ফুটো বন্ধের নাম নেই, সমীক্ষায় কোটি কোটি

সুরাহার উপায় হিসেবেই সমীক্ষায় জোর দিচ্ছেন পুর-কর্তৃপক্ষ। পুর-প্রশাসনের যুক্তি: খরচের হিসেব পেলে অপচয় রোখা সহজ হবে। তাই হাতে নেওয়া হয়েছে ওই সমীক্ষা-প্রকল্প (ওয়াটার লস ম্যানেজমেন্ট), আপাতত যার আওতায় টালা সংলগ্ন ছ’টি ওয়ার্ড (১-৬ নম্বর)।

Advertisement

অনুপ চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৬ মার্চ ২০১৬ ০২:৪৩
Share:

ফি বছরের মতো এ বারও।

Advertisement

গরম পড়তেই জলের আকাল মাথা চাড়া দিয়েছে কলকাতার নানা জায়গায়। অথচ হিসেব বলছে, মহানগরে রোজ যত জল স্রেফ নষ্ট হয়, তা দিয়েই দুই-তৃতীয়াংশ বাসিন্দার দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটানো সম্ভব। কিন্তু সেই চূড়ান্ত অপচয়ের সুরাহা করার বদলে পুরসভা নিছক সমীক্ষার পিছনেই জলের মতো টাকা ঢালতে চলেছে বলে অভিযোগ।

পুর-তথ্য অনুযায়ী, কলকাতায় দৈনিক ১৫৭ কোটি লিটার পরিস্রুত জল তৈরি হয়। এর অন্তত ৪৫ কোটি লিটার (প্রায় ৩০%) রোজ ফেলে-ছড়িয়ে নষ্ট হচ্ছে, যা দিয়ে প্রায় ৩৩ লক্ষ লোকের দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটানো যেত বলে এক কেন্দ্রীয় সংস্থার পর্যবেক্ষণ। অর্থাৎ, প্রায় আধ কোটি মানুষের শহরটির তিন ভাগের দু’ভাগ বাসিন্দার জলকষ্ট মিটে যাবে, যদি অপচয় বন্ধ হয়।

Advertisement

কিন্তু পুরসভার তরফে তেমন উদ্যোগ নেই। উল্টে জল নষ্টের ছবিটা ‘দেখা’র জন্য বরাদ্দ হয়েছে ১৩০ কোটি টাকা। তা-ও মাত্র ছ’টি ওয়ার্ডে। দেখে-শুনে পুরভবনের অন্দরেই বিতর্কের ঝড়। এক আধিকারিকের প্রশ্ন, ‘‘কী ভাবে জল নষ্ট হয়, তা তো সাদা চোখেই বোঝা যাচ্ছে। এর জন্য এত টাকা খরচ?’’ ওঁদের মতে, পুরকর্মীরা সচেষ্ট হলেই অপচয় রোখা যায়, সমীক্ষার দরকার পড়ে না। অন্য দিকে মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের দাবি, সমীক্ষার বিলক্ষণ প্রয়োজন আছে। ‘‘এতে ধরা পড়বে, কী ভাবে কত জল রোজ অপচয় হচ্ছে। পাশাপাশি জল সরবরাহের একটা পূর্ণাঙ্গ মানচিত্র পাওয়া যাবে।’’— মন্তব্য মেয়রের।

পুরসভার জল-কর্তারা অবশ্য সমীক্ষা-রিপোর্টের অপেক্ষায় না-থেকে এখনই বলে দিচ্ছেন, কোথায় কী ভাবে জল নষ্ট হচ্ছে। ওঁরা জানাচ্ছেন, অপচয়ের উৎস মূলত দু’টো— পাইপের ফুটো ও রাস্তার খোলা টাইম কল। এই ফাঁক দিয়ে প্রচুর জল রোজ গড়িয়ে যায়। বিভিন্ন পুর-জলাধারেও অপচয় চলছে। ‘‘একটু নজরদারি থাকলেই এটা আটকানো সম্ভব।’’— বলছেন এক অফিসার।

নজরদারির অভাব যে কতটা, তার নমুনা মিলল সুবোধ মল্লিক স্কোয়্যারে গিয়ে। ওখানে পুরসভার ভূগর্ভস্থ জলাধার থেকে গাড়িতে জল ভরে নানা জায়গায় পৌঁছে দেওয়া হয়। মোটা পাইপ থেকে দুরন্ত গতিতে বেরনো জলে চার হাজার লিটারের একটা ওয়াটার ট্যাঙ্কার টইটম্বুর হতে দু’-তিন মিনিটের বেশি লাগে না। দেখা গেল, জলের গাড়ি নেই। তা সত্ত্বেও পাইপ থেকে অঝোরে পরিস্রুত জল বেরিয়ে রাস্তা ভাসিয়ে দিচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানালেন, এমনটা হামেশাই হয়ে থাকে।

