ক্ষতি: শহরে কেটে ফেলা গাছ। ময়দানে। ছবি: সুমন বল্লভ
২০১৯ সালের ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের দাপটে শহরে আনুমানিক ক্ষয়ক্ষতির আভাস পেতে হিসাব কষেছিল কলকাতা পুরসভা। দেখা গিয়েছিল, ঘূর্ণিঝড়ের দাপটে বিদ্যুতের খুঁটি (সাড়ে সাত কোটি), রাস্তা (সাড়ে ১০ কোটি), ফুটপাত-নিকাশির পরিকাঠামো (সাড়ে ১০ কোটি) এবং বাড়িঘর ভাঙা (১.৫ কোটি)— সব মিলিয়ে প্রায় ৩০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল।
সেই ঘূর্ণিঝড়ে ৪৮টি বড় গাছ উপড়ে পড়েছিল। আরও ৪৩টি গাছের ডালপালা ভেঙে বিপর্যস্ত অবস্থা তৈরি হয়েছিল। তার জন্য আর্থিক ক্ষতির হিসাব অবশ্য উল্লেখ করা ছিল না।
অথচ, ঝড়ে উপড়ে পড়া বা কোনও প্রকল্পের কারণে বড় গাছ কাটার সঙ্গে আর্থিক ক্ষতির বিষয়টি যে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত, তা বুঝিয়েছিল গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে সুপ্রিম কোর্টে জমা পড়া এক কমিটির রিপোর্ট। যে রিপোর্ট প্রসঙ্গে দেশের শীর্ষ আদালত মন্তব্য করেছিল—‘কমিটির সুপারিশ মানলে সব সরকারই দেউলিয়া হয়ে যাবে।’
কী ছিল সেই রিপোর্টে, যার জন্য শীর্ষ আদালতের ওই পর্যবেক্ষণ?
ঘটনাপ্রবাহ বলছে, পাঁচটি রেলওয়ে ওভারব্রিজ তৈরির জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ৩৫৬টি গাছ কাটার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের হয়েছিল। যার পরিপ্রেক্ষিতে শীর্ষ আদালত একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গড়ে বলে, শুধুই গুঁড়ির মূল্য (টিম্বার ভ্যালু) নয়, বরং অক্সিজেন সরবরাহ-সহ পরিবেশে সামগ্রিক অবদানের ভিত্তিতে একটি গাছের অর্থনৈতিক মূল্য ঠিক করা হোক। সেই মতো বিশেষজ্ঞ কমিটি তাদের রিপোর্টে বলেছিল, অক্সিজেন, জৈব সার, মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টস-সহ একটি বড় গাছ বছরে গড়ে ৭৪,৫০০ টাকার ‘পণ্য’ বিনামূল্যে সরবরাহ করে থাকে। যার মধ্যে অক্সিজেনই সরবরাহ করে বছরে ৪৫ হাজার টাকার, বায়োফার্টিলাইজ়ার বা জৈব সার সরবরাহ করে ২০ হাজার টাকার।
যা দেখে অনেকেরই চক্ষু চড়কগাছ। কারণ ঠিক হয়েছিল, কাটা পড়া গাছের মূল্যও প্রস্তাবিত প্রকল্পের সঙ্গে যোগ করতে হবে। যার পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্ট গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য, ‘টাইগার এনভায়রনমেন্ট সেন্টার’-এর প্রাক্তন ম্যানেজিং ডিরেক্টর নিশিকান্ত মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘গাছ কাটার মূল্যকে প্রকল্পের প্রস্তাবিত খরচের সঙ্গে যোগ করলে তা বিলিয়ন ডলার ছাপিয়ে যাবে!’’ শীর্ষ আদালতের কথা মতো সরকার ‘দেউলিয়া’ হয়ে যাবে। কমিটির আর এক সদস্য, ‘সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল ডেভেলপমেন্ট’-এর চেয়ারম্যান সোহম পাণ্ড্য বলছেন, ‘‘একক গাছের (ইন্ডিভিজুয়াল ট্রি) ক্ষেত্রে দেশে এমন মূল্যায়ন প্রথম।’’
