ভরা বৃষ্টির জমা জলে আমাদের বেশ ভুগতে হয়েছে। আমার বিশ্বাস, নবনির্বাচিত পুরসভা এ বিষয়ে লক্ষ রাখবে।
আমার শৈশব, কৈশোর, বয়ঃসন্ধি— সবই কেটেছে দর্জিপাড়া-কেন্দ্রিক। বাড়ি থেকে এক পা এগোলেই প্রথম যৌবনের থিয়েটার পাড়া সরগরম ছিল। রঙ্গনায় নান্দীকারের নাটক দেখতে দেখতে কেমন করে জড়িয়ে পড়লাম এই দলের সঙ্গে। আমার নরম ইচ্ছেগুলো আবৃত্তির সঙ্গে থিয়েটারে মাখামাখি হয়ে গেল। রংমহল, বিশ্বরূপা, স্টারে তখন তারকাদের অভিনয়। অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন এই নাটকগুলিও দেখতে, অভিনয়ের সমঝদার হতে। এই হলগুলো এখন অতীত। সেখানে নতুন আবাসন বা মল গড়ে উঠেছে। ব্যতিক্রম স্টার থিয়েটার। যদিও এখন এখানে নিয়মিত সিনেমার প্রদর্শনী।
নতুন পুরসভা গঠিত হওয়ার পরে অনুরোধ থাকল, অন্তত থিয়েটারের জন্য দু’টি পুরো সন্ধে নির্দিষ্ট করার জন্য। স্টার থিয়েটারের কথা মনে হতেই ব্রাত্য বসুর অতি সাম্প্রতিক উপন্যাস ‘অদামৃত কথা’র উল্লেখ করতেই হবে। এই উত্তর কলকাতার সেই সময়ের যে নস্ট্যালজিক চিত্র তিনি ফুটিয়ে তুলছেন, তা স্বপ্নের মতো। হারানো দিনের কলকাতা কেমন পলকে ভেসে উঠছে এই লেখায় আর রয়েছে সেই সময়ের বিশিষ্ট নাট্যজনের ইতিহাসের কথা। স্টার মানেই তো গিরিশচন্দ্র, বিনোদিনী, অমৃতলাল, অর্ধেন্দুশেখর প্রমুখ। আর আমার অনুভূতিতে চিত্রিত হচ্ছে আমাদের বর্তমান বাসগৃহের প্রবেশপথটি। এখানেই ছিল মনমোহন পাঁড়ের থিয়েটার,
এটিই ছিল গ্রিন রুম, যা আমি শুনেছি এই বাড়ির প্রয়াত গিন্নিমা শোভা হাজারির মুখে। শুনে বিস্মিত হবেন, এই বাড়ির একতলায় ছিল বাঘ আর ছাদে ছিল কুমির। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখায় পড়েছি, এই বাঘ দেখতে ভিড় জমত।
এই শহর আমায় অনেক কিছু দিয়েছে, আবার নিয়েছেও। এই অতিমারির সময়ে যখন সব বন্ধ, তখন পাশে থাকার নিরন্তর প্রয়াস রেখেছি আমাদের প্রিয় মঞ্চের কলাকুশলী ও শিল্পীদের পাশে সাহচর্যের হাত বাড়িয়ে
দিতে। অসুস্থ মানুষকে উপেক্ষা না করে পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টায় কোনও খাদ রাখিনি। তখন যেন কলকাতা আমার বুকে বিষম পাথর হয়ে বসে ছিল।
অপিচ এই শহরের মায়া ত্যাগ করা বড়ই দু:সহ। তখন বার বার মনে হয়েছে, আর কি মঞ্চ আমাদের কাছে অবারিত হবে না? তখন মনকে শক্ত করে নেমে পড়েছি নতুন নাট্য প্রযোজনায়। আমাদের ‘পূর্ব পশ্চিম’-এর অভিনেতাদের নিয়ে উপস্থাপন করেছি কোভিড-আঙ্গিকে উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়ের ‘জ্বরাসুর বধ পালা’ নাট্য। খোলা মঞ্চে তারা মাস্ক পরে অভিনয় করেছে। আমপান আর ইয়াসের ঝড়ে বিধ্বস্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে এগিয়ে এসেছেন এই কলকাতার প্রবাসী বন্ধুরা। তাঁদের ভালবাসা, সাহায্যের উষ্ণতা আমরা শরীরে মেখে এগিয়ে যেতে পেরেছি অনেকখানি।