অর্থাৎ, শুধু ওখানেই গলে যাচ্ছে কয়েক লক্ষ লিটার। এক পুর-ইঞ্জিনিয়ারের আক্ষেপ, ‘‘এ ছাড়া শহরের পথে-ঘাটে প্রায় পাঁচ-সাত হাজার টাইম কল রয়েছে। অধিকাংশের মুখে ট্যাপ নেই। সেখান দিয়েও অনর্গল জল বেরিয়ে যায়।’’

সুরাহার উপায় হিসেবেই সমীক্ষায় জোর দিচ্ছেন পুর-কর্তৃপক্ষ। পুর-প্রশাসনের যুক্তি: খরচের হিসেব পেলে অপচয় রোখা সহজ হবে। তাই হাতে নেওয়া হয়েছে ওই সমীক্ষা-প্রকল্প (ওয়াটার লস ম্যানেজমেন্ট), আপাতত যার আওতায় টালা সংলগ্ন ছ’টি ওয়ার্ড (১-৬ নম্বর)। রূপায়ণ করবে পুরসভার অধীনস্থ কেইআইআইপি। টেন্ডার হয়ে গিয়েছে। প্রথম পর্যায়ের খরচ ধরা হয়েছে ১৩০ কোটি টাকা। দ্বিতীয় দফায় ধাপা এলাকায় খরচ হবে ১৬৬ কোটি। প্রকল্পে কাজ কী হবে?

কেইআইআইপি-সূত্রের বক্তব্য: কেন্দ্রীয় গাইডলাইন মোতাবেক, গৃহস্থবাড়িতে মাথাপিছু দৈনিক মোটামুটি দেড়শো লিটারের বেশি জল লাগার কথা নয়। বেশি লাগছে কি না, যাচাই করতে বাড়ি-বাড়ি মিটার বসানো হবে। যেখানে খরচের বহর অতিরিক্ত, সেখানে আবেদন করে জল খরচে রাশ টানার চেষ্টা হবে। তবে জল-কর নেওয়ার যে কোনও সম্ভাবনা নেই, সেটা পরিষ্কার করে দিয়েছেন সূত্রটি।

কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, শাস্তির সংস্থান না-রেখে নিছক আবেদন-নিবেদনে কী লাভ? তা ছাড়া অপচয়ের সিংহভাগ হয় রিজার্ভারে কিংবা রাস্তাঘাটের টাইম কলে। সে দিকে নজর নেই কেন? সর্বোপরি অপচয় রোধের চেষ্টা ছেড়ে শুধু পরিমাণ জানতে এত খরচ কতটা যুক্তিযুক্ত?

পুরসভা বা কেইআইআইপি’র কেউ মুখ খোলেননি। মেয়র শোভনবাবুর মন্তব্য, ‘‘গোড়ায় আমারও মনে হয়েছিল, এত খরচ কেন? পরে আমাকে বলা হল, এতে শহরে জল সরবরাহের মানচিত্রও তৈরি হবে। সুষ্ঠু সরবরাহের ব্যবস্থা হবে।’’ সাপ্লাই ম্যাপ তৈরি বা সরবরাহে উন্নতির পরিকল্পনা সম্পর্কে কেইআইআইপি’র তরফে অবশ্য বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি।

এমতাবস্থায় সংশয় বাড়ছে। সমীক্ষা শেষে বাড়ি-বাড়ি বসানো জল-মিটারগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়েও পুরমহলে বিস্তর ধন্দ। সমীক্ষা-প্রকল্পের কথা শুনে কলকাতার প্রাক্তন মেয়র বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যের দাবি, পুরসভায় বহু অভিজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ার রয়েছেন, যাঁরা অপচয়ের পরিমাণ বলে দিতে সক্ষম। কোটি কোটি টাকা খরচ করতে হয় না। ‘‘পুরোটাই ভাঁওতা। কিছু ঠিকাদারকে পাইয়ে দেওয়াই আসল উদ্দেশ্য।’’— প্রতিক্রিয়া বিকাশবাবুর।

পুরভবনের আনাচে-কানাচে কান পাতলে প্রায়ই একই সুর শোনা যাচ্ছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement