অনাদরে: দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় পুরসভার স্কুলগুলির পরিকাঠামো ভেঙে পড়েছে আরও। টেম্পল স্ট্রিট। ছবি: সুমন বল্লভ
একটি ভাড়ার বাড়িতে চলে পুরসভার প্রাথমিক স্কুল। সেই বাড়ি থেকে স্কুল সরানোর জন্য মালিক কলকাতা পুরসভাকে জানিয়েছিলেন। কিন্তু স্কুল চলছিল সেখানেই। অবশেষে বাড়ির মালিক কলকাতা পুরসভার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেন। পুরসভার ৫৪ নম্বর ওয়ার্ডের অধীনে ১২ ইসমাইল স্ট্রিটের ঠিকানায় পুরসভা পরিচালিত ওই স্কুলটিকে সম্প্রতি ইংরেজি মাধ্যমে উন্নীত করা হয়েছে। তবে দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় যে সংস্কারের প্রয়োজন, তাতে হাত দেওয়া যাচ্ছে না মামলা চলার কারণে। ওই স্কুলটি যে ভাড়াবাড়িতে চলে, তা জানেনই না বলে দাবি করেছেন স্থানীয় বিদায়ী ওয়ার্ড কোঅর্ডিনেটর আমিরুদ্দিন ববি।
পুরসভা পরিচালিত স্কুলগুলির এমন পরিকাঠামোগত সমস্যা রয়েছেই। এর পাশাপাশি করোনার জন্য প্রায় দু’বছর স্কুল বন্ধ থাকায় একটা বড় সংখ্যক পড়ুয়া স্কুলছুট হবে বলে আশঙ্কা। এর পরে পুরোপুরি স্কুল চালু হলে পড়ুয়ার সংখ্যা আরও কমে যাবে না তো? পড়ুয়া কমে গিয়ে পুর বিদ্যালয়গুলি কি আরও মুমূর্ষু অবস্থায় চলে যাবে? এমনই নানা আশঙ্কা দেখা দিয়েছে কলকাতা পুরসভা পরিচালিত প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলিকে ঘিরে।
কলকাতা পুরসভা পরিচালিত প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে ২৪১টি। সেগুলির মধ্যে ৮৩টি বাংলা, ৬৯টি ইংরেজি, ৪০টি হিন্দি, ৪৮টি উর্দু এবং একটি ওড়িয়া মাধ্যমে পরিচালিত। এর মধ্যে ৬০টি স্কুল চলে ভাড়ার বাড়িতে। দীর্ঘদিন ধরে ওই ৬০টি স্কুল সংস্কারের কাজেও তাই হাত দিতে পারছে না পুরসভা। সেগুলির বেহাল দশা চোখে পড়ার মতো। তার মধ্যে ৫৪ নম্বর ওয়ার্ডের ইসমাইল স্ট্রিট এবং ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের ২২এ, বেনিয়াটোলা লেনের ঠিকানায় দু’টি বাড়ির মালিক কলকাতা পুরসভার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেছেন আগেই।
পুরসভার শিক্ষা দফতর সূত্রের খবর, ব্রিটিশ আমল থেকে ভাড়াবাড়িতে চলা স্কুলগুলির নানা সমস্যা রয়েছে। ইসমাইল স্ট্রিটের বাড়িটি নিয়ে যে মামলা চলছে, সেই প্রসঙ্গে স্থানীয় বিদায়ী কোঅর্ডিনেটর তথা বিদায়ী পুর প্রশাসকমণ্ডলীর সদস্য আমিরুদ্দিন ববি বলেন, ‘‘আমার ওয়ার্ডে স্কুল ভাড়া বাড়িতে চলায় আদালতে মামলা চলছে। এই খবর শিক্ষা দফতরের তরফে জানানোই হয়নি। অথচ এই স্কুলটি সম্প্রতি ইংরেজি মাধ্যমে