আর এই সব অনুভূতি তো পেয়েছি আমাদের পূর্বসূরিদের কাছ থেকে। শহরের প্রাণকেন্দ্রে যখন মহাশ্বেতা দেবীর প্রবল আগ্রহে আমরা তিন বার শবর মেলার আয়োজন করলাম, পুরুলিয়া থেকে সেই শবর শিল্পীরা তাঁদের পসরা নিয়ে কলকাতার মানুষদের বিপণির সঙ্গে নাচে-গানে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন পঁচিশ বছর আগে। মহাশ্বেতাদি আবদার করেছিলেন, তাঁর শবর ছেলেমেয়েদের এই শহরের কোনও বড় হোটেলে আপ্যায়িত করতে। এই শহরে সহৃদয় সুহৃদের অভাব নেই। এগিয়ে এলেন এক উদার মানুষ। এই শহর তাই সবাইকে টানে গভীর অনুভূতিতে।
আবারও যখন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে কবিতা উৎসবের আয়োজন করি, তাঁরাও হয়ে ওঠেন সংগঠক। নিজের লেখক সত্তার বাইরে পরিপাটি এক কর্তা, যিনি আপ্যায়িত করছেন শিল্পী, লেখক, কবি, বান্ধবদের।এই অতিমারির ভ্রুকুঞ্চন সরিয়ে রেখে আবারও হবে নাট্যোৎসব, বইমেলা, ছবির প্রদর্শনী। আর এই পুরভোটের পরে আমরা অধীর আগ্রহে চেটেপুটে সারথি হব সেই সব সমারোহের, অবশ্যই অতিমারির বিধি-নিষেধ প্রতি পদে মেনে চলে।
ইতিহাস বলে পূর্বতন অভিজ্ঞতা থেকে, এই অতিমারি তিন-চার বছর স্থায়ী হয়। এ বার কী হবে, আমরা কেউ জানি না। কিন্তু আশা রাখি, জীবন সদর্পে চলবে, ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা বিদ্যায়তন আলো করবে, দরিদ্র-ধনী সবাই একসঙ্গে জয়ী হবে, জীবন হবে সহজ, সরল, দ্বিধামুক্ত।
এ কলকাতা আমার ভালবাসার, হাসি-কান্নার, আবেগ-অনুভূতির প্রাপ্তি। শহর ছেড়ে যেখানেই যাই, মনে হয় আমার অনুপস্থিতির সুযোগে কলকাতা এক-এক বার ধ্বংস হয়ে যায়। এই শহরের মায়া ত্যাগ করা বিষম কঠিন। এখানের বাজার, মধুসূদন মঞ্চ থেকে অ্যাকাডেমি, অগণিত বন্ধু, স্বজন, বান্ধব, বাদুড়ঝোলা বাস, রিন রিন সুর তোলা ট্রাম, অটোর দৌরাত্ম্য—সব, সব আমাকে টানে। এই শহর, শহরের প্রতিটি আনাচ-কানাচ, অলিগলির সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব এবং তা একান্ত নিজস্ব। আমার শ্বাস নেওয়া, আকুল ব্যাকুল হওয়া আর এত মুগ্ধতা আর কে-ই বা দিতে পারে!
কলকাতা আমায় অনেক দিয়েছে। আমি কিছুই ফিরিয়ে দিতে পারিনি।
(লেখক নাট্য পরিচালক ও আবৃত্তিশিল্পী)