গবেষণাকারী সংস্থা ‘সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট’-এর ডিরেক্টর জেনারেল সুনীতা নারায়ণ আবার বলছেন, ‘‘একটি গাছের যে ঐতিহাসিক ও বাস্তুতান্ত্রিক গুরুত্ব রয়েছে, তা রক্ষা করা দরকার।’’ কিন্তু, তা রক্ষা করতে গেলে শহরে গাছের সংখ্যা কত, সেটা সবার আগে জানা দরকার বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞেরা। যার জন্য প্রয়োজন গাছশুমারির। যা আজ পর্যন্ত করে উঠতে পারেনি কলকাতা পুরসভা। ‘পাইলট প্রজেক্ট’ হিসাবে পুরসভার ৬ এবং ৮, এই দু’টি বরোয় গাছশুমারি হলেও বাকি ১৪টি বরোয় তা হয়নি।
পুর উদ্যান দফতর সূত্রের খবর, শহরে কোথাও ৬০ বছর বা তার বেশি বয়সি, কোথাও আবার ৫-৭ বছরেরও গাছ রয়েছে। এক কর্তার কথায়, ‘‘তবে শহরের গাছের গড় বয়স ৩০-৩৫ বছর বলা যেতে পারে।’’ সেই নিরিখে সুপ্রিম কোর্ট গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির ঠিক করে দেওয়া গাছের মূল্যায়নের হিসাব ধরলে ২০১৮ সালের এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড় থেকে গত বছরের ঘূর্ণিঝড় আমপানের সময় পর্যন্ত, শহরে উপড়ে পড়া ৫৩০০টি গাছের ন্যূনতম অর্থনৈতিক ক্ষতির মূল্য প্রায় ১২০০ কোটি টাকা!
তবে এখানেই বিষয়টি থেমে যাচ্ছে না। কারণ, শুমারির সময়ে ৬ ও ৮ নম্বর বরো মিলিয়ে বড় গাছের সংখ্যা ছিল প্রায় ৩০ হাজার। অর্থাৎ, প্রতি বরোয় গড়ে ১৫ হাজার গাছ। সেই হিসাবে শহরের ১৬টি বরোয় সম্ভাব্য বড় গাছের সংখ্যা হল ২,৪০০০০। তাদের গড় বয়স ন্যূনতম ৩০ বছরও হলে এই মুহূর্তে কলকাতা যে পরিমাণ সবুজ-সম্পদের অধিকারী, তার আর্থিক মূল্য হল ৫৩৬৪০০০০০০০০ টাকা বা ৫৩ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা! অর্থাৎ, দেশের ধনকুবেরের তালিকায় ২১তম স্থানে থাকা ফাল্গুনী নায়ার বা ২২তম স্থানে থাকা মহেন্দ্র চোকসি এবং পরিবারবর্গের মোট সম্পত্তির থেকেও বেশি পরিমাণ অর্থ!
ঘটনাচক্রে, ভোটের শহরে রাজনৈতিক প্রচার চলাকালীন সবুজের যাতে ক্ষতি না হয়, সেই দাবি জানিয়ে রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে ইতিমধ্যে চিঠি দিয়েছে পরিবেশকর্মীদের সংগঠন ‘সবুজ মঞ্চ’।
যার পরিপ্রেক্ষিতে এক পুরকর্তা বলছেন, ‘‘ভোটে-জোটে নয়, শহর থাক ৫৩,৬৪০ কোটির সবুজ সম্পদে।’’ কিন্তু প্রশ্ন, এর পরেও কি কলকাতা তার সবুজ-সম্পদ সংরক্ষণে যত্নবান হবে? বা, ঝড়ে বড় গাছ উপড়ে পড়লে নিয়মমাফিক গাছের চারা পোঁতা হলেও তার রক্ষণাবেক্ষণ যথাযথ হচ্ছে কি না, সে ব্যাপারে নজরদারি থাকবে তো? এই প্রশ্নগুলোর উত্তরও কয়েকশো কোটি টাকারই বটে!