উন্নীত হয়েছে।’’
উল্টোডাঙা খালপাড় লাগোয়া একটি ভাড়াবাড়িতে চলে আরও একটি স্কুল। ওই স্কুলের এক শিক্ষক জানান, স্কুলের ঘুপচি ঘরের পরিবেশ অস্বাস্থ্যকর। সেই সঙ্গে শৌচালয়ের সমস্যা রয়েছে। অভাব রয়েছে পানীয় জলেরও। এই অবস্থায় স্কুলে অনেকেই আসতে চায় না। ওই শিক্ষকের কথায়. “আমরা বস্তি এলাকায় গিয়ে পড়ুয়াদের ডেকে ডেকে স্কুলে আনি। করোনার সময়ে পড়ুয়ারা কী করছে, দেখতে গিয়েছিলাম। দেখলাম, অনেকেই ছোট ছোট কাজে লেগে পড়েছে।”
করোনা পরিস্থিতিতে পুরসভার স্কুলগুলিতে অনলাইন ক্লাসের কার্যত কোনও ব্যবস্থা ছিল না। মিড-ডে মিলের মাধ্যমে পড়ুয়ারা যে প্রশ্ন পায়, তার উত্তর লিখে শিক্ষকদের পাঠানোও ছিল অনিয়মিত। কোনও কোনও খুদে পড়ুয়া স্কুল বন্ধ থাকায় খুঁজে নিয়েছে কাজ। তপসিয়া এলাকার এক পুর স্কুলের শিক্ষকের কথায়, “আমাদের স্কুলে মূলত আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পড়া বস্তির ছেলেমেয়েরা পড়ে। সাধারণ সময়ে যখন স্কুল খোলা ছিল, তখনই ওদের অনেককে ডেকে স্কুলে আনতে হত। এখন দীর্ঘ দিন পরে স্কুল খুললে কত জন আসবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।”
অভিযোগ, একাধিক পুর বিদ্যালয়ে শিক্ষক ও পড়ুয়ার অনুপাতেও অসাম্য রয়েছে। পুরসভার শিক্ষা দফতরের আধিকারিকেরা জানাচ্ছেন, পুর স্কুল বন্ধ থাকলেও অনলাইন ক্লাস সম্ভব নয়। কারণ পড়ুয়াদের সিংহভাগের মা-বাবাদের কাছে স্মার্ট ফোন নেই। ভরসা শুধু ‘অ্যাক্টিভিটি টাস্ক’। মাসে এক বার অভিভাবকদের মিড-ডে মিলের সামগ্রী দেওয়ার সময়ে টাস্কও হাতে দিয়ে দেওয়া হয়। এই টাস্ক পড়ুয়াদের বাড়িতে করতে দেওয়া হয়। পরের মাসে মিড-ডে মিল সংগ্রহের সময়ে অ্যাক্টিভিটি টাস্কের উত্তর নিয়ে আসতে বলা হলেও অনেক অভিভাবকই তা আনতে পারেন না। পুরসভার এক আধিকারিকের কথায়, ‘‘পড়ুয়াদের অনেকের বাড়িতে পড়ার পরিবেশই নেই। ক্রমশই পড়াশোনা থেকে দূরে চলে যাচ্ছে তারা।’’ পড়ুয়াদের স্কুলমুখী করতে বিদ্যালয়গুলি দ্রুত খোলা জরুরি বলে মনে করছেন শিক্ষকদের একাংশ।
শিক্ষা দফতরের দায়িত্বপ্রাপ্ত, বিদায়ী পুর প্রশাসকমণ্ডলীর সদস্য অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়ের দাবি, “করোনার পরে স্কুল খুললে আগের থেকেও ভাল পরিকাঠামোয় চলবে। ভাড়াবাড়িতে চলা বিদ্যালয়গুলির সংস্কারে জোর দেওয়া হবে। বস্তি অঞ্চলের অনেক পড়ুয়ার বাড়ির পরিবেশ ভাল নয় বলে তারা সারা দিন স্কুলে থেকে পড়াশোনা করতে চায়। তাই কিছু স্কুলকে ডে বোর্ডিং স্কুলে পরিণত করারও পরিকল্পনা রয়েছে।”